পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Σ. Φ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী কাছে ছোটো হয়ে না থাকে তবে সে ব্যক্তি কাজ করতেই পারে না । এইজন্যই ঈশ্বর দূরের জিনিসকে মানুষের দৃষ্টির কাছে খাটো করে দিয়েছেন– সব সত্যকেই সমান প্রত্যক্ষ করিয়ে তাকে মহা বিপদে ফেলেন নি। আমাদের একটা দিক বেছে নিতেই হবে, সব এক সঙ্গে আঁকড়ে ধরবার লোভ ছাড়তেই হবে, নইলে সত্যকেই পাব না । তুমি যেখানে দাড়িয়ে সত্যের যে মূর্তিকে প্রত্যক্ষ করছ, আমি সেখানে সে মৃতিকে অভিবাদন করতে যেতে পারব না— তা হলে আমার জীবনের সত্যকে হারাতে হবে । হয় এ দিক নয় ও দিক ৷” বিনয় কহিল, "হয় বিনয়, নয় গোরা । আমি নিজেকে ভরে নিতে দাড়িয়েছি, তুমি নিজেকে ত্যাগ করতে দাড়িয়েছ।” গোরা অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “বিনয়, তুমি মুখে মুখে বই রচনা কোরো না । তোমার কথা শুনে আমি একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, তোমার জীবনে তুমি আজ একটা প্রবল সত্যের সামনে মুখোমুখি দাড়িয়েছ— তার সঙ্গে ফাকি চলে না । সত্যকে উপলব্ধি করলেই তার কাছে আত্মসমপণ করতেই হবে— সে আর থাকবরি জে নেই । আমি যে ক্ষেত্রে দাড়িয়েছি সেই ক্ষেত্রের সত্যকেও অমনি করেই এক দিন আমি উপলব্ধি করব এই আমার আকাঙ্ক্ষা । তুমি এতদিন বই-পড়া প্রেমের পরিচয়েই পরিতৃপ্ত ছিলে— আমিও বই-পড়া স্বদেশপ্রেমকেই জানি– প্রেম আজ তোমার কাছে যখনি প্রত্যক্ষ হল তখনি বুঝতে পেরেছ বইয়ের জিনিসের চেয়ে এ কত সত্য— এ তোমার সমস্ত জগৎ-চরাচর অধিকার করে বসেছে, কোথাও তুমি এর কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছ না— স্বদেশপ্রেম যেদিন আমার সম্মুখে এমনি সর্বাঙ্গীণ ভাবে প্রত্যক্ষগোচর হবে সেদিন আমারও আর রক্ষা নেই । সেদিন সে আমার ধনপ্রাণ, আমার অস্থিমজ্জারত্ত, আমার আকাশ-আলোক, আমার সমস্তই অনায়াসে আকর্ষণ করে নিতে পারবে। স্বদেশের সেই সত্যমূর্তি যে কী আশ্চর্য অপরূপ, কী সুনিশ্চিত স্বগোচর, তার আনন্দ তার বেদন যে কী প্রচণ্ড প্রবল, যা বন্যার স্রোতের মতে জীবন-মৃত্যুকে এক মুহূর্তে লঙ্ঘন করে যায়, তা আজ তোমার কথা শুনে মনে মনে অল্প অল্প অনুভব করতে পারছি। তোমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে আজ আঘাত করেছে— তুমি যা পেয়েছ তা আমি কোনো দিন বুঝতে পারব কিনা জানি না— কিন্তু আমি যা পেতে চাই তার আস্বাদ যেন তোমার ভিতর দিয়েই আমি অনুভব করছি।” বলিতে বলিতে গোরা মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। পূর্বদিকের উষার আভাস তাহার কাছে যেন একটা বাক্যের মতে, বার্তার মতো প্রকাশ পাইল,