পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিলন-রাত্রি অভ্যন্ত আহলাদিত হইয়া উঠিল ; স্বরে বালকের হর্ষ-অধীরতা প্রকাশ করিয়া সে শরৎকুমারকে কহিল, —“তবে চলুন ডাক্তার-দা, রাজকুমারীর নিকট বিদায় নিয়ে আসি ।” রাজা শরৎকুমারের দিকে চাহিয়া বলিলেন,-- “কিন্তু এ সব কথা রাণীকে না বলাই ভাল, তাকে ভাবিত ক’রে ত কোনো লাভ নেই। বুঝলে হে, ডাক্তণর ?” e ডাক্তার মৃদুস্বরে বলিলেন,—“ষে আজ্ঞে ।” বাহিরে আসিয়া উচ্ছ্বাসভরে অনাদি নৃত্য আরম্ভ করিল ডাক্তারের হাতটা ইংরাজের অগ্নকরণে বাহুর মধ্যে পুরিয়া বলিল, -“চলুন শর-দl, এবার রাজকুমারীর কাছে।” হাসির অন্তকরণে অনাদি কখনো কখনো আজকীল ডাক্তারকে শরদাও বলে । রাজার শেষ কথা মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে করিতে শরৎকুমার বলিলেন, “রাত হয়ে পড়েছে, অনাদি, ৮টা বাজে, এখন তার কাছে যাব ? কি ভাববেন তিনি ৮ “কি আবার ভাববেন ? নইলে আর ত সময় নেই। কাল ভোরেই ত আমরা পলাতক, কে জানে, আর ফিরি কি না ? যদি শক্রর একটা গুলীই বুকে এসে লাগে, তা হ’লে আর ত রাণীদিদিকে দেখতে পাব না। চলুন ডাক্তার, সঙ্কোচের এ সময় নয়।” রহস্তচ্ছলে সে এ কথা বলিল, তাহার পর এক রকম টানিয়াই ডাক্তারকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিল। উভয়ে রাজকুমারীর মহলে আসিয়া শুনিলেন, তিনি তখনও বাগান হইতে গৃহে ফিরেন নাই। শরৎকুমারের বুকে কে যেন জোরে একটা ধাক্কা মারিল । প্রেমিকের মনশ্চক্ষু সাধারণতঃ দিব্যদর্শক —অণজও কি তবে তিনি সেই ভণ্ডটার সহিত কথা কহিতেছেন না কি ? তাহার অনুমান মিথ্যা নহে। কিছুদিন যাবৎ সত্তোষের খবর না পাইয়া তথা-কথিত গুরুদেব কুন্দর নিকট আজ তাহার খবর জানিতে আসিয়া রাজকুমারীর দর্শন প্রার্থনা করেন—তাছার প্রার্থনা রাজকুমারী অগ্রাহ করেন নাই । প্রার দুই ঘণ্টা কাল নানারূপ তর্ক যুক্তিতেও রাজকুমারীকে স্বপক্ষে আনিতে না পারিয়া দলপতি অবশেষে ক্ষুদ্রস্বরে বলিলেন, “এত অত্যাচার পীড়ন অহরহ দেখছেন, তবু যখন আপনি পাষণ, তখন আর বেশী কিছু বলা নিষ্ফল । কনফারেন্সের দিনেমু অস্থায় :: যে আপনাকে জাগিয়ে ーヤ 6 ዓ তুলতে পারে নি, এইটেই সব চেয়ে আশ্চৰ্য্য মনে হয় ।” শীতবায়ুতে সহসা হিপ্পোল-কম্পন উঠিল, স্তব্ধ রজনী মুখরিত করিয়া বুক্ষপত্রদল ঝর ঝর করিয়া পড়িতে লাগিল। লতা-মণ্ডপের কাঠের ছাত হইতে টাঙ্গান দোদুল্যমান কেরোসিন ল্যাম্পের আলোট নিব-নিব হইয়া অণবীর জ্বলিয়া উঠিল। জ্যোতিৰ্ম্মী অকম্পিতকণ্ঠে বলিলেন,-“কি কয়ূৰ বলুন, –কিছুতেই আমি মনে করতে পারছিনে যে, গোপন নিরস্ত্র প্রতিশোধের উপরেই আমাদের দেশের মঙ্গল নির্ভর কবৃছে।” দলপতি বলিলেন, “ওটা কি জানেন—যুদ্ধনীতির একটা কৌশল । সম্মুখ-সমরে যখন জয়লাভের সম্ভাবনা নেই, তখন ছদ্মকৌশলই আমাদের অবলম্বন-পথ ।” জ্যোতিৰ্ম্মীর সরলতাপূর্ণ ধৰ্ম্মনীতি এ তত্ত্ব গ্রহণে অসমর্থ হইল ; উত্তেজিত স্বরে বালিকা উত্তরে কহিল,—“আপনি যে কি ক’রে ভাবছেন—এই উপায়ে আমব জয়লাভ করব, এইটেই আশ্চর্য্যের কথা ? না না না— কখনও না, এইরূপ হিংস্র পশুর আচরণে আমাদের জাতীয় মহত্ব বাড়বে না, আমরা বড় হব না, বরঞ্চ উন্নতির চক্রে নেমেই পড়ব ।” দলপতি বিস্ফারিত নয়নের তেজোজ্যোতিঃ জ্যোতিৰ্ম্ময়ীর উপর নিক্ষেপ করিয়া, কহিলেন,— “কার্য্যসাধনের জন্ত মাত্র এখন কিছুক্ষণ আমাদের হীন কাষ করতে হচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যে কি আত্মত্যাগের মহিমা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না ? ত্যাগের এই উজ্জল মহত্ত্বে একদিন এই ছোট আমরাই যে খুব বড় হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহমাত্র নেই। একবার প্রকৃতির দিকে চেয়ে দেখুন দেখি ? ঝড়ঝঞ্জার মূলে শাস্তি, বদ্যার ফলে উর্বরতা আপনি দেখতে পাবেন ।” “কিন্তু প্রকৃতি দেবী নিজের মধ্যে যে প্রেরণার ইঙ্গিতে মঙ্গলের দাবীতে অমঙ্গল ঘটান—অামার মধ্যে ত সে ইঙ্গিত তিনি পাঠাচ্ছেন না ।” “স্বৰ্য্য স্বভাবতই স্বপ্রকাশ, কিন্তু তবুও স্থানভেদে কোথাও তিনি আলোক, কোথাও তিনি ছায়া রচনা করেন । প্রকৃতি দেবীর ইঙ্গিত যে সকলের মনে ব্যক্ত হয় না, এ সত্য ত এক দিন আপনিই স্বীকার করেছেন। অতএব আরও একবার বলছি, রাজকুমারি ! র্যায়। সে ইঙ্গিত বুঝেছেন, তাদের উপরই বিশ্বাসস্থাপন করতে হবে। একলব্য ভক্তিবলেই সিদ্ধিলাত করেছিলেন, তা ত জানেন ।”