১৩

 সােভিয়েট রাশিয়ায় জনসাধারণকে শিক্ষা দেবার জন্যে কত বিবিধ রকমের উপায় অবলম্বন করা হয়েছে তার কিছু কিছু আভাস পূর্বের চিঠিপত্র থেকে পেয়ে থাকবে। আজ তােমাকে তারই মধ্যে একটা উদ্যোগের সংক্ষেপ বিবরণ লিখে পাঠাচ্ছি।

 কিছুদিন হল মস্কৌ শহরে সাধারণের জন্য একটি আরামবাগ খােলা হয়েছে। বুলেটিনে তার নাম দিয়েছে Moscow Park of Education aud Recreation তার মধ্যে প্রধান মণ্ডপটি প্রদর্শনীর জন্যে। সেখানে ইচ্ছা করলে খবর পাওয়া যায় সমস্ত প্রদেশে কারখানার শতসহস্র শ্রমিকদের জন্যে কত ডিস্পেন্সারি খােলা হয়েছে, মস্কৌ প্রদেশে স্কুলের সংখ্যা কত বাড়ল; ম্যুনিসিপ্যাল বিভাগে দেখিয়েছে কত নতুন বাসাবাড়ি তৈরি হল, কত নতুন বাগান, শহরের কত বিষয়ে কত রকমের উন্নতি হয়েছে। নানা রকমের মডেল আছে, পুরানো পাড়াগাঁ এবং আধুনিক পাড়াগাঁ, ফুল ও সবজি উৎপাদনের আদর্শ খেত, সােভিয়েট আমলে সােভিয়েট কারখানায় যে-সব যন্ত্র তৈরি হচ্ছে তার নমুনা, হাল আমলের কো-অপারেটিভ ব্যবস্থায় কী রুটি তৈরি হচ্ছে আর ওদের বিপ্লবের সময়েতেই বা কী-রকম হত। তাছাড়া নানা তামাশা, নানা খেলার জায়গা, একটা নিত্য-মেলার মতো আর কি।

 পার্কের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র জায়গা কেবল ছােটো ছেলেদের জন্যে, সেখানে বয়স্ক লােকদের প্রবেশ নিষেধ, সেখানকার প্রবেশদ্বারে লেখা আছে ছেলেদের উৎপাত কোরাে না। এইখানে ছেলেদের যত রকম খেলনা খেলা, ছেলেদের থিয়েটার, সে-থিয়েটারের ছেলেরাই চালক, ছেলেরাই অভিনেতা।

 এই ছেলেদের বিভাগ থেকে কিছু দূরে আছে creche, বাংলায় তার নাম দেওয়া যেতে পারে শিশুরক্ষণী। মা-বাপ যখন পার্কে ঘুরে বেড়াতে প্রবৃত্ত তখন এই জায়গায় ধাত্রীদের জিম্মায় ছােটো শিশুদের রেখে যেতে পারে। একটা দোতলা মণ্ডপ pavillion আছে ক্লাবের জন্যে। উপরের তলায় লাইব্রেরি। কোথাও বা সতরঞ্চ খেলার ঘর, কোথাও আছে মানচিত্র আর দেওয়ালে-ঝোলানাে খবরের কাগজ। তা ছাড়া সাধারণের জন্যে আহারের বেশ ভালাে কো-অপারেটিভ দোকান আছে, সেখানে মদ বিক্রি বন্ধ। মস্কৌ পশুশালাবিভাগ থেকে এখানে একটা দোকান খুলেছে, এই দোকানে নানারকম পাখি মাছ চারাগাছ কিনতে পাওয়া যায়। প্রাদেশিক শহরগুলিতে এই রকমের পার্ক খােলবার প্রস্তাব আছে।

 যেটা ভেবে দেখবার বিষয় সেটা হচ্ছে এই যে, জনসাধারণকে এরা ভদ্রসাধারণের উচ্ছিষ্টে মানুষ করতে চায় না। শিক্ষা আরাম জীবন-যাত্রার সুযােগ সমস্তই এদের ষােলো আনা পরিমাণে। তার প্রধান কারণ জনসাধারণ ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই। এরা সমাজগ্রন্থের পরিশিষ্ট অধ্যায় নয়—সকল অধ্যায়েই এরা।

 আর-একটা দৃষ্টান্ত তােমাকে দিই। মস্কৌ শহর থেকে কিছুদূরে সাবেক কালের একটি প্রাসাদ আছে। রাশিয়ার প্রাচীন অভিজাত বংশীয় কাউণ্ট আপ্রাসিনদের সেই ছিল বাসভবন। পাহাড়ের উপর থেকে চারিদিকের দৃশ্য অতি সুন্দর দেখতে—শস্যক্ষেত্র নদী এবং পার্বত্য অরণ্য। দুটি আছে সরােবর অরি অনেকগুলি উৎস। থামওয়ালা বড়াে বড়াে প্রকোষ্ঠ, উঁচু বারান্দা, প্রাচীনকালের আসবাব ছবি ও পাথরের মূর্তি দিয়ে সাজানো দরবারগৃহ, এ ছাড়া আছে সংগীতশালা, খেলার ঘর, লাইব্রেরি, নাট্যশালা; এ ছাড়া অনেকগুলি সুন্দর বহির্ভবন গাড়িটিকে অধচন্দ্রাকারে ঘিরে আছে।

 এই বৃহৎ প্রাসাদে অগতাে নাম দিয়ে একটি কো-অপারেটিভ স্বাস্থ্যগার স্থাপন করা হয়েছে—এমন সমস্ত লােকদের জন্য যারা একদা এই প্রাসাদে দাসশ্রেণীতে গণ্য হােত। সােভিয়েট রাষ্ট্রসংঘে একটি কো-অপারেটিভ সােসাইটি আছে, শ্রমিকদের জন্যে বাস নির্মাণ যার প্রধান কর্তব্য; সেই সােসাইটির নাম বিশ্রান্তিনিকেতন—The Home of Rest। এই অলগভো তারই তত্ত্বাধীনে।

 এমনতরাে আরও চারটে সানাটোরিয়ম এর হাতে আছে। খাটুনির ঋতুকাল শেষ হয়ে গেলে অন্তত ত্রিশ হাজার শ্রমক্লান্ত এই পাঁচটি আরােগ্যশালায় এসে বিশ্রাম করতে পারবে। প্রত্যেক লােক এক পক্ষকাল এখানে থাকতে পারে। আহারের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত, আরামের ব্যবস্থা যথেষ্ট, ডাক্তারের ব্যবস্থাও আছে। কো-অপারেটিভ প্রণালীতে এই রকম বিশ্রান্তিনিকেতন স্থাপনের উদ্যোগ ক্রমশই সাধারণের সম্মতি লাভ করছে।

 আর কিছু নয়, শ্রমিকদের বিশ্রামের প্রয়োজন এমনভাবে আর কাথাও কেউ চিন্তাও করে নি, আমাদের দেশের অবস্থাপন্ন লোকের পক্ষেও এ-রকম সুযােগ দুর্লভ।

 শ্রমিকদের জন্যে এদের ব্যবস্থা কী রকম সে তো শুনলে, এখন শিশুদের সম্বন্ধে এদের বিধান কী রকম সে কথা বলি। শিশু জারজ কংবা বিবাহিত দম্পতির সন্তান সে-সম্বন্ধে কোনাে পার্থক্য এরা গণ্যই করে না। আইন এই যে, শিশু যে-পর্যন্ত না আঠারো বছর বয়সে সাবালক হয় সেপর্যন্ত তাদের পালনের ভার বাপ-মায়ের। বাড়িতে তাদের কী ভাবে পালন করা বা শিক্ষা দেওয়া হয় স্টেট সে-সম্বন্ধে উদাসীন নয়। ষােলাে বছর বয়সের পূর্বে সন্তানকে কোথাও খাটুনির কাজে নিযুক্ত করতে পারবে না। আঠারাে বছর বয়স পর্যন্ত তাদের কাজের সময় পরিমাণ ছয় ঘণ্টা। ছেলেদের প্রতি পিতামাতা আপন কতব্য করছে কিনা তার তদারকের ভার অভিভাবক বিভাগের ’পরে। এই বিভাগের কর্মচারী মাঝে মাঝে পরিদর্শন করতে আসে, দেখে ছেলেদের স্বাস্থ্য কী রকম আছে, পড়াশুনাে কী রকম চলছে। যদি দেখা যায় ছেলেদের প্রতি অযত্ন হচ্ছে, তাহলে বাপমায়ের হাত থেকে ছেলেদের ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তবু ছেলেদের ভরণপােষণের দায়িত্ব থাকে বাপমায়েরই। এই রকম ছেলেমেয়েদের মানুষ করবার ভার পড়ে সরকারী অভিভাবকবিভাগের।

 ভাবখানা এই, সন্তানেরা কেবল তাে বাপমায়ের নয়, মুখ্যত সমস্ত সমাজের। তাদের ভালােমন্দ নিয়ে সমস্ত সমাজের ভালােমন্দ। এরা যাতে মানুষ হয়ে ওঠে তার দায়িত্ব সমাজের, কেননা তার ফল সমাজেরই। ভেবে দেখতে গেলে পরিবারের দায়িত্বের চেয়ে সমাজের দায়িত্ব বেশি বই কম নয়। জনসাধারণ সম্বন্ধেও এদের মনের ভাব ঐ রকমেরই। এদের মতে জনসাধারণের অস্তিত্ব প্রধানত বিশিষ্টসাধারণের সুযােগ সুবিধার জন্যে নয়। তারা সমগ্র সমাজের অঙ্গ, সমাজের কোনাে বিশেষ অঙ্গের প্রত্যঙ্গ নয়। অতএব তাদের জন্য দায়িত্ব সমস্ত স্টেটের। ব্যক্তিগত ভাবে নিজের ভােগের বা প্রতাপের জন্য কেউ সমগ্র সমাজকে ডিঙিয়ে যেতে গেলে চলবে না।

 যাই হােক, মানুষের ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত সীমা এরা যে ঠিকমতো ধরতে পেরেছে তা আমার ঝেধ হয় না। সে হিসাবে এর ফ্যাসিস্টদেরই মতাে। এই কারণে সমষ্টির খাতিরে ব্যষ্টির প্রতি পীড়নে এরা কোনো বাধাই মানতে চায় না। ভুলে যায় ব্যষ্টিকে দুর্বল করে সমষ্টিকে সবল করা যায় না, ব্যষ্টি যদি শৃঙ্খলিত হয় তবে সমষ্টি স্বাধীন হতে পারে না। এখানে জবরদস্ত লােকের একনায়কত্ব চলছে। এই রকম একের হাতে দশের চালনা দৈবাৎ কিছুদিনের মতাে ভালাে ফল দিতেও পারে, কিন্তু কখনােই চিরদিন পারে না। উপযুক্তমতে নায়ক পরম্পরাক্রমে পাওয়া কখনােই সম্ভব নয়।

 তা ছাড়া অবাধ ক্ষমতার লােভ মানুষের বুদ্ধিবিকার ঘটায়। একটা সুবিধার কথা এই যে, যদিও সােভিয়েট মূলনীতি সম্বন্ধে এরা মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে অতি নিদয়ভাবে পীড়ন করতে কুণ্ঠিত হয় নি তথাপি সাধারণভাবে শিক্ষার দ্বারা চর্চার দ্বারা ব্যক্তির আত্মীনহিত শক্তিকে বাড়িয়েই চলেছে—ফ্যাসিস্টদের মতো নিয়তই তাকে পেষণ করে নি। শিক্ষাকে আপন বিশেষ মতের একান্ত অনুবর্তী করে কতকটা গায়ের জোরে কতকটা মােহমন্ত্রের জোরে একঝোকা করে তুলেছে তবুও সাধারণের বুদ্ধির চর্চা বন্ধ করে নি। যদিও সােভিয়েট নীতি প্রচার সম্বন্ধে এরা যুক্তির জোরের উপরেও বাহুবলকে খাড়া করে রেখেছে তবুও যুক্তিকে একেবারে ছাড়ে নি এবং ধর্মমূঢ়তা এবং সমাজ প্রথার অন্ধতা থেকে সাধারণের মনকে মুক্ত রাখবার জন্যে প্রবল চেষ্টা করেছে।

 মনকে একদিকে স্বাধীন করে অন্যদিকে জুলুমের বশ করা সহজ নয়। ভয়ের প্রভাব কিছুদিন কাজ করবে, কিন্তু সেই ভীরুতাকে ধিক্কার দিয়ে শিক্ষিত মন একদিন আপন চিন্তাস্বাতন্ত্র্যের অধিকার জোরের সঙ্গে দাবি করবেই। মানুষকে এরা দেহের দিকে নিপীড়িত করেছে, মনের দিকে নয়। যারা যথার্থই দৌরাত্ম করতে চায় তারা মানুষের মনকে মারে আগে—এরা মনের জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তুলেছে। এইখানেই পরিত্রাণের রাস্তা রয়ে গেল।

আজ আর ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে পৌছব নিয়ুইয়র্কে। তার পর আবার নতুন পালা। এরকম করে সাত ঘাটের জল খেয়ে বেড়াতে আর ভালাে লাগে না। এবারে এ অঞ্চলে না আসবার ইচ্ছায় মনে অনেক তর্ক উঠেছিল কিন্তু লােভই শেষকালে জয়ী হল। ইতি ৯ অক্টোবর, ১৯৩০।