চার

 সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে এক নূতন সমস্যার সম্মুখীন হইল। বিনা রক্তপাতে বিপ্লব সম্ভবপর হইলেও নূতন রাষ্ট্রকে রক্ষা করিবার জন্য রক্তপাতের প্রয়োজন হইল। রাশিয়ার কয়েকজন সেনাপতি পুরাতন রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের জন্য বিদ্রোহী সৈন্যদল লইয়া সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করেন। তাঁহাদের পশ্চাতে ফ্রান্স ও ইংলণ্ডের সাহায্য ছিল। রাশিয়া সকল দিক দিয়াই আক্রান্ত হইল।

 “বারংবার, বিশেষভাবে ১৯১৯-এর অক্টোবর মাসে দেখা গেল নূতন গণতন্ত্র ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে। কিন্তু কি হোয়াইট রাশিয়ান সৈন্যদল, কি পোলাণ্ডের যুদ্ধে যোগদান, কি কৃষক বিদ্রোহ, কি দুর্ভিক্ষ কিছুতেই লেনিনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ জাতির দুর্দমনীয় শক্তিকে পরাহত করিতে পারিল না। চৌদ্দটী জাতির সম্মিলিত আক্রমণ সোভিয়েট রাশিয়া প্রতিহত করিল।” একথা লিখিয়াছেন প্রতিক্রিয়াশীল সাংবাদিক এবং ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভক্ত মঃ ম্যালেট।

 এই দুর্দ্দিনে ষ্ট্যালিন কি ভাবে বারংবার বিপদজাল ছিন্ন করিয়াছেন আমরা সে ইতিহাস কিঞ্চিং অনুসন্ধান করিব। কালিনিন লিখিয়াছেন, “১৯১৮-২০ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি একমাত্র ষ্ট্যালিনকেই বিভিন্ন রণক্ষেত্রে প্রেরণ করিয়াছেন। যেখানেই বিপ্লব সঙ্গীন অবস্থার সম্মুখীন হইয়াছে সেইখানেই ষ্ট্যালিন গিয়াছেন। গৃহযুদ্ধের সময় ষ্ট্যালিনের সামরিক তৎপরতা মহাকাব্যের মতই বিচিত্র। উহার বিশেষত্ব কেবল জয়লাভ করায় নহে। তিনি অতি উচ্চস্তরের রণকৌশল ও নৈপুণ্য দেখাইয়াছেন। সৈন্যদল গঠন ও পরিচালনে তাঁহার লক্ষ্য থাকিত, শত্রুর বিরুদ্ধে সর্ব্বাপেক্ষা মারাত্মক কৌশল অবলম্বন করা।” যেখানে লালপল্টন দ্বিধাগ্রস্ত হইয়াছে প্রতি-বিপ্লবীদল কিছু সাফল্য অর্জ্জন করিয়াছে সেইখানেই ষ্ট্যালিন উপস্থিত হইয়া তাহা প্রতিষেধ করিয়াছেন। এই কালে তাঁহার রাত্রিতে নিদ্রা ছিলনা, দিনে বিশ্রাম ছিল না; অবিশ্রান্ত ভ্রমণ করিয়া তিনি ক্ষুধিত, রসদ ও সরঞ্জামহীন লালপণ্টনকে উৎসাহে সঞ্জীবিত রাখিয়াছেন। অতিরিক্ত উৎসাহী ট্রট‍্স্কী যেখানেই গোলমাল বাধাইয়া তুলিতেন সেইখানেই ষ্ট্যালিনকে যাইতে হইত। ষ্ট্যালিন একদা বিদ্রূপ করিয়া বলিয়াছিলেন, “সৈন্য বিভাগের অজিয়ান্ আস্তাবল সাফ, করিবার আমি একজন বিশেষজ্ঞ বলিয়া বিবেচিত হইতাম।”

 এই দুই বৎসরে ষ্ট্যালিন, ভরোশিলভ ও মিনিনকে সঙ্গে লইয়া জারিথসিন্ রক্ষা করিলেন এবং ঝেরঝিনিস্কির সহিত পেট্রোগাড সীমান্তে গিয়া প্রেমে বিদ্রোহী সেনাপতি জুডিনিচের অগ্রগতি রোধ করিলেন। পশ্চিম সীমান্তে পোলাণ্ডেও তাঁহার কার্যকারিতা দেখা গেল। দক্ষিণ রাশিয়ায় জেনারেল ডেনিকিনের বিরুদ্ধে এবং জেনারেল র‍্যাঙ্গেলের বিরুদ্ধেও তাঁহাকে আমরা সৈন্য পরিচালনা করিতে দেখিতে পাই।

 ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে রাশিয়ার ভয়াবহ অবস্থা কল্পনাতেও আনা যায় না। বহু যুদ্ধক্ষেত্র ধ্বংস ও মৃতদেহে, সমাকীর্ণ এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে মেনশেভিক প্রতিবিপ্লবী দলের ষড়যন্ত্র। মস্কৌ সহরে রিভলিউশনারী সমাজতন্ত্রীদল মাথা তুলিবার উপক্রম করিতেছে। উরাল পর্ব্বতমালায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চেক্ সৈন্যগণ বিপ্লবের বিরোধিতা করিবার জন্য সুসজ্জিত হইতেছে। দক্ষিণে বাকুর তৈল খনি অধিকার করিবার জন্য ইংরাজেরা অগ্রসর। যখন চারিদিকে আগুণ জ্বলিয়া উঠিয়াছে তখন ষ্ট্যালিন জারিথসিনে উপনীত হইলেন। লেনিনের সহিত তাঁহার অবিশ্রান্ত তারবিনিময় হইতে লাগিল। ষ্ট্যালিন কেবল সৈন্যদলের পরিদর্শক নহেন। দক্ষিণ রাশিয়া হইতে খাদ্যদ্রব্য সরববাহ করিবার ভারও তাঁহার উপর। জারিথসিনে অবস্থা সঙ্গীন। ডন অঞ্চলের কসাকেরা বিদ্রোহ কারিয়াছে। জারিথসিন হারাইলে উত্তর ককেশিয়ার উর্ব্বরা ভূমির সমস্ত গম শত্রুপক্ষের হাতে পড়িবে। ষ্ট্যালিন আসিয়াই লেনিনকে তার যোগে জানাইলেন, “আমি আসিয়া প্রত্যেককে ভর্ৎসনা ও তাড়না করিয়াছি। কমরেড লেনিন! আপনি নিশ্চয় জানিবেন যে আমি কাহাকেও ক্ষমা করিব না, এমন কি নিজেকেও না। যাহাই ঘটুক, আমরা আপনাকে গম পাঠাইব, যদি আমাদের সামরিক বিশেষজ্ঞগণ (নীরেট মূর্খ) অলসভাবে নিদ্রিত না থাকিত তাহা হইলে শত্রুরা আমাদের ব্যূহ ভেদ করিতে পারিত না এবং এই ব্যূহ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে ঐ সকল বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধেই কাজ করিতে হইবে।”

 ষ্ট্যালিন দেখিলেন সর্ব্বত্র বিশৃঙ্খলা। কসাকের। জার্ম্মাণবাহিনীর সহিত একত্র হইয়া ইউক্রেনে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্রোহী সেনারা একের পর আর জারিথসিনের জেলাগুলি দখল করিতেছে। ক্ষেত্র হইতে শস্য সংগ্রহ বন্ধ। প্রথমেই ষ্ট্যালিন দুর্ব্বল এবং দ্বিধাগ্রস্ত সৈন্যদলের পরিচালনা ভার গ্রহণ করিলেন। ১১ই জুলাই তিনি লেনিনকে তার করিলেন, “উত্তর ককেসিয়ার প্রধান সামরিক ঘাঁটির কর্ত্তারা প্রতি-বিপ্লব দমন করিতে সম্পূর্ণ অসমর্থ বলিয়া সমস্যা জটিল হইয়াছে।......ইহাদের অধীনস্থ কর্ম্মচারীরা যুদ্ধ পরিচালনার পরিবর্ত্তে দূরে থাকিয়া দর্শকের আসন গ্রহণ করিয়াছে, যেন যুদ্ধের প্রতি ইহাদের কোন কর্ত্তব্যই নাই।” দোষ ত্রুটি খুঁজিয়া বাহির করিয়া নিরস্ত থাকিবার মত লোক ষ্ট্যালিন নহেন। তিনি জানাইলেন, “আমার পক্ষে উদাসীন ভাবে থাকা সম্ভবপর নহে। কালিনিনের বাহিনী উত্তর ককেসিয়ায় রসদ পাইতেছে না। সমস্ত উত্তর রাশিয়ার সহিত গমক্ষেত্রগুলির সংযোগ ছিন্ন হইয়াছে। এইগুলি এবং স্থানীয় অন্যান্য দুর্ব্বলতা ও ত্রুটি আমি সংশোধন করিব। আমি উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেছি এবং করিব। প্রয়োজন হইলে আমাকে সমরনায়কদিগকে সরাইতে হইবে অথবা তাহাদের আমার নির্দ্দেশ মানিতে হইবে। সামরিক কর্ত্তৃপক্ষের আদেশ প্রয়োজন হইলে আমি বাতিল করিব। এক কথায় উচ্চতম কর্ত্তৃপক্ষের সহিত আমি পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করিতেছি।”

 মস্কো হইতে উত্তর আসিল, তাঁহাকে সমস্ত লালপল্টনকে পুনর্গঠন করিতে হইবে। “শৃঙ্খলা পুনঃ প্রতিষ্ঠা কর, ছত্রভঙ্গ সৈন্যদলকে কেন্দ্রীভূত করিয়া উপযুক্ত সেনানায়ক নিয়োগ কর, সর্ব্ববিধ অবাদ্যত| দমন কর।” বৈপ্লবিক সমর-সমিতি ঐ সঙ্গে ইহাও জ়ানাইলেন যে “এই তার” লেনিনের পূর্ণ সম্মতিক্রমেই প্রেরিত হইল।

 এই সরাসরি আদেশ আসিবার পর অবস্থা আরও সঙ্গীন হইয়া উঠিল। ইউক্রেনে হতাবশিষ্ট লালপল্টন ডন অঞ্চল হইতে জার্ম্মাণ বাহিনীর দ্বারা প্রতাড়িত হইয়া ছত্রভঙ্গভাবে জারিথসিনে প্রবেশ করিতে লাগিল। এই অবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এক অসাধ্য সাধন। কিন্তু দুর্দ্দমনীয় ইচ্ছা-শক্তি-সম্পন্ন ষ্ট্যালিনের ব্রতই অসাধ্য সাধন। যেন যাদুমন্ত্র-বলে তিনি বৈপ্লবিক যুদ্ধ-সমিতি প্রতিষ্ঠা করিয়া ছত্রভঙ্গ সৈন্যদলে পুনরায় শৃঙ্খলা আনয়ন করিলেন। সৈন্যেরা যথাযথ ভাবে শ্রেণীসংবদ্ধ হইল। বিপ্লবের প্রতি বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন লোকদের সরাইয়া দেওয়া হইল। সোভিয়েট এবং সাম্যবাদী দলের সহায়তায় রসদসরবরাহের ব্যবস্থা হইল। গোঁড়া বলশেভিকেরা আসিয়া ষ্ট্যালিনের পতাকা-তলে দাঁড়াইলেন। বিপ্লব-বিরোধী ডন কসাকদের মধ্য হইতে পুনরায় বলশেভিক অনুগামী লাল পণ্টন বাহির হইয়া আসিল।

 এইখানেই শেষ নহে। বিপ্লব ও যুদ্ধের ফলে জারিথসিনে সর্ব্ববিধ রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ঘটিয়াছিল। রুশ বিপ্লবে পলায়িত রাজতন্ত্রী মধ্যশ্রেণীর লোকেরা জারিথসিনে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। ইহারা একরূপ প্রকাশ্যেই বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছিল। ষ্ট্যালিন স্থানীয় বৈপ্লবিক যুদ্ধ-সমিতি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ঐ সকল লোকের প্রতি দৃষ্টি রাখিবার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগ সৃষ্টি করিলেন। প্রতিদিন বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হইতে লাগিল এবং বিপ্লবের নির্ম্মম হস্ত তারিমূলে উৎপাটিত করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিল না। বিদেশীদের উৎকোচ গ্রহণ করিয়া যে সকল কসাক-নেতা জারিথসিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিতেছিল তাহাদের চমক ভাঙ্গিল। রিভলিউশনারী স্যোশালিষ্ট দলকে ষ্ট্যালিন নির্ম্মুল করিতে লাগিলেন। লেনিন সংবাদ শুনিয়া ভীত হইলেন। এই বিপদকালে দমননীতি কুফল প্রসব করিতে পারে, লেনিনের এই উৎকণ্ঠিত তারের ষ্ট্যালিন উত্তর দিলেন, “আপনি ভাবপ্রবণদের কথায় বিচলিত হইবেন না, আমরা দৃঢ় আছি। শত্রুর সহিত আমরা শত্রুর মতই ব্যবহার করিব।”

 যখন বৈদেশিক আক্রমণ চলিতেছে সেই সময় যাহারা গৃহের মধ্যে সশস্ত্র বিরুদ্ধতা অবলম্বন করিতেছে এবং যাহাদের গুপ্তহত্যাই একমাত্র কৌশল, তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অবলম্বন করিবার সুফল অচিরেই দেখা দিল। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা দেখিলেন যে তাঁহারা শক্ত লোকের পাল্লায় পড়িয়াছেন। এই ব্যক্তি সাম্যবাদের আদর্শের ভিত্তিতে দৃঢ়পদে দণ্ডায়মান, এ ক্ষমা করিবে না, শত্রু মাত্রকেই নির্ম্মম ভাবে দমন করিবে।

 ষ্ট্যালিন যে দায়ীত্ব গ্রহণ করিলেন স্বাভাবিকভাবেই তাহা পালন করিবার উপযুক্ত ক্ষমতাও চাহিলেন। জারিথসিনের সামরিক কমিটির ডিরেক্টর (পরে ক্রাসনফের সৈন্যদলে যোগদানকারী বিশ্বাসঘাতক) নসোভিক (১৯১৯ ৩রা এপ্রিল) প্রতি-বিপ্লবীদের গৌরব ঘোষণা ও বলশেভিকদের নিন্দা করিয়াও সংবাদপত্রের এক প্রবন্ধে লিখিয়াছেন,— “বহু অধ্যবসায়ে গঠিত সামরিক নেতৃত্বের রদবদল দেখিয়া ট্রট্স্কী শঙ্কিত হইলেন। তিনি তার যোগে জানাইলেন, সামরিক নেতৃত্ব এবং কুমিশারদিগকে স্ব স্ব পদে পুনরায় নিযুক্ত করা হউক এবং অর্দ্ধবৃত্তাকারে করিবার সুযোগ দেওয়া হউক। ষ্ট্যালিন টেলীগ্রাফখানি, লাগিল যা তাহার উপর লিখিয়া দিলেন, ‘ইহা গ্রাহ্য করিবার প্রয়োজন নাই। ষ্ট্যালিনের আদেশই প্রতিপালিত হইল। গোলন্দাজ বাহিনীর নায়কগণ এবং সামরিক কর্ম্মচারীরা জারিথসিন বন্দরে একখানা ষ্টীমারে আটক রহিলেন।” দূর হইতে আদেশ প্রদানকারী ট্রট‍্স্কীর নির্দ্দ শ পালিত হইলে বিশ্বাসঘাতকেরা অবস্থা অধিকতর সঙ্গীন করিয়া তুলিত। ষ্ট্যালিন কর্ত্তৃত্ব গ্রহণ করিলেন; তাঁহার আদেশমত কার্য্য হইতেছে কিনা, বলশেভিক শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হইতেছে কিনা, ইহা দেখিবার জন্য স্বয়ং চারিশত মাইল ব্যাপী সংগ্রামক্ষেত্র পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। ষ্ট্যালিন জীবনে কখনও সৈন্যদলে কাজ করেন নাই। তাঁহার সামরিক পূর্ব্ব অভিজ্ঞতা না থাকিলেও, তিনি সঙ্ঘগঠন ও পরিচালনায় এবং রণনীতির জটিল সমস্যাগুলির দ্রুত মীমাংসায় অদ্ভূত নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়াছেন। ট্রট‍্স্কী নিযুক্ত জার-সৈন্যদলের ভূতপূর্ব্ব সেনাপতিদিগের পরিবর্ত্তে তিনি নিজের পছন্দমত সেনাপতি নিযুক্ত করিলেন। অধুনা বিখ্যাত ভরোশিলভ, বুডেনী ও টিমোশিঙ্কোর নেতৃত্বে এক নূতন লালপল্টন, জেনারেল ক্রাসনফের প্রচণ্ড আক্রমণ হইতে জারিথসিন রক্ষা করিতে লাগিল। উত্তর ককেসাস হইতে মস্কৌএর শিল্প-অঞ্চলে খাদ্য প্রেরণ বন্ধ হইবার উপক্রম হইল। ষ্ট্যালিন মুখ্যতঃ খাদ্যশস্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য প্রেরিত হইয়াছিলেন; ঘটনাচক্রে তিনি হইয়া পড়িলেন সামরিক নেতা। জারিথসিনের রক্ষাব্যূহ সুদৃঢ় করিয়া ষ্ট্যালিন উহা রক্ষা করিলেন। এই বিপুল সাফল্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট ঐ বন্দরের নাম রাখিলেন ষ্ট্যালিনগ্রাড। নূতন লালপল্টন জেনারেল ক্রানিক ষড়যন্ত্র পরাজিত করিয়া ইউক্রেন হইতে জার্ম্মানবাহিনীকে বহিষ্কৃত বর্ণসমূলে উৎস-র শরৎকালে দক্ষিণ রণাঙ্গণের বিপদ কাটিয়া গেল; সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট খাদ্যশস্য সরবরাহ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইলেন।

 কেগানোভিচ বলিয়াছেন, “১৯১৮ সালের প্রারম্ভে ক্রাসনফ চালিত কসাক সৈন্য জারিথসিন আক্রমণ করিয়াছে, ভল্গা নদীর তীরে তাহারা লাল পল্টনকে ঘিরিয়া ফেলিবার উপক্রম করিয়াছে, এই ঘটনা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল রহিয়াছে। ডোনেথস্ শ্রমজীবীদের দ্বারা গঠিত কমিউনিষ্ট সৈন্যদলের নেতৃত্বে চালিত লালপণ্টন উত্তমরূপে সুসজ্জিত কসাক সৈন্যদলের সহিত পূর্ণ বিক্রমে যুদ্ধ করিয়া তাহাদের হটাইয়া দিয়াছিল। সেই ভয়াবহ দিনগুলির স্মৃতি আজ অনেকে সহজে বিশ্বাস করিবেন না। এই সঙ্কটের মধ্যে ষ্ট্যালিন ধীর, আপন চিন্তায় আপনি নিমগ্ন,—নিদ্রাহীন ও নিরলস। তিনি একবার গুলিবর্ষণের সম্মুখীন হইতেছেন আর একবার সামরিক ঘাঁটিতে আসিয়া পরামর্শ করিতেছেন। আক্রমণ প্রতিহত করিয়া স্থির থাকা অসাধ্য হইয়া উঠিল। ক্রাসনফের সৈন্যদল আমাদের ভ্রান্তক্লান্ত সৈন্যদলকে আক্রমণ করিয়া প্রভৃত ক্ষতি করিতে লাগিল। অর্দ্ধ বৃত্তাকারে অগ্রসর শত্রু সৈন্য ভল্গা নদীর মুখে দুইদিক হইতে চাপিয়া আসিতে লাগিল, আমাদের পলায়নের পথ রহিল না। কিন্তু ষ্ট্যালিন পলায়নের কথা চিন্তা করিতেছিলেন না। জয়, একমাত্র জয়ের লক্ষ্য লইয়া তিনি সৈন্যদলকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। অবশেষে বিজয়লক্ষ্মীর আশীর্ব্বাদ মিলিল। ছত্রভঙ্গ শত্রুসৈন্য ডন নদীর অপর পারে পলায়ন করিল।”

 ১৯১৮-র শেষভাগে পূর্ব্বরণাঙ্গনে অনুরূপ বিপদ ঘনাইয়া আসিল। জেনারেল কোলচাকের সৈন্যদল শ্বেত রাশিয়া আক্রমণ করিয়া প্রেম অধিকার করিল। তৃতীয় লাল পল্টন পিছু হটিল—অর্দ্ধবৃত্তাকারে অগ্রসর শত্রুসৈন্য তাহাদের উপর অবিরত চাপ দিতে লাগিল। নভেম্বর মাসের শেষভাগে তৃতীয় পণ্টনের নৈতিক বল একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল। এই রণাঙ্গনে ছয় মাস যুদ্ধের ইতিহাস অতি শোচনীয়। রসদের অপ্রাচুর্য্য, রিজার্ভ বাহিনীর অভাব, নৈতিক মেরুদণ্ডহীন অলস সামরিক নেতৃত্ব, তাহার উপর খাদ্যাভাব ও প্রচণ্ড শীতে লাল পণ্টনের শত্রুকে বাধা দিবার ক্ষমতা প্রায় অন্তর্হিত হইল। উপর ট্রট‍্স্কী নিযুক্ত সেনাপতিরা বিশ্বাসঘাতকতা করিতে লাগিল, সৈন্যদল বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়া আত্মসমর্পণ করিতে লাগিল। ফলে ছত্রভঙ্গবৎ লালপল্টন বিশদিনে প্রায় দুইশত মাইল হটিয়া আসিল। ১৮ হাজার সৈন্য হতাহত হইল। অনেক কামান ও মেসিন গান শত্রুর হাতে পড়িল। শত্রুসৈন্য ভাইটকার দ্বারদেশে আসিয়া পড়িল।

 লেনিন বৈপ্লবিক সমর পরিষদের নিকট তার করিলেন, “প্রেমের নিকটবর্ত্তী অঞ্চল হইতে আমরা পার্টির পক্ষ হইতে অনেক রিপোর্ট পাইয়াছি। সৈন্যদলে প্রবল পানাসক্তি ও নানারূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে। আমি ষ্ট্যালিনকে তথায় পাঠাইবার কথা চিন্তা করিতেছি।” তিনি আর এক তারে ট্রট্‌স্কীকে জানাইলেন, “ষ্ট্যালিনকে না পাঠাইয়া উপায় নাই।” রণাঙ্গণের অবস্থা দেখিয়া ট্রট্‌স্কী অপ্রস্তুত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তিনি সম্মতি দিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ষ্ট্যালিন ও ঝেরঝিনিস্কিকে নির্দ্দেশ দিলেন, “প্রেমের পতনের কারণ এবং উরাল রণক্ষেত্রে আধুনিক পরাজয়ের কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিতে হইবে এবং সামরিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা স্থাপন করিতে হইবে।” কিন্তু ট্রট্‌স্কী জানিলেন, যে সৈন্যদলের মধ্যে মদ্যপানের আধিক্য হেতু যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে, ষ্ট্যালিন তাহার প্রতিকারের জন্য পানশালাগুলি বন্ধ করিতে যাইতেছেন।

 ১৯১৯-র ৫ই জানুয়ারী লেনিন নিম্নলিখিত তার পাইলেন, “তদন্ত আরম্ভ করিয়াছি এবং ইহার বিবরণ আপনাকে জানাইব। বর্ত্তমান মুহূর্ত্তে তৃতীয় সৈন্যদলের ৩০ হাজারের মধ্যে মাত্র ১১ হাজার অবসন্ন সৈন্য রহিয়াছে। ইহারা শত্রুর সম্মুখীন হইবার সম্পূর্ণ অযোগ্য। ট্রট্‌স্কী যে নূতন সৈন্যদল পাঠাইয়াছেন, তাহাদিগকে বিশ্বস্ত বলিয়া মনে হইতেছে না, প্রেরিত রংরূটের মধ্যে কতকগুলি লোক সম্পূর্ণ অনুগত নহে। ভাইট্‌কা বিপন্ন, উহা রক্ষা করিতে হইলে অবিলম্বে তিনদল বিশ্বস্ত সৈন্য প্রেরণ করা আবশ্যক। আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর উপযুক্ত চাপ দিন অন্যথায় ভাইট্‌কায় প্রেমের পুনরভিনয় হইবে। ইহাই স্থানীয় সহকর্মীদের অভিমত।”

ভাইট্‌কা
৫ই জানুয়ারী,
১৯১৯।

 স্বা: ষ্ট্যালিন, ঝেরঝিনিস্কি।

 তারের উত্তরে বার শত বাছা বাছা লোক এবং দুইদল অশ্বারোহী সৈন্য ভাইট্‌কায় প্রেরিত হইল এবং জানুয়ারী মাসের মধ্যে আব এক সাম্যবাদী দল প্রেরিত হইল। সংখ্যায় সামান্য হইলেও ইহাদের লইয়া ষ্ট্যালিন নগর রক্ষার ব্যবস্থা করিলেন এবং উভয় সৈন্যদলকে সুগঠিত করিয়া প্রচণ্ডভাবে শত্রুকে আক্রমণ করিলেন। শত্রু সৈন্য বিধ্বস্ত ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ণ করিল।

 আর এক নূতন বিপদ দেখা দিল। জুডেনিচ, চালিত বাহিনী জেনারেল কোলচাকের আদেশে পেট্রোগ্রাড অধিকার করিতে অগ্রসর হইল। এস্তোনিয়ান ও ফিন সৈন্যদল সহ ব্রিটিশ নৌবহরের সমর্থনে জুডেনিচ অকস্মাৎ পেট্রোগ্রাড আক্রমণ করিলেন। রাশিয়ার উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দুর্গগুলির সৈন্যরা প্রকাশ্যে সোভিয়েট শত্রুদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করিতে লাগিল। লাল পণ্টন হটিয়া আসিতে লাগিল। কেন্দ্রীয় কমিটি ষ্ট্যালিনকে আহ্বান করিলেন। ষ্ট্যালিন পেট্রোগ্রাডে ফিরিয়া আসিয়া প্রথমে সাম্যবাদী বিপ্লবীদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ করিলেন এবং কেহ পলাইয়া শত্রুপক্ষে যোগ দিতে না পারে তাহার জন্য পাহারার বন্দোবস্ত করিলেন। তারপর পাঁচবৎসরের রণশ্রান্ত, জীর্ণশীর্ণ দেহ. মলিন ছিন্ন বসন পরিহিত অথচ সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণীত সৈন্যদল লইয়া ষ্ট্যালিন শত্রুবাহিনীর সম্মুখীন হইলেন। নিজে সমরনীতিক না হইয়াও এবার তিনি সেনাপতিরূপে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। আর একটা ঐতিহাসিক অঘটন ঘটিল। তিনি লেনিনকে তার করিলেন, “ক্রাসানিয়। গোর্কা, সেরায়ালোসাদ্ অধিকৃত হইয়াছে। সমস্ত দুর্গ এবং সামরিক ঘাঁটিতে দ্রুত শৃঙ্খলা স্থাপিত হইয়াছে। নৌ-বিশেষজ্ঞগণ বলিতেছেন যে ক্রাসানিয়া গোর্কা দখল করিয়া আমরা নৌ-বিজ্ঞানের সমস্ত ধারণা বদলাইয়া দিয়াছি। বিজ্ঞান বলিতে ইহারা কি বুঝে তাহা আমার বুদ্ধির অগম্য। গোর্খা দ্রুত দখল করিয়া আমি জলে-স্থলে যুদ্ধ পরিচালনার পূর্ব্ব আদেশ বাতিল করিয়া দিয়াছি এবং আমাদের নূতন আদেশ মত কার্য্য করিতে নির্দ্দেশ দিয়াছি। আমি ইহা আপনাকে জানান আবশ্যক মনে করি, কেননা আমার রণবিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও আমি ভবিষ্যতে এইভাবে কাজ করিব।” যুদ্ধ ক্ষেত্রের দৃশ্য পরিবর্ত্তিত হইল। যে সকল সৈন্যদল শত্রুপক্ষে যোগ দিয়া ছিল তাহারা দলে দলে সাম্যবাদী দলে যোগ দিতে লাগিল। প্রতিআক্রমণে অস্থির হইয়া শত্রু সৈন্য হঠিতে লাগিল। তাহারা গ্রেটব্রিটেনের সাহায্যের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করিতে লাগিল, কিন্তু সে সাহায্য আসিল না। ষ্ট্যালিন জয়যুক্ত হইয়া ফিরিয়া আসিলেন।

 ১৯১৯ সাল সোভিয়েট রাশিয়ার চরম সঙ্কটের দিন। ব্রিটিশ ও ফরাসী সমর-নায়কগণের সাহায্য ও সমর্থন পাইয়া জেনারেল ডেনিকিন সমগ্র দক্ষিণ রাশিয়া আক্রমণ করিতে লাগিলেন। গৃহযুদ্ধে রাশিয়া তখন অত্যন্ত বিপন্ন। তিন চতুর্থাংশ কলকারখানা ধ্বংস হইয়াছে। কাঁচামালের অভাব এবং আভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলাও কম নহে। এই অবস্থার মধ্যে কোলচাক সাইবেরিয়া অবরোধ করিয়াছেন। ডেনিকিন দক্ষিণ দিক হইতে অগ্রসর হইতেছেন। ব্রিটিশ রণতরী বহর ফিনিশ উপসাগরে দাঁড়াইয়া। পরাজয়, বিশৃঙ্খলা ও অন্তবিপ্লবে ছিন্নভিন্ন রাশিয়ার নবোদিত স্বাধীনতা-সূর্য্য অস্তমিত হইবার উপক্রম। টুট‍্স্কী ভীতি-বিহ্বলের মত জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জনগণকে ভুলাইয়া রাখিবার মধ্যে সান্ত্বনা লাভ করিতে লাগিলেন। লেনিন বাগ্মীতার উপর বিশেষ ভরসা রাখিতে পারিলে না। কেননা, ডেনিকিনের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই দলে দলে কসাক দস্যুরা লুতরাজ শুরু করিল। টুলা হইতে মস্কো পর্য্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন বিপন্ন তখন ট্রট‍্স্কী শত্রু-সৈন্যের পার্শ্বদেশ আক্রমণ করিবার জন্য দক্ষিণ ভল‍্গা হইতে জারিথসিন পর্য্যন্ত সৈন্য সমাবেশের নির্দ্দেশ দিলেন। কিন্তু কি ডেনিকিন, কি দুর্দ্ধর্ষ জেনারেল র‍্যাঙ্গেল, জুডেনিচের মত অস্থিরচিত্ত ভীরু ছিলেন না। তাঁহাদের সম্মুখীন হইবার জন্য ট্রট‍্স্কীর ব্যবস্থা ষ্ট্যালিনের মনঃপূত হইল না।

 কেন্দ্রীয় কমিটি ষ্ট্যালিনকে আহ্বান করিলেন। বারংবার সাফল্যে আত্মপ্রত্যয়ে বিশ্বাসী ষ্ট্যালিন এবার আর রাথিয়। ঢাকিয়া কথা বলিলেন না! ঘটনা স্থলে যাইবার পূর্ব্বে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে তিনটী সর্ত্ত দিলেন। প্রথম—দক্ষিণ রণক্ষেত্রে ট্রট‍্স্কী হস্তক্ষেপ করিবেন না, দ্বিতীয় ট্রট‍্স্কীর নির্ব্বাচিত সেনা-নায়কদের প্রয়োজন হইলে সরাইয়া দিয়া তিনি নিজের মনোমত লোক নিযুক্ত করিবেন। তৃতীয়—ষ্ট্যালিন যে সকল নেতা ও কর্ম্মীকে প্রয়োজন বোধ করিবেন তাঁহাদিগকে অবিলম্বে রণক্ষেত্রে প্রেরণ করিতে হইবে। কেন্দ্রীয় কমিটি ইহাতে পূর্ণ সম্মতি দিলেন। এই প্রথম ষ্ট্যালিন ট্রট্‌স্কীকে প্রকাশ্যভাবে পশ্চাতে ঠেলিয়া দিলেন। ট্রট‍্স্কীর রণ-পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বদলাইয়া ষ্ট্যালিন সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে লইলেন। ১৯১৯-র অক্টোবর মাসে ডেনিকিন ওরেলে উপস্থিত, মস্কো বিপন্ন। ষ্ট্যালিন বুডেনী ও টিমোশিঙ্কোকে লইয়া রণক্ষেত্রে দেখা দিলেন। বুডেনী চালিত লাল অশ্বারোহী সৈন্যদলের আক্রমণে ডেনিকিন ওরেল ছাড়িয়া ক্যাষ্টোরনায়ায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। পার্শ্বদেশ হইতে টিমোশিঙ্কোর বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ডেনিকিনের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হইল। খারকোভ, রষ্টভ হইতে উৎখাত হইয়া ডেনিকিনের সৈন্যদল কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত হটিয়া গেল। ইউক্রেন ও উত্তর ককেশিয়া শত্রুকবল মুক্ত হইল। এই সময় ষ্ট্যালিন লেনিনের নিকট যে সকল পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং সামরিক অভিজ্ঞতার বহু নিদর্শন রহিয়াছে। এই যুদ্ধের মধ্যেই ষ্ট্যালিন, ডনকসাকদের লইয়া অশ্বারোহী সৈন্যদল গঠন করেন এবং রক্ষণশীল রণনীতির পরিবর্ত্তন করিয়া শত্রুর উপর অকস্মাৎ ঝাঁপাইয়া পড়িবার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝটিকাবাহিনী গঠন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যে যান্ত্রিক বাহিনী এত প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছে, ষ্ট্যালিনই তাহার আদি স্রষ্টা। ইংরাজ সেনাপতি মেজর হুভার লালপণ্টনের ইতিহাস লিখিতে গিয়া বলিয়াছেন, “এই সৈন্যদল (ষ্ট্যালিন গঠিত) ইতিহাসের প্রথম যান্ত্রিক বাহিনী বলিয়া দাবী করিতে পারে। তখন অশ্বারোহী সৈন্যদলের পরিপূরক হিসাবে ইহার গঠন ও পরিচালনে সর্ব্ববিধ মোটরযান ব্যবহৃত হইয়াছিল।”

 অন্যদিকে আত্মাভিমানী ও লুব্ধভাগ্যান্বেষী জেনারেল র‍্যাঙ্গেল ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের নিকট প্রচুর অর্থ, সৈন্য ও রসদ পাইয়া ক্রিমিয়। হইতে পোলাণ্ডে গেলেন এবং ভোনেক্স ঘাঁটি হইতে সমস্ত দক্ষিণ অঞ্চল আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। লেনিন ষ্ট্যালিনকে জানাইলেন, “কেন্দ্রীয় সমিতি বিভিন্ন যুদ্ধ-স্থলকে ভাগ করিয়া দিয়াছেন; অতএব তুমি কেবলমাত্র র‍্যাঙ্গেলের বিরুদ্ধে, অগ্রসর হও।” রুগ্ন দেহ লইয়াও ষ্ট্যালিন বিপ্লবী সামরিক সমিতির সদস্যরূপে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার উৎসাহে পরিচালিত লাল পণ্টন কিয়েভ এবং ইউক্রেন হইতে পোল সৈন্যদিগকে তাড়াইয়া দিল। ষ্ট্যালিন গঠিত প্রথম অশ্বারোহী সৈন্যদল আশ্চর্য্য ক্ষিপ্রতার সহিত শত্রুকে দলিত করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। কিন্তু ওয়ারশর নিকটে লাল পল্টনকে পরাজিত করিয়া পোল সৈন্যরা অশ্বারোহী সৈন্যদলের গতিরোধ করিল।

 ট্রট‍্স্কী ওয়ারশতে লালপণ্টনের সাহায্যার্থে বুডেনীকে অগ্রসর হইবার আদেশ দিলেন। কিন্তু তিনি পশ্চাদ্ভাগ রক্ষার এবং সরবরাহের কোন ব্যবস্থা না করায় অবস্থা সঙ্গীন হইয়া উঠিল। ফরাসী জেনারেল ওয়েগাঁর নেতৃত্বে চালিত পোল সৈন্য এই দুর্ব্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিল। ভরোশিলভ ও বুডেনী বহুকষ্টে লাল পল্টনকে শত্রুর বেষ্টনী হইতে রক্ষা করিলেন। পোলদের পশ্চাতে বৃটেন ও ফ্রান্সের সমর্থন ও সাহায্য ছিল। বৃটিশ গভর্ণমেণ্ট সোভিয়েট বিরোধী যুদ্ধে ১০ কোটী পাউণ্ড ব্যয় করিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে ইংলণ্ডে, রাশিয়ায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রবল হইল। লণ্ডন ডকের শ্রমিকরা ‘জলি জর্জ্জ’ জাহাজে পোলাণ্ডের জন্য অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করিতে অস্বীকার করিল। গ্রেটবৃটেন আর সাহায্য করিতে পারিল না। রণশ্রান্ত পোল সৈন্যের সহিত ১৯২০-র অক্টোবর মাসে সন্ধি হইল। কিন্তু এই সন্ধিতে সোভিয়েট রাশিয়াকে গ্যালিসিয়া ও বাইলো—রাশিয়ার কিয়দংশ ছাড়িয়া দিতে হইল।

 এই সকল সংঘর্ষের মধ্যে ষ্ট্যালিনের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা এবং ক্ষিপ্র কর্ম্মকৌশল দেখিয়া অনেকে চমৎকৃত হইলেন। কিন্তু যাঁহারা ঘনিষ্ঠভাবে এই মনুষ্যটিকে জানিতেন, তাঁহারা দেখিলেন যে অদ্ভুতকর্ম্মা ষ্ট্যালিন ক্ষেত্রান্তরে এক নূতন কর্ম্মক্ষেত্রে তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ নৈপুণ্য প্রয়োগ করিতেছেন মাত্র। এই বলশেভিক-নেতা সাফল্যের রহস্য জানিতেন এবং বাস্তবক্ষেত্রে তাহাকে পূর্ণতা দান করিয়াছিলেন। ষ্ট্যালিন অযোগ্যতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং বন্ধুর ছদ্মবেশে কার্য পণ্ড করিবার চেষ্টার বিরুদ্ধে ছিলেন নিষ্ঠুর, আবার এমন ঘটনাও দেখা গিয়াছে যে বিনা প্রমাণে বা অল্প প্রমাণে প্রতি-বিপ্লবী বলিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিনি দণ্ড হইতে রক্ষা করিয়াছেন।

 ইউরোপের এই দুঃসময়ে যখন এক একটা জাতির ভাগ্য কূটনীতিবিশারদগণের ক্রীড়াকন্দুকে পরিণত, যখন মানুষের ধন, মান, জীবনের কোন মূল্য নাই, যখন মানুষ ইচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, এক মহা ঘুর্ণিপাকে পড়িয়া বিব্রত, সামাজ-সংহতি বিশ্লিষ্ট, ন্যায়-নীতি-দয়া-ধর্ম্ম পদদলিত, তখন মনুষ্য-জীবনের মূল্য কতটুকু? সামান্য সন্দেহে “তরাসে নিষ্ঠুর” মানুষ মানুষের প্রাণ লইতে অনুমাত্র দ্বিধা করিত না। সেই পটভূমিকার দিক হইতে যদি আমরা সমাজতন্ত্রবাদকে বিচার করি, তাহা হইলে দেখিব সেই দুর্দ্দিনেও কম্যুনিষ্টরা বৃহৎ মনুষ্যত্বের দাবী ভোলেন নাই। মানুষের দুঃখ-দৈন্যকে তাঁহারা লাঘব করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। মনুষ্য-জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃই তাঁহারা এক শ্রেণীর লোককে অন্যায় হইতে বিরত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। একটী লোককে আঘাত করিয়া সহস্র বা লক্ষ লোকের জীবন রক্ষা এবং ভবিষ্যতে এমন সমাজ-ব্যবস্থা পত্তন করা যেখানে মানুষ-মানুষ শিকার করিবেনা অথবা মানুষকে ব্যক্তিগত দাসে পরিণত করিবেনা, ইহাই ছিল ষ্ট্যালিনের লক্ষ্য।

 বিপ্লব বিনা রক্তপাতে হয় না। ইতিহাসে প্রত্যেক বিপ্লবই নরশোণিতস্নাত ফরাসী বিপ্লব নৃশংসতায় নিষ্ঠুরতায় নির্ম্মম হইয়াও ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষকে শান্তি ও মুক্তির পথ প্রদর্শন করিয়াছিল। রুশবিপ্লবও তাহার শত্রুকে নির্ম্মম হস্তে দমন করিয়াছে। আর এক দিকে সে কৃষক ও শ্রমিকদিগকে শতাব্দীচয়ব্যাপী দাসত্বের নৈরাশ্য হইতে উদ্ধার করিয়াছে! ১৯৩১ সালের শেষ ভাগে ষ্ট্যালিন লিখিয়াছেন, “যখন বলশেভিকরা শাসনভার হাতে লইল তখন হইতেই শত্রুদের প্রতি তাহারা উদারতা দেখাইয়াছে। মেনশেভিকরা বৈধ প্রতিষ্ঠান রাখিবার এবং সংবাদপত্র পরিচালনার অধিকার পাইয়াছিল। রিভলিউশনারি স্যোশালিষ্ট এবং নিয়মতান্ত্রিক, গণতন্ত্রীদলকেও তাহাদের সংবাদপত্র প্রকাশ করিতে দেওয়া হইত। পেট্রোগাড দখল করিবার জন্য জেনারেল ক্রাসনফ্ তাঁহার প্রতি-বিপ্লবী দল লইয়া যখন অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং আমাদের হাতে বন্দী হন, তখন যুদ্ধের নিয়মানুসারে অন্ততঃ আমরা তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিতে পারিতাম, এমনকি আমাদের উচিত ছিল তাঁহাকে গুলি করিয়া হত্যা করা, কিন্তু আমরা তাঁহাকে সর্ত্তাধীনে মুক্তি দিয়াছিলাম। তাহার ফল কি হইয়াছিল? আমরা দেখিলাম এই উদার ব্যবহারের সুযোগ লইয়া সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের শক্তি ও প্রতিষ্ঠাকে আঘাত করিবার চেষ্টা হইয়াছিল। শ্রমিকশ্রেণীর শত্রুর প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করিয়া আমরা ভুল করিয়াছিলাম। যদি আমরা সর্ব্বক্ষেত্রে এইরূপ উদারতা দেখাইতাম তাহা হইলে আমরা শ্রমিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপরাধ করিতাম এবং তাহাদের স্বার্থ বিরোধী কার্য্য করিতাম। আমরা অনতিবিলম্বেই বুঝিলাম, শত্রুদের প্রতি দয়া ও উদারতা প্রদর্শনের ফলে তাহারা আমাদের প্রতি অধিকতর নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করিতে লাগিল। দয়াকে তাহারা দুর্ব্বলতা মনে করিল। অল্পদিনের মধ্যেই বলশেভিক দল বিরোধী বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রীদল ও মেনশেভিকেরা মিলিয়া পেট্রোগাড সামরিক বিদ্যালয়ের ছাত্রগণকে বিদ্রোহী করিয়া তুলিল; ফলে আমাদের বিপ্লবী নৌ-সৈন্যের বহু ব্যক্তি অকারণে প্রাণ হারাইল। যে ক্রাসনফকে আমরা ছাড়িয়া দিয়াছিলাম, সে হোয়াইট কসাকদের সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া মেমনটফের সহিত যোগ দিয়াছিল এবং দুই বৎসর সোভিয়েটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিল।···অতএব অতিরিক্ত ভদ্র হইয়া আমরা ভুল করিয়াছিলাম।’

 ১৯১৮—২০ এই দুই বৎসর প্রাণপণ সংগ্রাম করিয়া লালপণ্টন জয়ী হইল। কৃষক-শ্রমিক গঠিত সৈন্যদল অকুতোভয়ে যুদ্ধ করিয়াছে। অত্যন্ত সঙ্কটেও বিশ্বাস হারায় নাই। তাহাদের আদর্শনিষ্ঠা ছিল অতুলনীয়। পক্ষান্তরে হোয়াইট রাশিয়ান প্রতি-বিপ্লবীদের মধ্যে রাজনৈতিক মতের কোন ঐক্য ছিলনা। কেহ চাহিত নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র, কেহ রাশিয়ার সিংহাসনে একজন জার বসাইবার স্বপ্ন দেখিত, কেহ বা ফরাসী, কেহ বা মার্কিন আমেরিকার নকলে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কল্পনা করিত। আর তাহাদের সাহায্যদাতা ও পরামর্শদাতা বৃটেন ও ফরাসীর চরগণের রাশিয়ায় ব্যবসাবণিজ্যে সুবিধালাভ ছাড়া আর কোন চিন্তা ছিল না। বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থান্বেষীদের সম্মেলনে প্রতি-বিপ্লবীদল ভিতরের দুর্ব্বলতা ও দুর্নীতির জন্য ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল।