পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V&V) সমূহ বলিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া থাকিব । সমস্ত দেশের উপরে মৃত্যুর এই-যে অবিচ্ছিন্ন জলনিক্ষেপ দেখিতেছি, ইহাকে কি আমরা আকস্মিক বলিতে পারি। ইহা আকস্মিক নহে। ইহা বদ্ধমূল ব্যাধির আকার ধারণ করিতেছে। এমনি করিয়া অনেক জাতি মারা পড়িয়ছে- আমরাও যে দেশব্যাপী মৃত্যুর আক্রমণ হইতে বিনা চেষ্টায় নিস্কৃতি পাইব এমন তো কোনো কারণ দেখি না । আমরা চক্ষের সমক্ষে দেখিতেছি যে, যে-সব জাতি সুস্থ সবল তাহারাও প্রাণরক্ষার জন্য প্রতিক্ষণে লড়াই করিতেছে- আর আমরা আমাদের জীৰ্ণতার উপরে মৃত্যুর পুনঃপুন নখরাঘাত সত্ত্বেও বিনা প্ৰয়াসে বঁাচিয়া থাকিব ? ? এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে, ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুৰ্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষমাত্র, তাহারা বাহ্যলক্ষণমাত্র- মূল ব্যাধি দেশের মজার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। আমরা এতদিন এক ভাবে চলিয়া আসিতেছিলাম- আমাদের হাটে বাটে গ্রামে পল্লীতে আমরা এক ভাবে বঁচিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, আমাদের সে ব্যবস্থা বহুকালের পুরাতন । তাহার পরে আজ বাহিরের সংঘাতে আমাদের অবস্থান্তর ঘটিয়াছে। এই নূতন অবস্থার সহিত এখনো আমরা সম্পূর্ণ। আপস করিয়া লইতে পারি নাই ; এক জায়গায় মিলাইয়া লইতে গিয়া আর-এক জায়গায় অঘটন ঘটিতেছে। যদি এই নূতনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি। তবে আমাদিগকে মরিতেই হইবে। পৃথিবীতে যে-সকল জাতি মরিয়াছে তাহারা এমনি করিয়াই মরিয়াছে। ম্যালেরিয়ার কারণ দেশে নুতন হইয়াছে এমন নহে। চিরদিনই আমাদের দেশ জলা দেশবনজঙ্গল এখনকার চেয়ে বরং পূর্বে বেশিই ছিল, এবং কোনোদিন এখানে মশার অভাব ছিল না। কিন্তু দেশ তখন সচ্ছল ছিল। যুদ্ধ করিতে গেলে রসদের দরকার হয়- সর্বপ্রকার গুপ্ত মারীশক্রির সহিত লড়াইয়ে সেদিন আমাদের রসদের অভাব ছিল না। আমাদের পল্লীর অন্নপূর্ণ সেদিন নিজের সন্তানদিগকে অর্ধভুক্ত রাখিয়া টাকার লোভে পরের ছেলেকে স্তন্য দিতে যাইতেন না। শুধু তাই নয়, তখনকার সমাজব্যবস্থায় পল্লীর জলাশয়- খনন ও সংস্কারের জন্য কাহারও অপেক্ষা করিতে হইত না- পল্লীর ধর্মবুদ্ধি পল্লীর অভাবমোচনে নিয়ত জাগ্রত ছিল । আজ বাংলার গ্রামে গ্রামে কেবল যে জলকষ্ট হইয়াছে তাহা নহে, প্রাচীন জলাশয়গুলি দূষিত হইয়াছে। এইরূপে শরীর যখন আন্নাভাবে হীনবল এবং পানীয় জল যখন শোধনাভাবে রোগের নিকেতন, তখন বঁাচিবার উপায় কী । এইরূপে প্লেগও সহজেই আমাদের দেশ অধিকার করিয়াছে- কোথাও সে বাধা পাইতেছে না, কারণ পুষ্টি-অভাবে আমাদের শরীর অরক্ষিত । । পুষ্টির অভাব ঘটিবার প্রধান কারণ, নানা নূতন নূতন প্রণালী-যোগে অন্ন বাহিরের দিকে প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে- আমরা যাহা খাইয়া এতদিন মানুষ হইয়াছিলাম তাহা যথেষ্ট্রপরিমাণে পাইতেছি না। আজ পাড়াগায়ে যান, সেখানে দুধ দুর্লভ, ঘি দুর্মুল্য, তেল কলিকাতা হইতে আসে, তাহাকে পূর্ব-অভ্যাসবশত সরিষার তেল বলিয়া নিজেকে সান্তনা দিই। ; তা ছাড়া যেখানে জলকষ্ট সেখানে মাছের প্রাচুর্য নাই, সে কথা বলা বাহুল্য। সস্তার মধ্যে সিংকোেনা সস্তা হইয়াছে। এইরূপে এক দিনে নহে, দিনে দিনে সমস্ত দেশের জীবনীশক্তির মূলসঞ্চয় ক্রমে ক্ৰমে ক্ষয় হইয়া যাইতেছে। যেমন মহাজনের কাছে যখন প্রথম দেনা করিতে আরম্ভ করা যায়। তখনো শোধ করিবার সম্বল ও সম্ভাবনা থাকে ; কিন্তু সম্পত্তি যখন ক্ষীণ হইতে থাকে তখন, যে মহাজন। একদা কেবল নৈমিত্তিক ছিল, সে নিত্য হইয়া উঠে- আমাদের দেশেও ম্যালেরিয়া প্লেগ ওলাউঠা দুর্ভিক্ষ একদিন আকস্মিক ছিল, কিন্তু এখন ক্রমে আর কোনোকালে তাঁহাদের দেনা শোধ করিবার উপায় দেখা যায় না, আমাদের মূলধন ক্ষয় হইয়া আসিয়াছে, এখন তাহারা আর কেবল ক্ষণে ক্ষণে তাগিদ করিতে আসে না, তাহারা আমাদের জমিজমাতে আমাদের ঘরবাড়িতে নিত্য হইয়া বসিয়াছে। বিনাশ যে এমনি করিয়াই ঘটে, বৎসরে বৎসরে তাহার কি হিসাব পাওয়া যাইতেছে না । এমন অবস্থায় রাজার মন্ত্রণাসভায় দুটাে প্রশ্ন উত্থাপন করিতে ইচ্ছা করি। যদি তো করো, তাহাতে