পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিলন-রীত্রি পড়িতে পড়িতে হাসির চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল —সে বইখানা বন্ধ করিয়া অঞ্চলে চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল—“রাজা এইটুকু কেন বুঝলেন না যে, পরলোকের অপেক্ষায় আর তাকে থাকতে হবে না, --যে মুহুর্তে রাণী তার অনুতপ্ত হৃদয়ের অশ্র নিবেদন ক’রে দিয়ে স্বামীর পদতলে লুটিয়ে পড়েছেন—সেই মুহূর্বে এই লোকেই রাজার ইচ্ছা পূর্ণ হয়ে গেছে ! সেই পুণ্যমুহূর্বে শাপযুক্ত অহল্যাদেবীরই হার রাণী পাপতাপমুক্ত হয়ে গভীর পবিত্র প্রেমেই স্বামি বনানা করেছেন। আহ, এইটুকু রাজা যদি তখন বুঝতেন ? কেন যে তা বুঝলেন না, অামার এমন দুঃপ ছয় ।” এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সে জানালার ধারে অtসিয়া দাড়াইল । দিনটা সকাল হইতে মঘলা ; --কিছু পুৰ্ব্বে অল্প একটু বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে ; তাহার পর সহসা চন্দ্রকিরণের মত স্নিগ্ধ স্থান আধ ফোটা একটুখানি রৌদ্র জানালার মধ্য দিয়া ঘরখানা একবার চমকিত করিয়া তুলিয়া দুই চারি মিনিটের মধ্যেই আবার মেঘের কোলে লুকাইয়া পড়িল । হাসি উপবে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, তাহার নয়নবৰ্ত্তী ধূসরবর্ণ আকাশখানার উপরে কালো মেঘের ঢেউগুলা একটার পর একটা ভাসিয়া চলিতেছে। টেনিসনের বিযাদভরা কাব্যগাথাই যেন তাছার গাহিতে গাহিতে চলিয়াছিল। সেই অভিনয়-গীতি শুনিতে শুনিতে সে আপন মনে বলিয়া উঠিল— “রাগ ধরে –কিন্তু মায়াও করে। ল্যান্সিলটকে আর্থার ভেবে নিয়েই রাণী প্রথমে তাকে ভালবেসে ছিলেন— “Sir Lancelot went ambassador at first To fetch her, and she watched him from her window, And...she took him for the King So foiled her fancy for him.” রাণীর অন্তীয় অীচরণে হাসি নিজের প্রাণের মধ্যে যখনই তীব্র জালা অনুভব করে, তখনই এই কথাগুলি আওড়াইয়া মনকে মার্জনা-স্নিগ্ধ করিতে চাহে ; কিন্তু তবুও তা ঠিক পারে কই ?

  • ন হয় ল্যান্সিলটকে রাণী রাজাই ভেবেছিলেন —ন হয় ভুল ক’রে তাই ভালইবেসে ফেলেছিলেন তাকে,–কিন্তু এমনি কি ছাই সে ভালবাসা যে, বিশ্বের পরেও সে জন্য স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসী হ’ত্তে হবে ? আমাদের দেশের মেৰে হ’লে কখনই এমনতুর হত না ; আমি নিজের মন থেকেই এটা ঠিক

ጫማ বুঝতে পারি। শরদীকে কি আমি ভালবাসতুম না, ন। এখনো বালিনে ? অ বগু এটা যদিও উপন্যাসের মারাত্মক প্রেম নয়—র্তীকে ন পেয়ে অামার জীবনটা ব্যর্থও হয়ে ধায় নি, আর চিরকুমারী-ব্ৰতও অামি গ্রহণ করি নি ; - তা নাই ছোক, তা'র সঙ্গে বিয়ে হ'লে যে আমি স্বর্থী হতুম –অঙ্গর শুভদৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এই সহজ বন্ধুত্বই যে দাম্পত্য-প্রেমে পরিণত হ’ত, এটা ত বেশ বুঝতে পারি। কিন্তু তবুও ত আমি কৰ্ত্তব্য ভুলতে পারি নি। শরদাকে বিদায় দিতে আমার মনে তখন খুবই কষ্ট হয়েছিল —তবুও ত মায়ের অমত জেনে শরদার ঐকান্তিক প্রার্থনীও গ্রাহ করতে পাৰ্বলুম না ? ভালই হয়েছে,—ভালই করেছি । তখন যদি অত শত না ভেবে লজ্জ-সরম খুইয়ে ইংরাজ মেয়ের মত গো ধ’রে বসতুম যে, শরদাকে ছাড়া আমি অণর কাউকে বিয়ে করব না, ওগো মা-বাবা, শরদীয় সঙ্গেই আমার বিয়ে দাও গে,—ত হ’লে আজ শরদার অবস্থাটাই বা কি রকম দাড়াত ? এমন রাজকন্স-লাভ ত তার অদৃষ্টে ঘটতে না ! ভাগ্যিস—ভাগ্যিস ! কিন্তু শরদ। এখানে থাকলে বোধ হয়, এ কথাটা ঘুরিয়ে আমার উপরেই ফেলতেন !" গৃহটিকটিকিট। এই সময় টিক টিক্‌ করিয়া উঠিল। হাসি বলিল, “ঠিক ঠিক বলেই হ’ল কিনা আমনি ঠিক ! রাজরাণী হই আগে, তখন সে কথা । আমি কিন্তু এখন একশবায় বলব ভাগ্যিস —শরণ। ভাগ্যিস !” শরৎকুমারের সৌভাগ্য ভাবিয়া তাহায় মনঃপ্রাণ আত্মপ্রসাদে ভরিয়া উঠিল । মেঘের চলাচল দেখিতে দেখিতে হাসিতে হাসিতে সে ভাবিল,— “ঔপন্যাসিকরা ব’লে থাকেন, প্রেম নাকি জীবনে একবারই জন্মায়, আর জন্মাবামাত্র সমুদ্রবিছার মত তার শত দাড়া দিয়ে প্রাণটাকে অষ্টেপুষ্ঠে এমন অঁাকড়ে ধরে যে, প্ৰাণ ধায়, তবুও প্রেম যায় না । আমার কিন্তু কথাটা ঠিক মনে লাগে না- আমার মনে হয়, দাম্পত্যপ্রেম সম্বন্ধেই এ কথাটা ঠিক খাটে। স্বীতীনক্ষত্রের জলেই যেমন শুক্তিতে মুক্তার জন্ম— সেইরূপ বিবাছের – শুভদৃষ্টিপাতেই নরনারীর হৃদয়ে শুভ্র অটল প্রেমের প্রতিষ্ঠা । অন্ততঃ আমার ত এইরূপই ধারণা। তার আগে, ঐ মেঘগুলার মতই মানুষের প্রেম—তাঁর জীবনপথে সঙ্গীর খোজে পথস্থার হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শরদ এতদিনে তার মনের মানুষ পেয়েছেন, আর আমি ? অামি সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় আছি " সে গুণ গুণ, করি। গান ধরিল—