বাসন্তিকা/তৃতীয় দৃশ্য

তৃতীয় দৃশ্য

[দৃশ্য-পরিচয়—বাসন্তীনিশা—ফুল্ল লতাকুঞ্জের মাঝে বসন্তরাণী, পুলকের আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে তা’র মুখে—দূর থেকে আনন্দের উচ্ছ্বাসমাখা মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ভেসে আসছে। একে একে গাহিতে গাহিতে দখিন হাওয়া, বকুল, বেলা, চামেলী প্রভৃতির প্রবেশ]

(গান)

দঃ হাঃ— আমি এসেছি দখিন্‌ হাওয়া।
বকুল— আমি দিয়েছি বকুল ছোঁওয়া।
বেলা— আমি এনেছি প্রাণের প্রীতি
গাহিতে বরণ-গীতি।
চামেলী— তোমারই লাগিয়া হারায়েছি সখি,
প্রাণের গোপন দিঠি।
সকলে— সকলে মিলিয়া সাজায়েছি ডালা
প্রীতির সায়রে নাওয়া।

(রাজার প্রবেশ)

রাজা। ঋতুকুঞ্জে আজ কা’র অভ্যর্থনা রাণী?
বাসন্তিকা। ঋতুরাজের।
রাজা। তোমার শুন্‌তে ভুল হোয়েছে, রাণী। আজ নিখিল বাতাসে তোমার অভ্যর্থনা-গীতি ছড়িয়ে পড়েছে, বিহঙ্গের মুখে আজ তোমারই অভ্যর্থনী-কাকলী বেজে উঠেছে, লুব্ধ ভ্রমর পিয়ার বুকের মধু আকণ্ঠ পান কোরতে কোরতে গুঞ্জন-গীতিতে তোমাকেই স্মরণ কোরছে। ধন্যা তুমি রাণী, আর ধন্য আমি তোমায় পেয়ে।
বাসন্তিকা। কিন্তু আমার নিজের ত কোন বৈশিষ্ট্যই নাই। তুমি আমায় সাজিয়েছো যে সাজে, তুমি আমায় চাও যে ভাবে, সেই সাজে, সেই ভাবেই ত এলাম আমি ধরার বুকে, তোমায় ধরা দিতে।
রাজা। রাণী, আমি খেয়ালের বশে আমার ছয় ছয়টি রাণীকে ছ’রকম ভাবে, দৃশ্যে, কল্পনায় সাজিয়েছি, নিত্য-নূতনের আকিঞ্চনে। তা’দের প্রত্যেকের আগমনে ফুটে ওঠে আমারই অবিমৃষ্যকারিতার ফল,—মন আমার বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে তাদের সাহচর্য্যে; কিন্তু তুমি যখন আসো তখন মন আমার কানায় কানায় ভরে ওঠে।
বাসন্তিকা। কেন রাজা? নিত্য-নূতনের প্রলোভন কি তোমায় ভোলাতে পারে না?
রাজা। তা’রা হয়ত আমার নয়নের খেয়াল মেটাতে পারে, কিন্তু বিরাট ধরণীর তা’তে কি যায় আসে? রাজা আমি, তা’দের সুখ, ঐশ্বর্য্য, উন্নতিই আমার কাম্য।
বাসন্তিকা। কিন্তু এ ত তা’দের দোষ নয় রাজা।
রাজা। না রাণী, তাইত এই অবিমৃষ্যকারিতার গ্লানি আমার সারা জীবন ছেয়ে আছে। কিন্তু তুমি যখন আসো আমার সে গ্লানি অতর্কিতে চলে যায়, ধরার মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে, লতায় পাতায় সবুজের হিল্লোল, আমার মনের কানায় কানায় সবুজ, সবুজ, কেবল সবুজ, আর তারই মাঝে বসে আছো তুমি, তুমি সবুজসুন্দরী।
বাসন্তিকা। এই রং, এই গন্ধ, এই গান, যখন তোমার এত পছন্দ, তখন কেন তুমি তোমার ছয় রাণীকেই এই একই রংয়ে, গন্ধে, গানে, সাজিয়ে নাও না?
রাজা। দুঃখ যে আমার সে ক্ষমতা নেই বাসন্তিকা। দেবরাজ সৃষ্টির পূর্ব্বে আমায় বর দিয়েছিলেন যে আমার ছয় রাণীকে যে মূর্ত্তিতে সাজাবো, পৃথিবীর বুকে তা’রই ছাপ পর্য্যায়ক্রমে যা’বে আসবে। আমি আমার ছয় রাণীকে ছয়টি বিভিন্ন রূপে সাজিয়েছিলাম, তাই ধরার বুকে ছয়টি ঋতু বিরাজ কোরছে।
বাসন্তিকা। আবার নূতনভাবে সাজিয়ে নেবার বর কি দেবরাজ তোমায় দেন নি?
রাজা। না, প্রলয়ের পূর্ব্বে, ধরার নববিকাশের পূর্ব্বে, সে ক্ষমতা আমি ফিরে পাবো না। এক একবার ভাবি, প্রলয়ের পর, ধ্বংসের বুকে, আমার ছয় রাণীকে তোমারই সাজে সাজাবো—তোমার রূপ যা’তে শাশ্বত হোয়ে ওঠে আমার চোখে। আবার মনে হয়, না, না, না, এই ভালো, নইলে তোমায় পাবার আগ্রহ আর আমার থাকবে না, তোমার মধুর সঙ্গের দুর্ব্বার লোভ লুপ্ত হ’বে।
বাসন্তিকা। তা’তে ক্ষতি কি রাজা?
রাজা। জীবন মৃত্যুব ব্যবধান কোথায় থাকবে দেবী?
বাসন্তিকা। বিচ্ছেদের আশঙ্কাও তেমনই লুপ্ত হ’বে।
রাজা। বিচ্ছেদ কত মধুর তা’ কি তুমি জানো না রাণী? মিলনকে পূর্ণ কোরে তোলাই তার সার্থকতা। দিবা-লোকে প্রদীপের যেমন কোন প্রয়োজন নাই অফুরন্ত মাঝে পাওয়ার মাঝে মিলনেরও তেমনই কোন সার্থকতা নাই।

(গান গাহিতে গাহিতে ঋতুদূতের প্রবেশ)

(গান)

ধরার বুকে আগুন জ্বেলে বিদায় নেবে ফাগুন হাওয়া।
চুকিয়ে দিয়ে ঋণের বোঝা অসীমপানে ভেসে যাওয়া।
ফুলের বুকে ফুরায় মধু,
কোথায় এখন ভ্রমর-বঁধু?
চাঁদের আলোয় ঘুমিয়ে আছে তাহার সকল পাওয়া।
বিশ্বকে সই নিঃস্ব কোরে আজ্‌কে বিদায় চাওয়া।

[ঋতুদূতের প্রস্থান


বাসন্তিকা। ঐ আমারও বিদায়ের ডাক এসেছে। বিদায়ের পূর্ব্বক্ষণে, বিচ্ছেদের যে মাধুরী তোমার ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে, সেই আশ্বাসবাণীই আমার একমাত্র পাথেয়।

 [হঠাৎ ঋতুকুঞ্জ তপ্ত হাওয়ায় ঝল্‌সে’ গেলো—নিদাঘের সূচনায় সহচর-সহচরী পরিবৃতা বাসন্তিকার বিদায়—ঋতুরাজের মুখ আবার নৈরাশ্যে ভরে গেলো।]

যবনিকা