►

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রবাবুর জীবনে এবং কাব্যে এত বিচিত্র ভাবের সমাবেশ আছে যে তাহার নানান মহালায় প্রবেশদ্বারের চাবি সকল সময়ে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

 আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করিয়া বিচিত্রতার স্বাদের জন্য কবির চিত্তে এমন সুগভীর আকাঙ্ক্ষা কী করিয়া জাগিল, তাহা আমার কাছে বিস্ময়কর। আমাদের দেশের সমাজের জীবন নানা কারণে অত্যন্ত ক্ষুদ্র— কৃত্রিম লোকাচারের বন্ধন তো আছেই— কিন্তু ক্ষুদ্রতার আসল কারণ এ দেশে কর্মক্ষেত্র নিতান্ত সংকীর্ণ, সেইটুকুর মধ্যে মানুষের বিচিত্র শক্তিকে ভালো করিয়া ছাড়া দেওয়া যায় না, তাহাতে আমাদের জীবনের লীলা ব্যাঘাত পায় বলিয়া আনন্দের অভাব ঘটে। শুধু তাই নয়। আমাদের হৃদয়ের ভাব বাহিরের ক্ষেত্রে নানা রূপে আপনাকে সৃষ্টি করিতে চায়; সেই সৃষ্টি করিতে গিয়াই সে যথার্থ পরিণতি লাভ করে, সে বল পায়, তাহার বাড়াবাড়ি সমস্ত কাটিয়া যায়, সে আপনার ঠিক ওজনটি রক্ষা করিতে শেখে— এক কথায় সে রীতিমত পাকা হইয়া উঠে। কিন্তু যে সমাজে মানুষের চিত্ত বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করিবার এমন প্রশস্ত স্থান ও বিচিত্র অধিকার না পায়, সে সমাজে ভাবুকতা আপনার পরিমাণ হারাইয়া ফেলে; হয় সে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হইয়া পঙ্গু হইয়া নিতান্ত গ্রাম্য হইয়া থাকে, নয় সে আপনাকে অসংগত— রূপে স্ফীত করিয়া অদ্ভুত প্রমত্ততার মধ্যে ছুটিয়া যায়। যেখানে জীবনের ক্ষেত্র দূরবিস্তৃত সেখানে মানুষের কল্পনা নিয়তই সত্যের সংস্রবে আপনাকে সুবিহিত আকার দান করিতে পারে— যতদূর পর্যন্ত তাহার শক্তির অধিকার ততদূর পর্যন্ত সে ব্যাপ্ত হয় এবং কোন্‌খানে তাহার সীমা তাহাও আবিষ্কার করিতে তাহার বিলম্ব ঘটে না।

 সংগীত, শিল্প, চিত্রকলা, সৌন্দর্য, মানুষের সঙ্গ, ভাবের আলোচনা, শক্তির স্ফূর্তি প্রভৃতি জিনিস বাহির হইতে ক্রমাগত উত্তাপ দিতে থাকিলে আমাদের প্রকৃতি যে শোভায় সৌন্দর্যে একটি আশ্চর্য বিকাশ লাভ করিতে পারে, তাহা আমরা অন্য দেশের অন্য কবিদের জীবনচরিতে দেখিয়াছি। কেবল আমাদেরই দেশে এ-সকলের অভাব যে কত বড় অভাব এবং এই-সকল প্রাণের উপকরণ হইতে বঞ্চিত হইয়া থাকা যে কত বড় শূন্যতা তাহা আমরা ভালো করিয়া অনুভব করিতেও পারি না।

 কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্বের আগুনকে চিরকাল ছাইচাপা দিয়া রাখা যায় না। যখনই সে বাহির হইতে খোঁচা পায় তখনই সে শিখা হইয়া জ্বলিয়া উঠিতে চায়। এই তাহার স্বাভাবিক ধর্ম। আমাদের এই বহুদিনের সুপ্ত দেশ একদিন সহসা বৃহৎ পৃথিবীর আঘাত পাইয়াছে। যে পশ্চিমমহাসমুদ্রতীরে মানুষের মন সচেতন ভাবে কাজ করিতেছে, চিন্তা করিতেছে ও আনন্দ করিতেছে, সেইখানকার মানসহিল্লোল আমাদের নিস্তব্ধ মনের উপর আসিয়া যখন পৌঁছিল তখন সে কি চঞ্চল না হইয়া থাকিতে পারে? আমাদের মনের এই যে প্রথম উদ্বোধনের চঞ্চলতা, ইহা তো নীরব হইয়া থাকিবার নহে। যতদিন সুপ্ত ছিলাম ততদিন আপনার মনের নানা অদ্ভুত স্বপ্ন লইয়া দিব্য রাত কাটিতেছিল, কিন্তু যখন জাগিলাম, যখন শয়নঘরের জানালার ফাঁকের মধ্য দিয়া দেখিলাম জীবনের উদার-বিস্তীর্ণ লীলাভূমিতে মানুষ দিকে দিকে আপনার বিচিত্র শক্তিকে আনন্দে পরিকীর্ণ করিয়া দিয়াছে, তখন স্বপ্নের বন্ধন ও পাথরের দেয়ালে আর তো বাঁধা থাকিতে ইচ্ছা হয় না। তখন বিশ্বের ক্ষেত্রে ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িবার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠে।

 বিশ্বকে, মানুষের জীবনকে নানা দিক দিয়া উপলব্ধি করিবার এই ব্যাকুলতাই কবি রবীন্দ্রনাথের কবিত্বকে উৎসারিত করিয়াছে ইহাই আমাদের বিশ্বাস। আপনার জীবনের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে যে জীবনকে পাওয়া যাইতেছে না অথচ দূর হইতে যাহার পরিচয় পাইতেছি, নিজের অন্তরের ঔৎসুক্যের তীব্র আলোকে তাহা দীপ্যমান হইয়া দেখা দেয়। কবির ব্যাকুল কল্পনার শতধাবিচ্ছুরিত নানাবর্ণময় রশ্মিচ্ছটায় প্রদীপ্ত জগদ্দৃশ্যই আমরা তাঁহার কাব্যের মধ্যে দেখিতে পাই। এক দিক হইতে যে অবস্থাকে প্রতিকূল বলিয়াই মনে করা যাইত, কবিত্বের পক্ষে তাহাও অনুকূল হইয়াছে। কাপড়ের আবরণের মধ্যে খাঁচার পাখির গান আরো বেশি করিয়া স্ফূর্তি পায় তাহা দেখা গিয়াছে; এ ক্ষেত্রেও বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পূর্ণভাবে যোগের অভাবই আমাদের কবির বিশ্ববোধকে এমন অসামান্যভাবে তীব্র করিয়া তাহাকে নানা ছন্দের অশ্রান্ত সংগীতে উৎসারিত করিয়া দিয়াছে।

 আমাদের দেশের অন্তরতম চিত্তে এই বিশ্বের জন্য বিরহবেদনা জাগিয়া উঠিয়াছে। সে অভিসারে বাহির হইতে চায় কিন্তু এখনো সে পথ চেনে নাই— সে নানা দিকে ছুটিতেছে এবং নানা ভুল করিতেছে। অনেক ঠেকিয়া তাহাকে এই কথাটি আবিষ্কার করিতে হইবে যে, নিজের পথ ছাড়া পথ নাই— অন্য পথের গোলকধাঁধায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া শেষকালে নিজের রাজপথটি ধরিতে হয়। কবির কাব্যের মধ্যেও আমরা তাঁহার সেই বিশ্ব–অভিসারযাত্রার ভ্রমণের ইতিহাস দেখিতে পাই। তিনি তাঁহার অনুভূতির আবেগে ছুটিয়া চলিয়াছেন, মনে করিয়াছেন এইবার যাহা চাই তাহা পাইয়াছি, কিন্তু সেই বেগের দ্বারাই তিনি দ্রুতগতিতে তাহার পাওয়ার অঙ্কে গিয়া ঠেকিয়াছেন— তখন আবার তাহা হইতে বাহির হইবার জন্য বেদনা এবং নুতন পথে প্রবেশ। আমরা তাঁহার সমস্ত কাব্যগ্রন্থাবলীতে ইহাই দেখিয়াছি— বিশ্ব-উপলব্ধির জন্য উৎকণ্ঠা এবং বারম্বার তাহার বাধা হইতে মুক্তিলাভের জন্য প্রয়াস।

 এমনি করিয়া ঠেকিতে ঠেকিতে চলিতে চলিতে অবশেষে কবি এক সময়ে ভারতবর্ষের পথ এবং তাহার মধ্য দিয়া আপনার পথটি পাইয়াছেন ইহাই তাঁহার কাব্যের শেষ পরিচয়। সেই বিপুল ধর্মসাধনার পথ বাহিয়া তাঁহার জীবনের ধারা সাগরসংগমে আপনার সংগীত পরিসমাপ্ত করিতে চাহিতেছে।

 কিন্তু ভারতবর্ষের এই পথটি দেশাচারের সংকীর্ণ কৃত্রিম পথ নহে, তাহা সত্য পথ। এইজন্য সকল দেশের সকল সত্যের সঙ্গেই তাহার সামঞ্জস্য আছে। তাহা যদি না হইত তবে কবির কাব্য বিশ্বজনীন সার্থকতার মধ্যে স্থান পাইত না, তাহা সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার মরুভূমির মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া যাইত।

 যাঁহারা সংস্কারগত ভাবে বা পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণের প্রতিক্রিয়াবশতঃ ভারতবর্ষের ধর্মের পথটিকে ধরিবার চেষ্টা করিতেছেন, তাঁহারা ভারতবর্ষকে ভারতবর্ষেরই মধ্যে আবদ্ধ করিয়া দেখিতেছেন। নানা–দেশাগত বিপুল ভাবধারার পরস্পরের সহিত সম্মিলনের বৃহৎ প্রয়াসের মাঝখানে ভারতের ইতিহাসের ভিতরের চিরন্তন অভিপ্রায়ের ধারাটিকে তাঁহারা দেখিতেছেন না। সুতরাং ভারতবর্ষের অতীত তাঁহাদের কাছে চির-অতীত, বর্তমান কেবল দেশাচার ও লোকাচারের জড়সমষ্টি, তাহার কোনো প্রবাহ নাই; এবং ভবিষ্যৎও তাঁহাদের কাছে আকাশকুসুম মাত্র।

 রবীন্দ্রনাথের জীবনী সম্বন্ধে এই একটি কথা মনে রাখিতে হইবে যে, তিনি বরাবর নিজের স্বভাবের অন্তর্নিহিত পথ অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন, সেই তাঁহার স্বভাবের মধ্যেই তাঁহার কবিপ্রকৃতি, তপস্বীপ্রকৃতি, ত্যাগীপ্রকৃতি, ভোগীপ্রকৃতি পরস্পর ঠেলাঠেলি করিতে করিতে ক্রমশই পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য করিয়া লইতেছে। সেই প্রকৃতিটির মধ্যে অনুভূতি যতই তীব্র হউক, ভোগপ্রবৃত্তি যতই প্রবল হউক, তাহারই মধ্যে কোনো বিশেষ একটি দিকে সমস্ত প্রকৃতিকে আবদ্ধ করিবার বিরুদ্ধে ভিতর হইতে বরাবর একটা ঠেলা ছিল। সেইজন্য নদীর বাঁকের মতো ক্রমাগত একটা হইতে অন্যটায়, এক রস হইতে অন্য রসে তাঁহার স্বভাব আপনার সার্থকতাকে খুঁজিয়া বেড়াইয়াছে এবং অবশেষে ধর্মের মধ্যে আপনার সমস্ত দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সামঞ্জস্য লাভ করিয়াছে বলিয়া আপনারই ভিতর হইতে ভারতবর্ষের চিরন্তন সমন্বয়াদর্শকে সে আবিষ্কার করিয়াছে।

 এখানে আমার একটি কৈফিয়ত গোড়াতেই দেওয়া আবশ্যক। অনেকের মনে এ কথা উঠিতে পারে যে, কবির জীবনের ভিতর হইতে তাঁহার কাব্যকে পাঠ করিলে কাব্যের অংশবিশেষের চেয়ে সমগ্রের দিকেই বেশি দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব। জীবনে এক অবস্থা হইতে অন্য অবস্থায় ক্রমাগতই যাইতে হয়, কেবলই ছাড়াইয়া চলাটাই জীবন। সেইজন্য তাহার প্রত্যেক অবস্থার ও অভিজ্ঞতার দিকে অধিকাংশ লোকেরই ভালো করিয়া তাকাইবার অবকাশও থাকে না। অথচ কবিতার মধ্যে জীবনের যে অবস্থাই প্রকাশ পাক-না কেন, কবিতায় তাহার একটি সম্পূর্ণতার ভাব আছে। কবিতার মধ্যে বিচিত্র ও সমগ্র এ দুইয়েরই সমান গৌরব। জীবনে এক সময়ে হয়তো প্রেমের জোয়ার অনির্বচনীয় আবেগে সমস্তকে পূর্ণ করিয়া দেখা দিয়াছে এবং তাহার কাল উত্তীর্ণ হইয়া গেলে ভাঁটার মুখে কোন্ কালে সরিয়া গিয়াছে। কিন্তু কাব্য যদি সেই জোয়ারের পরম মুহূর্তের পরিপূর্ণ সুরটিকে ধরে, তবে তাহা বিশ্বমানবের চিরকালের সুর হইয়া বাজিবেই। যে-কোনো দেশে যে-কোনো কালে যে-কোনো মানুষ তাহাকে উপভোগ করিবে, তাহার মধ্যে সংসারের অবশ্যম্ভাবী দশাবিপর্যয়ের আশঙ্কা কোনো দ্বিধার বাধা জন্মাইয়া দিবে না। ইহার কারণ এই যে, জীবনের পরিণামটাই আমরা বড় করিয়া দেখি, কিন্তু কবিতায় কেবলই পরিণাম দেখিলে চলে না, তাহার কোনো বৈচিত্র্যই অবহেলিত হইবার যোগ্য নহে। কবিতার সঙ্গে জীবনের এক জায়গায় একটা ভেদ আছে।

 কবিতায় যাহাকে দেখায় তাহাকে একেবারে পরিপূর্ণ করিয়া দেখায়— গাছের যেমন শাখা, পল্লব, ফুল ও ফল একটা হইতে অন্যটা অভিব্যক্ত হইলেও প্রত্যেকটিই যখন দেখা দেয় তখন তাহাকেই চরম বলিয়া মনে হয়। দেশকালপাত্রের মধ্যে কিছুকে সংকীর্ণ করিয়া দেখা কবিত্বের দেখা নহে— মানুষের নিত্য অনুভূতির ক্ষেত্রে সব জিনিসকেই তাহার হাজির করিতে হয়। সেই জন্য কাব্য যখন ব্যক্তিগত হয় তখন আমাদের সকলের চেয়ে বেশি খারাপ লাগে। কাব্যে কবি তাঁহার নিজের অনুভূতিকে এমন করিয়া প্রকাশ করিবেন যাহাতে সেটা তাঁহার নিজস্ব কোনো অনুভূতি না হইয়া সকল মানুষের অনুভূতি হইয়া উঠে।

 আমি তো মনে করি কবির কাব্যরচনা ও জীবনরচনা একই রচনার অন্তর্গত, জীবনটাই কাব্যে আপনাকে সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে। সেইজন্য জীবনের ভিতর হইতে কাব্যকে যদি দেখি, অথবা কাব্যের ভিতর হইতে যদি জীবনকে দেখি, তাহাতে কবিতার ব্যক্তিগত দিকটার উপরেই বেশি ঝোঁক দেওয়া হইবে না। কারণ কবিতা জিনিসটাই ব্যক্তিগত নহে, এবং কবির যথার্থ জীবনও তাঁহার আপনার একলার জিনিস নহে। তিনি যেন সচ্ছিদ্র বংশখণ্ডের মতো, অন্য জিনিষে যে ছিদ্র কাজের পক্ষে ব্যাঘাতকর হয়, বংশখণ্ডে সেই ছিদ্রই বিশ্বসংগীত প্রচার করিয়া থাকে।

 সেইজন্য আমি যখন বলিলাম যে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সাধনা কোনো বাহিরের সংস্কারকে অবলম্বন করে নাই, তাহা তাঁহার সমস্ত জীবনের ভিতর হইতে উদ্ভুত হইয়াছে, তখন এ কথা বুঝিতে হইবে যে, জীবনের সকল বিচিত্রতাকে পরিপূর্ণ একের মধ্যে পাইবার আকাঙ্ক্ষাই কবির পরিণত জীবনে কাজ করিতেছে। সুতরাং এই পরিণতিকে সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে পড়িতে হইবে, নানা তানকে সমের মধ্যে মিলাইয়া পূর্ণ রাগিণীর সমগ্র রূপটিকে দেখিতে হইবে। সমগ্রকে তেমন করিয়া দেখা শক্ত। সমগ্র হর্ম্যের একটা ভাবগত চেহারা তাহার নির্মাতার মনের মধ্যে থাকে, হর্ম্যের প্রত্যেকটি অংশ তাই সেই ভাবগত সম্পূর্ণ চেহারাটির অন্তর্গত হইয়া গড়িয়া উঠে। সেই ভাবগত চেহারাটি দেখাই আসল দেখা— কত ইঁট বা কত প্রস্তর এবং কী পরিমাণ মজুরি দিয়া হর্ম্যটি নির্মিত হইয়াছে তাহার হিসাব রাখিয়া আনন্দ কি!

 গীত-সংগতে যেমন নানা বাদ্যযন্ত্র বাজে, নানা সুরে— প্রত্যেকটিই তাহার চরম সংগীতকেই প্রকাশ করিবার জন্য ব্যস্ত— অথচ সেই সমস্তকে মিলাইয়া এক বিপুল একতান সংগীত শোনা যায়, ঠিক সেইরকম রবীন্দ্রনাথের জীবনে সমস্ত বিচিত্রতা প্রত্যেকে আপনার চরমতম সুরকে প্রকাশ করিয়াও পরম ঐক্যের রাগিণীর মধ্যেই আপনাকে বিসর্জন দিয়াছে। সেইজন্যই তাঁহার কাবের খণ্ডতার চেয়ে তাহার সমগ্রতার মূর্তিই বেশি করিয়া দেখিবার বিষয়।

 এখানে তাহার অপ্রকাশিত পত্র হইতে একটি স্থান উদ্ধৃত করিয়া দিলে আমার কথাটি পরিস্ফুট হইবে।

 ‘আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই সে কখনোই আমার ধর্ম হয়ে ওঠে না। তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটা অভ্যাসের যোগ জন্মে। ধর্মকে নিজের মধ্যে উদ্ভুত করে তোলাই মানুষের চিরজীবনের সাধনা। বা মুখে বলছি, যা লোকের মুখে শুনে প্রত্যহ আবৃত্তি করছি, তা যে আমার পক্ষে কতই মিথ্যা তা আমরা বুঝতেই পারি নে। এ দিকে আমাদের জীবন ভিতরে ভিতরে নিজের সত্যের মন্দির প্রতিদিন একটি একটি ইঁট নিয়ে গড়ে তুলছে। জীবনের সমস্ত সুখদুঃখকে যখন বিচ্ছিন্ন ক্ষণিক ভাবে দেখি, তখন আমাদের ভিতরকার এই অনন্ত সৃজনরহস্য ঠিক বুঝতে পারি নে— প্রত্যেক পদটা বানান করে পড়তে হলে যেমন সমস্ত বাক্যটার অর্থ এবং ভাবের ঐক্য বোঝা যায় না সেইরকম। কিন্তু নিজের ভিতরকার এই সৃজনব্যাপারের অখণ্ড ঐক্যসূত্র যখন একবার অনুভব করা যায় তখন এই সৃজ্যমান অনন্ত বিশ্বচরাচরের সঙ্গে নিজের যোগ উপলব্ধি করি, বুঝতে পারি যেমন গ্রহনক্ষত্র চন্দ্রসূর্য জ্বলতে জ্বলতে ঘুরতে ঘুরতে চিরকাল ধরে তৈরি হয়ে উঠছে, আমার ভিতরেও তেমনি অনাদিকাল ধরে একটা সৃজন চলছে— আমার সুখ দুঃখ বাসনা বেদনা তার মধ্যে আপনার আপনার স্থান গ্রহণ করছে।’

 কবি রবীন্দ্রনাথ যদি গোড়া হইতেই ধর্মের পথে আপনাকে চালনা করিতেন তাহা হইলে আমরা একতারার একটি তারের সুরই তাঁহার নিকট হইতে পাইতাম, জীবনের নানা তারের নানা বিচিত্র সংগীত পাইতাম না। তিনি যে প্রবৃত্তির পথকে রুদ্ধ করেন নাই, এইজন্যই তাঁহার কবিপ্রকৃতি সমস্ত প্রবৃত্তিকে তাহার একটি বড় সামঞ্জস্যের অন্তর্গত করিয়া বিশ্বের হইয়া উঠিবার চেষ্টা পাইয়াছে। আমাদের দেশের আধুনিক ধর্মসাধনা নিবৃত্তির পথেই প্রধানতঃ চলে, বাহিরকে বিশ্বসংসারকে জ্ঞানে, কর্মে, ভোগে, সকল জায়গায় অস্বীকার করিবার দরুন প্রবৃত্তির স্বাভাবিক চরিতার্থতা তাহাকে লাভ করিতে দেয় না । প্রবৃত্তিগুলিকে পরিপূর্ণভাবে বাহিরে আসিতে দিলেই যে তাহারা বিকৃতির হাত হইতে রক্ষা পায় এবং জীবনকে বিশ্বের সঙ্গে, বৃহতের সঙ্গে সত্যসম্বন্ধযুক্ত করিতে পারে, সে কথা আমরা ভুলিয়া যাই।

 রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা দেখিব যে তাঁহার প্রকৃতি বার বার প্রবৃত্তির ক্ষুদ্র গণ্ডি অতিক্রম করিয়া তাহাকে বিশ্বের মধ্যে, সমগ্রের মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া দিয়াছে। প্রত্যেক অবস্থায় কাব্যের মধ্যে এই বিশ্বযাত্রার জন্য ব্যাকুল ক্রন্দন রহিয়াছে।

 যখন ‘সন্ধ্যাসংগীতে’ আপনার হৃদয়াবেগের জটিল অরণ্যের মধ্যে আপনারই ভিতরে আপনি অবরুদ্ধ থাকিবার বেদনায় কবি পীড়িত তখনও “সংগ্রামসংগীত” “আমি হারা” প্রভৃতি কবিতায় ক্রন্দন বাজিয়াছে— আমার অবরুদ্ধ হৃদয় জগৎকে হারাইতে বসিয়াছে:

বিদ্রোহী এ হৃদয় আমার
জগৎ করিছে ছারখার। ...
উষার মুখের হাসি লয়েছে কাড়িয়া,
গভীর বিরামময় সন্ধ্যার প্রাণের মাঝে
দুরন্ত অশান্তি এক দিয়াছে ছাড়িয়া!...
ফুল ফুটে, আমি আর দেখিতে না পাই!
পাখি গাহে, মোর কাছে গাহে না সে আর!

 যখন ‘ছবি ও গান’ প্রভৃতিতে কল্পনার মোহাবেশের মধ্যে থাকিয়া তাহারই রঙে সব জিনিসকে রঙিন করিয়া দেখিতেছেন, ‘কড়ি ও কোমলে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’য় সৌন্দর্যের আবেগ এক অনির্বচনীয় রহস্যে হৃদয়কে দোলা দিতেছে অথচ ভোগপ্রবৃত্তি তাহাতে মিশিয়া একটি মোহরচনা করিতেছে— তখনও এই বেদনা শেষাশেষি জাগিতেছে যে, বাসনা সমস্ত ম্লান করিয়া দিল, তাহার জন্য বৃহতের সঙ্গে যোগের বিচ্ছেদ ঘটিতেছে। সেই বেদনাতেই কবি বলিতেছেন:

ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না ওরে, দাঁড়াও সরিয়া।
ম্লান করিয়ো না আর মলিন পরশে।
ওই দেখো তিলে তিলে যেতেছে মরিয়া
বাসনা- নিশ্বাস তব গরল বরষে। ...
যে প্রদীপ আলো দেবে তাহে ফেল শ্বাস,
যারে ভালোবাস তারে করিছ বিনাশ!

 তার পর ‘মানসী’তে আপনার ব্যক্তিগত আবরণের মধ্যে যখন প্রেমকে নিবিড় করিয়া তাহাকে তাহারই মধ্যে একান্ত করিয়া দেখিতেছেন, তখনও ভিতরে ভিতরে ঐ এক ক্রন্দন জাগিতেছে যে, প্রেম সব নয়, সমস্ত পরিপূর্ণতার মধ্যে তাহার যেটুকু স্থান সে তাহা ছাড়াইয়া অত্যন্ত একান্ত হইয়া উঠিতে চায়।

বৃথা এ ক্রন্দন!
বৃথা এ অনল-ভরা দুরন্ত বাসনা!...
ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব,
কেহ নহে তোমার আমার।
অতি সযতনে
অতি সংগোপনে,
সুখে দুঃখে, নিশীথে দিবসে,
বিপদে সম্পদে,
জীবনে মরণে,...

বিশ্বজগতের তরে, ঈশ্বরের তরে
শতদল উঠিতেছে ফুটি—
সুতীক্ষ্ণ বাসনা-ছুরি দিয়ে
তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে!

 এই যেমন তাঁহার প্রথমবয়সের তেমনি তাঁহার শেষবয়সের কাব্য ‘ক্ষণিকা’তেও “সৌন্দর্যের সন্ন্যাসী” কবি যখন ভোগক্ষুব্ধ যৌবনকে ছাড়াইয়া ভারশূন্য প্রাণে বাংলা গ্রাম্যপ্রকৃতির বুকের মধ্যে একটি স্থির শান্তির ঘর বাঁধিতেছেন, একটি “আকুল শান্তি বিপুল বিরতি”র মধ্যে সমস্ত সৌন্দর্যকে সহজ করিয়া সরল করিয়া ব্যাপ্ত করিয়া বিরল করিয়া দেখিতেছেন, তখন শেষের দিকে ক্রমেই একটি অতলতার মধ্যে নিমগ্ন হইবার উপক্রম চলিতেছে:

পথে যতদিন ছিনু ততদিন
অনেকের সনে দেখা।
সব শেষ হল যেখানে সেথায়
তুমি আর আমি একা।

 এইরূপে দেখা যাইতে পারে যে কেবলই এক অবস্থা হইতে অবস্থান্তরে আসিবার এই যে একটি ভাব রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাব্যের মধ্যে দেখা যায় তাহার কারণ ঐ যে, তাঁহার কবিপ্রকৃতি আপনার সমস্ত বিচিত্রতাকে কেবলই উদ্ঘাটন করিতে করিতে অগ্রসর হইয়াছে, এবং কেবলই তাহাদের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তাহাদের বিরোধের মধ্যে একটি বৃহৎ সামঞ্জস্য একটি বৃহৎ ঐক্যকে অনুসন্ধান করিয়াছে। এ যেন ভারতবর্ষের আপনাকে খর্ব করিয়া সকলের মধ্যে প্রবেশ করিবার সাধনার সঙ্গে ইউরোপীয় প্রবৃত্তিমূলক সাধনা মিলিত হইয়া এক অভিনব বৈচিত্র্য রচনা করিয়াছে।

 সকলের মধ্যে প্রবেশ করিবার সাধনা —সর্বমেবাবিশন্তি— আধুনিক ধর্মোপদেশসমূহে যে কথাটির প্রতি রবীন্দ্রনাথ সকলের চেয়ে বেশি জোর দেন এবং যে সাধনাটি তাঁহার মতে বিশেষভাবে ভারতবর্ষেরই, সেই কথাটির উল্লেখ করিলাম বলিয়া এখানে আর একটি কথা বলা আবশ্যক।

 আমার মনে হয় সকল কবির জীবনের মধ্যেই একটি মূলসুর থাকে। অন্যান্য সকল বৈচিত্র্য সেই মূলসুরের সঙ্গে সংগত হইয়া একটি অপরূপ রাগিণী নির্মাণ করে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সেই মূলসুরটি কী? সেটি প্রকৃতির প্রতি একটি অতিনিবিড় অতিগভীর প্রেম। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি প্রেম নানা কবির মধ্যে নানা ভাবে বিরাজমান। ইঁহার প্রেমের স্বরূপটি কী?

 তাঁহার লেখা হইতেই তাহা উদ্ধৃত করিয়া দিলেই আপনারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিবেন:

 ‘প্রকৃতির মধ্যে যে এমন একটা গভীর আনন্দ পাওয়া যায়, সে কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা নিগূঢ় আত্মীয়তা অনুভব ক’রে। এই তৃণগুল্মলতা, জলধারা, বায়ুপ্রবাহ, এই ছায়ালোকের আবর্তন, জ্যোতিষ্কদলের প্রবাহ, পৃথিবীর অনন্ত প্রাণীপর্যায়, এই সমস্তের সঙ্গেই আমাদের নাড়ী-চলাচলের যোগ রয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে আমরা একই ছন্দে বসানো, তাই এই ছন্দের যেখানেই যতি পড়ছে সেখানে ঝংকার উঠছে, সেইখানেই আমাদের মনের ভিতর থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছে। জগতের সমস্ত অণুপরমাণু যদি আমাদের সগোত্র না হত, যদি প্রাণে ও আনন্দে অনন্ত দেশকাল স্পন্দমান হয়ে না থাকত, তা হলে কখনোই এই বাহ্যজগতের সংস্পর্শে আমাদের অন্তরের মধ্যে আনন্দের সঞ্চার হত না। যাকে আমরা জড় বলি তার সঙ্গে আমাদের যথার্থ জাতিভেদ নেই বলেই আমরা উভয়ে এক জগতে স্থান পেয়েছি, নইলে আপনিই দুই স্বতন্ত্র জগৎ তৈরি হয়ে উঠত।’

 প্রকৃতির সঙ্গে যোগের এই ভাবটিকে রবীন্দ্রবাবু উত্তরকালে বিশ্ববোধ নাম দিয়াছেন, সর্বানুভূতি বলিয়াছেন। সমস্ত জলস্থল-আকাশকে সমস্ত মনুষ্যসমাজকে আপনার চৈতন্যে অখণ্ডপরিপূর্ণ করিয়া অনুভব করিবার নামই সর্বানুভূতি।

 আমি নিঃসংকোচে বলিতে পারি যে, এই সর্বানুভূতিই কবির জীবনের ও কাব্যের মূলসুর: অন্যান্য সমস্ত বৈচিত্র্য— সৌন্দর্য, প্রেম, স্বদেশানুরাগ, সমস্ত সুখদুঃখবেদনা এই মূলসুরের দ্বারা বৃহৎ বিশ্বব্যাপী একটি প্রসার প্রাপ্ত হইয়াছে। আমি যে দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছি যে, ‘সন্ধ্যাসংগীত’ হইতে আরম্ভ করিয়া আজ পর্যন্ত সকল কাব্যের মধ্যেই যেখানেই জীবন কোনো প্রবৃত্তির ভিতরে বাঁধা পড়িতেছে, সেখানেই আপনার অবস্থাকে অতিক্রম করিয়া আপনার চেয়ে যাহা বড় তাহাকে পাইবার কান্না লাগিয়াই আছে, এই মূলসুরের মধ্যেই সেই ক্রন্দনের অর্থ নিহিত। এই সুরই কবির জীবনের সকল বিচিত্রতাকে গাঁথিয়া তুলিয়াছে— এই সুরই বারম্বার ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ছাড়াইয়া বিরাটের সঙ্গে তাঁহার জীবনকে যুক্ত করিয়াছে।

 এইবার তাঁহার জীবনচরিত ও কাব্য উভয়কেই একত্রে মিলাইয়া ক্রমে ক্রমে তাহাদের ভিতরের এই তত্ত্বটি উদ্ঘাটন করিয়া দেখাইবার চেষ্টা করা যাইবে।