(পৃ. ১৮-২১)
◄  
  ►

 বিষ্ণু জগতের রক্ষাকর্ত্তা। তিনি নারদকে ডাকিয়া বলিলেন, “ব্রহ্মা ত সৃষ্টি করিয়াই দায় হইতে মুক্ত, এই জগৎকে রক্ষা করা কিরূপ শক্ত তাহা ত তিনি জানেন না। পুত্রটি অতিরিক্ত আদরে নষ্ট হইতেছে, ইহার দুর্গতির সীমা পরিসীমা থাকিবে না। আমার সে সকল কথা এখন আত্মীয়তা-স্থলে না বলাই ভাল, কিন্তু পৃথিবীর রক্ষার একটা উপায় ত করিতে হইবে। তুমি বৈবস্বত মনুর পুত্র প্রিয়ব্রতকে যজ্ঞ করিতে বলিয়া আইল। সে অতি প্রবল রাজা, সাতবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়াছিল, প্রদক্ষিণ-কালে তাহার রথচক্রের ঘর্ষণে পৃথিবী ক্ষয়গ্রস্ত হইয়াছিল, সেই সপ্তরেখা সপ্ত-সিন্ধুতে পরিণত হইয়াছে। প্রিয়ব্রত জগতের রাজকুল-চক্রবর্ত্তী। বিশেষতঃ, সে দক্ষের শ্যালক। সম্ভবতঃ, সে সাহসী হইয়া যজ্ঞারম্ভ করিতে পারে।”

 নারদের বীণাধ্বনি শুনিয়া প্রিয়ব্রত দিগ্বিজয়ে যাত্রা স্থগিত করিয়া দেবর্ষির আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। স্বর্গপ্রদেশ অপূর্ব্ব বীণাঝঙ্কারে নাদিত করিয়া দিব্যপ্রভা-মণ্ডিত ঋষিপ্রবর প্রিয়ব্রতের প্রাসাদে অবতীর্ণ হইলেন। নারদ তাঁহাকে গোপনে বিষ্ণুর অভিপ্রায় জানাইলেন। কিছুকাল নীরব থাকিয়া—প্রিয়ব্রত বলিলেন, “যাহার দেহ কোন ভৌতিক উপাদানে নির্ম্মিত নহে, যিনি সচ্চিদানঙ্গ-বিগ্রহ, এমন দেবাদিদেব শিবের নমস্য আবার কে থাকিবে? দক্ষ প্রজাপতি পাগল হইয়াছেন—শিবহীন বিশ্ব দগ্ধ হইতে উদ্যত, আমি পৃথিবীকে সরস রাখিবার জন্য যে সপ্তসিন্ধু প্রস্তুত করিয়াছি, রুদ্রের অপমানে বারিরাশি ধূমের ন্যায় উড়িয়া যাইতেছে, আর কিছুকাল পরে তাহা শুষ্ক হইয়া যাইবে। শিবহীন বিশ্ব বাস-যোগ্য নহে। আমি শিবহীন যজ্ঞ কখনই করিতে সমর্থ নহি। বিষ্ণু ঘরের কলহ মিটাইয়া আমাকে যে আদেশ করিবেন, তজ্জন্য আমি সকলই করিতে প্রস্তুত। কিন্তু দেবসমাজের এই বিদ্বেষ-বহ্নিতে পুড়িয়া মরিবার জন্য আমিই সর্ব্বপ্রথম পতঙ্গ হইতে স্বীকৃত নহি।”

 বীণা বাজাইতে বাজাইতে নারদ বিষ্ণুকে যাইয়া প্রিয়ব্রতের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিলেন। বিষ্ণু এই সংবাদে একটু চিন্তান্বিত হইয় পড়িলেন।

 ‘দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং প্রথম যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন না কেন? দক্ষ প্রজাপতি, বৃহস্পতি, ভৃগু ও সপ্তর্ষিমণ্ডলী তাঁহার সহায়, তিনি দক্ষের দৌহিত্র; ভীত হইবার পাত্র নহেন। নারদ, তুমি দেবরাজকে আমার আদেশ জানাইয়া আইস। দেবরাজ স্বয়ং যজ্ঞ করিলে নরলোকে যজ্ঞানুষ্ঠানে আর কোন বাধা থাকিবে না।’

 ইন্দ্র নারদকে বলিলেন, “আমি শিবহীন যজ্ঞ সর্ব্বপ্রথম করিতে সাহসী নহি। শিবের পিণাক অমরাবতীর সর্বপ্রথম ভিত্তিস্বরূপ। ত্রিপুরাসুরকে বধ করিয়া এই সিংহাসনে শিবই আমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। বিষ্ণু আমাকে কেন এই বিপজ্জনক ব্রতে ব্রতী হইতে অনুরোধ করিতেছেন? দেবগণ বহুদিন যজ্ঞভাগ পান নাই—তাঁহারা ক্ষীণপুণ্য হইয়া পড়িতেছেন, কিন্তু আমি কি করিব? আমি এ সম্বন্ধে কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। আপনি অন্যত্র চেষ্টা দেখুন।”

 নারদ এই উত্তর লইয়া আর বিষ্ণুর নিকট গেলেন না, তিনি স্বয়ং আর একটা উপায় উদ্ভাবন করিলেন।

 দক্ষের গৃহে উপনীত হইয়া নারদ দক্ষকে প্রণামপূর্ব্বক দাঁড়াইয়া রহিলেন। দেবশিল্পিনির্ম্মিত বহুমূল্য রোমজ পরিচ্ছদে দক্ষের সুদীর্ঘ দেহ মণ্ডিত, তাঁহার কান্তিতে প্রখর দেব-প্রভা, তাহা হইতে সৌরকরজ্বালা বিচ্ছুরিত। ললাটের শিরা স্ফীত, নেত্রে দর্প, ওষ্ঠ ও হনুতে বাগ্মিতার চিহ্ন। অহঙ্কারে স্ফীত মুখমণ্ডলে সর্ব্বদা জগতের প্রতি উপেক্ষার ভাব বিদ্যমান। নারদকে দেখিয়া দক্ষ প্রজাপতি বলিলেন, “নারদ, তুমি কি শোন নাই, পিতা আমায় সমস্ত প্রজাপতিগণের উপরে আধিপত্য প্রদান করিয়াছেন। তোমার ঘটকালীতে সতী-মেয়েটাকে একেবারে ভরাডুবী করিয়াছি, ভাঙ্গর বেটা বিশেষ অপদস্থ হইয়াছে। দেবসমাজে আর তাহার স্থান নাই, যজ্ঞভাগ কেহ আর তাহাকে দেয় না—সে একেবারে দেবসমাজ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে।”

 নারদ বলিলেন, “শিব আর কি অপদস্থ হইয়াছেন! শিবহীন যজ্ঞ আর কেহই করিতে সাহস পাইতেছে না। আপনার নিষেধ-বিধিতে এই লাভ হইয়াছে, দেবতাদের মধ্যেও আর কেহ যজ্ঞভাগ পাইতেছেন না। তাঁহারা ক্ষীণ-পুণ্য হইয়া পড়িয়াছেন। ধরিত্রী যজ্ঞহীন হইতে প্রপীড়িত হইতেছেন। পুষ্কর, শম্বর ও আবর্ত্ত প্রভৃতি মেঘমণ্ডল অন্তঃসারশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। মহার্ণব জলহীণ হইয়া যাইতেছেন। বরুণের রাজ-কোষ শূন্য। হোমাগ্নির অভাবে মরুৎ-মণ্ডল দূষিত হইয়া পড়িয়াছে। শিবের কিছুই ক্ষোভ হয় নাই। নন্দী সিদ্ধি ঘুটিতেছে, আপনার ভাঙ্গড় জামাতার চিরাভ্যস্ত মহানন্দের কোনই ত্রুটি নাই। বিষাণে ওঙ্কার ধ্বনিত হইতেছে এবং কর্ণাবলম্বী ধুস্তূর-পুষ্পের ঘ্রাণে তিনি মাতোয়ারা হইয়া আছেন।”

 দক্ষের ভ্রূ কুঞ্চিত হইল, তিনি গর্ব্বিত কণ্ঠে বলিলেন, “কি? আমি প্রজাপতিগণের অধীশ্বর দক্ষ সহায় থাকিতে শিবহীন যজ্ঞ করিতে কেহ সাহসী হইতেছেন না? এ বড় আশ্চর্য্য কথা। যাহা হউক, আমি এই বিষয়ের উদ্যোগী হইয়া দেবসমাজকে শিক্ষা দিব। নারদ, তুমি প্রচার করিয়া দাও, আমার গৃহে বাজপেয় ও বার্হস্পত্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান হইবে। ত্রিজগৎ নিমন্ত্রিত হইবে। সুধু কৈলাসপুরী বাদ দিয়া তুমি সর্ব্বত্র নিমন্ত্রণ প্রচার কর।”