পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্ৰজা VVS এককে, ক্ষুদ্রতার মধ্যে ভূমাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের সাধনাকে ভারতবর্ষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন । অতীতকাল হইতে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের এই এক-একটি অধ্যায় ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত প্ৰলাপমাত্র নহে- ইহারা পরস্পর গ্রথিত, ইহারা কেহই একেবারে স্বপ্নের মতো অন্তর্ধান করে নাই- ইহারা সকলেই রহিয়াছে, ইহারা সন্ধিতেই হউক সংগ্রামেই হউক, ঘাতপ্ৰতিঘাতে বিধাতার অভিপ্ৰায়কে অপূর্ব বিচিত্ররূপে সংরচিত করিয়া তুলিতেছে। পৃথিবীর মধ্যে আর-কোনো দেশেই এতবড়ো বৃহৎ রচনার আয়োজন হয় নাই ; এত জাতি এত ধর্ম এত শক্তি কোনো তীৰ্থস্থলেই একত্র হয় নাই ; একান্ত বিভিন্নতা ও বৈচিত্ৰ্যকে প্ৰকাণ্ড সমন্বয়ে বাধিয়া তুলিয়া বিরোধের মধ্যেই মিলনের আদর্শকে পৃথিবীর মধ্যে জয়ী করিবার এমন সুস্পষ্ট আদেশ জগতের আর কোথাও ধ্বনিত হয় নাই। আর সর্বত্র মানুষ রাজ্য বিস্তার করুক, পণ্য বিস্তার করুক, প্ৰতাপ বিস্তার করুক- ভারতবর্ষের মানুষ দুঃসহ তপস্যা দ্বারা এককে ব্ৰহ্মকে জ্ঞানে প্রেমে ও কর্মে সমস্ত অনৈক্য ও সমস্ত বিরোধের মধ্যে স্বীকার করিয়া মানুষের কর্মশালার কঠোর সংকীর্ণতার মধ্যে মুক্তির উদার নির্মল জ্যোতিকে বিকীর্ণ করিয়া দিক- ভারত-ইতিহাসের আরম্ভ হইতেই আমাদের প্রতি এই অনুশাসন প্রচারিত হইয়াছে। শ্বেত ও কৃষ্ণ, মুসলমান ও খৃস্টান, পূর্ব ও পশ্চিম, কেহ আমাদের বিরুদ্ধ নহে— ভারতের পুণ্যক্ষেত্রেই সকল বিরোধ এক হইবার জন্য শত শত শতাব্দী ধরিয়া অতি কঠোর সাধনা করিবে: বলিয়াই অতি সুদূরকালে এখানকার তপোবনে একের তত্ত্ব উপনিষদ এমন আশ্চর্য সরল জ্ঞানের সহিত প্রচার করিয়াছিলেন যে, ইতিহাস তাহাকে নানা দিক দিয়া ব্যাখ্যা করিতে করিতে আজও অন্ত পায় कां । তাই আমি অনুরোধ করিতেছিলাম, অন্যান্য দেশে মনুষ্যত্বের আংশিক বিকাশের দৃষ্টান্তে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে সংকীর্ণ করিয়া দেখিবেন না- ইহার মধ্যে যে বহুতর আপাতবিরোধ লক্ষিত হইতেছে তাহা দেখিয়া হতাশ হইয়া কোনাে ক্ষুদ্র চেষ্টায় নিজেকে অন্ধভাবে নিযুক্ত করিবেন নাকরিলেও, কোনোমতেই কৃতকার্য হইবেন না। এ কথা নিশ্চয় জানিবেন । বিধাতার ইচ্ছার সহিত নিজের ইচ্ছাকে সম্মিলিত করাই সফলতার একমাত্র উপায় ; তাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে গেলেই ক্ষণিক কার্যসিদ্ধি আমাদিগকে ভুলইয়া লইয়া ভয়ংকর ব্যর্থতার মধ্যে ডুবাইয়া মারিবে । যে ভারতবর্ষ মানবের সমস্ত মহৎশক্তিপুঞ্জ দ্বারা ধীরে ধীরে এইরূপে বিরাটমূর্তি ধারণ করিয়া উঠিতেছে, সমস্ত আঘাত-অপমান সমস্ত বেদনা যাহাকে এই পরমপ্রকাশের অভিমুখে অগ্রসর করিতেছে, সেই মহাভারতবর্ষের সেবা। আমাদের মধ্যে সজ্ঞানে সচেতনভাবে কে করবেন, কে একান্ত অবিচলিত ভক্তির সহিত সমস্ত ক্ষোভ-অধৈর্য-অহংকারকে এই মহাসাধনায় বিলীন করিয়া দিয়া ভারতের মহাজাতীয়-উদবোধনের সেই আমাদের পুরোহিতবৃন্দ কোথায় । তাহারা যেখানেই থাকুন, এ কথা আপনারা ধ্রুবসত্য বলিয়া জানিবেন, তাহারা চঞ্চল নহেন, তাহারা উন্মত্ত নহেন, তাহারা কর্মনির্দেশশুন্য স্পর্ধাবাক্যের দ্বারা দেশের লোকের হৃদয়বেগকে উত্তরোত্তর সংক্রামক বায়ুরোগে পরিণত করিতেছেন না ; নিশ্চয় জানিবেন, তঁহাদের মধ্যে বুদ্ধি হৃদয় এবং কর্মনিষ্ঠার অতি অসামান্য সমাবেশ ঘটিয়াছে, তঁহাদের মধ্যে জ্ঞানের সুগভীর শান্তি ও ধৈর্য এবং ইচ্ছাশক্তির অপরাজিত বেগ ও অধ্যবসায় এই উভয়ের সুমহৎ সামঞ্জস্য আছে। কিন্তু যখন দেখা যায়, কোনো-একটা বিশেষঘটনামূলক উত্তেজনার তাড়নায়, একটা সাময়িক বিরোধের ক্ষুব্ধতায় দেশের অনেক লোক সহসা দেশের হিত করিতে হইবে বলিয়া এক মুহুর্তে উৰ্ব্বশ্বাসে ধাবিত হয়- নিশ্চয় বুঝিতে হইবে, হৃদয়বেগকে একমাত্র সম্বল করিয়া তাহারা দুৰ্গম পথে বাহির হইয়া পড়িয়ছে। তাহারা দেশের সুদূর ও সুবিত্তীর্ণ মঙ্গলকে শান্তভাবে সত্যভাবে বিচার করিতে অবস্থগতিকেই অক্ষম । তাহারা তাহাদের উপস্থিত বেদনাকেই এত তীব্ৰভাবে অনুভব করে এবং তাহারই প্ৰতিকারচেষ্টাকে এত উগ্রভাবে মনে রাখে যে, আত্মসংবরণে অক্ষম হইয়া দেশের সমগ্ৰ হিতকে আঘাত করা তাহদের পক্ষে অসম্ভব হয় না ।