পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা Μ , 8ԳV.) গেল। দূর থেকে শোভনলাল তার আত্মনিবেদনের একটি শেষ পরিচয় দিলে, সেই বিবরণটা অন্তর্যামী ছাড়া আর কেউ জানত না । বি. এ. পরীক্ষায় সে যখন পেয়েছিল প্ৰথম স্থান, লাবণ্য পেয়েছিল তৃতীয়। সেটাতে লাবণ্যকে বড়ো বেশি আত্মলাঘব-দুঃখ দিয়েছিল। তার দুটাে কারণ ছিল, এক হচ্ছে শোভনের বুদ্ধির পরে অবনীশের অত্যন্ত শ্রদ্ধা নিয়ে লাবণ্যকে অনেকদিন আঘাত করেছে। এই শ্রদ্ধার সঙ্গে অবনীশের বিশেষ স্নেহ, মিশে থাকতে পীড়াটা আরো হয়েছিল বেশি। শোভনকে পরীক্ষার ফলে ছাড়িয়ে যাবার জন্যে সে চেষ্টা করেছিল খুব প্ৰাণপণেই । তবুও শোভন যখন তাকে ছাড়িয়ে গেল তখন এই স্পর্ধার জন্যে তাকে ক্ষমা করাই শক্ত হয়ে উঠল । তার মনে কেমন-একটা সন্দেহ লেগে রইল যে, বাবা তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করাতেই উভয় পরীক্ষিতের মধ্যে ফলবৈষম্য ঘটল, অথচ পরীক্ষার পড়া সম্বন্ধে শোভনলাল কোনোদিন অবনীশের কাছে এগোয় নি। কিছুদিন পর্যন্ত শোভনলালকে দেখলেই লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে চলে যেত। এম. এ. পরীক্ষাতেও শোভনের প্রতিযোগিতায় লাবণ্যর জেতবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তবু হল জিত। স্বয়ং অবনীশ আশ্চর্য হয়ে গেলেন । শোভনলাল যদি কবি হত তা হলে হয়তো সে খাতা ভরে কবিতা লিখিত— তার বদলে আপন পরীক্ষা-পাসের অনেকগুলো মোটা মার্কা সে লাবণ্যর উদ্দেশে উৎসর্গ করে দিলে । তার পরে এদের ছাত্ৰদশা গেল কেটে । এমন সময় অবনীশ হঠাৎ প্রচণ্ড পীড়ায় নিজের মধ্যেই প্রমাণ পেলেন যে, জ্ঞানের চর্চায় মনটা ঠাসবোঝাই থাকলেও মনসিজ তার মধ্যেই কোথা থেকে বাধা ঠেলে উঠে পড়েন, একটুও স্থানাভাব হয় না। তখন অবনীশ সাতচল্লিশ । সেই নিরতিশয় দুর্বল নিরুপায় বয়সে একটি বিধবা র্তার হৃদয়ে প্রবেশ করলে, একেবারে তার লাইব্রেরির গ্রন্থ বৃহ ভেদ করে, তার পাণ্ডিত্যের প্রাকার ডিঙিয়ে । বিবাহে। আর কোনো বাধা ছিল না, একমাত্র বাধা লাবণ্যর প্রতি অবনীশের স্নেহ। ইচ্ছার সঙ্গে বিষম লড়াই বাধল। পড়াশুনো করতে যান খুবই জোরের সঙ্গে, কিন্তু তার চেয়ে জোর আছে এমন কোনো-একটা চমৎকারা চিন্তা পড়াশুনোর কাধে চেপে বসে । সমালোচনার জন্যে মডার্ন রিভিয়ু থেকে তাকে লোভনীয় বই পাঠানাে হয় বৌদ্ধধ্বংসাবশেষের পুরাবৃত্ত নিয়ে- অনুদঘাটিত বইয়ের সামনে স্থির হয়ে বসে থাকেন এক ভাঙা বৌদ্ধস্তুপেরই মতো, যার উপরে চেপে আছে বহুশত বৎসরের মীেন। সম্পাদক ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, কিন্তু জ্ঞানীর স্তৃপাকার জ্ঞান যখন একবার টলে তখন তার দশা এইরকমই হয়ে থাকে। হাতি যখন চােরাবালিতে পা দেয় তখন তার বঁচবার উপায় কী ? এতদিন পরে অবনীশের মনে একটা পরিতাপ ব্যথা দিতে লাগল। তীর মনে হল, তিনি হয়তো পুঁথির পাতা থেকে চােখ তুলে দেখবার অবকাশ না পাওয়াতে দেখেন নি যে, শোভনলালকে তঁর মেয়ে ভালোবেসেছে ; কারণ, শোভনের মতো ছেলেকে না ভালোবাসতে পারাটাই অস্বাভাবিক । সাধারণভাবে বাপ-জাতটার পরেই রাগ ধরল-- নিজের উপরে, ননীগোপালের ‘পারে। এমন সময় শোভনের কাছ থেকে এক চিঠি এল । প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তির জন্যে গুপ্তরাজবংশের ইতিহাস আশ্রয় করে পরীক্ষার প্রবন্ধ লিখবে বলে সে তার লাইব্রেরি থেকে গুটিকতক বই ধার চায়। তখনই তিনি তাকে বিশেষ আদর করে চিঠি লিখলেন, বললেন, “পূর্বের মতোই আমার লাইব্রেরিতে বসেই তুমি কাজ করবে, কিছুমাত্র সংকোচ করবে না।” শোভনলালের মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। সে ধরে নিলে, এমন উৎসােহপূর্ণ চিঠির পিছনে হয়তো লাবণ্যর সম্মতি প্রচ্ছন্ন আছে। সে লাইব্রেরিতে আসতে আরম্ভ করলে। ঘরের মধ্যে যাওয়া-আসার পথে দৈবাৎ কখনাে ক্ষণকালের জন্যে লাবণ্যর সঙ্গে দেখা হয়। তখন শোভন গতিটাকে একটু মন্দ করে আনে। ওর একান্ত ইচ্ছে, লাবণ্য তাকে একটা-কোনো কথা বলে ; জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছ ; যে প্রবন্ধ নিয়ে ও ব্যাপৃত সে সম্বন্ধে কিছু কৌতুহল প্রকাশ করে। যদি করত। তবে খাতা খুলে এক সময় লাবণ্যর সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে ও বেঁচে যেত। ওর কতকগুলি নিজের উদভাবিত বিশেষ মত সম্বন্ধে লাবণ্যর মত কী জািনবার জন্যে। ওর অত্যন্ত ঔৎসুক্য । কিন্তু এ-পর্যন্ত কোনাে কথাই হল না, গায়ে-পড়ে কিছু বলতে পারে এমন সাহসও ওর নেই।