পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8Q○ “তবে কি যেতে হবে দাদা ?” “তোকে নিষেধ করতে পারি। এমন অধিকার আর আমার নেই। তোর সন্তানকে তার নিজের ঘরছাড়া করব কোন স্পর্ধায় ?” কুমু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল, বিপ্রদাসও কিছু বললে না। অবশেষে খুব মৃদুস্বরে কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে কবে যেতে হবে ?” “কালই, আর দেরি সইবে না।” “দাদা, একটা কথা বোধ হয় বুঝতে পারছি, এবার গেলে ওরা আমাকে আর কখনো তোমার কাছে আসতে দেবে না ।” “তা আমি খুবই জানি।” # “আচ্ছ, তাই হবে। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলে রাখি, কোনােদিন কোনো কারণেই তুমি ওদের বাড়ি যেতে পারবে না । জানি দাদা, তোমাকে দেখবার জন্যে আমার প্রাণ ইপিয়ে উঠবে, কিন্তু ওদের ওখানে যেন কখনো তোমাকে না দেখতে হয় । সে আমি সইতে পারব না ।” “না কুমু, সেজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না ।” “ওরা কিন্তু তোমাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করবে ।” “ওরা যা করতে পারে তা করা শেষ হলেই আমার উপর ওদের ক্ষমতাও শেষ হবে । তখনই হব স্বাধীন। তাকে তুই বিপদ বলছিস কেন ?” “দাদা, সেইদিন তুমি আমাকেও স্বাধীন করে নিয়াে । ততদিনে ওদের ছেলেকে আমি ওদের হাতে দিয়ে যাব । এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোওয়ানো যায় না।” “আচ্ছা, আগে হােক ছেলে, তার পরে বলিস।” “তুমি বিশ্বাস করছ না, কিন্তু মা'র কথা মনে আছে তো ? তার তো হয়েছিল ইচ্ছামৃত্যু। সেদিন সংসারে তিনি তার জায়গাটি পাচ্ছিলেন না, তাই তার ছেলেমেয়েদেরকে অনায়াসে ফেলে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মানুষ যখন মুক্তি চায় তখন কিছুতেই তাকে ঠেকাতে পারে না। আমি তোমারই বোন, দাদা, আমি মুক্তি চাই। একদিন যেদিন বঁাধন কািটব, মা সেদিন আমাকে আশীর্বাদ করবেন। এই আমি তোমাকে বলে রাখলুম।” আবার অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে রইল। হঠাৎ হু হু করে বাতাস উঠল, টিপায়ের উপর বিপ্ৰদাসের পড়বার বইটার পাতাগুলো ফর ফর করে উলটে যেতে লাগল। বাগান থেকে বেলফুলের গন্ধে ঘর গেল ভরে। কুমু বললে, “আমাকে ওরা ইচ্ছে করে দুঃখ দিয়েছে তা মনে কোরো না । আমাকে সুখ ওরা দিতে পারে না। আমি এমনি করেই তৈরি। আমিও তো ওদের পারব না। সুখী করতে । যারা সহজে ওদের সুখী করতে পারে তাদের জায়গা জুড়ে কেবল একটা-না-একটা মুশকিল বাধবে । তা হলে কেন এ বিড়ম্বনা ? সমাজের কাছ থেকে অপরাধের সমস্ত লাঞ্ছনা। আমিই একলা মেনে নেব, ওদের গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগবে না। কিন্তু একদিন ওদেরকে মুক্তি দেব, আমিও মুক্তি নেব ; চলে আসবই এ তুমি দেখে নিয়ো । মিথ্যে হয়ে মিথ্যের মধ্যে থাকতে পারব না। আমি ওদের বড়োবউ, তার কি কোনো মানে আছে যদি আমি কুমুনা হই ? দাদা, তুমি ঠাকুর বিশ্বাস কর না, আমি বিশ্বাস করি। তিন মাস আগে যেরকম করে করতুম, আজ তার চেয়ে বেশি করেই করি। আজ সমস্ত দিন ধরেই এই কথা ভাবছি যে, চারি দিকে এত এলোমেলো, এত উলটাে-পালটা, তবু এই জঞ্জালে একেবারে ঢেকে ফেলে নি জগৎটাকে । এ-সমস্তকে ছাড়িয়ে গিয়েও চন্দ্ৰসূৰ্যকে নিয়ে সংসারের কাজ চলছে, সেই যেখানে ছাড়িয়ে গেছে সেইখানে আছে বৈকুণ্ঠ, সেইখানে আছেন আমার ঠাকুর । তোমার কাছে এ-সব কথা বলতে লজ্জা করে- কিন্তু আর তো কখনো বলা হবে না, আজ বলে যাই । নইলে আমার জন্যে মিছিমিছি ভাববে। সমস্ত গিয়েও তবু বাকি থাকে এই কথাটা বুঝতে পেরেছি। সেই আমার অফুরন, সেই আমার ঠাকুর, এ যদি না বুঝতুম তা হলে এইখানে তোমার পায়ে মাথা ঠুকে মরতুম, সে গারদে