পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@ 88s. রবীন্দ্র-রচনাবলী গুলিকে নিজেদের মধ্যে স্বীকার করিয়া লইয়াছি। শারদোৎসব সেই ঋতু-উৎসবেরই নাটকের পালা । নাটকের পাত্ৰগণের মধ্যে এই উৎসবের বাধা কে ? লক্ষেশ্বর— সেই বণিক আপনার স্বার্থ লইয়া, টাকা উপার্জন লইয়া, সকলকে সন্দেহ করিয়া, ভয় করিয়া, ঈর্ষা করিয়া সকলের কাছ হইতে আপনার সমস্ত সম্পদ গোপন করিয়া বেড়াইতেছে। এই উৎসবের পুরোহিত কে ? সেই রাজা যিনি আপনাকে ভুলিয়া সকলের সঙ্গে মিলিতে বাহির হইয়াছেন, লক্ষ্মীর সৌন্দর্যের শতদল পদ্মটিকে যিনি চান । সেই পদ্ম যে চায় সোনাকে সে তুচ্ছ করে ; লোভকে সে বিসর্জন দেয় বলিয়াই লাভ সহজ হইয়া সুন্দর হইয় তাহার হাতে আপনি ধরা দেয় । কিন্তু এই-যে সুন্দরকে খুজিবার কথা বলা হইল সে কী ? সে কোথায় ? সে কি একটা পেলব সামগ্ৰী, একটা সৌখিন পদাৰ্থ ? এই কথারই উত্তরটি এই নাটকের মাঝখানে রহিয়াছে। শারোদৎসবের ছুটির মাঝখানে বসিয়া উপনন্দ তার প্রভূর ঋণ শোধ করিতেছে ; রাজসন্ন্যাসী এই প্রেমঋণ-পরিশোধের, এই অক্লাস্ত আত্মোংসর্গের সৌন্দর্যটি দেখিতে পাইলেন। তার তখনই মনে হইল, শারদোৎসবের মূল অর্থটি এই ঋণশোধের সৌন্দর্য। শরতে এই যে নদী ভরিয়া উঠিল কুলে কূলে, এই-যে খেত ভরিয়া উঠিল শস্তের ভারে, ইহার মধ্যে একটি ভাব আছে, সে এই : প্রকৃতি আপনার ভিতরে যে অমৃতশক্তি পাইয়াছে সেটাকে বাহিরে নানা রূপে নানা রসে শোধ করিয়া দিতেছে । সেই শোধ করাটাই প্রকাশ। প্রকাশ যেখানে সম্পূর্ণ হয় সেইখানেই ভিতরের ঋণ বাহিরে ভালে৷ করিয়া শোধ করা হয় ; সেই শোধের মধ্যেই সৌন্দর্য । দেবতা আপনাকেই কি মানুষের মধ্যে দেন নাই ? সেই দানকে যখন অক্লান্ত তপস্যার অকৃপণ ত্যাগের দ্বারা মানুষ শোধ করিতে থাকে তখনই দেবতা তাহার মধ্য হইতে আপনার দান অর্থাৎ আপনাকে নূতন আকারে ফিরিয়া পান, আর তখনই কি তাহার মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণ হইয়া উঠে না ? সেই প্রকাশ যতই বাধা কাটাইয়া উঠিতে থাকে ততই কি তাহা সুন্দর-তাহ উজ্জল হয় না ? বাধা কোথায় কাটে না ? যেখানে আলস্য, যেখানে বীর্যহীনতা, যেখানে আত্মাবমাননা। যেখানে মানুষ জ্ঞানে প্রেমে কর্মে দেবত হইয়া উঠিতে সর্বপ্রযত্নে প্রয়াস না পায় সেখানে নিজের মধ্যে সে দেবত্বের ঋণ অস্বীকার করে। যেখানে ধনকে সে অঁাকড়িয়া থাকে, স্বার্থকেই চরম আশ্রয় বলিয়া মনে করে, সেখানে দেবতার ঋণকে সে নিজের ভোগে লাগাইয়া একেবারে ফুকিয়া দিতে চায়— তাহাকে যে অমৃত দেওয়া হইয়াছিল, যে অমৃতের উপলব্ধিতে মৃত্যুকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অবজা করিতে পারে, দুঃখকে গলার হার করিয়া