পথ

আমি পথ, দূরে দূরে দেশে দেশে ফিরে ফিরে শেষে
দুয়ার বাহিরে থামি এসে
ভিতরেতে গাঁথা চলে নানা সূত্রে রচনার ধারা,
আমি পাই ক্ষণে ক্ষণে তারি ছিন্ন অংশ অর্থহারা,
সেথা হ’তে লেখে মোর ধূলিপটে দীপ-রশ্মি-রেখা
অসম্পূর্ণ লেখা॥


জীবনের সৌধমাঝে কত কক্ষ কত-না মহলা,
তলার উপরে কত তলা।
আজন্ম-বিধবা তা’রি এক প্রান্তে র’য়েছি একাকী,
সবার নিকটে থেকে তবুও অসীম-দূরে থাকি,
লক্ষ্য নহি, উপলক্ষ্য, দেশ নহি আমি যে উদ্দেশ,
মোর নাহি শেষ॥

উৎসব সভায় যেতে যে পায় আহ্বান-পত্রখানি
তাহারে বহন ক’রে আনি।
সে লিপির খণ্ডগুলি মোর বক্ষে উড়ে এসে পড়ে,
ধূলায় করিয়া লুপ্ত তাদের উড়ায়ে দিই ঝড়ে,
আমি মালা গেঁথে চলি শত শত জীর্ণ শতাব্দীর
বহু বিস্মৃতির॥


কেহ যারে নাহি শোনে, সবাই যাহারে বলে, “জানি,”
আমি সেই পুরাতন বাণী।
বণিকের পণ্য-যান, হে তুমি রাজার জয়-রথ,
আমি চলিবার পথ, সেই আমি ভুলিবার পথ,
তীব্র-দুঃখ মহা-দম্ভ, চিহ্ন মুছে গিয়েছে সবাই
কিছু নাই, নাই॥


কভু সুখে, কভু দুঃখে নিয়ে চলি; সুদিন দুর্দ্দিন
নাহি বুঝি আমি উদাসীন।
বার বার কচি ঘাস কোথা হ’তে আসে মোর কোলে,
চ’লে যায়,—সে-ও যায় যে যায় তাহারে দ’লে দ’লে,
বিচিত্রের প্রয়োজনে অবিচিত্র আমি শূন্যময়,
কিছু নাহি রয়॥

বসিতে না চাহে কেহ, কাহারো কিছু না সহে দেরী,
কারো নই, তাই সকলেরি।
বামে মোর শস্য-ক্ষেত্র দক্ষিণে আমার লোকালয়,
প্রাণ সেথা দুই হস্তে বর্ত্তমান আঁকড়িয়া রয়।
আমি সর্ব্ব-বন্ধ-হীন নিত্য চলি তা’রি মধ্যখানে,
ভবিষ্যের পানে॥


তাই আমি চির-রিক্ত কিছু নাহি থাকে মোর পুঁজি,
কিছু নাহি পাই, নাহি খুঁজি।
আমারে ভুলিবে ব’লে যাত্রীদল গান গাহে সুরে,
পারিনে রাখিতে তাহা, সে গান চলিয়া যায় দূরে।
বসন্ত আমার বুকে আসে যবে ধূলায় আকুল,
নাহি দেয় ফুল॥


পৌঁছিয়া ক্ষতির প্রান্তে বিত্তহীন একদিন শেষে
শয্যা পাতে মোর পাশে এসে।
পাস্থের পাথেয় হ’তে খ’সে পড়ে যাহা ভাঙাচোরা,
ধূলিরে বঞ্চনা করি’ কাড়িয়া তুলিয়া লয় ওরা;
আমি রিক্ত, ওরা রিক্ত, মোর পরে নাই প্রীতিলেশ,
মোরে করে দ্বেষ॥

শুধু শিশু বোঝে মোরে, আমারে সে জানে ছুটি ব’লে,
ঘর ছেড়ে আসে তাই চ’লে।
নিষেধ বা অনুমতি মোর মাঝে না দেয় পাহারা,
আবশ্যকে নাহি রচে বিবিধের বস্তুময় কারা,
বিধাতার মতো শিশু লীলা দিয়ে শূন্য দেয় ভ’রে
শিশু বোঝে মোরে॥


বিলুপ্তির ধূলি দিয়ে যাহা খুসি সৃষ্টি করে তাই,
এই আছে এই তাহা নাই।
ভিত্তিহীন ঘর বেঁধে আনন্দে কাটায়ে দেয় বেলা,
মূল্য যার কিছু নাই তাই দিয়ে মূল্যহীন খেলা,
ভাঙা-গড়া দুই নিয়ে নৃত্য তা’র অখণ্ড উল্লাসে,
মোরে ভালোবাসে॥


সান্ ইসিড্রো, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯২৪।