পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV)8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বিদ্যালয়ের এই সর্দার-পোড়োটিকে বিলাতি বেশভুষা-আচারব্যবহারের অনুকরণ করিতে দেখিলেই বিমুখ না হইয়া থাকিতে পারে না। জাপান নিজের এই অদ্ভুত কুরুচি, এই হাস্যজনক অসংগতি সম্বন্ধে নিজে একেবারেই অন্ধ। কিন্তু যুরোপ এই ছদ্মদেশী এশিয়াবাসীকে দেখিয়া বিপুল শ্রদ্ধা সত্ত্বেও না হাসিয়া থাকিতে পারে না । আর আমরা কি য়ুরোপের সহিত অন্য সমস্ত বিষয়েই এতটা দূর একাত্ম হইয়া গিয়াছি যে, বাহা অনৈক্য বিলোপ করিয়া দিলে অসংগতি-নামক গুরুতর রুচিদোষ ঘটিবে না । এই তো গেল একটা কথা। দ্বিতীয় কথা এই যে, এই উপায়ে লাভ চুলায় যাক, মূলধনেরই ক্ষতি হয়। ইংরাজের সহিত অনৈক্য তো আছেই, আবার স্বদেশীয়ের সহিত অনৈক্যের সূচনা হয়। আমি যদি আজ ইংরাজের মতো হইয়া ইংরাজের নিকট মান কাড়িতে যাই তবে আমার যে ভ্রাতারা ইংরাজের মতো সাজে নাই তাহাদিগকে আত্মীয় বলিয়া পরিচয় দিতে স্বভাবতই কিছু সংকোচবোধ হয়ই। তাহাদের জন্য লজ্জা অনুভব না করিয়া থাকিবার জো নাই। আমি যে নিজগুণে ঐ-সকল মানুষের সহিত বিচ্ছিন্ন, হইয়া স্বতন্ত্ৰজাতিভুক্ত হইয়াছি। এইরূপ পরিচয় দিতে প্রবৃত্তি হয়। ইহার অর্থই এই-- জাতীয় সম্মান বিক্রয় করিয়া আত্মসম্মান ক্রয় করা । ইংরাজের কাছে একরকম করিয়া বলা যে, সাহেব, ঐ বর্বরদের প্রতি যেমন ব্যবহারই করা, আমি যখন কতকটা তোমাদের মতো চেহারা করিয়া আসিয়াছি তখন মনে বড়ো আশা আছে যে, আমাকে তুমি দূর করিয়া দিবে না। মনে করা যাক যে, এইরূপ কাঙালবৃত্তি করিয়া কিছু প্ৰসাদ পাওয়া যায়। কিন্তু ইহাতেই কি আপনার কিংবা স্বজাতির সম্মান রক্ষা করা হয় । কৰ্ণ যখন অশ্বখামাকে বলেন যে, তুমি ব্ৰাহ্মণ, তোমার সহিত কী যুদ্ধ করিব, তখন অশ্বত্থামা বলিয়াছিলেন, আমি ব্ৰাহ্মণ সেইজন্যেই তুমি আমার সহিত যুদ্ধ করিতে পরিবে না !! আচ্ছা, তবে আমার এই পইতা ছিড়িয়া ফেলিলাম । সাহেব যদি শেকহ্যাভূপূর্বক বলে এবং এস্কোয়ার-যোজনা-পূর্বক লেখে যে, আচ্ছা, তুমি যখন তোমার জাতীয়ত্ব যথাসম্ভব ঢাকিয়া আসিয়াছ তখন এবারকার মতো তোমাকে আমাদের ক্লাবের সভ্য করা গেল, আমাদের হােটেলে স্থান দেওয়া গেল, এমন-কি, তুমি দেখা করিলে এক-আধবার তোমার “কল রিটার্ন” করা যাইতেও পারে- তবে কি তৎক্ষণাৎ আপনাকে পরমসম্মানিত জ্ঞান করিয়া পুলকিত হইয়া উঠিব, না বলিব- ইহারই জন্য আমার সম্মান ! তবে এ ছদ্মবেশ আমি ছিড়িয়া ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া দিলাম ; যতক্ষণে না আমার সমস্ত স্বজাতিকে আমি যথার্থ সম্মানযোগ্য করিতে পারিব ততক্ষণ আমি রঙ মাখিয়া একসেপশন সাজিয়া তোমাদের দ্বারে পদার্পণ করিব না । আমি তো বলি, সেই আমাদের একমাত্র ব্ৰত । সম্মান বঞ্চনা করিয়া লইব না, সম্মান আকর্ষণ করিব ; নিজের মধ্যে সম্মান অনুভব করিব । সেদিন যখন আসিবে তখন পৃথিবীর যে সভায় ইচ্ছা! প্ৰৱেশ করিব- ছদ্মবেশ, ছদ্মনাম, ছদ্মব্যবহার এবং যাচিয়া মান কাদিয়া সোহাগের কোনো প্রয়োজন থাকিবে না । w উপায়টা সহজ নহে। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, সহজ উপায়ে কোন দুঃসাধ্য কাজ হইয়াছে! বড়ো কঠিন কাজ ; সেইজন্য অন্য-সমস্ত ফেলিয়া তাঁহারই প্রতি বিশেষ মনোযোগ করিতে হইবে। কার্যে প্রবৃত্ত হইবার আরম্ভে এই পণ করিয়া বসিতে হইবে যে, যতদিন-না সুযোগ্য হইব। অজ্ঞাতবাস অবলম্বন করিয়া থাকিব । নির্মাণ হইবার অবস্থায় গোপনের আবশ্যক। বীজ মৃত্তিকার নিম্নে নিহিত থাকে, ভুণ গর্ভের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে রক্ষিত হয় । শিক্ষাবস্থায় বালককে সংসারে অধিক পরিমাণে মিশিতে দিলে সে প্রবীণ-সমাজের মধ্যে গণ্য হইবার দুরাশায় প্রবীণদিগের অযথা অনুকরণ করিয়া অকালপক্ক হইয়া যায়। সে মনে করে সে একজন গণ্যমান্য লোক হইয়া গিয়াছে; তাহার। আর রীতিমত শিক্ষার প্রয়োজন নাই- বিনয় তাহার পক্ষে বাহুল্য । পাণ্ডবেরা পূৰ্বগীেরব গ্রহণ করিতে প্ৰবৃত্ত হইবার পূর্বে অজ্ঞাতবাসে থাকিয়া বল সঞ্চয় করিয়াছেন