বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৩৪

শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে স্বাধীনতার পক্ষে ডঃ শহীদুল্লাহ “শহীদুল্লাহ সম্বর্ধনা গ্রন্থ এবং বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি” ডিসেম্বর, ১৯৪৮

পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন ঢাকা অধিবেশনে মূল সভাপতির অভিভাষণ

৩১-১২-১৯৪৮ইং

সমবেত সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিক বন্ধুগণ,

 দয়াময় খোদাতায়ালার অসংখ্য ধন্যবাদ, আমরা আজ এক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাদেশিক রাজধানীর বুকে মুক্ত আকাশের নীচে মুক্ত-মানুষরূপে সমবেত হতে সক্ষম হয়েছি। জাহাঙ্গীর, শায়েস্তা খান ও ইসলাম খান পূর্ববঙ্গের এলাকাধীন রাজধানী সোনারগাঁও ন্যায়বান বাদশাহ গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের পুণ্য স্মৃতি আজও বুকে ধরে আছে। স্মৃতি আমাদের নিয়ে যায় ঢাকার অদূরবর্তী বিক্রমপুরে সেন রাজাদের শেষ রাজধানীতে, যেখানে একদিন লক্ষণ সেন, কেশব সেন ও মধু সেন রাজত্ব করেছিলেন। দূর স্মৃতি আমাদের টেনে নিয়ে চলে বিক্রমপুরের সন্নিকট রাজা রামপালের স্মৃতিচিহ্ন রামপালে এবং বৌদ্ধ মহাপণ্ডিত শীলভদ্র, কমলশীল ও দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের স্মরণপূত অধুনা-বিস্মৃত জন্মভূমিতে। এই অঞ্চল যেমন বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানের স্মারকলিপি হয়ে আছে, প্রার্থনা করি তেমনই এ যেন নূতন রাষ্ট্রের জাতি বর্ণ ধর্ম্ম নিবির্বশেষে সকল নাগরিকের মিলনভূমি হয়। আমীন!

 পূর্ব বাংলার বিশেষ গৌরব এই যে, এই প্রদেশের প্রাচীন নাম বাঙ্গাল থেকে সমস্ত দেশের নাম হয়েছে বাঙ্গালা বা বাংলা। এই বঙ্গাল নাম পাই আমরা রাজেন্দ্র চোড়ের তিমরুলৈ লিপিতে (১০২৩ খ্রীঃ অব্দে)। বৌদ্ধযুগের কবি ভুসুকু একটি চর্য্যাগীতিতে বলেছেন

“বাজ-ণাব পাড়ী পউঅী খালে বাহিউ।
অদ্বয় বঙ্গাল দেশ লুড়িউ”।

 —বজ্রযানরূপ নৌকায় পাড়ি দিয়ে পদার খালে বাইলাম। অদ্বয়-রূপ বঙ্গাল দেশ লুট করলাম। -এতে বুঝতে পারি যে পদ্মা নদীর পারেই হ’ল বঙ্গাল দেশ। “বাঙাল” আমাদের নিন্দার কথা নয়, এই দেশবাসীর প্রাচীন নাম। শীরাযের অমর কবি হাফিয সোনারগাঁওয়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহকে যে গযল কবিতা উপহার পাঠিয়েছিলেন, তাতে বলেছেন

“শক্কর-শিকন শওন্দ হমা তৃতীয়ানে হিন্দ।
যে কন্দে পারসী কে ব-বঙ্গালা মী রওদ।”

-ভারতের তোতা হবে চিনি খেকো সকলি।
পারসীর মিছর এই যে বাঙ্গালায় চলিছে।

 কেবল হাফিয নন, মিথিলার বিদ্যাপতিও বাংলার এই সুলতানকে প্রশংসা করেছেন- “মহলম যুগপতি চিরজীব জীবথু গ্যাসদীন সুরতান’।

 মালব, কর্ণাট প্রভৃতি দেশের নামের ন্যায় এই বঙ্গাল দেশও সঙ্গীত শাস্ত্রের এক বিশেষ রাগের নামকরণ করেছে। ভুসুক একটি চর্য্যাগীতি এই বঙ্গাল রাগে রচনা করেছেন।

 পূর্ববঙ্গের শ্রেষ্ঠ গৌরব এই যে, এই দেশ থেকেই বাংলা সাহিত্য এবং নাথপন্থের উৎপত্তি হয়েছে। মৎস্যেন্দ্রনাথ যেমন বাংলার আদিম লেখক, তেমনি তিনি নাথপন্থের প্রবর্তক। তাঁর নিবাস ছিল ক্ষীরোদ সাগরের তীরে চন্দ্রদ্বীপে, বর্ত্তমানে সম্ভবতঃ যাকে সনদ্বীপ বলে। ৬৫৭ খ্রীঃ অব্দে তিনি রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে উপস্থিত হন। তাঁর একটি কবিতা তাঁর পরদর্শন থেকে আশ্চর্যচর্য্যাচয়ের টীকায় উদ্ধৃত হয়েছে।

“কহস্তি গুরু, পরমার্থের বাট
কর্ম্মক রঙ্গ সমাধিক পাট।
কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা
কমল মধু পিবিবি ধোকই ন ভমরা।”

অর্থ-কহনে গুরু পরমার্থের বাট।
কর্ম্মের রঙ্গ সমাধির পাট॥
কমল বিকসিল কহিওনা জোংড়াকে (শাযুককে)।
কমল মধু পান করিতে ভুল করে না ভোমরা।

 এর শেষ দুই পদের সঙ্গে তুলনা করুন

“গুণিনি গুণজ্ঞো রমতে নাগুণশীলস্য গুণিনি পরিতোষঃ।
অলিরেতি বনাৎ কমলং নহি ভেকেতৃেকবাসোহপি।”

(হিতোপদেশ)

 মৎস্যেন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কানু পা, কুকুরীপা, ডোম্বী, সরহ, শবরী প্রভৃতি বহু সিদ্ধাচার্য্য চর্য্যাগীতি বা পারমার্থিক গান রচনা করেন। তার কতকগুলি আমরা পেয়েছি। এই গানগুলির একটি বিশেষত্বপদের শেষে ভণিতা। যেমন ধরুন

“সরহ গুণন্তি বর সূন গোহালী কি মো দুঠ বলদে
একেলে জগা নাসিআ রে বিহরহু সুচ্ছন্দে॥”

-সরহ ভণেণ বরং শূন্য গোয়াল, কি মোর দুষ্ট বলদে।
একেলা জগৎ নাশিয়া রে আমি বিহার করি স্বচ্ছন্দে॥

 এই ভণিতার রীতি প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃতে যায়। যেমন জয়দেবের গীতগোবিন্দে। সমস্ত মহাজন পদাবলী চর্য্যাগীতির বৈঞ্চব সংস্করণ। নাথপন্থের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে চর্য্যাগীতির রীতি পঞ্জাব পর্য্যন্ত উত্তর ভারতের পারমার্থিক গানে চলতে তাকে। পঞ্জাব থেকে এই রীতি পারস্যে যায়। পারসী গজল আরবীর অনুকরণে নয়। তা চর্য্যাগীতিরই অনুকরণে। আরবীতে রুসাদী আছে গযল নেই।

 ত্রিপুরার মেহেরকুলের রাজা গোপীচন্দ্র গুরু জালন্ধরী পার নিকট নাথপন্থে দীক্ষিত হয়ে বৈরাগী হয়ে যান। নাথপন্থের সঙ্গে সঙ্গে এই আখ্যান ভারতময় বিভিন্ন ভাষার কবিতার উপজীব্য হয়ে ওঠে। সুদূর হিমালয়ের কাংড়া উপত্যকায় যে গোপীচাঁদের গান প্রচলিত আছে, আমি তার প্রথম চার চরণ উদ্ধৃতি করছি

“চনন চৌকী বো রূপী ঝাড়িয়াঙ রাজা গোপীচন্দ নহাএ।
তা অম্বর ভোলা বো অঘণা চান্দী বর্ণা ঠভী বুন্দ কতেীও আএ।
তা সজে বো বৈঠী মাতা নৈনবন্তী নৈন-ভর ভরী টোএ।
তা ফির উপড়হুঙ হেরে রাজা গোপীচন্দ তা মাতা নৈনবন্তী রোএ।”


-চন্দনের চৌকিতে রূপার ঘড়ায় রাজা গোপীচাঁদ করে।
আকাশ পরিস্কার চাঁদীবর্ণ, ঠাণ্ডা বৃষ্টিবিন্দু কোথা থেকে আসে?
বারান্দায় বসে মা ময়নামতী চোখ ভরে ভরে কাদে।
তখন ফের উপর দিকে চেয়ে দেখে রাজা গোপীচাঁদ,
মা ময়নামতী কাঁদে।

 এই পূর্বাঞ্চলের ভীম, দিব্বোক, ঈসা খান, চাঁদ রায়, কেদার রায় প্রভৃতি বীরেরা সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। পূর্ববঙ্গের সাহসী সন্তানেরা শুধু আজ নয়, প্রাচীন কাল থেকে সমুদ্রযাত্রায় নির্ভীক। এরাই একদিন সুমাত্রা, জাভা, বালিদ্বীপ, কম্বোডিয়া এবং বর্ণিও পর্য্যন্ত সাগরে পাড়ি দিত। মহাকবি কালিদাস নৌ বিদ্যায় দক্ষ বঙ্গবাসীর উল্লেখ করেছেন। কবিকঙ্কণ প্রচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করেই ধনপতি সদাগরের জাহাজের মাঝি-মাল্লাদিগকে পূর্ব্ববঙ্গবাসী বলে বর্ণনা করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এবং পূর্ব্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলার ছাপ রয়েছে। বাংলার উপকথা এখনও সেখানে প্রচলিত আছে। বাংলার রক্ত যে তাদের রক্তের সঙ্গে মেশেনি, তা কে বলতে পারে? জাভার বরবুদুরের স্থাপত্য উত্তর বঙ্গের পাহাড়পুরের মঠের স্থাপত্যের অনুকরণে।

 প্রাচীন রাঢ়, বরেন্দ্র এবং বঙ্গ নিয়েই আমাদের বাঙ্গালা দেশ। রাঢ় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মকে আঁকড়ে ছিল। সেখানে শূর বংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন। এই বংশের আদিশূর বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ আমদানী করে হিন্দুত্বকে বাঁচিয়ে রাখেন। শুর বংশের পর সেন বংশ এই রাঢ় থেকেই রাজত্ব বিস্তার করেন। তাঁরাও গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। বল্লাল সেন কৌলীণ্য প্রথা চালিয়ে আদিশূরের ধারাকেই স্থায়ী করেন। তুর্কিদের বাংলা বিজয়ের সূত্রপাত রাঢ় থেকে হলেও এখানে ইসলাম তেমন বিজয়ী হতে পারিনি। বরেন্দ্র ও বঙ্গ মুসলিম আক্রমণের প্রাক্কালে বৌদ্ধ বা নাথপন্থী ছিল। তারা সনাতন পন্থীদের দ্বারা নির্য্যাতিত হচ্ছিল। এমন সময়ে আসে তুর্কিদের হামলা। তারা এই বিদেশীদের রক্ষাকর্তা মনে ক'রে বোধ হয় সাহায্য করেছিল এবং পরে সাম্যবাদী ইসলাম ধর্মের শীতল ছায়ার আশ্রয় নিয়েছিল। তাই আজ পূর্ব পাকিস্তান হওয়া সম্ভবপর হয়েছে। নাথপন্থীদের একটি ছড়ায় এই যুগের অহিন্দু জনসাধারনের মনের ছাপ রয়েছে-

 “জাজপুর পুরবাদি  সোল সআ ঘর বেদি
বেদি লয় কেবোল দুর্জন
দখিন্যা মাগিতে জাঅ  জার ঘরে নাহি পাঅ
সাঁপ দিয়া পুড়ান ভুবন॥

* * *

বেদ করে উচ্চারণ  বের‌্যাঅ অগ্নি ঘনে ঘন
দেখিয়া সভাই কম্পমান
মনেত পাইআ মন্ম  সভে বোলে রাখ ধম্ম
তোমা বিনে কে করে পরিত্তান

************



ধম্ম হৈল্য জবনরূপি   মাথাএত কাল টুপি
হাথে সোভে ত্রিকচ কামান।
চাপিআ উত্তম হয়   ত্রিভূবনে লাগে ভয়
খোদায় বলিয়া এক নাম॥
নিরঞ্জন নিরাকার   হৈলা ভেন্ত অবতার
মুখেত বলে তদম্বদার।
যতেক দেবতাগণ   সভে হয়্যা একমন
আনন্দেত পরিল ইজার॥
* * *


জতেক দেবতাগণ   হয়্যা সবে একমন
প্রবেশ করিল জাজপুর।
দেউল দেহারা ভাঙ্গে   কাড়্যা ফিড়্যা খায় রঙ্গে
পাখড়া পাখড় বোলে বোল।
ধরিআ ধর্ম্মের পায়   রামঞ্চি পণ্ডিত খায় রঙ্গে
ই বড় বিষম গণ্ডগোল॥”*** (শূন্য পুরাণ)



 পরবর্তীকালে কিছু কিছু হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করলেও পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলমান যে বৌদ্ধ বংশজাত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলার বৌদ্ধ ও নাথ পন্থীদের প্রধান উপাস্য ছিল শূন্যমূর্ত্তি নিরঞ্জন। কানুপা তাঁর দোহায় বলেছেন-

  “লোঅহ গবব সমুঝব্বহই হউ পরমথে পবীন।
  কোড়িহ মঙেঝ এক্কুজই হোই নিরংজন লীন।”

  অর্থাৎ- লোকগর্ব বয়ে বেড়ায় যে আমি পরমার্থে প্রবীণ।
  কোটির মধ্যে একজন যদি নিরঞ্জনে লীন হয়।

 প্রাচীন মুসলমান লেখকেরা কেহই ঈশ্বর বা ভগবান আল্লাহের প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহার করেননি। কিন্তু তাঁরা নিরঞ্জন শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটি বৌদ্ধ উৎপত্তির একটি বলবৎ প্রমাণ। ইসলাম জাত পাত মানে না। মানুষ মাত্রেই আদমের সন্তান এবং সমান। কুরআনের বাণী “ইন্না আকরামাকুম ইন্দাল্লাহি আতক্বাকুম" নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে যে সকলের চেয়ে বেশি ধার্ম্মিক, সেই আল্লাহের নিকট সকলের চেয়ে বেশি সম্মানিত। কাজেই আমরা বংশ দেখি না, আমরা দেখি গুণ। বাংলার মুসলমান যদি গুণে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, তবে আরব, পারস্য, তুকী, হিন্দুস্থান প্রভৃতি পৃথিবীর যে কোন মুসলমানের চেয়ে সে কেন নিকৃষ্ট হবে? কবি হাফিজ কেমন সুন্দর বলেছেন-

  “তাজে শাহী তলবী গওহরে যাতী বু-নামা।
  ওয়ার খোদ আয় তুখ্‌মাএ চম্শীদ ও ফরীর্দু বাশী।”

  অর্থাৎ- রাজার মুকুট চাও যদি নিজ গুণের প্রকাশ কর।
  হও ফরীদুন জমশীদের বা যদি বংশধরও।  স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বাধীন নাগরিকরূপে আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্বশাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্যে আমরা আজাদ পাক-নাগরিক গঠনের উপযুক্ত প্রয়োজনীয় বিষয়ের অনুশীলন চাই। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় সাহিত্য ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকেই পারস্য আরব কর্তৃক বিজিত হয়েছিল, পারস্য আরবের ধর্ম্ম নিয়েছিল, আরবী সাহিত্যের চর্চা করেছিল। কিন্তু তাঁর নিজের সাহিত্য ছাড়েনি। তাই রুদাগী ফিরদৌসী, নিযামী, সাদী, হাফিয, উফি, খাকানী, বুআলী সীনা, গাযালী, খায়্যাম প্রমুখ কবি, ভাবুক সুফী ও দার্শনিক লেখকগণের রচনায় পারস্য সাহিত্য গৌরব-সমুজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের চর্চা আমাদের মধ্যে আজ নূতন নয়। বাংলাদেশ যখন দিল্লীর অধীনতা-নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে গৌড়ে এক স্বাধীন সুলতানত প্রতিষ্ঠা করে, তখন থেকেই বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির দিকে রাজার মনোযোগ পড়ে। ইউসুফ শাহ হোসেন শাহ, নসরত শাহ, ফিরোয শাহ, নিযাম শাহশূর, ছুটী খাঁ, পরাগল খাঁ প্রভৃতি রাজা ও রাজপুরুষগণ বাংলা সাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। হিন্দু কবিরা মুক্তকষ্ঠে তাদের যশ কীর্তন করে গেছেন। কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এক গৌড়েশ্বর। তাঁর প্রশংসায় কবি বলেছেন-

“পঞ্চ গৌড় চাপিয়া গৌড়েশ্বর রাজা।
গৌড়েশ্বর পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা।”

 এই গৌড়েশ্বর খুব সম্ভবতঃ রাজা গণেশ নন; কিন্তু তাঁর পুত্র উত্তরাধিকারী জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ। রাজা গণেশের রাজত্বকাল অল্প এবং অশান্তিপূর্ণ ছিল। আমরা তাঁকে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকরূপে কোথাও দেখি না। অন্যপক্ষ জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ দীর্ঘকাল শান্তিতে রাজত্ব করেন (১৪১৯-১৪৩১ খ্রীঃ)। তিনি ভরত মল্লিককে নানা উপহাসহ বৃহস্পতি ও রায়মুকুট এই দুই উপাধি দিয়েছিলন। কৃত্তিবাস স্বধর্ম্মত্যাগী বলে বোধ হয় এই গৌড়েশ্বরের নাম উল্লেখ করেননি।

কবীন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান আলীউদ্দীন হোসেন শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“কলিযুগ অবতার গুণের আধার
পৃথিবী ভরিয়া যাঁর যশের বিস্তার।
সুলতান আলাউদ্দিন প্রভু গৌড়েশ্বর
এ তিন ভুবনে যাঁর যশের প্রসার।”

শ্রীকর নন্দী নসরত শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“নসরত শাহ নামে তথি অধিরাজ
রাম সম প্রজা পালে করে রাজ-কাজ।”

কবি শেখর এই নসরত শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“কবি শেখর ভণ অপরূপ রূপ দেখি
রায় নসরত শাহ ভজলি কমলমুখী”।

(মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান হিন্দু অপেক্ষা কম নয়।)

 পল্লীগীতিকায় মুসলমানের দান অতি মহৎ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসাহায্যে জ্যেষ্ঠ সহোদরকল্প। পরলোকগত দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ও উৎসাহে যে গাথাগুলি সংগৃহীত হয়েছে, তা ছাড়া আরও বহু পল্লীকবিতা পূর্ব্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ব্ববঙ্গের সরকার কি এদিকে মনোযোগ দিবেন? এইে পল্লীকাব্য সম্বন্ধে দীনেশবাবু বলেছেন, “এই বিরাট সাহিত্যের সূচনা আমি যেদিন পাইয়াছিলাম, সেদিন আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। আমি সেদিন দেশ-মাতৃকার মোহিনীমূর্ত্তি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলাম, আমাদের বাংলা ভাষার শক্তি ও প্রসার দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম এবং হিন্দু ও মুসলমানের যে যুগলরূপ দেখিয়াছিলামতাহাতে চক্ষু জুড়াইয়া গিয়াছিল।” এ পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫টি পল্লীগাথা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ২৩টি মুসলমান কবির রচিত।

 গত ব্রিটিশ যুগের ও বর্ত্তমানের সাহিত্য সাধনার কথা সকলের সুবিদিত। সুতরাং এখানে বলা নিম্প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন আছে আদিকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমানের সাহিত্য সাধনার বিস্তৃত ইতিহাস লেখা এবং প্রাচীন মুসলিম লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশ করা। আমাদের সাহিত্যিক বন্ধুরা কি এ দিকে অবহিত এবং অগ্রসর হবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সরকারের অবশ্য কর্ত্তব্য পূর্ববাংলার সকল স্থান থেকে পুঁথি, পল্লীগীতি, পল্লীকাব্য ও উপকথা সংগ্রহ করে রক্ষা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিবিভাগকে আর সমৃদ্ধ করতে হবে। মোটকথা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ব্ববঙ্গের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়রূপে দেখতে চাই, সরকারী নওকরখানারূপে নয়। এখানে আমি অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি “নুরনামার” লেখক নোয়াখালির সন্দ্বীপ নিবাসী আবদুল হাকিমের একটি কথা আমাদের দেশের একশ্রেণীর লোককে শুনিয়ে রাখছি-

“যে সবে বঙ্গেতে জনি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সবার কিবা রীতি নির্ণয় না জানি॥
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেতে বসতি।
দেশীভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
দেশীভাষা বিদ্যা যার মনে না জুরায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে না যায়।

 যেমন আমরা বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এক মিশ্রিত জাতি, আমাদের ভাষা বাংলাও তেমনি এক মিশ্রিত ভাষা। বাংলার উৎপত্তি গৌড় অপভ্রংশ থেকে। সংস্কৃতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা অতিদূরের। তবুও যেমন কেউ বড় মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আবিস্কার বা উদ্ভাবন করেন আত্মগৌরবের জন্য, তা তিনি মেসো মশায়ের খুড়তুত বোনের মামাশ্বশুরের পিসতুত ভাই হোন না কেন, সেই রকমই আমরা বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের কুটুম্বিতা পাতাই। কথাটা কিছু অতিরঞ্জিত হ’ল বটে। বিশেষ করে সংস্কৃতের ঋণ বাংলা ভাষার আপাদমস্তক এমন ভারাক্রান্ত করেছে যে, সম্পর্কটা স্বীকার না করেই অনেকে পারেন না। ভাষাতত্ত্বামোদীদের জন্য একটা উদাহরণ দেই- “তোমরা ঐ গাছটা দেখ”। এর গৌড় অপভ্রংশ হবে “তুমহেলোআ ওহি গচ্ছং দেকখহ”; এর সংস্কৃত হচ্ছে “যুয়ং অমুং বৃক্ষং পশ্যত।” যুয়ং- তোমার, অমুং- ঐ, বৃক্ষং- গাছ, পশ্যত- দেখ, -বাংলার কোন শব্দই সংস্কৃত থেকে আসেনি। তবে বাংলার গোড়ায় যে আর্যভাষা, তা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।

 সেই আর্য্যভাষার সঙ্গে মিশেছে আদি যুগে কোল, মধ্যযুগে পারসী ও পারসীর ভিতর দিয়ে কিছু আরবী ও যৎসামান্য তুর্কি এবং পরবর্তী যুগে পর্তুগীজ আর ইংরেজি। দু’চারটা দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয়, ফরাসী, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার শব্দও বাংলায় আছে। মিশ্রভাষা বলে আমাদের কিছু লজ্জা নেই। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা চলতি ভাষা ইংরেজির প্রায় দশ আনা শব্দসমষ্টি বিদেশী। পশ্চিমবঙ্গের পরিভাষা-নির্ম্মাণ-সমিতি খাঁটি সংস্কৃতভাষার পরিভাষা রচনা করেছেন। পাঠ্যপুস্তকে এরূপ খাঁটি আর্যভাষা চলতে পারে; কিন্তু ভাষায় চলে না। বহুদিন পূর্ব্বে রেলওয়ের স্থানে লৌহবর্ত, টেলিগ্রাফের স্থানে তাড়িতবার্ত্তাবহ প্রভৃতি সংস্কৃত প্রতিশব্দ সৃষ্টি করা হয়েছিল; কিন্তু সেগুলি পোরাণিক বিশ্বামিত্রের সৃষ্টির মতই অচল হয়ে গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুমার্গের কোনও স্থান নেই।

 ঘৃণা ঘৃণাকে জন্ম দেয়। গোড়ামি গোড়ামিকে জন্ম দেয়। এক দল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত-ঘেষা করতে চেয়েছে, তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবী-পারসী ঘেষা করতে উদ্যত হয়েছে। এক দল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে ‘বলি দিতে, আর এক দল চাচ্ছে ‘জবে করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া, আর একদিকে কসাইয়ের ছুরি।

 নদীর গতিপথ যেমন নির্দেশ করে দেওয়া যায় না, ভাষারও তেমনি। একমাত্র কালই ভাষার গতি নির্দিষ্ট করে। ভাষার রীতি (Style) ও গতি কোন নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা নিয়মের অধীন হতে পারে না। ফরাসী ভাষার বলে Le style c’est I homme ভাষার রীতি সেটা মানুষ অর্থাৎ মানুষে মানুষে যেমন তফাৎ, প্রত্যেক লোকের রচনাতেও তেমনি তফাৎ থাকা স্বাভাবিক। এই পার্থক্য নির্ভর করে লেখকের শিক্ষাদীক্ষা, বংশ এবং পরিবেষ্টনীর উপর। মোট কথা, ভাষা হওয়া চাই সহজ, সরল এবং ভাষার রীতি (Style) হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত্ত, সুন্দর ও মধুর। এ সাধনার ধন ঘসে-মেজে রূপ আর ধরে-বেঁধে পীরিত যেমন, নিয়ম বেঁধে ভাষার রীতি শেখানও তেমন। অবশ্য প্রয়োজনবোধে (খামখেয়ালিতে নয়) সংস্কৃত, আরবী, পারসী, ইংরেজি, জার্ম্মান, রুশ যে কোন ভাষা থেকে আমাদের শব্দ ধার করতে হবে। কিন্তু আমাদের দুটি কথা স্মরণ রাখা উচিত- ভাষা ভাব প্রকাশের জন্য ভাব গোপনের জন্য নয়; আর সাহিত্যের প্রাণ সৌন্দর্য্য, গোঁড়ামি নয়।

 কিছু দিন থেকে বানান ও অক্ষর সমস্যা দেশে দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্তভাবে এগুলির আলোচনা করা উচিত এবং তার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সমিতি গঠন করা আবশ্যক। যাঁরা পালী, প্রকৃত ও ধ্বনিত্ত্বর সংবাদ রাখেন, তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য যে, বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, সুতরাং তার সংস্কার দরকার। স্বাধীন পূর্ববাংলায় কেউ আরবী হরফে, কেউ বা রোমান অক্ষরে বাংলা লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৫ জন যে নিরক্ষর, তাদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের জন্য কি চেষ্টা হচ্ছে? যদি পূর্ববাংলার বাইরে বাংলা দেশ না থাকত আর যদি গোটা বাংলা দেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকত, তবে এই অক্ষরের প্রশ্নটা এত সঙ্গীন হত না। আমাদের বাংলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও মুসলিম জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা আমরা স্বীকার করি। তার উপায় আরবী হরফ নয়; তার উপায় আরবী ভাষা। আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকন্ত আরবীতে এতগুলি নূতন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যোগ করতে হবে যে বাংলার বাইরে তা যে কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে, তা বোধ হয় না। ফলে যেমন উর্দু ভাষা না জানলে কেউ উর্দু পড়তে পারে না, তেমনই হবে বাংলা।

 বিদেশীর জন্য অক্ষর জ্ঞানের পূর্বে ভাষাজ্ঞান- এমন অদ্ভুত কল্পনা এ বৈজ্ঞানিক যুগে খাটে না। মীম-য়ানুন এই বানান মে, মায়, মিয়ন, মুয়িন, মুয়ন, মীন, মেন, মুয়ন এই রকম বহুরূপেই পড়া যেতে পারে। যদি কোন বৈজ্ঞানিক অক্ষর নিতে হয়, তবে International Phonetic Script ব্যবহার করতে হয়। অক্ষর সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হলে ছাপাখানা, টাইপ-রাইটার, শর্টহ্যাণ্ড এবং টেলিগ্রাফের সুবিধা ও অসুবিধার কথা মনে করতে হবে। বিশেষ করে আজ যখন বাংলাকে প্রাদেশিক রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণেরও সম্ভাবনা রয়েছে, তখন বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও উপযোগিতার কথা চিন্তা করারও প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য Basic English-এর মত এক সোজা বাংলার বিষয় আমাদের বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। যদি ৮৫০টি ইংরেজী কথায় সমস্ত প্রয়োজনীয় ভাব প্রকাশ করতে পারা যায়, তবে বাংলায় তা কেন সম্ভব নয়?

 আমরা পূর্ববাংলার সরকারকে ধন্যবাদ দেই যে তাঁরা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করে বাংলা ভাষার দাবীকে আংশিকরুপে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকারের ও জনসাধারণের এক বিপুল কর্ত্তব্য সম্মুখে রয়েছে। পূর্ববাংলা জনসংখ্যায় গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল, আরব, পারস্য, তুর্কি, প্রভৃতি দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই সোনার বাংলাকে কেবল জানে নয়, ধনে-ধান্যে, জ্ঞানে-গুণে, শিল্প-বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন সভ্য দেশের সমকক্ষ করতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাকে উচ্চ আসন নিতে ও দিতে হবে। তার জন্য শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাগোড়া বাংলা করতে হবে।

 বিট্রিশ আমলে অনুমোদিত ওল্ড স্কীম, নিউ স্কীম ও সাধারণ- এই তিন বিভিন্ন ধারার শিক্ষা-পদ্ধতিকে একই সাধারণ ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে। ধর্ম্মে যেমন আমরা একত্ববাদী, শিক্ষায়ও আমাদিগে একত্ববাদী হতে হবে। এজন্য নানা বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আশু প্রয়োজন হয়েছে। আযাদ পাকিস্তানে আমাদের অবিলম্বে শিক্ষা-তালিকার সংস্কার করতে হবে। এই নূতন তালিকায় রাষ্ট্র-ভাষা উর্দুকে স্থান দিতে হবে। যারা এতদিন রাজ-ভাষারূপে ইংরেজির চর্চা করেছে, তাদের উর্দু শিখতে কি আপত্তি থাকতে পারে? দেশে গণশিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা ও বয়স্কদের শিক্ষার বিস্তার করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা, ধর্ম্ম ও নীতি শিক্ষা এবং সামরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

 আমাদিগে একটি একাডেমী (পরিষদ) গড়তে হবে, যার কর্তব্য হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলীর অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ। এজন্য একটি পরিভাষা-সমিতির প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে আরবী, পারসী এবং উর্দু ভাষা থেকে ইসলাম, ধর্ম্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বইগুলির অনুবাদ একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। মুখে পাকিস্তান জিন্দাবাজ’ বলেই পাকিস্তান জীবিত থাকবে না; তাকে ধর্ম্মে ও জ্ঞানে, চরিত্রে ও দৈহিক শক্তিতে উন্নত করে কৃষি ও শিল্পে, বাণিজ্যে ও রণকৌশলে, সাহিত্যে ও কলায় মহিমাম্বিত ও গৌরবাম্বিত করতে হবে। যে দিন সে দিন হবে, সে দিন আমরা দ্বিধামুক্ত অযুত কষ্ঠে বলতে পারব-

পাকিস্তান জিন্দাবাদ


  * আমরা হিন্দু বা মুসলমান সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গী-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।

  ** ভাষনের শেষ যে অংশটি (তারকা চিহ্নিত) গ্রন্থে প্রকাশিত হয়নি তা এখানে বদরুদিন উমরের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হলো।