আটাশ

 ১৯৪০ সালে রামগড়ে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন হয়। বাংলায় কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচন ব্যবস্থার পরিচালনা লইয়া কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির সহিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির মতান্তর হয়। মূল কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি বাংলায় নির্বাচন কার্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিশেষ সমিতি (Ad-hoc Committee) গঠনের আদেশ দেন। বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটির তৎকালীন সভাপতি শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসু কংগ্রেস কমিটির এই আদেশ গণতন্ত্রবিরোধী বলিয়া ঘোষণা করেন। সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বে বাংলার এক বিপুল জনসভা একযোগ এই অভিমত ব্যক্ত করে যে, কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী দল বামপন্থীদিগকে কংগ্রেস হইতে বিতাড়িত করিবার জন্যই এই কাণ্ড করিতেছে। বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটির পরিচালকগণ এই মর্মে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন যে, ‘মূল কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতি বাংলার উপর এক বিশেষ সমিতি চাপাইয়া দিয়াছেন। তাহাদের এই কার্য্য কংগ্রেসের আভ্যন্তরিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বংসকর।’ উক্ত প্রস্তাবে ইহাও বলা হয় যে “বর্ত্তমান বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটি নিয়মানুগভাবে গঠিত হইয়াছে। সুতরাং উহা কার্য করিতে থাকিবে এবং ইহার পরিচালনাধীন কংগ্রেস কমিটিগুলি বিশেষ (Ad-hoc) কমিটির সহিত কোনরূপ সহযোগিতা করিতে পারিবে না।”

 কাজেই, ভারতের রাজনৈতিক জীবনের এক মহাসন্ধিক্ষণে বল্লভ-রাজেন্দ্র-শাসিত কংগ্রেসের সহিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বিরোধ অপরিহার্য হইয়া উঠিল। পুণা চুক্তির সময় ও সুভাষচন্দ্রের দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্ব্বাচনের সময় হইতেই এই বিরোধ ঘনীভূত হইতে থাকে। এবার কংগ্রেসের সহিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিল। ১৯৪০ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ্চ মাসে ওয়ার্কিং কমিটির পাটনা অধিবেশনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ও তাহার কার্যকরী সমিতিকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়। বাংলার অধিকাংশ কংগ্রেসকর্মী ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন—তাঁহারাই প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি পরিচালনা করিতেন। এখন তাঁহাদিগকে বিতাড়িত করিয়া যে দল সংখ্যায় অল্প তাহাদের উপরেই প্রাদেশিক কংগ্রেসের পরিচালনাভার অর্পিত হইল। এই স্বেচ্ছাচারিতা ও অবিবেচনার ফলে বাংলার কংগ্রেস আন্দোলন শক্তিহীন হইয়া পড়ে।

 ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকা জেলার মালিকান্দা গ্রামে গান্ধী সেবা-সঙ্ঘের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে মহাত্মা গান্ধী বাংলায় আগমন করেন। বহুদিন পরে মহাত্মা গান্ধী বাংলায় আসিলেও সেবার জনসাধারণের মধ্যে তাঁহাকে দেখিবার জন্য ও মহাত্মার বাণী শুনিবার জন্য তেমন আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা যায় নাই। বাংলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্রের প্রতি ওয়ার্কিং কমিটির অবিচারের ফলেই বাংলাদেশ গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃবর্গের প্রতি পূর্ব্বেকার মত অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে বিরত হইয়াছে, মহাত্মা তাহা নিজচক্ষেই দেখিয়া গেলেন।

 ইতিমধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের সংগ্রামশীল কর্মপন্থা দিকে দিকে দেশের যুবশক্তিকে আকর্ষণ করিতে থাকে। ফরওয়ার্ড ব্লক ক্রমেই শক্তিশালী হইয়া উঠে এবং ভারতের সর্বত্র শাখা-প্রশাখা বিস্তার করিয়া তাহারা কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত করিতে সক্ষম হয়। সুভাষচন্দ্রের আন্তরিকতা ও কর্মোদ্যম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী ও সর্বোপরি তাঁহার চৌম্বক ব্যক্তিত্ব সকল বামপন্থী কংগ্রেস কর্মীদিগকেই ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতি আকৃষ্ট করিতে সমর্থ হয়। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী বহু বিশিষ্ট সভ্য ও ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগদান করে। সুভাষচন্দ্র ভারতের সর্বত্র এই নূতন দলের নীতি ও কার্যক্রম ব্যাখ্যা করিয়া বক্তৃতা করেন ও সর্বত্রই জনসাধারণের মধ্য হইতে অদ্ভুত সাড়া পান। এই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত ‘Glimpses of My Tour’ নাম দিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই সময় ফরওয়ার্ড ব্লকের লক্ষ্য ছিল প্রধানতঃ তিনটি (ক) Left-consolidation (বাম পক্ষের সংহতি); (খ) Establishment of real and effective unity within the Congress (কংগ্রেসেরে মধ্যে প্রকৃত ও কার্য্যকরী ঐক্য প্রতিষ্ঠা); (গ) Resumption of National struggle in the name of the Congress (কংগ্রেসের নামে জাতীয় আন্দোলন পুনরায় আরম্ভ করা)। দক্ষিণ পক্ষের প্রবল বিরোধিতাসত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র এই উদ্দেশ্য গুলিকে কার্য্যে পরিণত করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। অপরদিকে কংগ্রেস হাই কমাণ্ড ও গান্ধীপন্থী নেতারা সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারকার্য চালাইতে থাকে। সমগ্র জাতীয় মহাসভার শক্তি ও প্রভাব তাঁহার বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়। জাতীয় কংগ্রেস হইতে তিনি ত অপসৃত হইয়াছেনই তাহা ছাড়া জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত শক্তি ও প্রভাব জনসাধারণের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের প্রভাব খর্ব করিবার উদ্দেশ্যে উদ্যত ও প্রযুক্ত হইল। অনেক স্থানে কংগ্রেসের চারি আনা সদস্যদের ও সুভাষচন্দ্রের সভা ও বক্তৃতাদিতে উপস্থিত থাকিতে নিষেধ করা হয়। পণ্ডিত জওহরলাল নেহ্‌রু যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেস কমিটিগুলির উপর হুকুমনামা জারী করেন, “to dissociate themselves from any tours or visits of leaders who undertake them independently of official Congress sanction.”

 পূর্বেই বলিয়াছি ইউরোপের যুদ্ধ সুরু হইতে না হইতেই কংগ্রেস সর্তাধীনে যুদ্ধ সমর্থন করিবার ইঙ্গিত দিতে থাকে; ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ব্যাপারে কিছু সুবিধালাভের পরিবর্ত্তে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ব্যবস্থায় সাহায্যদানের কথা উঠিতে থাকে। কংগ্রেস নেতৃবর্গ বোমাবিধ্বস্ত ইংলণ্ডবাসীর প্রতি সহানুভূতিতে গদ্‌গদ হইয়া উঠেন। মহাত্মা গান্ধী ত বিনাসর্ত্তে সাহায্য করিতেও প্রস্তুত। তিনি একবাক্যে ঘোষণা করিলেন—My sympathies are wholly with the allies. পণ্ডিত নেহেরুও ইউরোপীয়-মার্কা তথাকথিত ‘Progress ও Democracy’র ধুয়া তুলিয়া গান্ধীজীর পক্ষ সমর্থন করিলেন। কারণ, তাঁহার বিবেচনায় ভারতবর্ষের এমন কিছু করা উচিত নয় ‘which might alienate the progressive forces of the world.’ কংগ্রেসের ‘Policy of Non-embarrassment’ অব্যাহতভাবে চলিতে থাকে। বিগত মহাযুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য দানের চরম পুরষ্কার জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের রক্তরঞ্জিত স্মৃতি মানসপট হইতে মুছিয়া না গেলেও মহাত্মা বৃটেনের এই দুর্দ্দিনের সুযোগ লইবেন না। “If the British Government will not ‘suo motu’ declare India free country, having the right to determine her own status and constitution, I am of the opinion that we should wait till the heat of the battle in the allied countries subsides and the future is clearer than it is. We do not seek our independence out of Britain's ruin.”

 গান্ধীজী ইহাও বলিলেন এই সময়ে যদি কোন আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হয় তবে তিনি তাহা নিজের জীবন দিয়া প্রতিরােধ করিতেও পশ্চাৎপদ হইবেন না। চতুর বৃটিশ রাজনীতিকেরা কংগ্রেস নেতৃত্বের এই নিস্ক্রিয়তার সুযােগে ভারতের উপর যুদ্ধের দক্ষিণা চাপাইয়া দিলেন— অর্ডিন্যান্সের পর অর্ডিন্যান্স জারি করিয়া জনসাধারণের মৌলিক অধিকার গুলিও একে একে হরণ করিয়া লইলেন; বড়লাটের সহিত নিষ্ফল আলােচনায় ও ক্রিপস্ প্রস্তাবের মহড়া দেখাইয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন এবং ভারতের জনবল ও ধনসম্পদকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে লাগিলেন।

 কংগ্রেসের বাহির হইতে সুভাষচন্দ্র দাবী করিলেন, কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের এই ব্যাপারে অধিকতর সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় প্রদান করা উচিত। ভারতবর্ষের পক্ষে বড়লাটের যুদ্ধ ঘােষণাকে বাধাদানের জন্য জাতীয় কংগ্রেসের পরিচালনায় অবিলম্বে দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভ ও আন্দোলন আরম্ভ করা উচিত। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে লিপ্ত গ্রেট বৃটেনের সহিত কোন প্রকার সহযোগিতা করার তিনি ঘাের বিরােধী। যাহারা মাঞ্চুরিয়া ও আবিসিনিয়ায় নাৎসী আক্রমণকে প্রশ্রয় দিয়াছে, স্পেন ও চেকোশ্লোভাকিয়া গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে তাহাদের মুখে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতির গালভরা কপট বুলি শুনিয়াই সংগ্রামভীরু কংগ্রেস কর্ত্তৃপক্ষ বৃটিশের ভুয়া অশ্বাস বাণীতে আস্থা স্থাপন করিয়া যে কি মহাসর্ব্বনাশ ডাকিয়া আনিতেছেন সুভাষচন্দ্র বারংবার সে সম্বন্ধে দেশবাসীকে সতর্ক করিয়া দিলেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান করিলেন। বিপ্লবী নেতার সংগ্রামের আহ্বানে দেশ বিরাটভাবে সাড়া দেয়। দেশের জাগ্রত যুবশক্তি ও বিপ্লবিগণ—কিষাণ, মজুর ও ছাত্রদল আপোষহীন সংগ্রামের পতাকাতলে সমবেত হইতে থাকে। পেশোয়ার হইতে আসাম পর্যন্ত, দক্ষিণে কুমারিকা পর্যন্ত ফরওয়ার্ড ব্লকের সংগঠন ছড়াইয়া পড়ে। ইতিমধ্যে রামগড়ে কংগ্রেসের ৫৩তম অধিবেশন আসিয়া পড়িয়াছিল।

 এবার কংগ্রেসের সংগে সংগে রামগড়ে বামপন্থী নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে একটি আপোষ বিরোধী সম্মেলনের অনুষ্ঠান হয়। মহাত্মা প্রমুখ কংগ্রেসের বর্ত্তমান পরিচালকগণ জাতীয় মহাসভার পূর্ণ আদর্শ ক্ষুণ্ণ করিয়া ব্রিটিশ সরকারের সহিত আপোষ করিতে উদ্‌গ্রীব বলিয়া তাহার বিরুদ্ধে মনোভাব জ্ঞাপনের জন্যই এই স্বতন্ত্র সম্মেলনের ব্যবস্থা হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র সমগ্র দেশের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে একাকী দণ্ডায়মান হইয়া যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়াছেন তাহা ভারতের ইতিহাসে অদ্বিতীয়। সুভাষচন্দ্রের সমর্থক দলের সংখ্যা যে কংগ্রেসের বর্ত্তমান নেতৃবর্গের সমর্থকগণের তুলনায় কম নহে রামগড় কংগ্রেসে তাহা প্রমাণিত হয়। কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশন অপেক্ষা আপোষ-বিরোধী সম্মেলনেই অধিক জনসমাবেশ হইয়াছিল। দলে দলে বিহার ও বাংলার কৃষক ও মজুরেরা রামগড় যাইয়া এই আপোষ-বিরোধী সম্মেলনে যোগদান করে। ত্রিবর্ণ-রঞ্জিত কংগ্রেস পতাকা ও রক্তপতাকা উড্ডীন করিয়া সম্মেলনের সভাপতি সুভাষচন্দ্র নিম্নোক্ত অভিভাষণ প্রদান করেন—

 ‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সমর্থকগণ যুক্তি দেখাইয়া থাকেন যে কংগ্রেসই সর্ব্বাপেক্ষা বৃহত্তম আপোষ বিরোধী প্রতিষ্ঠান। পাটনায় কংগ্রেসওয়ার্কিং কমিঠির সর্ব্বশেষ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব কংগ্রেসের আপােষ বিরােধী মনােভাবের নজির হিসাবে তুলিয়া ধরা হয়। কিন্তু পাটনা প্রস্তাব ও বিশেষ করিয়া উহার শেষাংশ পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে উহাতে এমন কতকগুলি ছিদ্র আছে যাহা ঐ প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্যই নষ্ট করিয়া দিয়াছে। উপরন্তু, পাটনা প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সংগে সংগেই গান্ধীজী এক বিবৃতি দিয়া জানাইয়াছেন যে, আপােষ মীমাংসার জন্য ভবিষ্যৎ আলােচনার পথ রুদ্ধ হয় নাই। যুদ্ধ বাঁধিবার পরই গান্ধীজী কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সহিত পরামর্শ না করিয়াই সিমলায় বড়লাটের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান এবং যুদ্ধ পরিচালনায় তিনি বিনাসর্ত্তে গ্রেটবৃটেনকে সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দেন। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া মাত্রই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি আমাদের পূর্ণ স্বরাজের দাবীকে পাশ কাটাইয়া চলিতে আরম্ভ করেন ও তৎপরিবর্ত্তে কৃত্রিম গণ পরিষদের জিগির তুলিয়াছেন। দক্ষিণপন্থী বড় বড় নেতারা এমনকি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণও গণ পরিষদের যথার্থ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিস্মৃত হইয়া পৃথক নির্বাচন ও বর্ত্তমান আইনসভার সংকীর্ণ ভােটাধিকারের ভিত্তিতেই গণপরিষদ গঠনের স্বপ্ন দেখিতেছেন। কংগ্রেস মন্ত্রিমণ্ডলীর পদত্যাগের পরও কতিপয় কংগ্রেসী মন্ত্রী মন্ত্রীত্বের মসনদে পুনরােপবেশন করিতে অতিমাত্রায় ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। সমস্ত দেশ আজ ওয়ার্কিং কমিটির নিকট হইতে সুস্পষ্ট ঘােষণা চাহিতেছে এই মর্মে যে সাম্রাজ্যেবাদের সহিত সকলরকম আপােষ আলােচনার পথ চিরতরে রুদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটি এইরূপ ঘােষণা করিবেন কী? করিলে তাহা কবে করিবেন?

 বৃটিশ গভর্ণমেণ্টও কংগ্রেসের উপর কোন গুরুত্ব আরােপ করিতেছেন না। তাহারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে যে কংগ্রেসীরা যতই আস্ফালন করুক কেন কার্য্যতঃ তাহারা সংগ্রামে অবতীর্ণ হইবে না। গত ছয়মাস যাবৎ আমরা কেবল কথার জাল বুনিয়াছি ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে সেই এক বহু বিঘোষিত উত্তরই পাইয়া আসিতেছি যে, হিন্দু মুসলমানে ঐক্য সংস্থাপিত না হইলে পূর্ণ স্বরাজের কথা উঠিতেই পারে না।

 যে বিপদ আমাদের দ্বারদেশে উপস্থিত ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাহা অভিনব হইলেও জগতের ইতিহাসে ইহা কিছু নূতন নয়। যুগ পরিবর্ত্তনকালে এই রকম সংকটজনক পরিস্থিতি প্রায়ই দেখা দেয়। যে যুগ অতীত হইতে চলিয়াছে তাহার উপর আমরা যবনিকা টানিয়া দিতেছি এবং অপরদিকে আমরা এক নূতন যুগের তোরণদ্বারে উপস্থিত হইয়াছি। আজ সাম্রাজ্যবাদের অন্তিমকাল উপস্থিত হইয়াছে এবং স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যুগ আমাদিগের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছে। আজ ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ উপস্থিত। যে পুরুষানুক্রম ও অতীত ঐতিহ্য সারা পৃথিবীর জন্য অপেক্ষা করিতেছে আমাদিগকে তাহার যোগ্য উত্তরাধিকারী হইতে হইবে।

 পুরাতন কাঠামো যখন নিজের ভারেই ভাঙ্গিয়া পড়ে এবং পুরাতনের ধ্বংসস্তুপ হইতে নূতনের আবির্ভাব সূচিত হয় তখন মানুষের সংস্কারদুষ্ট মন যে বিহ্বল হইয়া পড়িবে ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই; কিন্তু, এই অনিশ্চয়তার মুহূর্ত্তে আমরা যেন আমাদের নিজেদের প্রতি, দেশবাসীর প্রতি ও সমগ্র মানব সমাজের প্রতি বিশ্বাস হারাইয়া না ফেলি। আত্মবিশ্বাস লুপ্ত হইলে আমাদের বিপদ গুরুতর হইবে।

 এই বিপজ্জনক অবস্থায় জাতির নেতৃত্বের চরম পরীক্ষা হয়। বর্ত্তমান অবস্থায় আমাদের নেতৃত্ব পরীক্ষিত হইয়াছে এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ এই নেতৃত্ব ব্যর্থ ও অভাবগ্রস্ত প্রতিপন্ন হইয়াছে। এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান ও পর্য্যালোচনা করিলে আমরা ইতিহাসের শিক্ষালাভ করিতে পারিব এবং ভবিষ্যৎ প্রচেষ্টা ও সাফল্যের সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন করিতে পারিব।

 এখানে অপ্রাসঙ্গিক হইলেও অন্যান্য দেশ ও জাতির জীবনের এবম্বিধ সংকটময় অবস্থার সহিত আমাদের অবস্থার তুলনামূলক বিচার করিতে চাই। ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রুশ বিপ্লবের যখন সূত্রপাত হয় তখন কাহারও মনেই কোন পরিষ্কার ধারণা ছিল না, কি ভাবে এই বিপ্লবকে সন্তোষজনক পরিণতির দিকে পরিচালিত করিতে হইবে। বলশেভিকদের অনেকেই অন্যান্য দলের সহিত কোয়ালিশন করার কথা ভাবিতেছিল। কিন্তু লেনিন কোয়ালিশনের সুখস্বপ্নকে বিচূর্ণ করিয়া দিয়া ধ্বনি তুলিলেন—‘সমস্ত ক্ষমতা সােভিয়েটের হস্তে অর্পিবে।’ সমস্ত রুশজাতি যখন সন্দেহ ও সংশয়ে দুলিতেছিল, সেই সময়ে লেনিনের এই সময়ােচিত নেতৃত্ব না হইলে রাশিয়ার ইতিহাসে কোন্ পরিবর্ত্তন দেখা দিত কে জানে? লেনিনের দ্রষ্টাসুলভ ও নির্ভুল অন্তর্দৃষ্টি রাশিয়াকে দারুণ বিপদের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছে নতুবা এই সে দিন স্পেনের যে শােচনীয় অবস্থা হইয়াছিল রাশিয়ার অবস্থাও হইত তদ্রূপ।

 এখন আমি আর একটি বিরুদ্ধ ঘটনার উল্লেখ করিব। ১৯২২ সালে ইটালীর অবস্থা সমাজতন্ত্রবাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা অনুকুল ও আশাপ্রদ ছিল। অভাব ছিল কেবল লেনিনের ন্যায় একজন বিচক্ষণ নেতার। ইটালীর এই যুগসন্ধিক্ষণে উপযুক্ত নেতার আবির্ভার হইল না, ফলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই সুযােগ হাতছাড়া হইয়া গেল। ফ্যাসিষ্ট নেতা বেনিটো মুসােলিনী এই সুযােগ গ্রহণ করিলেন। তাঁহার রোম অভিযান ও রাষ্ট্রশক্তি করায়ত্ত করার ফলে ইটালীর ইতিহাসে এক অপ্রত্যাশিত সম্পূর্ণ নূতন পরিবর্ত্তন ঘটিয়া গেল। সমাজতন্ত্রের পরিবর্ত্তে ফ্যাসিষ্টতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হইল। ইতালীর নেতাদের মনে সংশয় ও সন্দেহ ঢুকিয়াছিল বলিয়াই তাঁহারা অকৃত-কার্য্য হইলেন; অপরপক্ষে, মুসােলিনীর এমন একটি প্রধান গুণ ছিল যাহা তাঁহাকে ত রক্ষা করিলই অধিকন্তু তাঁহার কণ্ঠে জয়মাল্য পরাইয়া দিল। তাঁহার মনে দ্বিধা ও সংশয় ছিল না। ইহাই নেতৃত্বের প্রধান উপাদান।

 আজ আমাদের নেতারা সন্দিগ্ধচিত্ত। ঐক্য ও শৃঙ্খলার সহজ বুলি শোনা যায় কিন্তু ইহাদের সহিত বাস্তবের কোন সম্পর্ক নাই। এইরূপ মোহকর বুলির কুহকে পড়িয়া তাঁহারা ভুলিতে বসিয়াছেন যে, বর্ত্তমান সময়ের বৃহত্তম প্রয়োজন হইতেছে জাতীয় সংগ্রামকে জয়যুক্ত করিতে সক্ষম এমন একটি বলিষ্ঠ ও আপোষহীন কর্মপন্থা। যাহাই আমাদিগের উদ্দেশ্যকে কার্য্যে পরিণত করিয়া তুলিতে সাহায্য করিবে তাহাকেই আমরা সাদরে গ্রহণ করিব এবং যাহা এই উদ্দেশ্যের পরিপন্থী তাহাকে নিঃসংশয়ে বর্জ্জন করিব। ঐক্য প্রতিষ্ঠার যে আকুতি দক্ষিণ পন্থীদের সহিত আমাদের সমন্বয়সাধনের প্রয়াসী তাহাকে কোনক্রমেই কল্যাণকর বলিতে পারি না। যদি সর্ব অবস্থায় ঐক্য সংস্থাপনই একমাত্র লক্ষ্য হয় তবে আমরা কংগ্রেসকে বরং নরমপন্থীদের সহিত ঐক্যবদ্ধ হইতে পরামর্শ দিতে পারি।

 এই সংকটসময়ে বামপন্থী মতবাদের চরম পরীক্ষা হইবে। যাঁহারা এই পরীক্ষায় অভাবগ্রস্থ বলিয়া প্রমাণিত হইবেন তাঁহারা কপট বামপন্থীরূপে পরিগণিত হইবেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের সভ্যদিগকে তাঁহাদের কার্য্য ও চিন্তাধারার মধ্য দিয়া ইহাই প্রমাণিত করিতে হইবে যে তাঁহারা বস্তুতঃই অগ্রগামী ও গতিশীল। এমনও হইতে পারে, আমরা আজ যে অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়াছি তাহাতে আজিকার দিনে যাহারা দক্ষিণপন্থী বলিয়া পরিচিত তাঁহারাই যথার্থ বামপন্থী বলিয়া প্রমাণিত হইবেন। বামপন্থী বলিতে কার্য্যক্ষেত্রে যাহারা বামপন্থী আমি তাহাদিগকেই বুঝিয়া থাকি।

 আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বর্ত্তমান পর্য্যায়কে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পর্য্যায় বলিতে পারি। এই পর্য্যায়ে আমাদের প্রধান কর্ত্তব্য সাম্রাজ্যবাদের বিলোপসাধন করা ও ভারতীয় জনগণের জন্য পূর্ণস্বাধীনতা অর্জ্জন করা। স্বাধীনতা অর্জ্জিত হইলে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজ আরম্ভ হইবে—সেই যুগকে আমরা বলিব সমাজতন্ত্রের যুগ। আমাদের আন্দোলনের বর্ত্তমান ক্রমে যাঁহারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষ হীন সংগ্রাম চালাইবেন তাঁহারাই বামপন্থী বলিয়া অভিহিত হইবেন। পক্ষান্তরে যাঁহারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে সন্দেহ ও সংশয়ের প্রশ্রয় দিবেন এবং উহার সহিত আপোষ মীমাংসার চেষ্টা করিবেন তাঁহারা কখনই বামপন্থী নহেন। আমাদের আন্দোলনের পরবর্ত্তী ক্রমে বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রবাদ একার্থবোধক হইবে। সাম্রাজ্যবাদের সহিত সংঘর্ষে বামপন্থীরা যদি বলিষ্ঠ ও আপোষহীন নীতি অনুসরণ করিয়া চলিতে পারেন তবে তাঁহারাই ভবিষ্যৎ ভারতের ইতিহাস রচনা করিবেন।

 যাঁহারা এখনও আপোষের কথা ভাবিতেছেন তাঁহাদের নিকট আয়রল্যাণ্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাস এবং ইঙ্গ-আইরিশ চুক্তির পরিনামফল বিশেষ শিক্ষাপ্রদ হইবে। এদেশে যদি সাম্রাজ্যবাদের সহিত কোনরূপ আপোষ সংঘটিত হয় তাহা হইলে বামপন্থীদের ভবিষ্যতে কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেবাদের সহিত সংগ্রাম করিতে হইবে না, সাম্রাজ্যবাদের নবলব্ধ ভারতীয় মিত্রদের সহিতও সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। আপোষ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন সেক্ষেত্রে দারুণ অন্তর্যুদ্ধে পরিণত হইবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভারতীয় মিত্রদের উদ্দেশ্যে এই সম্মেলন হইতে আমি এই সতর্ক বাণী উচ্চারণ করিতেছি।”