পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓዓS রবীন্দ্র-রচনাবলী তুলিবে তাহার সহিত প্রতিযোগিতা করিবার উপযুক্ত নখদন্ত কোথায় মিলিবে । আমরা উপদেশের তাড়নায় অত্যন্ত দুর্বলভাবে কাজ আরম্ভ করিব, কিন্তু যে নিষ্ঠুর বিদ্বেষ উন্মথিত হইয়া উঠিবে সেই হলাহল অনায়াসে গলাধঃকরণ করিবার শক্তি ও অভ্যাস আমাদের নাই । আমি এ কথা ভয় হইতে বলিতেছি না। দাঁত ভাঙা, নাক থ্যাবড়ানো, জেলে যাওয়া অত্যন্ত গুরুতর অশুভ বলিয়া গণ্য নাই হইল। কিন্তু যে গরিলকে পরিপাক করিতে আমরা স্বাভাবিক কারণেই অক্ষম সেই গরলকে উদ্রিক্ত করিয়া তোলা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক কি না, জানি না । কিন্তু একটা অবস্থা আছে যখন ফলাফল বিচার অসংগত এবং অন্যায় । ইংরাজ যখন অন্যায় করিয়া আমাকে অপমান করে, তখন যতটুকু আমার সামৰ্থ্য আছে, তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিকার করিয়া জেলে যাওয়া এবং মরাও উচিত । ইহা নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, হয়তো ঘুষায় পারিব না এবং হয়তো বিচারশালাতেও দোষী সাব্যস্ত হইব ; তথাপি অন্যায় দমন করিবার জন্য প্রত্যেক মানুষের যে স্বগীয় অধিকার আছে যথাসময়ে তাহা যদি না খাটাইতে পারি, তবে মনুষ্যের নিকট হেয় এবং ধর্মের নিকট পতিত হইব। নিজের দুঃখ ও ক্ষতি আমরা গণ্য না করিতে পারি, কিন্তু যাহা অন্যায় তাহা সমস্ত জাতির প্রতি এবং সমস্ত মানুষের প্রতি অন্যায়, এবং বিধাতার ন্যায়দণ্ডের ভার আমাদের প্রত্যেকের উপরেই আছে। বিদ্বেষ হইতে, বাহাদুরি হইতে স্পর্ধা হইতে নিজেকে সর্বপ্রযত্নে বঁাচাইয়া, ন্যায়নীতির সীমার মধ্যে কঠিনভাবে নিজেকে সংবরণ করিয়া দুষ্টশাসনের কর্তব্য আমাদিগকে গ্ৰহণ করিতেই হইবে । শারীরিক কষ্ট ক্ষতি বা অকৃতকার্যতা ভয়ের বিষয় নহে— ভয়ের বিষয় এই যে, ধর্মকে বিস্মৃতি হইয়া প্রবৃত্তির হাতে পাছে আত্মসমর্পণ করি, পরকে দণ্ড দিতে গিয়া পাছে আপনাকে কলুষিত করি, বিচারক হইতে গিয়া পাছে গুণ্ডা হইয়া উঠি । আমরা দেখিয়াছি, দুই দিক বঁাচাইয়া চলা সাধারণ মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন, এইজন্য ভালোমন্দ ওজন করিয়া অনেক সময় আমাদিগকে একটা দিক অবলম্বন করিতে হয় । কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সেরূপ রফা করিতে গেলেই সেই ছিদ্ৰযোগে শনি প্ৰবেশ করে- প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যে সামঞ্জস্যপথ আছে তাহা অত্যন্ত দুরূহ হইলেও, তাহাই আমাদিগকে নিয়তযত্নে অনুসন্ধান ও অবলম্বন করিতে হইবে- নতুবা বিনাশপ্ৰাপ্ত হইতেই হইবে। ধর্মের এই অমোঘ নিয়ম হইতে য়ুরোপ বা এশিয়া কাহারও নিস্কৃতি নাই। অতএব ঘুষাঘুষি-মারামারির কথা যখন ওঠে, তখন সাবধান হইতে বলি। দেবতার তুণেও অস্ত্র আছে, দানবের তৃণও শূন্য নহে- অপ্ৰমত্ত হইয়া অস্ত্র নির্বাচন যদি করিতে পারি। তবেই যুদ্ধের অধিকার জন্মে, তখন কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। Q (ܠܹ বঙ্গবিভাগ বঙ্গবিভাগ এবং শিক্ষাবিধি লইয়া আমাদের দেশে সম্প্রতি যে আন্দোলন হইয়া গেছে, তাহার মধ্যে একটি অপূর্বত্ব বিদেশী লোকেরাও লক্ষ্য করিয়াছে। সকলেই বলিতেছে, এবারকার বক্তৃতাদিতে রাজভক্তির ভড়ং নাই, সামলাইয়া কথা কহিবার প্রয়াস নাই, মনের কথা স্পষ্ট বলিবার একটা চেষ্টা দেখা গিয়াছে। তা ছাড়া, এ কথাও কোনো কোনো ইংরাজি কাগজে দেখিয়াছি যে, রাজার কাছে দরবার করিয়া কোনো ফল নাই- এমনতরো নৈরাশ্যের ভাবও এই প্রথম প্রকাশ পাইয়াছে। কনগ্রেস প্রভৃতি রাষ্ট্রনৈতিক সভাস্থলে আমরা বরাবর দুই কুল বঁাচাইয়া কথা কহিবার চেষ্টা করিয়াছি । রাজভক্তির অজস্র গৌরচন্দ্ৰকার দ্বারা আমরা সর্বপ্রথমেই গোরার মনোহরণব্যাপার সমাধা করিয়া তাহার পরে কালার তরফের কথা তুলিয়াছি। হতভাগ্য হতবল ব্যক্তিদের এইরূপ নানাপ্রকার নিম্ফল কালকীেশল দেখিয়া নিষ্ঠুর অদৃষ্ট অনেক দিন হইতে হাস্য করিয়া আসিয়াছে।