পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থসমালোচনা SeYA দেখা যায়। উহা আমাদের কাছে কেমন একটা ভঙ্গিমা বলিয়া ঠেকে- প্রথম যে লেখক এই ভঙ্গিটি বাহির করিয়াছিলেন তাহকে কথঞ্চিৎ মার্জনা করা যায়- কিন্তু যখন দেখা যায় আজকাল অনেক লেখকই এই সকল সুলভ উচ্ছাসোক্তির ছড়াছড়ি করিয়া হািদয়বাহুল্য প্রকাশ করিতে চেষ্টা করেন তখন অসহ্য হইয়া উঠে। নবীনবাবুও যে এই সকল সামান্য বাক্য-কৌশল অবলম্বন করবেন ইহা আমাদের নিকট নিতান্ত পরিতাপের বিষয় বলিয়া মনে হয়। অপরিচিতের পত্র। জগতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া জ-রি নামক প্রচ্ছন্ননামা কোনো ব্যক্তি এই পুস্তক ছাপাইয়াছেন। জগৎ ক্ষমা করিবে কি না জানি না। কিন্তু আমরা এ ধৃষ্টতা মার্জনা করিতে পারি না। ইহাতে নির্লজ এবং কুঁটা সেন্টিমেন্টালিটির চূড়ান্ত দেখানো হইয়াছে। এবং সর্বশেষে আড়ম্বরপূর্বক জগতের নিকট ক্ষমা ভিক্ষার অভিনয়টি সর্বাপেক্ষা অসহ্য। প্রকৃতির শিক্ষা। গদ্যে অবিশ্রাম হৃদয়োচ্ছাস বড়ো অসংগত শুনিতে হয়। গদ্যে যেমন ছন্দের সংযম নাই তেমনি ভাবের সংযম অত্যাবশ্যক- নতুবা তাহার কোনো বন্ধন থাকে না, সমস্ত অশোভনভাবে আলুলায়িত হইয়া যায়। গদ্যে যদি হৃদয়ভােব প্রকাশ করিতেই হয় তবে তাহা পরিমিত, সংযত এবং দৃঢ় হওয়া আবশ্যক। সমালোচ্য গ্রন্থের আরম্ভ দেখিয়াই ভয় হয়। “আর পারি না! সংসারের উত্তপ্ত মরুভূমিতে শান্তির পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইয়া আর ঘুরিতে পারি না। প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিতেছে। শুষ্কতার উষ্ণ নিশ্বাসে হৃদয়ের সম্ভাব ফল শুকাইয়া যাইতেছে, চারি দিকে কঠোরতা, কেবল কঠোরতাই দেখিতেছি। কিছুতেই তৃপ্তি হইতেছে না। জীবনটা অত্যন্ত নীরস বোধ হইতেছে। যেন কী হৃদয়হীন সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িতেছি, যেন ভালো করিয়া, বুক ভরিয়া নিশ্বাস ফেলিতে পারিতেছি না। কী যে ভার বুকের উপর চাপিয়া ধরিতেছে, বুঝিতে পারিতেছি না।... আর ভালো লাগে না ছাই সংসার!” যদি সুন্দর করিয়া প্ৰকাশ করিতে না পারা যায়। তবে সাহিত্যে হৃদয়ের ভাব প্রকাশের কোনো অর্থ নাই। কারণ, হৃদয়ভােব চিরপুরাতন, তাহা নূতন সংবাদও নহে এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালকও নহে। তাহা সহস্রাবার শুনিয়া কাহারও কোনো লাভ নাই। তবে যদি ভাবটিকে অপরাপ নূতন সৌন্দৰ্য দিয়া প্ৰকাশ করিতে পারা যায়। তবেই তাহা মানবের চিরসম্পত্তিস্বরাপ সাহিত্যে স্থান পায়। এইজন্য ছন্দোময় পদ্য হৃদয়ভােব প্রকাশের অধিক উপযোগী। ভাবের সহিত একটি সংগীত যোগ করিয়া তাহার অন্তরের চিরনূতন সৌন্দর্যটি বাহির করিয়া আনে। কিন্তু সাধারণ গদ্যে হৃদয়োচ্ছাস প্রকাশ করিতে গেলে তাহা প্রায়ই নিতান্ত মূল্যহীন প্ৰগলভত হইয়া পড়ে এবং তাহার মধ্যে যদি বা কোনো চিন্তাসাধ্য জ্ঞানের কথা থাকে। তবে তাহাও উচ্ছাসের ফেনরাশির মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া যায়। দ্বারকানাথ মিত্রের জীবনী। শ্ৰীকালীপ্রসন্ন দত্ত। এ গ্ৰন্থখানি লিখিবার ভার যোগ্যতার হন্তে সমৰ্পিত হইলে আমরা সুখী হইতাম। গ্রন্থকার যদি নিজের বক্তৃতা কিঞ্চিৎ ক্ষান্ত রাখিয়া কেবলমাত্র দ্বারকানাথের জীবনীর প্রতি মনোযোগ করিতেন তবে আমরা তাহার নিকট অধিকতর কৃতজ্ঞ হইতাম। আমরা মহৎ ব্যক্তির জীবনচরিত পাঠ করিয়া আনন্দ লাভ করিব। এই আশ্বাসে গ্ৰন্থখানি পড়িতে বসি, কিন্তু মাঝের হইতে সমাজ ও লোকব্যবহার সম্বন্ধে কালীপ্রসন্নবাবুর মতামত শুনিবার জন্য আমাদের কী এমন মাথাব্যথা পড়িয়াছে। তিনি যেন পাঠকসাধারণের একটি জ্যেষ্ঠতাত অভিভাবক- একটি ভালো ছেলেকে দাঁড় করাইয়া ক্রমাগত অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিতেছেন “দেখ দেখি এ ছেলেটি কেমন। আর তোরা এমন লক্ষ্মীছাড়া হলি কেন” আমরা দ্বারকানাথ মিত্ৰকে অন্তরের সহিত ভক্তি করি