জয়লক্ষ্মী পঞ্চবিংশ পুত্তলিকা

 কহিল হে রাজন, আমি রাজা বিক্রমাদিত্যের এক দিবসের বৃত্তান্ত কহিতেছি শ্রবণ কর।

 এক দরিদ্র ভাট নানাদেশীয় রাজাদিগের স্তুতিপাঠ করিয়া কোন প্রকারে দিনপাত করিত। সময়ে ঐ ভাট নানাদেশে নানা রাজসভা ভ্রমণ করিল, কিন্তু কোন স্থানে কপর্দকও লাভ হইল না। তাহাতে এক নিরাশ হইয়া বাটীতে ফিরিয়া আসিল। গৃহে আসিয়া দেখিল তাহার কন্যা যৌবনবতী এবং বিবাহের যোগ দশাপ্রাপ্ত হইয়াছে, অতএব কি প্রকারে তাহার বিবাহ দিবে এই দুর্ভাবনাই প্রবল হইল। তাহার ভার্য্যা কহিল তুমি অনেক রাজসভা ভ্রমণ করিলে, কি উপার্জন করিয়া আনিয়াছ। স্তুতিপাঠক কহিল আমি অকেন রাজসভা ভ্রমণ করিলাম যথার্থ, রাজারা আমার যথোচিত মর্য্যাদা করিলেন, কিন্তু আমার অদৃষ্টে ধন নাই, এই জন্য কোন স্থানে কিছু প্রাপ্তি হয় নাই। কেবল রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাতে যাওয়া হয় নাই, তাহার নিকটে একবার গমন করিলে, অন্তঃকরণের ক্ষোভ দূর হয়। তাহার বনিতা কহিল তুমি আর কোন স্থানে যাইও না, সন্তুষ্ট হইয়া গৃহে বসিয়া থাক, অদৃষ্টে ধন থাকিলে এইখানেই পাইবে। ভাট বলিল সে কথা প্রকৃত, কিন্তু শুনিয়াছি রাজা বিক্রমাদিত্য অতি দয়ালু, কোন ব্যক্তি তাহার নিকটে উপস্থিত হইলে কখন নিরাশ হইয়া আইসে না।

 ইহা বলিয়া ভাট সিদ্ধিদাতা গণেশ স্মরণ পূর্ব্বক রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় গমন করিল। উপস্থিত হইলে, রাজা তাহাকে প্রণাম করিলেন। ব্রাহ্মণ আশীর্বাদ করিয়া বলিল মহারাজ আমি আপনার নামের সৌরভে এখানে আসিয়াছি, আপনি মর্তলোকে ইন্দ্রাবতার, এবং পরোপকারী, পৃথিবীতে আপনার তুল্য দানশীল মনুষ্য আর নাই। রাজা সভায় হরিশ্চন্দ্র যেপ্রকার দাতা ছিলেন আপনিও সেইরূপ, আপনার যশে তাবৎ জগৎ আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। আমি কালিকার পুত্র, ভাট বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছি, সম্প্রতি আমি আপনার স্থানে যাচ ঞার্থ আসিয়াছি, আপনি আমার মনোবাঞ্ছা সিদ্ধি করুন। আমি তাবৎ পৃথিবী ভ্রমণ করিয়া দেখিলাম, আপনি ভিন্ন আমার আশা পূর্ণ হইবার আর স্থান নাই। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার কি বাসনা প্রকাশ করিয়া বল। ভাট কহিল আমার যেপ্রকার অদৃষ্ট, তাহাতে মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করা ধৃষ্টতামাত্র, কিন্তু মহারাজ যদি আমাকে আশ্বাস দেন তবে সাহস করিয়া প্রকাশ করিতে পারি। রাজা বচনদত্ত হইলেন। তখন ভাট কহিল মহারাজ আমার কন্যা দ্বাদশবর্ষীয়া হইয়াছে, তাহার বিবাহ দিবার সামর্থ্য নাই, এই দায় হইতে আমাকে মুক্ত করুন। রাজা ঈষদ্ধান্য পূর্ব্বক মন্ত্রীকে কহিলেন এ ব্যক্তি যাহা চাহে তাহা দাও। ভাট বলিল মহারাজ আপনার যাহা দিবার বাঞ্ছা হয় তাহ আপন সম্মুখে আনাইয়া দেউন, একালে সংসারে কাহাকেও বিশ্বাস হয় না। এই কথায় রাজা দশ লক্ষ মুদ্রা এবং কয়েক থাল হীরা মতি স্বর্ণ ও রজতালঙ্কার পূর্ণ করিয়া তাহাকে দিলেন। ভাট তাহা পাইয়া মহাসন্তোষে রাজাকে আশীর্বাদ পূর্ব্বক গৃহে আসিল, এবং যে সমস্ত মুদ্রা ও অলঙ্কার আনিল কন্যার বিবাহে সমুদয় ব্যয় করিল, কিছুমাত্র রাখিল না। রাজা ভাটকে এতাবৎ সামগ্রী দিয়া, সে তাহা ব্যয় করে কি না তাহা দেখিবার জন্য, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দুই দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। দূতগণ দেখিল ব্রাহ্মণ বিবাহে সকল অর্থই ব্যয় করিল, তাহার পরে এক দিব- সের আহার সঙ্গতি রহিল না। বার্তাবহেরা রাজাকে আসিয়া এই বার্তা কহিলে, রাজা আর কয়েক লক্ষ মুদ্রা তাহার বাটীতে পাঠাইয়া দিলেন। এবং অত্যন্ত আহলাদিত হইয়া কহিলেন আমার রাজ্যে এমত সাহসিক লােক বাস করে ইহা বড় আহলাদের বিষয়।

 পুত্তলিকা কহিল, হে ভােজরাজ, দেখ রাজা বিক্র- মাদিত্য ভাটকে এত অর্থ দিয়াছিলেন, ভাট তাহা সমস্ত ব্যয় করিলেও রাজা তাহাকে আরো ধনদান করিলেন। যদি তুমি এবম্ভত দান করিতে সমর্থ হও তবে সিংহাসনে উপবেশন কর। নতুবা বৃথা ইচ্ছার অধীন হইও না, তাহাতে কোন লাভ নাই। এই কথা শুনিয়া ভােজরাজ সে দিবস সিংহাসনারােহণ করিলেন না। পরদিবস প্রত্যুষে স্নান পূজা করিয়া তদাররাহণ মানসে সভাতে আসিলে,