বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/বিংশ প্রবাহ

বিংশ প্রবাহ

 “সীমার নাই? আমার চির-হিতৈষী সীমার নাই? মহাবীর সীমায় ইহজগতে নাই? হায়! যে বীরের পদভরে কারবালা-প্রান্তর কাঁপিয়াছে, যাহার অস্ত্রের তেজে রক্তের স্রোত বহিয়াছে, হোসেন-শির দামেস্কে আসিয়াছে, —সেই বীর নাই? কে তাহার প্রাণহরণ করিল? হায়! নিমকহারাম সৈন্যগণ ষড়যন্ত্র করিয়া সীমারকে বাঁধিয়া দিল, তাহাতেই এই ঘটিল; কাসেদ! বল, কে সীমারকে বধ করিল?”

 কাসেদ জোড়করে বলিতে লাগিল, “বাদশাহ্-নামদার। মহাবীর সীমারকে এক জনে মারে নাই। পঞ্চদশ রথী মিলিয়া বাণাঘাতে সীমারকে মারিয়া ফেলিয়াছে।”

 “সীমারের হস্তে অস্ত্র ছিল না?”

 “তাঁহার হস্তপদ লৌহদণ্ডে বাঁধা ছিল। ঐ বন্ধন-দশায় তীরের আঘাতে তাঁহার শরীরের মাংস, শেষে অস্থি পর্যন্তও জর্জ্জরিত হইয়া খসিতে লাগিল, তবুও মহাবীরের প্রাণ বাহির হয় নাই। শেষে ঈশ্বরের নাম করিয়া মৃত্যু প্রার্থনা করায় সীমারের আত্মা ইহজগৎ হইতে অনন্তধামে চলিয়া গেল।”

 এজিদ মহারোষে বলিলেন, “সেখানে আমার সৈন্যাধ্যক্ষ কেহই ছিল না?”

 “বাদশাহ্-নামদার। সৈন্য বলিতে আর কেইই নাই! তবে পতাকাধারী, ভারবাহী প্রহরী, আর জনকয়েক মাত্র সৈন্য উপস্থিত ছিল।”

 “আর আর সৈন্য?

 “আর আর সৈন্য হানিফার অস্ত্রে মারা গিয়াছে। যাহারা জীবিত ছিল, তাহারা প্রাণভয়ে কে কোথায় পলাইয়াছে, তাহার সন্ধান নাই।”

 “অলীদ?”

 “সৈন্যাধ্যক্ষ মহামতি জীবিত আছেন,— কিন্তু—”

 “কিন্তু কি?”

 “বাদশাহ্-নামদার! সকলি পত্রে লেখা আছে।”

 (মহাক্রোধে) “পত্র শেষে পড়িব। ওত্‌বে অলীদ উপস্থিত থাকিতে সীমার-উদ্ধার হইল না? সে কি কথা?

 “তিনি উপস্থিত ছিলেন, এখনও জীবিতই আছেন, কিন্তু মরিয়া বাঁচিয়া আছেন।”

 “হানিফা মদিনা যাইতে সাহসী হইয়াছে?”

 “বাদশাহ্-নামদার। সে সকল কথা মুখে বলিতে আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইতেছে। পত্রেই বিশেষ লেখা আছে।”

 “না—আমি পত্র খুলিব না। তোমার মুখে সকল কথা শুনিব, বল।”

 “বাদশাহ্-নামদার! অলীদ পরাস্ত হইয়াছেন।”

 “কে পরাস্ত করিল?”

 “মোহাম্মদ হানিফা।”

 “কি প্রকারে?”

 “অলীদ মদিনা-প্রবেশ-পথ বন্ধ করিয়াছিলেন। তাহাতে হানিফার সহিত যুদ্ধ হয়, ক্রমে কয়েক দিন যুদ্ধ-দিবারাত্র যুদ্ধ! শেষ দিন মস্‌হাব কাক্কা বিস্তর অশ্বারোহী সৈন্যসহ উপস্থিত হইলে, দামেস্ক-সৈন্য আর টিঁকিতে পারিল না—রক্তমাখা দেহ লইয়া দলে দলে ভূতলে গড়াইতে লাগিল; অশ্বদাপটেই কত শত জনের প্রাণবিয়োগ হইল। বাদশাহ্-নামদার! এমন যুদ্ধ কখনও দেখি নাই। এমন বীরও কখনও দেখি নাই। অস্ত্রের আঘাত, অশ্বের পদাঘাত সমানেই চলিল। দেখিতে দেখিতে দামেস্ক-সৈন্য তৃণবৎ উড়িয়া গিয়া কোথায় পলাইল, তাহার অন্ত রহিল না। বিপক্ষের সেনাপতি মহাশয়ের শিবির লুটপাট করিয়া মদিনাভিমুখে ‘জয় জয়’ রব করিতে করিতে চলিয়া গেল।”

 “অলীদ কিছুই করিল না?”

 “তিনি আর কি করিবেন? মস্‌হাব কাক্কা তাঁহার অশ্বকে লাথি মারিয়া ফেলিয়া দিল। তাঁহাকে শূন্যে উঠাইয়া এক আছাড়েই তাঁহার প্রাণ বাহির করিবে—মস্‌হব কাক্কার এইরূপ কথা; কেবল হানিফার অনুরোধে অলীদের প্রাণ রক্ষা হইয়াছে। কিন্তু মস্‌হাব কাক্কা ছাড়িবার পাত্র নহেন, এমন সজোরে তিনি অলীদ মহামতিকে ফেলিয়া দিয়াছিলেন যে, অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত অচেতন অবস্থায় পড়িয়া থাকিয়া শেষে তিনি উঠিতে উঠিতে, পড়িতে পড়িতে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছেন।”

 “মস্‌হাব কাক্কা কে?”

 “তিনিই ত মহারথী সীমারকে ধরিয়া লইয়া—”

 “তাহা ত শুনিয়াছি, অলীদ বাঁচিয়া গিয়াও কিছু করিল না?”

 “মহারাজ! তিনি পলায়িত, পরাজিত, আতঙ্কিত, নিদ্রাবশে কাক্কারূপে চকিত—চমকিত। তিনি কি আর তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারেন?”

 “মারওয়ান বোধ হয় অলীদের সাহায্য করিতে পারে নাই?”

 “তিনি আর কি সাহায্য করিবেন? বাদশাহ্-নামদার! মোহাম্মদ হানিফা আমাদের সর্ব্বস্বান্ত করিয়া মদিনায় প্রবেশ করিলেন। এদিকে মহামতি অলীদ দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিলেন—ওদিকে মন্ত্রী মহোদয়ও দামেস্ক হইতে মদিনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। পথিমধ্যে উঁহাদের দেখা হইল। এইক্ষণে তাঁহারা সেই সংযোগস্থানে শিবির নির্ম্মাণ করিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। আমি সেই সংযোেগ-স্থান হইতে মন্ত্রীপ্রবরের পত্র লইয়া আসিয়াছি। তাঁহারা গোপন অনুসন্ধানে জানিতে পারিয়াছেন যে, মোহাম্মদ হানিফা শীই দামেস্ক-নগর আক্রমণ করিবেন।”

 এজিদ রোষে অধীর হইয়া বলিলেন, “তাহারা শুনিতে পারে, তাহারা হারিতে পারে, তাহারা হানিফার নামে কাঁপিতে পারে, তাহারা বিশ্রামও করিতে পারে। কিন্তু দামেস্ক নগরে মানুষের আক্রমণ করিবার কি সাধ্য আছে? এই নগরে শত্রু প্রবেশের কি ক্ষমতা আছে? এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর, পঞ্চবিংশতি লৌহদ্বার, ষষ্টি সেতু, অশীতি পরিখা, পঞ্চ সহস্র গুপ্ত কূপ, এজিদ জীবিত,—ইহাতে হানিফা দূরের কথা; হানিফার পিতা আলী গোর হইতে উঠিয়া আসিলেও এ নগরে প্রবেশ করিতে পারিবেন না। যাও কাসেদ; এখনই যাও—মারওয়ানকে গিয়া বল যে; আমি স্বয়ং যুদ্ধে আসিতেছি। দেখি মদিনা আক্রমণ করিতে পারি কি না? দেখি মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারি কি না? দেখি আমার হস্তে হানিফা বন্দী হয় কি না? দেখি এই তরবারিতেও মস্‌হাব কাক্কার শির ধরায় গড়াগড়ি যায় কি না? যাও; তোমার পত্র তুমি ফিরাইয়া লইয়া যাও,—যাহা বলিবার বলিলাম—মুখে বলিও”

 এজিদ ক্রোধে অধীর হইয়া মারওয়ানের পত্র দূরে নিক্ষেপ করিলেন। কাসেদ পত্র লইয়া ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে চলিয়া গেল।

 এজিদ বিশ্রাম-গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া আদেশ করিলেন, “যত সৈন্য এক্ষণে নগরে উপস্থিত আছে, সমুদয় প্রস্তুত হও—সামান্য প্রহরীমাত্র রাজপুরী রক্ষা করিবে, সৈন্য নামে নগরমধ্যে কেহই থাকিতে পারিবে না, সকলকে আমার সঙ্গে মদিনা আক্রমণে যাইতে হইবে;—হানিফার বধসাধনে যাইতে হইবে, মস্‌হাব কাক্কার মস্তক চূর্ণ করিতে যাইতে হইবে—সীমারের দাদ উদ্ধার করিতে যাইতে হইবে। বাজাও ডঙ্কা, বাজাও ভেরী, আন অশ্ব, আন উষ্ট্র, এখনই যাত্রা করিব।”

 অমাত্যগণ যাঁহারা তথায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা যুদ্ধে বিরত থাকিতে অনেক কথা বলিলেন, কিন্তু কাহারও কথাই এজিদের নিকট স্থান পাইল না, তাঁহার কর্ণে ভাল লাগিল না। পরিশেষে বৃদ্ধ হামান বলিতে লাগিলেন,— এত দিন পরে বৃদ্ধ সচিব নিতান্ত বাধ্য হইয়া স্থিরভাবে বলিতে লাগিলেন:

 “মহারাজ! আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, বয়স-দোষে আমার বুদ্ধিভ্রম জন্মিয়াছে, বিবেচনার দোষ ঘটিয়াছে—ভবিষ্যৎ ফলাফলের চিন্তাতেও অপারগ হইয়াছি— ইহা আমি স্বীকার করি। কিন্তু মহারাজ! এই বৃদ্ধ আপনার পিতার চিরহিতৈষী, আপনার হিতৈষী, দামেস্ক-রাজ্যের হিতৈষী। এই দামেস্ক রাজ্য পূর্ব্বে যাহার করতলগত ছিল, ন্যায়ের অনুরোধে উচিত কথা বলিতে এই বৃদ্ধ কখনই তাঁহার নিকট সঙ্কুচিত হয় নাই। তাহার পর আপনার পিতার রাজত্বকালেও এই বৃদ্ধ সর্ব্বপ্রধান মন্ত্রীর আসন প্রাপ্ত হইয়াও ন্যায্য কথা বলিতে কখনই ত্রুটি করে নাই,—ভীত হয় নাই; মহারাজের রাজত্বসময়েও কর্ত্তব্যকার্য্যে পশ্চাৎপদ হয় নাই। কিন্তু মহারাজ! সে কাল আর এ কাল অনেক ভিন্ন। পূর্ব্বে মন্ত্রণায় বিচার হইত,—তর্কে মীমাংসা হইত।—ভ্রম কাহার না আছে? ভূপতির ভ্রম হইলে তিনি ভ্রম স্বীকার করিতেন। অমাত্যগণের ভ্রম হইলে তাঁহারাও ভ্রম স্বীকার করিতেন। এখন সে কাল নাই, সে মন্ত্রণাও নাই, সে মীমাংসাও নাই,—ন্যায্য হউক, অন্যায্য হউক, ন্যায় হউক, অন্যায় হউক, স্ব স্ব মত প্রবল করিতে সকলেই ব্যস্ত, সকলেই চেষ্টিত। বিশেষতঃ অপরিপক্ক মস্তিষ্কের নিকট আমরা এক প্রকার বাতুল বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছি। মহারাজ! মনে হয়, হাসানের বিষপানের পর এই নির্ব্বোধ বৃদ্ধ কি বলিয়াছিল? সেই প্রকাশ্য দরবারে কে কি বলিয়াছিল? নবীন বয়সে নূতন সিংহাসনে বসিয়া কৃষ্ণকেশ বিকৃত অপরিপক্ক মস্তিষ্কের মন্ত্রণাতেই আপনি মত দিলেন। সেই অদূরদর্শী, ভবিষ্যৎ-জ্ঞানশূন্য মারওয়ানই বেশী আদর পাইল। মনের বিরাগে সারগর্ভ উপদেশ বিবেচনা না করিয়া সেই সম্পূর্ণ ভ্রমময় অসার বাক্যেরই আপনি পোষকতা করিলেন। এ পাগল তুচ্ছ হইল। বালকেই বালকের বুদ্ধির প্রশংসা করে, যুবাই যুবার নিকট আদর পায়। আমি বয়সে মহাপ্রাচীন হইলেও আপনি রাজা,—মাথার মণি। এ যুদ্ধ সম্বন্ধে সেই একদিন আমার মত প্রকাশ করিয়াছি, আর আজ রাজ্যের দুরবস্থা —ভবিষ্যতে বিপদের আশঙ্কা দেখিয়া বলিতে বাধ্য হইতেছি। মহারাজ! বৃদ্ধ মন্ত্রীর অপরাধ মানা হউক। একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি, যে কারণে যুদ্ধ, যে কারণে দামেস্ক-রাজ্যের এই শোচনীয় দশা, সে কারণের পরীক্ষা ত অগ্রেই হইয়াছিল! যে আমার নয়, আমি তাহার কেন হইব—একথা সকলের বুঝা উচিত। এক জিনিষের দুই গ্রাহক হইলে পরস্পরের মধ্যে শত্রুভাব, হিংসাভাব স্বভাবতঃই যে উপস্থিত হয়, ইহা আমি অস্বীকার করি না। যাহার হৃদয় আছে, মনুষত্ব আছে, সে সেদিকে ভ্রমেও লক্ষ্য করে না, তাহাও জানি। যাহার অসহ্য হয়, সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিয়া বসে—করিতেও পারে। কারণ, যৌবনকাল বড়ই ভীষণ কাল। সে কালের অনেক দোষ মার্জ্জনীয়। তবে যে হৃদয়ে শক্তি আছে, যে মনে বল আছে, তাহার কথা স্বতন্ত্র। শত্রুপরিবারের সহিত শত্রুতা কি? তাহার সন্তান-সন্ততি পরিজনের সহিত হিংসা কি? মহারাজ! হোসেনের শির দামেস্কে আসিল কেন? হোসেন-পরিবার দামেস্ক কারাগারে বন্দী কেন? ইহার কি কোন উত্তর আছে? বিধির ঘটনা, অদৃষ্টের লেখা খাইতে কাহারও সাধ্য নাই। মহারাজ! এখনও উপায় আছে— রক্ষার পন্থা আছে। আপনি ক্ষান্ত হউন। রাজ্যবিস্তারে আমার অন্ত নাই, কিন্তু তাহার জন্য সময় ও সুযােগের অপেক্ষা করুন। এখন চতুর্দ্দিকে যে আগুন জ্বলিয়াছে, আপনি তাহা সহজে নির্ব্বাণ করিতে পারিবেন না। প্রকৃতি ন্যায়ের সহায়, অন্যায়ের বৈরী। মন্ত্রীবর মারওয়ান এখন নিজ ভ্রম স্বীকার করিয়া দামেস্করাজ্য রক্ষাহেতু জয়নাল আবেদীনকে কারামুক্ত করিতে মন্ত্রণা দিতেছে। সে সম্বন্ধে মহারাজ যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তাহার সদুত্তর দিব। তবে সামান্য একটু বলিয়া রাখি যে, হানিফার সে জ্বলন্ত রােষাগ্নি সহজে নির্ব্বাণ হইবার নহে। আপনি যে আজ স্বয়ং অগ্রসর হইতেছেন, সেই সম্বন্ধে আমার কয়েকটি কথা আছে। প্রথম, আপনি কোথায় যুদ্ধে যাইতেছেন? যদি বলেন, মদিনা—আমি বলিতেছি, মদিনায় যাইবার আর আপনার ক্ষমতা নাই। সীমার হত, অলীদ পরাস্ত, মারওরান ভয়ে সন্ত্রস্ত; এ অবস্থায় মদিনা আক্রমণ করা দূরে থাকুক-মদিনার প্রান্তঃসীমাতেও প্রবেশ করিতে পারিবেন না। ধন-বল আর বাহুবলই রাজার বল, ক্রমাগত যুদ্ধে ধন-ভাণ্ডার প্রায় শূন্য হইল, আর বাহুবল এখন নাই বলিলেই হয়। সীমারের সহিত সীমারের সৈন্যও গিয়াছে—ওত বে অলীদ সৈন্যসামন্ত হারাইয়া প্রাণে বাঁচিয়া আছেন মাত্র। এখন একমাত্র সম্পূর্ণরূপে জীবিত মারওয়ান। রাজ্যরক্ষার জন্যও সৈন্য়ের প্রয়ােজন। আজ যে আদেশ প্রচারিত হইয়াছে, তাহাতে রাজ্যরক্ষার আর কোন উপায় দেখিতেছি না;—কারণ, শত্রুর নানা পথ—শত্রুর সন্ধান অব্যর্থ। মহারাজ এদিকে যুদ্ধযাত্রা করিবেন, অন্য পথে শত্রু আসিয়া যদি নগর আক্রমণ করে, তখন কে রক্ষা করিবে? সে অস্ত্রসম্মুখে বক্ষঃ পাতিয়া কে দণ্ডায়মান হইবে? আমি মহারাজের গমনে বাধা দিতেছি না। আপনারই রাজ্য, আপনারই সিংহাসন,—আপনিই রক্ষা করিবেন। আমার যাহা বলিবার, বলিলাম—গ্রাহ্য করা না করা মহারাজের ইচ্ছা।”

 এজিদ মন্ত্রীবর হামানের কথা মনঃসংযােগে শুনিলেন, কিন্তু তাঁহার চির-হিংসাপূর্ণ হৃদয়কে স্ববশে আনিতে পারিলেন না। দুর্নিবার ক্রোধ দ্বাদশ প্রকার হিংসার জীবমুর্ত্তি ধারণ করিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়া বসিল। লোহিত লোচনে ক্রোধযুক্ত স্বরে তিনি বলিলেন, “তুমি মাবিয়ার মন্ত্রী—আমার সহিত তোমার কোন মতেই ঐক্য নাই—হইবেও না— —হইতে পারেও না। তুমি অনেক সময় আমাকে মনোকষ্ট দিয়াছ! আমি তোমার মুখ দেখিতেও ইচ্ছা করি না। তুমি দূর হও, আমার সম্মুখ হইতে দূর হও! কে আছ, এই বৃদ্ধ পাগলকে রাজপুরী হইতে বাহির করিয়া কারাগারে আবদ্ধ কর। যাহার কোন জ্ঞান নাই, তাহার উপযুক্ত স্থান মশান বা শ্মশান। যাও বুদ্ধিমান, যাও— তোমার পরিপক্ক মস্তক লইয়া জীবনের অবশিষ্ট অংশ কারাগারে বাস কর। রাজপ্রাসাদে তোমার আর স্থান নাই।”

 আজ্ঞামাত্র প্রহরিগণ বৃদ্ধ সচিবকে লইয়া চলিল। মন্ত্রিবর যাইবার সময়ও বলিলেন, “মহারাজ! রাজ-আজ্ঞা শিরোধার্য্য। আমি এখনও বলিতেছি: আপনি স্বয়ং যুদ্ধে যাইবেন না, মারওয়ানের সংবাদ না লইয়া কখনও নগর পরিত্যাগ করিবেন না।”

 এজিদ মহাক্রোধে বলিলেন, “আমি এখনই যুদ্ধে যাইব। কোথায় —ওমর কোথায়?—হাসেম কোথায়?”

 শশব্যস্তে সৈন্যাধ্যক্ষগণ উপস্থিত হইলেন। পুনরায় এজিদ বলিলেন, “মদিনা-আক্রমণে, হানিফার বধ-সাধনে, আমার সহিত এখনই সসৈন্য়ে যাত্রা করিতে হইবে। প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ-পদে আজ ওমর বরিত হইল, যাও—প্রস্তুত হও, যত সৈন্য নগরে আছে, তাহাদিগকে লইয়া প্রস্তুত হও।”