পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাবলী f শয়ন করিয়া সেই বাতায়নের দিকে এক দটিতে দেখিতেছেন, অন্ধকারস্থিত লতাপল্লব ফেরাপ বাহ-বিস্তার করিয়া আলোকের দিকে ধায়, বন্দীর নয়ন সেইরুপ বাতায়নের দিকে রহিয়াছে। বন্দী কি চিন্তা করিতেছেন ? রৌদ্ররেখায় পতঙ্গসমুহের খেলা দেখিতেছেন ? বাতায়নাগত পক্ষিগণ যখন পনরায় পক্ষ বিস্তার করিয়া উড়িয়া যাইতেছে, বন্দীও তাহার সঙ্গে সঙ্গে মানসপক্ষ বিস্তার করিয়া সন্দের জগৎসংসার ও অনন্ত নীল আকাশে পৰ্য্যটন করিতেছেন ? ইন্দ্রনাথ এ সকল চিন্তা করিতেছেন না। তাঁহার হৃদয়ে অন্য চিস্তার উদ্রেক হইতেছে। ইন্দ্রনাথ যোদ্ধা, যোদ্ধার মৃত্যুতে ভয় নাই। কিন্তু তিনি মরিলে অন্যের কি ক্লেশ হইবে, সেই চিন্তায় তিনি অস্থির হইয়াছিলেন। তাঁহার পিতা পণ্যোত্মা নগেন্দ্রনাথ এই বান্ধক্যে একমাত্র পত্রের মৃত্যুবাত্তা শ্রবণ করিলে জীবন ত্যাগ করবেন। নগেন্দ্রনাথের আর কেহই নাই; ভাষা নাই, কন্যা নাই, অন্য পত্র নাই, বদ্ধ একমাত্র পত্রের উপর চাহিয়া জীবনধারণ করিতেছে, সেই পত্রের নিধনবাত্তা শ্রবণ করিলে নগেন্দ্রনাথের গহ শান্য হইবে, বদ্ধ প্রাণত্যাগ করিবেন। আর সেই অজ্ঞান বালিকা, সেই প্রেমবিহৰলা সরলা, সেই সহায়হীনা, সম্পত্তিহীনা, কুটীরবাসিনী সরলা, তাহারই বা কি দশা ঘটিবে ? ইন্দ্রনাথ সপ্তম পণিমার মধ্যে যাইবার প্রতিজ্ঞ। করিয়াছিলেন, সে সপ্তম পণিমা অতীত হইবে, বালিকা আশানেত্রে চাহিয়া চাহিয়া অবশেষে । নয়ন মাদ্রিত করিবে, জীবন অভাবে অপরিসফট পম্পের ন্যায় নীরবে অসময়ে শকাইবে। চিন্তা করিতে করিতে ইন্দ্রনাথের মস্তক ঘুরিতে লাগিল, নয়ন দটিশন্যে হইল, বলিলেন,— ভগবান! তোমার যাহা ইচ্ছা হয় কর, বিধির নিবন্ধে যাহা আছে হউক, আমি আর এ চিন্তাযাতনা সহ্য করিতে পারি না । শত্রদিগের মধ্যে ইন্দ্রনাথকে পীড়ার সময় যত্ন করে এরপে কেহই ছিল না। কারাগারের পাশ্বে প্রহরিগণ নিঃশব্দে খড়্গহন্তে দিবারাত্রি দন্ডায়মান থাকিত। সমস্ত দিনের পর সন্ধ্যার সময় একজন ব্রাহ্মণ নিঃশব্দে আহারীয় দ্রব্য আনয়ন করিয়া দিত, আহার সাঙ্গ হইলে একমাত্র দাসী নিঃশব্দে সেই স্থান পরিকার করিয়া যাইত। ইহা ভিন্ন আর কেহই সেই গহে প্রবেশ করিতে পারিত না। শত্রশিবিরের মধ্যে ইন্দ্রনাথের কেবল একমাত্র বন্ধ ছিল। যে দাসী প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় সেই কারাগহ পরিস্কার করিতে আসিত, সেই ইন্দ্রনাথের দুঃখে যথার্থ দুঃখিনী। প্রত্যহ নীরবে আসিয়া নীরবে প্রস্থান করিত বটে, কিন্তু সেই বীরের দঃখ দেখিয়া অন্তরালে আশ্রমবিন্দ বর্ষণ করিত। নিন্দয় শত্ৰুগণ বন্দীকে অতিশয় কটে রাখিত, শয়নের জন্য ভূমিতে কেবলমাত্র তৃণশয্যা রচনা করিত,—দাসী ইন্দ্রনাথের জন্য আপন বস্ত্র দ্বারা সেই তৃণশয্যা মণ্ডিত করিয়া যাইত। শত্ররা ইন্দ্রনাথকে দিনের মধ্যে কেবল একবার মাত্র অপকৃষ্ট আহার দিত,—দাসী আপনি অনাহারে থাকিয়া ইন্দ্রনাথকে নানাপ্রকার সুপথ্য আনিয়া দিত। শত্রগণ ইন্দ্রনাথের চিকিৎসা করাইত না,—দাসী তাঁহার ক্ষতগুলি জলে ধৌত করিয়া পনরায় পরিকার বসে বধিয়া দিত এবং ঔষধি আনিয়া দিত। সেই কর্ণা-জল-সেচনে ইন্দ্রনাথের ক্ষত আরাম হইতে লাগিল, তিনি দিন দিন আরোগ্য লাভ করিতে লাগিলেন। ইন্দ্রনাথ প্রায় আপন চিন্তায় ব্যস্ত থাকিতেন, তথাপি সময়ে সময়ে দাসীর যত্ন ও মমতা দেখিয়া মন্ধে হইতেন। কারাগাহের অন্ধকারে দাসীকে পল্ট দেখিতে পাইতেন না, কোন কথা কহিতে চাহিলে দাসী ধীরে ধীরে প্রহরীর দিকে অঙ্গুলি নিন্দেশ করিত। ইন্দ্রনাথ আবার নিস্তব্ধ হইয়া আপন চিন্তায় অভিভূতই হইতেন। প্রহরিগণ দাসীর এই সবাভাবিক মমতা দেখিয়া কখন কখন উপহাস করিয়া বলিত,-- এ বিবি, এ হিন্দ কি তোমাকে সাদী করিবে ? এরপে উপহাসে দাসী বিরক্ত হইত না, কখন কখন অতি নম্র ভাবে উত্তর দিত, কখন কখন প্রহরীদিগকে সরাপান করিতে দিত, সতরাং সকল প্রহরীই দাসীর উপর অতিশয় সস্তুষ্ট ছিল। সমস্ত রাত্ৰি দণ্ডায়মান হইয়া চৌকি দিবার সময়ই সেই নব প্রস্ফটিত পন্ধের ন্যায় সন্দেরী দাসীর কথা ভাবিত, নিদ্রার সময়ে সাকী ও সরাপেয়ালার স্বপ্ন দেখিত । অদ্য রজনীতে দাসী রক্ষকদ্বয়কে সরোপান করিতে দিবে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল। রজনী প্রায় এক প্রহর হইয়াছিল, দাসী সারা লইয়া উপস্থিত হইল। দেখিয়া প্রহরিদ্বয়ের মন আহাদে পরিপন্ণ হইল। ক্রমে সরো মস্তকে উঠিতে লাগিল, রজনী দ্বিপ্রহরের মধ্যে প্রহরিদ্ধয় অজ্ঞান も●