পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8vy রবীন্দ্র-রচনাবলী ভিতর দিয়ে যেখানে খুশি, এমন সময় আষাঢ় এল পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বনে তার সজল ঘনচ্ছায়ার চাদর লুটিয়ে । খবর পাওয়া গেল, চেরাপুঞ্জির গিরিশৃঙ্গ নববর্ষার মেঘদলের পুঞ্জিত আক্ৰমণ আপন বুক দিয়ে ঠেকিয়েছে; এইবার ঘন বর্ষণে গিরিনিঝরিণীগুলোকে খেপিয়ে কুলছাড়া করবে। স্থির করলে, এই সময়টাতে কিছুদিনের জন্যে চেরাপুঞ্জির ডাকবাংলায় এমন মেঘদূত জমিয়ে তুলবে যার অলক্ষ্য অলকার নায়িকা অশরীরী বিদ্যুতের মতো, চিত্ত-আকাশে ক্ষণে ক্ষণে চমক দেয়— নাম লেখে না, ঠিকানা রেখে যায় না । - সেদিন সে পারল হাইলান্ডারি মোটা কম্বলের মোজা, পুরু সুকতলাওয়ালা মজবুত চামড়ার জুতো, খাকি নরফোক কোর্তা, হাঁটু পর্যন্ত হ্রস্ব অধোবাস, মাথায় সোলা টুপি | অবনী ঠাকুরের আঁকা যক্ষের মতো দেখতে হল না- মনে হতে পারত রাস্তা তদারক করতে বেরিয়েছে ডিসট্রিকটু এঞ্জিনিয়ার । কিন্তু পকেটে ছিল গোটা পাঁচ-সাত পাতলা এডিশনের নানা ভাষার কাব্যের বই | আঁকাবঁকা সরু রাস্তা, ডান দিকে জঙ্গলে ঢাকা খদ । এ রাস্তার শেষ লক্ষ্য অমিতার বাসা । সেখানে যাত্রী-সম্ভাবনা নেই, তাই সে আওয়াজ না করে অসতর্কভাবে গাড়ি হাকিয়ে চলেছে। ঠিক সেই সময়টা ভাবছিল, আধুনিক কালে দূরবর্তিনী প্ৰেয়সীর জন্যে মোটর-দূতটাই প্রশস্ত— তার মধ্যে “ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ” বেশ ঠিক পরিমাণেই আছে- আর, চালকের হাতে একখানি চিঠি দিলে কিছুই অস্পষ্ট থাকে না। ও ঠিক করে নিলে আগামী বৎসরে আষাঢ়ের প্রথম দিনেই মেঘদূতবর্ণিত রাস্তা দিয়েই মোটরে করে যাত্রা করবে, হয়তো বা অদৃষ্ট ওর পথচেয়ে “দেহলীদত্তপুষ্পা” যে পথিকবধূকে এতকাল বসিয়ে রেখেছে সেই অবস্তিকা হােক বা মালবিকাই হােক, বা হিমালয়ের কোনো দেবদারুবনচারিণীই হােক, ওকে হয়তো কোনো- একটা অভাবনীয় উপলক্ষে দেখা দিতেও পারে। এমন সময়ে হঠাৎ একটা বঁাকের মুখে এসেই দেখলে আর-একটা গাড়ি উপরে উঠে আসছে। পাশ কাটাবার জায়গা নেই। ব্ৰেক কষতে কষতে গিয়ে পড়ল তার উপরে- পরম্পর আঘাত লাগল, কিন্তু অপঘাত ঘটল না । অন্য গাড়িটা খানিকটা গড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে আটকে থেমে গেল । একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালো পটখানা তার পিছনে, তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবি— চারিদিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র । মন্দরপর্বতের নাড়া-খাওয়া ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দােলনের উপরে- মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলে । ড্রয়িং রুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না । পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না । মেয়েটির পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট, পায়ে সাদা চামড়ার দিশি ছাদের জুতো । তনু দীর্ঘ দেহটি, বর্ণ চিকন শ্যাম, টানা চোখ ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় স্নিগ্ধ, প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল আঁট করে বাধা, চিবুক ঘিরে সুকুমার মুখের ডোলটি একটি অনতিপক ফলের মতো রমণীয়। জ্যাকেটের হাত কবজি পর্যন্ত, দু-হাতে দুটি সরু প্লেন বালা । ব্রোচের-বন্ধনহীন কঁধের কাপড় মাথায় উঠেছে, কাঁটকি কাজ-করা রুপোর কাটা দিয়ে খোপার সঙ্গে < | অমিত গাড়িতে টুপিটা খুলে রেখে তার সামনে চুপ করে এসে দাঁড়াল। যেন একটা পাওনা শাস্তির অপেক্ষায়। তাই দেখে মেয়েটির বুঝি দয়া হল, একটু কৌতুকও বােধ করলে। অমিত মৃদুস্বরে বললে, “অপরাধ করেছি।” মেয়েটি হেসে বললে, “অপরাধ নয়, ভুল। সেই ভুলের শুরু আমার থেকেই।” উৎসজলের যে উচ্ছলতা ফুলে ওঠে, মেয়েটির কণ্ঠস্বর তারই মতো নিটােল। অল্প-বয়সের বালকের গলার মতো মসৃণ এবং প্রশস্ত। সেদিন ঘরে ফিরে এসে অমিত অনেকক্ষণ ভেবেছিল, এর গলার সুরে যে-একটি স্বাদ আছে স্পর্শ আছে, তাকে বর্ণনা করা যায় কী করে। নোট-বইখানা খুলে লিখলে, “এ যেন অম্বুরি তামাকের হালকা ধোওয়া, জলের ভিতর দিয়ে পাক খেয়ে আসছে