পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brObr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী

  • লেখকের পক্ষে অপ্রিয় হওয়া একটা মহৎ ক্ষতি । কারণ, লেখা বুঝিতে বুদ্ধির যেমন আবশ্যক গ্ৰীতির আবশ্যক তদপেক্ষা অল্প নহে। প্রথম হইতে পাঠকের মনটি যদি অনুকুল থাকে, অন্তত প্রতিকুল না থাকে, তবে ভাবের সৌন্দৰ্য উপলব্ধি করা তাহার পক্ষে অনেকটা সহজ হয় । গোড়াতেই বিমুখ হইয়া বসিলে সহস্র তর্কের দ্বারা সৌন্দর্য প্রতিপন্ন করা যায় না। এইজন্য প্রাচীন কবিরা অপর্যাপ্ত নম্রতার দ্বারা পাঠকের মন আর্দ্র করিয়া রচনা আরম্ভ করিতেন- তাহারা শ্রোতামাত্রকেই সুধীজন এবং সুধীমাত্রকেই ক্ষীরগ্রাহী হংস এবং কেবলমাত্র আপনাদিগকে অভাজন বলিয়া প্রচার করিতেন এবং বোধ করি যথোচিত ফললাভ করিয়া মনে মনে হাসিতে ছাড়িতেন না ।

“কিন্তু যে লেখক সমালোচনা করেন তাহার পক্ষে এই নম্রতা রক্ষা করা বড়ো কঠিন । পাঠকেরা একেবারে বদ্ধপরিকর হইয়া অস্ত্রশস্ত্র বঁাধিয়া তাহার লেখা পড়িতে আরম্ভ করেন, এমন-কি, অধিকাংশ সময়ে পাঠ না করিয়াই অস্ত্ৰক্ষেপণ করিতে থাকেন। তাহারা ভুলিয়া যান যে অবলা সরস্বতীর হস্তে গদা নাই, কেবল একটি বীণা আছে মাত্র । “এই কারণে যে-সকল লেখক রচনার দ্বারা অনিশ্চিতমতি-পাঠকজাতির মনোরঞ্জনের উচ্চাশা হৃদয়ে পোষণ করিয়া থাকেন, সমালোচন-কার্যে অগ্রসর হইতে তাহদের অভিরুচি হয় না । রীতিমত এ কার্যে প্ৰবৃত্ত হইলে চিত্তও অনেকটা বিক্ষিপ্ত হয়। এইজন্য যে দেশে সাহিত্যচর্চা অধিক সে দেশে প্রায়ই লেখক এবং সমালোচক -সম্প্রদায় স্বতন্ত্র হইয়া থাকে । “আমাদের দেশে এখনো সেই কাৰ্যবিভাগের সময় আসে নাই- এবং বঙ্কিম যখন সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন তখন সেই সময় আরো সুদূরবতী ছিল । সেইজন্য রচনা এবং সমালোচনা এই উভয় কাৰ্যই তিনি বীরের ন্যায় একাকী গ্ৰহণ করিলেন ।” বর্তমান মুদ্রণের ৫৩৪ পৃষ্ঠার ১১ ও ১২ ছত্রের মধ্যে নিম্নলিখিত অংশটুকু ‘সাধনায় অন্তরনিবিষ্ট ছিল- ݂ “বঙ্কিম যেদিন সমালোচকের আসন হইতে অবতীর্ণ হইলেন সেদিন হইতে এ পর্যন্ত আর সে আসন পূর্ণ হইল না। সাহিত্যের প্রতি এখনকার সমালোচনার কোনো প্রভাব নাই। সাধারণে এখনকার সমালোচনা কেবল বিজ্ঞাপনস্তম্ভ সজ্জিত করিবার আয়ােজন-স্বরূপে দেখে। যথার্থ রসবোধ এবং সূক্ষ্ম বিচার প্রকাশ পায় এমন সমালোচনা বহুকাল দেখা যায় নাই। গ্ৰন্থসমালোচনার ভার অনেক সময় অযোগ্য লোকের হস্তে ন্যস্ত হয় এবং অনেক কৃতবিদ্য লেখকও অত্যুক্তি কাল্পনিকতা এবং অবান্তর প্রসঙ্গে তাহাদের সমালোচনা সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলেন ; গ্রন্থের অন্তর্গত প্রকৃত সাহিত্যপদার্থকে প্রাধান্য না দিয়া তাহার আনুষঙ্গিক নীতি অথবা অন্য কোনো তত্ত্বকথার অবতারণা করিয়া পাঠকের চিত্তকে যথার্থ সাহিত্যপথ হইতে ভ্ৰষ্ট করেন। অন্য হিসাবে তাহার গীেরব থাকিতে পারে, কিন্তু সমালোচনার হিসাবে তাহার মূল্য নাই। তাহাতে পাঠকদের মনে রসবোধ বা নির্বাচনশক্তির চর্চা হয় না । ‘সেজন্য এখনকার সাহিত্যে বিস্তর স্বেচ্ছাচারিতা এবং ইতর ভাবের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। এখনকার কোনো রচনা কোনো যথার্থ শ্রদ্ধেয় সমালোচক্সের হন্তে কোনোরূপ প্ৰতিঘাত প্ৰাপ্ত হয় না- সকলেই স্বপ্রধান হইয়া উঠিয়াছেন এবং সাহিত্যক্ষেত্র জঙ্গলে সমাকীর্ণ হইয়া পড়িয়ছে। সাহিত্যের মধ্যে সংযমের, সৌন্দর্যের, শিষ্টতার এবং উচ্চ আদর্শের আবশ্যক কেহ স্মরণ করাইয়া দিতেছেন না, স্বাভাবিক বিচারশক্তির সহিত নিরপেক্ষভাবে দণ্ডপুরস্কার বিধান করিবার কেহই । নাই, পত্রে এবং সংবাদপত্রে উৎসাহ অত্যন্ত মুক্তহন্তে বিতরিত হইয়া থাকে এবং রাজকোষের শূন্য অবস্থায় কাগজের নোট যেরূপ অজস্র অথচ অনাদৃত হইয়া উঠে এই সকল প্রাচুর্যবিশিষ্ট সমালোচনাও সাধারণের নিকট সেইরূপ প্রায় বিনামূল্যে বিক্ৰীত হয়। ] “এই বর্তমান দুরবস্থার উল্লেখ করিয়া কাহারও প্রতি দোষারোপ করা আমার অভিপ্ৰায় নহে।