মিবাররাজ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 দ্বিপ্রহর, সূর্য্য আকাশের মধ্য ভাগে—পাহাড়ের একটি উচ্চ শিখরের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে—সেই শিখরকাশ খানিক দুর লইয়া এত উজ্জ্বল যে তাহার দিকে চাওয়া যায় না, আর সূর্য্যের পরিত্যক্ত পূর্ব্বাকাশ এত নীল যে দ্বিপ্রহরে সেখানে চন্দ্র দেখা যাইতেছে। সেই নীল আকাশচন্দ্রতপের গায়ে এক এক টুকরা শাদা শাদা মেঘ ভাসিতেছে, মেঘের নীচে ছোট ছোট পাখীগুলি বিন্দুর আকার ধরিয়াছে—বুঝি তাহারা চাতক পাখী—মেঘের সঙ্গে আপনাকে মিশাইয়া ফেলিতে যায়।—বড় বড় চীল দুই একটি পাতের মত সমান ভাবে পক্ষ বিস্তার করিয়া পলকহীন নিস্পন্দ গতিতে উড়িতেছে, আর মাঝে মাঝে কর্ক্কশ উচ্চ কণ্ঠে চিহিঁহিঁ করিয়া উঠিতেছে, সে চীৎকারে নিস্তব্ধ পাহাড় ঝাঁঝাঁ করিয়া উঠিতেছে, গাছের মধ্য হইতে কাকগুলা গম্ভীর ভাবে সাড়া দিয়া উঠিতেছে—তাহাদের কলরবে ঘুঘুর অবিশ্রান্ত ঘুঘুরব যেন চকিতের মত ঢাকিয়া পড়িতেছে!

 এই সময় বৃদ্ধ ভীল ঘর্মাক্ত কলেবরে তাহাদের গ্রামের নিকটের একটি নির্দিষ্ট বৃক্ষ তলে আসিয়া স্কন্ধের বোঝা ভূমিতে নামাইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন তখনও সেখানে আর কেহ আসে নাই, তিনি বৃক্ষতলে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। কিছু পরেই দু একজন করিয়া অন্য শিকারীগণও সেখানে জমিতে আরম্ভ হইল। দুই তিন জন পিঠ হইতে কতকগুলা করিয়া পাখীর রাশ নামাইল, একজন দুইটা ছাগল পিঠে লইয়া উপস্থিত,—একজন কতকগুলা ভেড়ার বাচ্ছা আনিয়া ফেলিল,—৪৫ জনে মিলিয়া একটা মহিষ ঘাড়, হইতে নামাইল, একজন একরাশ খরগোশ পাইয়াছে, একজন কিছুই আনিতে পারে নাই—শেষে রিক্ত হস্তে ফিরিয়া আসিবার সময় একটা শৃগাল মারিয়া আনিয়াছে, তাহা দেখিয়া অন্যেরা তাহাকে সাবাস দিয়া মহা হাসির ধূম লাগাইয়াছে,—দুরে পৃষ্ঠ ভারে অবনত ভীল পুত্রকে দেখা গেল, সকলে উৎসুক হইয়া তাহার আগমন অপেক্ষা করিতে লাগিল, —ভীলপুত্র নিকটে আসিয়া বোঝাটা দুম করিয়া মাটিতে ফেলিল, সকলে করতালি দিয়া বলিয়া উঠিল—“আজ তুই জিতিলি রে—।” বোঝাটা আর কিছু নহে, একটা বরাহ। ভীলেদের নিকট বরাহ একটা বড় শীকার, ইহা তাহাদের একটি উপাদেয় খাদ্য। এরূপ শিকার এতক্ষণ আর কেহই আনে নাই, পরে যে আর কেহ আনিবে তাহারে সম্ভাবনা নাই—কেন না প্রায়ই একটার, অধিক বরাহ এক দিনের শিকারে পাওয়া যায় না। সকলেই শিকারীর প্রতি বিশেষ প্রশংসার দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, আজকের দিন যেন তাহার জন্যই প্রভাত হইয়াছিল, ভীলরাজ পুত্রের জয়ে আহ্লাদে নির্ব্বাক হইয়া রহিলেন,—আত্ম-গৌরবে ভীলপুত্রের বুক ফুলিয়া উঠিল—পরিশ্রম ক্লান্তি সে সকল ভুলিয়া গেল—এই সময় আমাদের পূর্ধ্ব পরিচিত যুবক তাহাদের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, তিনি না জানি কি আনেন! আর একবার সকলে কুতূহল হইয়া উঠিল,—ভীলপুত্রের হঠাৎ বুকটা একবার কাঁপিয়া উঠিল, মুহূর্ত্তের মধ্যেই সে ভাব চলিয়া গেল, আশ্বস্ত ভাবে তাহার আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। যুবক নিকটে আসিয়া একটা বড় হরিণকে মাটিতে নামাইলেন। সকলে আহ্লাদে চীৎকার করিয়া উঠিল। বরাহ হইতেও হরিণ দুষ্প্রাপ্য শিকার, কদাচিৎ তাহা পাওয়া যায়। এত দ্রুত বেগে হরিণ দৌড়ে যে তাঁহার প্রতি লক্ষ্য ঠিক রাখিয়া বাণ ছোঁড়া বড় কঠিন কাজ। ভীলরাজ বলিয়া উঠিলেন “সাবাস বেটা সাবাস—” ভীলপুত্রের মুখ মলিন হইয়া গেল—ভীলরাজ তাহাকে কি এ কটা প্রশংসার কথা বলিতে পারিতেন না! আর কিছু না হউক সেত একটা বরাহ শিকার করিয়াছে, বরাহ শিকার করা হরিণ শিকার হইতে এতই কি সহজ! ভীলপুত্র গুম হইয়া রহিল, ভীলরাজ তাহার নিকটে আসিয়া বলিলেন—“বাপুটা তুই ওডার মত অমন শিকারী হইলি নে—ক্যান্ রে!

 তিনি সান্ত্বনাচ্ছলে কথাটা বলিলেন, কিন্তু কি সান্ত্বনা ই দিলেন। ভীমপুত্রের মনে কষ্টের যতটুক বাকী ছিল ঐ কথায় তাহা পুরিয়া গেল।

 অভিপ্রায় ভাল হইলেই সব সময় তাহার ফল ভাল হয় না। পৃথিবী ভ্রান্তিময়,—ভুল বুঝিবার অবকাশ পাইলে সে সত্য বুঝিতে চাহে না, কেন না ভুলই তাহার জীবনের অবলম্বন, ভুল লইয়াই সে বাঁচিয়া আছে—যে মুহূর্ত্তে পৃথিবী হইতে ভুল চলিয়া যাইবে, —সেই মুহূর্ত্তে পৃথিবীর মৃত্যু, পৃথিবীর স্বর্গলাভ হইবে,—তখন আর পৃথিবী পৃথিবী থাকিবে না।