সময় অসময় নিঃসময়/কালবেলার কথকতা

কালবেলার কথকতা

 যা অবধারিত, তা-ই হলো। রাঘববোয়ালের রাক্ষুসে খিদেয় মুছে গেল আরেকটি পুঁটি মাছের অস্তিত্ব। শক্তের ভক্ত এই দুনিয়ায় অনেকেই তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করল এই মনোরম দৃশ্য। যে-পথে গেছে আফগানিস্তান কিংবা তারও আগে যুগোশ্লাভিয়া বা চেকোস্লোভাকিয়া নামে প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সে-পথেই গেল ইরাক। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ধারাবিবরণীর উত্তেজনাও নেই আর। যাদের ড্রয়িং রুমে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ভালো বিকল্প তৈরি হয়েছিল, তাদের এখন সময় কাটতে চায় না। উত্তর কোরিয়া নামক গোকুলটি তৈরি হচ্ছে, সিরিয়া-ইরানে উনুন গরম হয়নি এখনো; রুটি সেঁকার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি আসেনি। এখন ইরাকে লুটপাটের চাটনি আর সিয়া-সুন্নির ঝগড়ার পায়েস চেটেপুটে খাওয়া যেতে পারে।

 বুশ-ব্লেয়ারের যুগলবন্দি সেলিম-জাভেদ কিংবা লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের চেয়েও বক্স অফিসে ঢের বেশি হিট করেছে। নইলে আমাদের এই ভারতবর্ষের প্রান্তিক উত্তর-পূর্বের আধা-নাগরিক শহরেও ভাড়াটে কলমচিদের হুক্কা হুয়া এত স্পষ্ট হয়ে উঠত না। বিশ্বায়নের এমন চমৎকার সঙ্গত কোকাকোলা-পেপসির হিজড়ে-সেনারাও করতে পারেনি। মার্কিন প্রভুর নেকনজরে পড়ার জন্যে কী ব্যাকুল সম্পাদকীয়, সংবাদ পরিবেশনের কী বাহার! সাদা-চামড়ার মালিকেরা যদি কখনও বাতাসা ছুঁড়ে দেয়, এই আশায় বুক বেঁধে নিজেদের বাদামি-চামড়ায় নির্লজ্জ দাসত্বের, আত্মবিক্রয়ের শ্বেতীও প্রসাধন হিসেবে গ্রহণ করেছে এরা। সি.এন.এন, বি.বি.সি-র স্বেচ্ছানিযুক্ত ভাষ্যকার হিসেবে আগাগোড়া বজায় রেখেছে হুক্কা হুয়ার ঐকতান।

 অথচ পাশাপাশি তখন দেশে দেশে, এমনকী, বুশ-ব্লেয়ারের আপন ভূমি নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন-শিকাগো-লণ্ডনেও হাজার হাজার যুদ্ধবিরোধী মানুষ সভ্যতা-গ্রাসী সংস্কৃতিগ্রাসী নব্য সাম্রাজ্যবাদের দানবিক হিংস্রতার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে। কিন্তু ইতিহাস ও মনুষ্যত্বের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে যে বেপরোয়া দাম্ভিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদীরা, তাদের কাছে জনগণ অর্থহীন। শিঙে বসে-থাকা মশা-মাছিকে যতখানি তাচ্ছিল্য করে ষাঁড়, তার চেয়ে ঢের বেশি অবজ্ঞা দেশ-বিদেশের যুদ্ধবিরোধী জনতাকে করেছে ওই ঘৃণিত পিশাচেরা। ওদের চাই ইরাকের অঢেল তেল-সম্পদ, যে করেই হোক! এইজন্যে ওরা মিথ্যার পাহাড় গড়েছে, রাষ্ট্রসকে ছেড়া ন্যাকড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলেছে আস্তাকুঁড়ে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন পর্যায় শুরু করেছে অস্ত্রহীন অসহায় ইরাকের ওপর যথেচ্ছ মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইঙ্গ-মার্কিন জল্লাদের হানাদারি শুরু হওয়ার আগে ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া-চীন যতই ঘেউ ঘেউ করুক, এখন তাদের গলায় মিনি বেড়ালের মিহি মাও-মাও। ইরাকের শবদেহের ওপর শকুন ও হায়েনাদের অধিকার মেনে নিয়েই ওইসব রাষ্ট্র এখন চাইছে অন্তত কয়েক টুকরো মাংস খাওয়ার সুযোগ।

 বড়ো চমৎকার অজুহাত: ইরাকের পুনর্গঠন। বারো বছর ধরে যাদের ভাতে মেরেছে মার্কিন প্রভুত্ববাদ, সেই ছিবড়ে হয়ে-যাওয়া ইরাকিদের ওপর হাজার হাজার বোমা ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে, তাদের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন ধ্বংস কিম্বা লুণ্ঠন করে দেখাতে চাইছে, যার শিল তারই নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া: এই হবে একুশ শতকের একমাত্র নীতি। ইরাকের অফুরন্ত তরল সোনা এখন থেকে ওই পুনর্গঠনের সূত্রে মজুত হবে মার্কিন প্রভুর ভাঁড়ারে। স্বাধীনতা বা মুক্তি এখন শয়তানের পদাবলী; চরম ঔদ্ধত্য নিয়ে মার্কিন ঘাতকেরা অশ্বেতাঙ্গ দেশে-দেশে ঝাপিয়ে পড়বে। অজগর সাপের ঐক্যনীতি অনুযায়ী গিলে খাবে প্রতিটি দুর্বল দেশের সার্বভৌমত্ব। ওরা প্রয়োজন মতো সত্য, মুক্তি ইত্যাদি উৎপাদন করবে। সর্বাধুনিক তথ্য-বিনোদন প্রযুক্তির মায়ায় আচ্ছন্ন জনদের মনে দৃঢ় প্রোথিত হয়ে গেছে নব্য উপনিবেশ। এরা ডলারের মেকি স্বপ্নে বুদ হয়ে বিশ্বায়নের স্তোত্রপাঠক হতে পারে। একই ছাঁচে ঢালাই হয়ে ইতিমধ্যে যাবতীয় উচ্চাবচতা মুছে যেতে বসেছে। সার্বভৌমত্ব এখন অনাবশ্যক যেহেতু আমেরিকার ইচ্ছাই বিশ্ব জুড়ে একমাত্র আইন। ইরাকের ঘটনাবলী বহু কিছু চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে গেছে।

 আধুনিকোত্তর রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, জীববিশ্ব, ব্যবহারবিধি ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা অদূর ভবিষ্যতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্বকথা লিখবেন, তাদের ‘নিরপেক্ষতা বা ‘দায়বদ্ধতা নিয়ে হয়ত বা চুলচেরা বিতর্ক হবে। কিন্তু এইসব কী কাজে লাগবে বসরায়-বাগদাদে মৃত কিংবা মৃতবৎ পঙ্গু হয়ে-যাওয়া নারী-শিশু ও সর্বস্বান্ত জনদের? নাকি সাময়িক উত্তেজনার আগুন-পোহানো শেষ হয়ে গেলে ভোগবাদী জমানার প্রতীত বাস্তবে প্রতীত নাগরিক শুধু হতে থাকবে আমজনতা! পি-পু-ফি-শু নীতি অনুযায়ী মার্কিন প্রভুদের চরণদাস হওয়ার জন্যে নিবেদিত হবে কি আমাদের সমস্ত অধ্যবসায়? তাহলে ইতিহাস মুছে যাবে এখন, এই নির্মানবায়ন প্রক্রিয়ার তুমুল সন্ত্রাসে? এই জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য মীমাংসা আমাদের কাছই রয়েছে, অন্য কোথাও নয়। দানবিক শক্তির দম্ভে যারা স্বাতন্ত্র-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-মানবিকতাকে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আগুনে ইন্ধন করে তুলেছে—এরাই আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বনাম সাধারণ জনগণের বিশ্বব্যাপ্ত প্রধান দ্বন্দ্বকে প্রকট করে তুলছে। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের ক্রমিক অগ্রগতির সত্য এই মুহূর্তে মিথ্যা প্রচার ও বারুদের কটু ধোঁয়ায় যতই ঝাপসা হতে দেখি না কেন, শেষ কথা মানুষই বলবে নিশ্চয়। বস্তুত এই ধোঁয়াশার মধ্যেও দেশে-বিদেশে শান্তিযোদ্ধা সংস্কৃতি-শ্রমিকেরা একজোট হয়েছেন, পথে-পথে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুত্ববাদের নয়া সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।

 একুশ শতকের তৃতীয় বছরে প্রমাণিত হলো, এই নতুন শতাব্দীতে সমগ্র মানব জাতির ঘৃণ্যতম শত্রু হলো বোম্বেটের দল। সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বসে যাওয়ার পরে পৃথিবীতে মার্কিনী গুণ্ডামি যেভাবে দেখা গেছে, তা সমস্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশের পক্ষে ভয়ানক বিপদের কথা। সোভিয়েট রাশিয়া যতদিন ছিল, নেকড়ে ও শকুনেরা এত দুঃসাহসী হয়ে ওঠেনি। গত কুড়ি বছরে এরা প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উস্কানি দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্র-স্বাধিকার-প্রগতি বারবার ধর্ষিত হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিশ্বায়নের ফাস। দখলদারির রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ বিশ শতকের শেষ কয়েকটি বছরে নিরঙ্কুশ হয়ে পড়েছে। আফগানিস্তানে ওসামা-বিন-লাদেন ও তালিবান তো মার্কিনীদের অপসৃষ্টি; পরে হাত থেকে আম বড়ো হয়ে গেল যখন, বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেণ্টাগন আক্রান্ত হল। এমন না ঘটলেও আফগানিস্তানকে ওরা ছারখার করতই। কারণ, ভূ-রাজনীতি ও তেল-অর্থনীতির বাধ্যবাধকতা। বিশ্ববিবেক যখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসকদের হাতে জিম্মা থাকে, লাখে-লাখে মানুষ মরলেও কাগুজে বিবৃতি আর কূটনীতির প্যাচ-পয়জার ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে, দেশে-দেশে, গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রযন্ত্র অবান্তর ও ভড়দের মহাসভা বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। উপগ্রহ-প্রযুক্তির ওপর দখলদারির সুযোগে বার্তাবাহী চ্যানেলগুলিকে সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে পাইক-বরকন্দাজে পরিণত করেছে, সংবেদনশীল মানুষেরা এদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।

 ইরাক-যুদ্ধে ইণ্টারনেটের ওপর শকুনের ছায়া পড়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বেয়াদব ওয়েবসাইটকে হয় মুছে দিয়েছে প্রভুত্ববাদীরা নয়তো এদের বিকৃত করেছে। তবু, বিকল্প সংবাদ বিকল্প বক্তব্য বিকল্প অবস্থান খুঁজে নেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী নিজেদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ঘোষণা করছেন। ইণ্টারনেটকে সদর্থক ভাবে কাজে লাগাতে না পারলে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে লাখ-লাখ মানুষ জমায়েত হতে পারতেন না। কালো জিউলানি শহিদ হতেন না; ইরাকে প্রসূতিসদন, গ্রন্থাগার ও প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরে লুঠতরাজের খবরও আমাদের কাছে পৌঁছাত না। একুশ শতক যদি আফগানিস্তান ও ইরাক ধর্ষণের কালো ছবি দিয়ে শুরু হয়ে থাকে, তা ইতিহাসের সম্ভাব্য নতুন অধ্যায় সূচনার প্রতি তো তর্জনি সংকেত করছে। এই অধ্যায়ে একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র, অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক জনগণের যুক্তফ্রণ্ট। যতদিন যাবে, এই প্রধান দ্বন্দ্ব আরও ব্যাপক ও শানিত হয়ে উঠবে। অন্তত এখনকার সংস্কৃতিকর্মী ও সমাজকর্মীদের ন্যূনতম ও প্রধানতম দায় বলে বিবেচিত হোক এই দ্বন্দ্বকে সচেতন ভাবে ব্যাপকতর ও শানিততর করে তোলা।

 হাতির গোদা পায়ের নিচে পিঁপড়ের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে যেসব মতলববাজেরা ‘যুদ্ধ’ বলে সম্রান্ত করতে চায়, ওদের ধারণা, এভাবেই ওরা দুনিয়ার তাবৎ বোকাসোকা ললাকেদের চোখে ঠুলি পরাতে পারবে। অন্তত, শয়তানি সাম্রাজ্যের শাহানশাহ বুশ ভয় দেখাতে পেরেছে তাদের যারা তাকে কুর্নিশ করে না, তার কথামতো ঘুঙুর পরে নাচে এবং হিজড়ে ও বিদূষক সাজে না। কেননা এই উদ্ধত দানবটি মাত্র কিছুদিন আগে, হিটলার মুসোলিনীর কায়দায় চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, যারা আমেরিকার সঙ্গে নেই, তারাই শত্রু। তার মানে, এই একুশ শতকে কোথাও কোনো অপর পরিসর বা সমান্তরালতা থাকবে না, থাকতে দেওয়া হবে না কোনো দ্বিরালাপের সম্ভাবনা। ভিন্নমত পোষণ করার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত হবে না এই নতুন বিশ্বে। বিশ্বায়ন মানে মার্কিনীকরণ, আরও চাঁছাছোলা ভাষায় বলা যায়, বুশীকরণ বা বুশায়ন। ওবামার জমানা এরই ধোপদুরস্ত সংস্করণ। রবীন্দ্রনাথ যে মানববিশ্বের বয়ান পেশ করেছিলেন, এই বুশীকরণ প্রক্রিয়া রয়েছে ঠিক তার উল্টো মেরুতে। এ হলো দশমাথা বিশ হাতওয়ালা রাবণের নীতি; দুনিয়ায় যেখানে যত সম্পদ রয়েছে, সব কিছুতে বুশ ও তার উত্তরসূরির সাঙ্গপাঙ্গদের অধিকার শুধু। বহুজাতিক সংস্থার শুড় দিয়ে সব রস শুষে নেওয়াকে যারা বিরোধিতা করবে, তারাই কোতল হবে। কোতল করার আগে শত্রুদের মুখে মাখিয়ে দেওয়া হবে চুনকালি; অজস্র বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম সহ সমস্ত ঢোল-শহরতের ওপর কজা বুশ-পাওয়েলদের। দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে এদের জুড়ি নেই, গোয়েবলস্ এদের খাস কংসমামা। অতএব ইরাকের সম্ভাব্য বার্ষিক তেলসম্পদ (এই মুহূর্তে গোমস্তা সৌদি আরবের তুলনায় পৃথিবীতে দ্বিতীয় হলেও সমস্ত উৎসকে কাজে লাগালে প্রথম হতে পারে) (তিরিশ হাজার কোটি ব্যারেল) নিঙড়ে নেওয়ার জন্যে সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে। এখনও চলছে চোঁয়াঢেঁকুর।

 মূল মন্ত্র হল পরিচিত সেই ইংরাজি প্রবাদ: কুকুরকে মেরে ফেলার আগে তার বদনাম করো। বুশ-ব্লেয়ারের তিনটে ধারণা খুব বদ্ধমূল; এক, জনতার চেঁচামেচিতে কান দিলে বড়ো কাজ করা যায় না; দুই, জনতার স্মৃতি খুব দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী; তিন, উত্তেজক ও ভীতিকর কিছু গুজব ছড়িয়ে দিলে কেল্লা ফতে। এই তৃতীয় নীতি অনুযায়ী আফগানিস্তানকে শায়েস্তা করার সময় অ্যানথ্রাক্স আর ইরাকের টুটি টিপে ধরার সময় সার্স-এর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে বুশ সাহেবের চেলারা। বুশায়ন মানে, কেউটে হয়ে ছোবল দাও এবং ওঝা হয়ে ঝাড়তে আসসা। কিংবা, একই অসুখে দুটো আলাদা দাওয়াই দাও। তাই আফগানিস্তান থেকে সমাজতান্ত্রিক চেতনার মূলোলাচ্ছেদ করার জন্যে ধর্মান্ধ তালিবানদের তৈরি করেছে মার্কিন প্রভুত্ববাদ; মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাষ্ট্রগুলিতে জন্ম দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে, পরে আরব জাতীয়তা ও ইউরোর সম্ভাব্য সম্পর্ককে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যে ঝি-কে মেরে বউকে শেখাতে চেয়েছে। গত শতকে ইরাক-ইরানের যুদ্ধ লাগিয়েছিল কারা? ঐ মার্কিনীরা। ইরানের সম্রাট কাদের প্রশ্রয় পেয়েছিল, খোমেইনি কাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ দেখছে? এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, ইরাকে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক তৈরি হচ্ছে কাদের উৎসাহে? আফগানিস্তানে ছিল সন্ত্রাসবাদ ও মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইরাকের সাদ্দাম তো লাদেনের মতো পৃথিবীর কোথাও সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করেননি। সাদ্দামের প্রধান বিরোধী দল ছিল আল-কায়দার ঘনিষ্ঠ ইনসাফ-আল-ইসলামি নামে সংগঠন। তাহলে? সাদ্দামের ইরাকে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক পুনর্গঠনের নামে ওখানে এখন মধ্যযুগের অন্ধকার ফিরে আসবে। আর, তা ঘটবে যুদ্ধোন্মাদ রক্তচোখ ড্রাকুলার হিংস্রতম অবতার বুশ ও ওবামা সাহেবের প্রত্যক্ষ মদতে। সাদ্দাম যদি একনায়ক, বুশ তবে কী? কদিন আগে জানা গেছে, খোদ মার্কিন মুল্লুকে যুদ্ধবিরোধী জনতার প্রতিবাদে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ভাবছে, পাজি বেয়াদবদের কিছু কিছু গঠনতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা যেতে পারে।

 এই তো ছিল বুশের গণতন্ত্র যেখানে গণ নেই ঘাতকতন্ত্র আছে শুধু। বুশের বন্ধুদের সর্বাঙ্গ গলিত হলেও বাধা নেই; অবশ্য মার্কিনী অভিধানে বন্ধুত্ব পদলেহনের মর্যাদাপ্রাপ্ত। যেমন পাকিস্তানের শাসক পারভেজ মুশারফ কিংবা বেনজির-পতি জারদারি। আফগানিস্তান-বসনিয়া সহ নানা দেশে যারা হাজার-হাজার সাধারণ মানুষকে খুন ও সর্বস্বান্ত করে, সারা জীবনের মতো পঙ্গু, ভিখিরি ও উদ্বাস্তু করে, তাদের মতামতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুতুল সরকার বসিয়েছে, তাদের পালের গোদার মুখে ‘গণতন্ত্র ভূতের মুখে রাম নাম ছাড়া আর কী? এই গণতন্ত্র হল এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পর্যায়ে প্রভুত্ববাদীর হাতের তাস। এর মূল নীতি সুকুমার রায়ের ছড়ার ভাষায় এরকম: ‘আমরা খাব মণ্ডা-মিঠাই/আমরা খাব চমচম/তোমরা সে-সব পাবে না কো/পেলেও পাবে কমকম। তাই তো মার্কিনীদের পরমাণু-অস্ত্র রাসায়নিক-অস্ত্র জীবাণু-অস্ত্র থরে থরে মজুত করতে বাধা নেই। কিন্তু ওইসব গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইরাক মজুত করছে বলে শশারগোল তুলে, রাষ্ট্রপুঞ্জের তথাকথিত পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে ইরাককে পিষে মারার অজুহাত তৈরি করতে অসুবিধে নেই। ইরাক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও কিছুই তো বেরোল না। তবু এই প্রশ্ন ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া-জাপান: কেউই করছে না, কোথায় গণবিধ্বংসী অস্ত্র? ঘোর সাদ্দাম-বিরোধী ইরাকি পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ইমাদ খান্দুরি প্রবন্ধ লিখে জানিয়েছিলেন, ইরাকে হামলার পেছনে কোনো কারণ ছিল না। তবু নির্লজ্জতার বান ডেকেছে প্রভুত্ববাদের চাপরাশিদের মধ্যে। উলঙ্গ রাজার দিকে প্রকাশ্যে আঙুল তুলে যারা বলেছে ‘রাজা তুই ন্যাংটো’—তাদের কণ্ঠস্বর ডুবে গেছে ক্রুজ মিসাইলের ভয়ংকর বিস্ফোরণে।

 পেট্রোলিয়াম কোম্পানির মালিক বুশ পরিবার এখন আর উঁচ হয়ে ঢোকে না, সরাসরি ফাল হয়েই ঢোকে। ইরাককে মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার পরেও স্পর্ধিত ইরাকিরা হাজারে-হাজারে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন: ‘দখলদার বাহিনী, ইরাক ছাড়ো। এই প্রতিবেদন লিখতে লিখতে জানলাম, মার্কিনী সেনাপতি বলছে কভি নেহি। আরও অ-নে-ক দিন এদেশের কলকজা ঠিক করার জন্যে আমরা থাকব। হল্লারাজার আরও সেনা ঢুকছে ইরাকে। কেননা বেয়াদব ইরাকিরা বলছে, ইরাক আমাদের। আমরা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ চালাব! আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের প্রত্নসম্পদ লুঠ হয়ে গেল; ইতিহাসকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করা হলো। ন্যায়-নীতি-মানবতাবোধ মাটিতে মিশে গেল। ডলার ও ইউরোর যুদ্ধ শ্বেতাঙ্গদের রুটি ও মাখনের লড়াই; উলুখাগড়ার প্রাণ গেল তাতে। হেনরি কিসিঙ্গারের কুখ্যাত বই ‘ডাজ আমেরিকা নিড এ ডিপ্লোম্যাসি’র সরল বীজগণিত আরও একবার বাস্তবে দেখা গেল। না, আমেরিকার কূটনীতি চাই না, আন্তর্জাতিক আইন চাই না, রাষ্ট্রসঘ চাই না। যা-খুশি যখন খুশি যেমন-খুশি করাই যেহেতু বিধি। আমেরিকা যাকে চাইবে, প্রতিটি দেশের সরকার চালাবে সেই ব্যক্তি। সার্বভৌমত্ব এখন থেকে অতীতের মহাফেজখানার প্রত্নবস্তু কেননা গোটা পৃথিবীতে বুশায়ন হি কেবলম। জনমত বলে কিছু নেই; যেহেতু মানুষ নামক প্রাণী থাকলেও মনুষ্যত্ব অবান্তর।

 মার্কিন বাজেটে ঘাটতি উনিশ হাজার কোটি ডলার, মার্কিনীদের ব্যক্তিগত ও সংস্থাগত ঋণের পরিমাণ পৌনে দু-লক্ষ কোটি ডলার। তাই ওদের অঢেল তেল চাই নইলে শক্তিমদমত্ততার মূল স্নায়ুকেন্দ্র টলে যাবে। ওদের ডলার চাই কাড়িকাড়ি যাতে ইউরো ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে না পারে। ওরা বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে তুলছে। কেননা ওদের মনস্তত্ত্বের গভীরে রয়েছে বিপুল ভয়। তাই বিশ্বায়ন, থুড়ি বুশায়ন-এর নামে সব কিছু একাকার করে দিচ্ছে ওরা। এই কালবেলায় তবু প্রতিরোধেও নতুন প্রকরণ তৈরি হচ্ছে। দাঁত-খিচানো পেশি-ফোলানো ভয়ঙ্করকে ভয় দেখানো ওই প্রকরণের অঙ্গ। না-মানুষী জান্তব কুশ্রীতার বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব জুড়ে স্বপ্নময় সম্ভোগের জাল ছড়ানোর বিরুদ্ধে, ঘরে ঘরে মহল্লায় মহল্লায় সংস্থায় সংস্থায় বুশায়নের বিরুদ্ধে স্পর্ধিত তর্জনি তুলে দেখানো এবং সব ধরনের প্রতিবাদী মানুষের যুক্তফ্রণ্ট গড়ে তোলাই আজকের দায়।

 ইরাক যদি কালবেলার কৃষ্ণবিবরকে উন্মুক্ত করে থাকে, মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানোর জন্যে, মানুষের জমায়েতে মানুষ খুঁজে নেওয়ার জন্যে জরুরি প্রস্তুতি তো শুরু হল এখন। নতুন নতুন পথে নতুন নতুন পাথেয় খোঁজা চলুক অবিরাম। আর, প্রতিটি মুহূর্তে চলুক বুশায়ন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত লড়াই, নিরবচ্ছিন্ন ক্রোধ ও ঘৃণার অঙ্গীকার।