অন্যতম পশু হ’য়েও তার পশুত্বকে অতিক্রম করে দেবত্বের দিকে অগ্রসর হয়েছে, সাহিত্য তাদের মধ্যে উচ্চতম;—এক কথায় বলতে গেলে সাহিত্য মানবসভ্যতার মুকুটমণি। সাহিত্য বিভিন্ন জাতির অতীত সংস্কৃতির বাহন এবং ভবিষ্য সংস্কৃতির জনক।
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই সভ্যতার সর্বনিম্নস্তরে শিল্পের পরেই সাহিত্য দেখা দিয়েছে। ছড়া, বচন, গাথা, রূপকথা, ব্রতকথা, মন্ত্র প্রভৃতি আদিযুগের লোকসাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করলে আর একটা সত্য স্পষ্ট হ’য়ে ওঠে, এই সব গ্রাম-প্রাকৃত সাহিত্যের অধিকাংশই নারীর রচনা অর্থাৎ পৃথিবীর সকল দেশে আদিযুগে সাহিত্যের সূত্রপাত এবং ভিত্তি স্থাপন হয়েছে নারীর হাতে। মানব সভ্যতার উষাকালে বর্বরপুরুষ যেদিন বনে বনে শিকার অ’রে বেড়াত, শক্ত এবং হিংস্রজন্তুর আক্রমণভয়ে আত্মরক্ষার উদ্যোগে এবং আহার্য সংগ্রহের চেষ্টায় যে দিন তার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হত, সেদিন গৃহকর্মরতা নারী ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শিশুকে ঘুম পাড়াত, অতীতের বীরত্বগাথা গেয়ে মৃগয়া প্রত্যাগত স্বামীপুত্রের অবসর বিনোদন ক’রত, প্রিয়জনের কল্যাণ এবং অপ্রিয়জনের অকল্যাণকর কামনায় তুকতাক তন্ত্রমন্ত্র এবং তরু-প্রস্তর, দেবতা-অপদেদতার পূজামন্ত্র রচনা করত। বিভিন্ন দেশে পুরুষ নারীর প্রদর্শিত পথে চলে ক্রমে ক্রমে সাহিত্যক্ষেত্রে ভাষায় ও শিল্পনৈপুণ্যে এবং ভাবের গভীরতায় তাকে অতিক্রম করেছে, এ কথা আদৌ অস্বীকার করা যায় না, তবু সেই সঙ্গে এ কথাও স্মরণযোগ্য যে, নারীর দান সাহিত্যক্ষেত্রে উপেক্ষণীয় নয়। আজও অধিকাংশ দেশের লোকসাহিত্য, পৃথিবীর সাহিত্যের শতকরা নব্বই অংশ যার অন্তর্গত, তার রচনাগৌরব অধিকাংশক্ষেত্রেই নারীর প্রাপ্য। অভিজাত, সাহিত্যেও পদলালিত্য, ব্যঞ্জনা, অর্থগৌরব কোনোদিক দিয়েই নারীর রচনা পুরুষের চেয়ে খুব বেশী পিছিয়ে নেই, অতীতেও ছিল না।