পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSV রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী । প্ৰেম লইয়া কথোপকথন করিতেছিল। কিছুক্ষণ পরে এমিলিয়া গেটেকে কহিল- ‘তোমাতে আমাতে। তবে এই পর্যন্ত।’ গেটেকে দ্বার পর্যন্ত লইয়া গিয়া এমিলিয়া কহিল, “আমাদের এই শেষ দেখা। তোমাকে যাহা কখনো দিই নাই ও দিতাম না, আজ তাহা দিলাম,’’ এই বলিয়া গেটের গলা ধরিয়া তাহাকে চুম্বন করিল। উন্মত্ত গেটে তাহাকে আলিঙ্গন করিলেন- এমন সময়ে লুশিন্দা তাহার রোগশয্যা হইতে বিশৃঙ্খল-বসনে ছুটিয়া আসিয়া এমিলিয়াকে কহিল, “তুমি একলা কেবল উহার নিকট হইতে বিদায় লইতে পরিবে না।” এমিলিয়া গেটেকে ছাড়িয়া দিললুশিন্দা গেটের বক্ষ জড়াইয়া ধরিল— ও তাহার স্বর্ণবৰ্ণ কেশপাশ দিয়া তাহার মুখ ঢাকিয়া ফেলিল। লুশিন্দা অনেকক্ষণ নীরবে এই অবস্থায় রহিল— গেটে তো কতকটা হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে লুশিন্দা গেটেকে ছাড়িয়া দিয়া ব্যাকুলনেত্রে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আবার কিয়ৎক্ষণ পরে ছুটিয়া গিয়া চুম্বনে তাহাকে যেন প্লাবিত করিয়া দিল; পরিশেষে কহিল- “এখন আমার অভিশাপ শুন- আমার ”পরে প্রথম যে তোমার ওই অধর চুম্বন করিবে- চিরকাল তাহার দুঃখের পর দুঃখ হউক! যদি সাহস হয় তবে পুনরায় চুম্বন করিয়ো- কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনিয়াছেন। এখন তুমি বিদায় হও— যত শীঘ্ৰ পাের, বিদায় হও!” গেটে বিদায় হইতে কিছুমাত্র কালবিলম্ব করিলেন না। এখন আমরা পুনরায় ফ্রেডুরিকার নিকট প্রত্যাবর্তন করি। পূর্বোক্ত দ্বিতীয় মিলনকালে গেটে ফ্রেডুরিকার সহিত গ্ৰামপথে ভ্ৰমণ করিতেছেন- দিনগুলি অতি শীঘ্র ও অতি সুখে চলিয়া যাইতেছে- কিন্তু এ পর্যন্ত সেই অভিশাপের ভয়ে গেটে কখনো ফ্রেডুরিকাকে চুম্বন করেন নাই। এইখানে পুনরায় পাঠকদিগকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি যে, বৈদেশিকের জীবন চরিত্র পড়িবার সময় আপনাকে কতকটা তাহাদেরই রীতিনীতি প্ৰথা সহাইয়া লওয়া প্রয়োজনীয়। তাহদের কার্য তাহাদেরই আচার-ব্যবহারের সহিত তুলনা করিয়া বিচার করা কর্তব্য। এক প্রকার তাস খেলা আছে, হারিলে চুম্বন দণ্ড দিতে হয়— গেটে এই চুম্বনের পরিবর্তে কবিতা উপহার দিতেনকিন্তু যে মহিলার তাহার নিকট হইতে চুম্বন প্রাপ্য থাকিত তাহার যে মর্মে আঘাত লাগিত তাহা বলা বাহুল্য। কিন্তু গেটে অধিক দিন এরূপ সামলাইয়া চলিতে পারেন নাই। একটি নাচের উৎসবে গেটে ফ্রেডুরিকার সহিত নাচিয়াছিলেন— গেটের নাচ ফ্রেডুরিকার বড়ো ভালো লাগিয়াছিল। নাচ শেষ হইলে উভয়ে হাত ধরাধরি করিয়া নির্জনে গিয়া আলিঙ্গন করিয়া হইতে লাগিল— অবশেষে গেটের বিদায় লইবার সময় আত্মীয়দের সম্মুখেই ফ্রেডুরিকা তঁহাকে চুম্বন করিল। গেটে ফ্রেডুরিকার প্রেমকে বরাবর পালন করিয়া আসিয়াছিলেন— কিছুই বলা এ কহা হয় নাই, অথচ একপ্রকার স্থির হইয়া গিয়াছিল যেন তিনি বিবাহ করিবেন। কিন্তু গেটে জানিতেন তাহার বিবাহ করিবার কোনো সম্ভাবনা নাই। বিদায় হ’ব হ’ব সময়ে ওই কথা তাহার স্মরণ হইল। তখন ফ্রেডুরিকাকে দেখিলে তঁহার মন কেমন অসুস্থ হইত— ফ্রেডুরিকা হইতে দূরে থাকিতে পারিলেই একটু শান্ত হইতেন। বিদায়কালে গেটে অশ্বে আরোহণ করিয়া হাত বাড়াইয়া দিলেন- ফ্রেডুরিকা তাহার হাত ধরিয়া কঁদিতে লাগিল। মনে মনে বিবাহ করিব না জানিয়াও বালিকার প্রেমকে প্রশ্রয় দেওয়া যে অন্যায় হইয়াছিল, তাহা বলা বাহুল্য। কিন্তু ফ্রেডুরিকা তঁহাকে কিছুমাত্র তিরস্কার বার্তাহার নামে কোনো দোষারোপ তা সে করে নাই। গেটের হৃদয় হইতে প্রেম যেরূপ ধীরে ধীরে অপসৃত হইয়াছিল, ফ্রেডুরিকারও সেইরূপ হইয়াছিল। কিনা বলিতে পারি না। যাহা হউক অবিবাহিত অবস্থাতেই তাহার মৃত্যু হয় গেটে ফ্রেডুরিকা সম্বন্ধে কহেন- M ‘গ্রেশেন আমার নিকট হইতে দূরীকৃত হইয়াছিল— অ্যানসেন আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল- কিন্তু এই প্রথম আমি নিজে দোষী হইয়াছিলাম। আমি একটি অতি সুন্দর হৃদয়ের অতি গভীরতম স্থান পর্যন্ত আহত করিয়াছিলাম। অন্ধকারময় অনুতাপে সেই অতি আরামদায়ক