যথানিয়মে কার্য্য আরম্ভ করিবার দিনধার্য্য ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক বিষয় নির্দ্দেশ করিবার উদ্দেশ্যে তাহার পরদিন আমরা সভা আহবান করিলাম।

 যথাসময়ে কার্য্য আৱম্ভ হইল। সর্ব্বসম্মতিক্রমে বন্ধুবরকে সভাপতি পদে বরণ করা হইল। সভার প্রথম কার্য্য—হাসানজী কোম্পানীর বিল শোধ করা। তাঁহাদের প্রধান অংশীদার উপস্থিত ছিলেন; বিলখানি বিশলক্ষ টাকার। চুক্তি কিন্তু ছিল পনের লক্ষের। একজন অংশীদার এই পার্থক্যেরকারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

 বন্ধুবর ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন:—

 “এই যে অতিরিক্ত টাকা দেখিতেছেন উহা একখানি সবমেরিন্ বোট্ ক্রয় বাবত পড়িয়াছে—”

 “সেকি? সবমেরিন্ বোট্ কি হইবে?”

 “যখন কোম্পানী স্থাপন করি, তখন ঐ বোট কিনিবার কোন আবশ্যকতা দেখি নাই। কিন্তু আমাদের কোন পরম হিতৈষী বন্ধুর হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য ইহা ক্রয় করিতে বাধ্য হইয়াছি। তাঁহার নাম উল্লেখ করিবার কোন আবশ্যকতা নাই, কেন না তাঁহাকে আপনারা সকলেই জানেন। অতএব আমি আশা করি এই অতিরিক্ত ব্যয়টা আপনারা পাস করিয়া দিবেন।”

 সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।”

 “আমি আর একটা অতিরিক্ত খরচার হিসাব দেখাইয়া দিতে ইচ্ছা করি। আপনারা তাহা লক্ষ্য করিয়াছেন কিনা জানি না। একটা তারহীন-বার্ত্তা-প্রেরণ-যন্ত্রের বাবত হাসানজী কোম্পানী ২০০০০ টাকা মাত্র চাহিয়াছেন। ইহা পূর্ব্বে ধরা ছিল না। কিন্তু ইহার আবশ্যকতা যে কত, তাহা বোধ হয় আপনাদিগকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। আমি প্রস্তাব করি, আপনারা এই বিল একবাক্যে মঞ্জুর করুন।”


  সকলে তাহাই করিলেন। হাসানজী কোম্পানীকে তাহাদিগের প্রাপ্য টাকার বাবৎ এক চেক লিখিয়া দিয়া আমরা কার্য্যারম্ভের দিনধার্য্যের জন্য প্রবৃত্ত হইলাম।

 অনেক বাদানুবাদের পর স্থির হইল যে, যে কয়মাস কার্য্য হইবে সেই সময় মাত্র বন্ধুবর ও আমি সর্ব্বদাই জাহাজে থাকিব। আমরা কলিকাতার আফিসে সপ্তাহে সপ্তাহে রিপোর্ট পাঠাইব। আফিসের কার্য্যে অপর তিন জন ডাইরেক্‌টার্ নিযুক্ত থাকিবেন।

 তাহার পর জাহাজের কর্ম্মচারী নিয়োগের কথা উঠিল। কাপ্তেন, নাবিক, প্রভৃতির নির্ব্বাচনবিষয়ে কোনও গোলযোগ হইল না। কিন্তু যখন ভাণ্ডারী (steward) নির্ব্বাচনের কথা উঠিল, তখন বেশ একটু গোলযোগ হইল।

 আমি প্রস্তাব করিলাম যে, আমার ভৃত্য সুন্দরলালকে ঐকার্য্যে নিযুক্ত করা হউক।

 বন্ধুবর আপত্তি করিলেন।

 আমি বলিলাম:—

 “যে কয় দিবস ও আমার বাটীতে কার্য্য করিয়াছে তাহাতে আমার বিশ্বাস হয়—সে ভাণ্ডারী পদের উপযুক্ত।”

 “তাহার উপযুক্ততার দুই একটী উদাহরণ দাও,” বন্ধুবর একটু শ্লেষের সহিত বলিলেন।

 “একটা দিব! একদিন আমি খুচরা টাকায় ও নোটে প্রায় ১০০০ মুদ্রা ভুলক্রমে এক টেবিলের উপর ফেলিয়া যাই। ও অনায়াসেই উহা লইতে পারিত, কিন্তু তাহা না করিয়া আমি আসিবামাত্র উহা আমায় দেয়। আমি তাহাকে পুরস্কার দিতে গেলে সে তাহা লইল না। আর একদিন আমার ঘড়ি ও চেন ঐ রূপে ফেলিয়া যাই। তাহাও সে আমায় দেয়। তখন মনে করিয়াছিলাম যে, বিপদের ভয়ে সে টাকা ও ঘড়ি আমায় দিয়াছিল। তাহার সাধুতা পরীক্ষা করিবার ইচ্ছায় একদিন গোটা পনের টাকা আমার বিছানার উপর রাখিয়া যাই। যথাসময়ে সে ঐ টাকা আমার হস্তে পৌঁছিয়া দেয়। সেই দিন হইতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে ও অতি বিশ্বাসী। ভাণ্ডারের কার্য্যের জন্য বিশ্বাসী লোকের প্রয়োজন। আমার ধারণা সুন্দরলাল ঐ কার্য্যের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি।”

 বন্ধুবর মস্তক নাড়িয়া বলিলেনঃ—

 “আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করিতেছি না। তবে তাহাকে তোমার ওখানে যে দিন প্রথম দেখি সেই দিন হইতে আমার মনে কেমন একটা সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে যে উহার দ্বারা আমাদের বিশেষ অনিষ্ট ঘটিবে। তুমি কি উহার ভদ্রয়ানা চেহারা লক্ষ্য করিয়াছ? আমার এক ঘটনা শুন। এক দিন আমি সহসা তোমার গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখি যে ও একখানা ইংরাজী সংবাদ পত্র নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করিতেছে। আমায় দেখিয়া ত্র্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল ও কাগজখানা পাট করিয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিল। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করায় বলিল যে সে ইংরাজী জানে না, কাগজের অক্ষরগুলি দেখিতেছিল মাত্র। ইহা হইতে কি মনে হয়? অতএব আমার ইচ্ছা অপর কাহাকে ভাণ্ডারী নিযুক্ত করা হউক।”

 আমি বলিলামঃ—

 “ঐ পদ-প্রার্থীর সংখ্যা বেশী নহে, সর্ব্বসমেত দশজন মাত্র। ইহাদের মধ্যে ভোটাধিক্যে যে মনোনীত হইবে তাহাকে নিযুক্ত করা হউক, ইহাই আমার প্রস্তাব।”

 সকলে ভোট দিলে পর দেখা গেল যে সুন্দরলাল সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভোট পাইয়াছে। কাজেকাজেই তাহাকে ভাণ্ডারী নিযুক্ত করা হইল।

 ক্রমে ক্রমে অন্যান্য কার্য্যগুলি সমাধা করিয়া এক সপ্তাহের পরে আমাদের কার্য্যের দিনধার্য্য করিয়া সভা ভঙ্গ করা হইল।