বাসর।


মিলন-রজনী সেই বিবাহ-বাসরে—
প্রবাহিত সুখস্রোত কি উচ্ছ্বাস ভরে!
জ্যোৎস্না-পুলকিত সেই বিমল যামিনী—
পুলকিত দশদিশি হাসিছে ধরণী।
সুমন্দ মলয় তবে বহিল তখন।
কুসুম সুরভি ল’য়ে করি বিতরণ।
মুখরিয়া দশদিক্‌ কল কণ্ঠ তানে।
শুভগীত গাহে পিক আকুল পরাণে।
সুধাকর ঢালে সুধা যেন শতধারে—
সুধাসিক্ত ধরাতল হেরি সুধাকরে।
রহিলাম তব পাশে হরিষ অন্তর—
হেরি সে ললিত রূপ সুঠাম সুন্দর—
হৃদয়ে বহিল হায় সুখের লহর।
লভিয়া বাঞ্ছিত ধন মনোমত বর।
বসিলাম তব পাশে প্রফুল্লিত মনে।
আনন্দ উচ্ছ্বস যেন উছলে নয়নে।
রক্তবস্ত্রে আবরিয়া রাখিল বদন।
শোভে গায় মণিমুক্তা নানা আভরণ।


গলদেশে ছিল মম কুসুমের হার।
লইয়া পরিলে গলে ওহে প্রাণাধার!
কুসুমের হার সহ মম এ হৃদয়—
উৎসর্গ তোমার করে হল প্রাণময়!
মধুর সে মধুনিশি মধুর মিলন—
হইল যে চির তরে এ চিরবন্ধন!

নাহি জ্ঞান ছিল মনে দাম্পত্য-প্রণয়।
তথাপি হইল হায় প্রাণ-বিনিময়।
নবীন কিশোর তুমি প্রেমে ভরা প্রাণ।
করেছিলে প্রেম ভরে প্রাণ প্রতিদান।

মৃদু মৃদু সুধারাশি অধরে বিকাশি।
অনিমিশে মম প্রতি চেয়েছিলে হাসি।

তৃষিত আকুল নেত্রে উচ্ছ্বাস অন্তরে—
বালিকার সে হৃদয় অধিকার তরে।
কহিলে যে নয়নের নীরব ভাষায়—
প্রতিদান তব প্রাণ করলো আমায়।

আকুল হইল প্রাণ সে সঙ্কেত হেরি,
হৃদয়ে স্থাপিনু হায় মূরতি তোমারি।
আমিও ঈঙ্গিতে তবে দিনু প্রত্যুত্তর—
এ হৃদয় প্রাণ মন লহ প্রাণেশ্বর!


সরলা বালিকা আমি কিছু নাহি জানি।
গোপন চাতুরি ছলা ওহে গুণমণি!
পুলকেতে ভরা প্রাণ হৃদয়ে উচ্ছ্বসি।
পূরিল হৃদয়ে যাহা ছিল অভিলাষ।
কিছু দিন হতে হায় হৃদয়-মন্দিরে।
রেখেছিনু তব মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত ক’রে।
মানস-দর্পণে লয়ে তব প্রতিকৃতি।
নীরবেতে পূজিতাম ওহে প্রাণপতি!
হেরিয়া নিকটে সেই ঈপ্সিত-রতন—
যে মূরতি হৃদয়েতে জাগে অনুক্ষণ।
হইলাম সুখনীরে হায় নিমজ্জিতা।
পাইয়া বাঞ্ছিতনিধি অভীষ্ট-দেবতা!
সে সুখ বাসরসজ্জা আজ জাগে মনে।
সম্মিলিত হইলাম দোঁহে প্রাণে প্রাণে।
কোথা সেই সুখ-দিন গিয়াছে চলিয়া!
আছে সেই স্মৃতি সুধু হৃদয় ব্যাপিয়া।
কি সুখের সে রজনী বিবাহ-বাসর!
পুরবালাগণ সবে হরিষ অন্তর।
জ্বলিতেছে শত বাতি রজত আধারে।
সুশোভিত সেই গৃহ আলোকিত করে।


সুসজ্জিত স্তরে স্তরে কুসুম নিকর—
গন্ধবহ সে সুগন্ধ বহে নিরন্তর।
সুবিস্তৃত চারি দিকে কুসুমের রাশি।
ভ্রমিতেছে রামাগণ সৌন্দর্য্য বিকাশি।

আনন্দেতে সকলের হৃদয় বিভোল।
বহিতেছে ভবনেতে সুখের হিল্লোল।
বসাইয়া বাসরেতে আমা দোঁহাকারে।
কৌতুক করিল কত রামাগণ ঘিরে।

ধর ধর চরণেতে রসিক নাগর!
প্রণয়ের অভিনয় আরম্ভন কর।
মানময়ী বসিবেক মানেতে মজিয়া।
সাধিবেক তুমি তার চরণে ধরিয়া।

শিখাইনু প্রণয়ের এই রীতি নীতি।
এ সুখ বাসরে মোরা মিলনের দৃতী।
রহ এ মিলন সুখে দোঁহে চিরদিন।
প্রস্ফুটিত রবে সদা না হবে মলিন।

রহিয়াছে সুশোভিত নাসায় বেসর।
লও খুলি সাবধানে তারে অতঃপর।
মিলনের শুভ কাজে হ’য়ে প্রতিকূল।
আবরিত রহিয়াছে করহ নির্ম্মূল।


এইরূপে সকলেতে কৌতুক করিয়া।
হাসি হাসি যায় তবে সকলে চলিয়া।
বিগত হইয়া প্রায় আইল যামিনী।
ক্ষীণ আভা দীপ-প্রভা মুদে কুমুদিনী।
চুল ঢুলু করে আঁখি নিশি জাগরণে।
সোহগে ধরিয়া কর কহিলে যতনে—
আনমিত আঁখি তব নিদ্রার পরশে।
করহ শয়ন প্রিয়ে মম বাহুপাশে।
হইতেছে দেখ ওই বিগতা রজনী—
জাগরণে কতক্লেশ পেয়েছ না জানি।
বিশুদ্ধ হইবে তব কমনীয় কায়—
উজ্জ্বলতা নাহি রবে আঁখি তারকায়।
জ্যোতি নাহি রবে জ্যোতি নিশিজাগরণে।
প্রস্ফুটিত পদ্ম সম তোমার বদনে।
সোহাগেতে করি কত প্রীতি সম্ভাষণ।
দ্রবীভূত করিলে যে বালিকার মন।
হেন কালে আইলেন অগ্রজা তথায়—
উজলিয়া চারিদিক রূপের প্রভায়।
আইলেন ধীরে ধীরে মন্থর গমনে।
তুষিলেন তোমারে হে মিষ্ট সম্ভাষণে।


লাজ ভরে তুমি নাথ নত করি শির।
নীরবে রহিলে বসি সৌম্য শান্ত ধীর।

আহা মরি কি সুন্দর কি মোহন রূপ!
কি গাম্ভীর্য্য কি মাধুর্য্য একত্রে সম্ভূত।
কি সৌন্দর্য্য কিবা বীর্য্য দেহ সুগঠিত।
কমনীয়:মনোরম সুরূপ ললিত।

মোহে সুরপুরবাসী রমণী কি ছার।
হেরি নাই হেন রূপ জগৎ মাঝার।
জাগে মনে অনুক্ষণ সে সুখ-বাসর।
রজনীতে দহে হায় অনলে অন্তর।
কোথা সেই সুখ সাধে বাসর সজ্জিত।
কোথা সেই হৃদয়ের ভাব উচ্ছ্বসিত।
কি যাতনা সহি প্রাণে বিহনে তোমার!
কি দারুণ জ্বালা প্রাণে জ্বলে অনিবার।
কি তীব্র বেদনা হয় অনুভব প্রাণে।
হইবে এ জ্বালা শেষ হায় কত দিনে!
কবে হায় পাব পুন মম প্রাণেশ্বর।
গিয়া সে ত্রিদিবধামে অমর নগর।
পুন সে বাসর সজ্জা কবে হবে হায়!
শয়ন করিব যবে জলন্ত চিতায়।


হৃদয়ের এ অনল অনলে মিশিবে।
প্রজ্বলিত সে অনলে এ জ্বালা জুড়াবে
বিষেতে বিষের ক্ষয় হয় চির দিন।
অনলে অনল রাশি হইবে বিলীন।
সুশীতল হইবে এ তাপিত জীবন।
যবে স্থান দিবে মোরে দেব হুতাশন।
অভিসার করিব যে চিতানল মাঝে।
সাজাবে সে ভষ্মরাশি বাসরের সাজে!
মন সুখে যাব আমি নাথের সদন।
হইবে সে চির তরে আবার মিলন।