পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা Qの> বুকে টেনে নিয়ে তার মুখটি উপরে তুলে ধরলে। লাবণ্যর চােখ অর্ধেক বোজা, কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশে সোনার রঙের উপর চুনি-গলানো পান্না-গলানো আলোর আভাসগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ; মাঝে মাঝে পাতলা মেঘের ফাঁকে ফঁাকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে, যেখানে দেহ নেই। শুধু আনন্দ আছে সেই অমর্ত্যজগতের অব্যক্ত ধ্বনি আসছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হল ঘন। সেই খোলা আকাশটুকু, রাত্রিবেলায় ফুলের মতো নানা রঙের পাপড়িগুলি বন্ধ করে দিলে । অমিতার বুকের কাছ থেকে লাবণ্য মৃদুস্বরে বললে, “চলো এবার।” কেমন তার মনে হল, এইখানে শেষ করা ভালো । অমিত সেটা বুনলে, কিছু বললে না। লাবণ্যর মুখ বুকের উপর একবার চেপে ধরে ফেরবার পথে খুব ধীরে ধীরে চলল। বললে, “কাল সকালেই আমাকে ছাড়তে হবে । তার আগে আর দেখা করতে আসব না ।” “কেন আসবে না ।” “আজ ঠিক জায়গায় আমার শিলঙ পাহাড়ের অধ্যায়টি এসে থামল- ইতি প্ৰথমঃ সৰ্গঃ, আমাদের সয়ে-বিয়ে স্বৰ্গ ।” লাবণ্য কিছু বললে না, অমিতার হাত ধরে চলল। বুকের ভিতর আনন্দ, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে একটা কান্না স্তব্ধ হয়ে আছে | মনে হল, জীবনে কোনোদিন এমন নিবিড় করে অভাবনীয়কে এত কাছে পাওয়া যাবে না। পরম ক্ষণে শুভদৃষ্টি হল, এর পরে আর কি বাসরঘর আছে। রইল কেবল মিলন আর বিদায় একত্র মিশিয়ে একটি শেষ প্ৰণাম । ভারি ইচ্ছে করতে লাগল। অমিতকে এখনই সেই প্ৰণামটি করে ; বলে, তুমি আমাকে ধন্য করেছ। কিন্তু সে আর হল না। বাসার কাছাকাছি আসতেই অমিত বললে, “বন্যা, আজ তোমার শেষ কথাটি একটি কবিতায় বলো, তা হলে সেটা মনে করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে । তোমার নিজের যা মনে আছে এমন একটা-কিছু আমাকে শুনিয়ে দাও ।” লাবণ্য একটুখানি ভেবে আবৃত্তি করলে “তোমারে দিই নি সুখ, মুক্তির নৈবেদ্য গেনু রাখি রজনীর শুভ্র অবসানে। কিছু আর নাই বাকি, নাইকো প্রার্থনা, নাই প্রতি মুহুর্তের দৈন্যরাশি, নাই অভিমান, নাই দীন কান্না, নাই গৰ্ব-হাসি, নাই পিছু ফিরে দেখা। শুধু সে মুক্তির ডালিখানি ভরিয়া দিলাম আজি আমার মহৎ মৃত্যু আনি।” “বন্যা, বড়ো অন্যায় করলে। আজকের দিনে তোমার মুখে বলবার কথা এ নয়, কিছুতেই নয়। কেন এটা তোমার মনে এল । তোমার এ কবিতা এখনই ফিরিয়ে নাও ।” “ভয় কিসের মিতা। এই আগুনে-পোড়া প্ৰেম, এ সুখের দাবি করে না, এ নিজে মুক্ত বলেই মুক্তি দেয়, এর পিছনে ক্লান্তি আসে না, স্নানতা আসে না- এর চেয়ে আর কিছু কি দেবার আছে।” “কিন্তু আমি জানতে চাই, এ কবিতা তুমি পেলে কোথায় ।” ‘ब्रवि ठाकूनिद्ध।” - “তার তো কোনাে বইয়ে এটা দেখি নি।” “বইয়ে বেরোয় নি।” “তবে পেলে কী করে।” । “একটি ছেলে ছিল, সে আমার বাবাকে গুরু বলে ভক্তি করত । বাবা দিয়েছিলেন তাকে তার জ্ঞানের খাদ্য, এ দিকে তার হৃদয়টিও ছিল তাপস । সময় পেলেই সে যেত। রবি ঠাকুরের কাছে, খাতা থেকে মুষ্টিভিক্ষা করে আনত ।” v