অনুবাদ:সিণ্ডেরেলা
সিণ্ডেরেলা:
বা,
ছোট কাঁচের চটিজুতো।
অনেক বছর আগে, একজন সজ্জন তার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে সুখে-শান্তিতে বাস করত। তাদের একমাত্র মেয়ে তার বাবা-মায়ের প্রতি খুবই কর্তব্যপরায়ণ ছিল। কিন্তু সে যখন খুব ছোট, তখন তার মা মারা যায়। কিছুদিন পর, এই ছোট্ট মেয়েটির বাবা আবার বিয়ে করে। এই মহিলাটি ছিল অত্যন্ত উদ্ধত ও মেজাজী আর তার বড় দুটি মেয়ের মেজাজও তাদের মায়ের মতই; সেই কারণে দুঃখী মেয়েটির জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ধৈর্য্যের সাথে তার সমস্যাগুলি সয়ে চলেছিল, এমনকি সে তার নিজের বাবাকেও কখনো কোন অভিযোগ করেনি, এবং এত কষ্টের পরেও প্রতি বছর সে আরো সুন্দরী হয়ে উঠছিল।
একদিন রাজার ছেলে এক জমকালো নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন, সব মানী ব্যক্তিরা সেখানে আমন্ত্রিত হলেন। আমাদের দুই তরুণীও বাদ যায়নি। কত দামী পোষাক তারা পড়বে, এ গল্প বাদে তাদের মুখে আর কোন কথাই নেই।
অবশেষে সেই আনন্দের দিন উপস্থিত হল। গরবিনী দুই বোন খুব আহ্লাদের সঙ্গে বেরোল। যতক্ষণ না তাদের ঘোড়ার গাড়ীটি অদৃশ্য হল, ততক্ষণ পর্যন্ত সিণ্ডেরেলা তাদের দিকে চেয়েই রইল। তারপর সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সে যখন এরকম করে কাঁদছে, তখন তার ধর্ম-মা তার সামনে এসে উপস্থিত হলেন, ইনি ছিলেন এক পরী।
পরী বললেন, “সিণ্ডেরেলা, আমি তোমার ধর্ম-মা, তোমার প্রিয় মায়ের অনুরোধে আমি তোমাকে চাঙ্গা করতে এসেছি, তাই চোখের জল মোছ; তুমি আজ রাতে নাচের আসরে যাও; কিন্তু তার আগে আমি যা বলব সেটাই তোমাকে করতে হবে। যাও, বাগান থেকে একটা কুমড়ো নিয়ে এসো।” সিণ্ডেরেলা সব থেকে সেরা কুমড়োটি এনে দিল। তার ধর্ম-মা খুব তাড়াতাড়ি কুমড়োর ভেতর থেকে সব বের করে নিলেন আর জাদুছড়ির ঘা দিতেই অমনি সেটা একটা সুন্দর ঘোড়ার গাড়িতে পাল্টে গেল। এরপর, তিনি ইঁদুর ধরার কলে উঁকি মেরে ছ’টি ইঁদুর দেখতে পেলেন। তিনি তাদের ওপর ছড়ির মৃদু টোকা দিতেই ইঁদুরগুলি সেরা সেরা ঘোড়া হয়ে গেল। ইঁদুরকলে দুটি ধেঁড়ে ইঁদুর ছিল; তার জাদুতে একটি সহিস আর আরেকটি গাড়োয়ান হয়ে গেল। পরী এরপর সিণ্ডেরেলাকে বাগান থেকে ছয়টি টিকটিকি খুঁজে আনতে বললেন। তিনি সেগুলিকে সুন্দর জামাকাপড় পড়া ছ’জন আর্দালি বানিয়ে দিলেন।
যখন সবকিছু শেষ হল, তখন দয়াময়ী ধর্ম-মা তাঁর জাদুছড়ি ছুঁইয়ে তার ছেঁড়া কাপড়গুলিকে রূপো ও মুক্তোয় মোড়া সুন্দর পোশাকে বদলে দিলেন। এরপর তিনি তাকে মাকড়সার জালের মত সূক্ষ্ম কাঁচ দিয়ে বোনা একজোড়া কাঁচের চটিজুতো দিলেন।
সিণ্ডেরেলার সাজ যখন শেষ হল, তার ধর্ম-মা তাকে সেই সুন্দর ঘোড়ার গাড়িতে চাপানোর সময় সাবধান করে দিলেন যেন ঘড়িতে বারোটা বাজার আগেই সে আসর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
সিণ্ডেরেলা পোঁছতেই তার সৌন্দর্য্যে সকলে অবাক হয়ে গেল। বীর রাজকুমার তাকে সাদরে আমন্ত্রণ করে নাচের ঘরে নিয়ে গেলেন; রাজা-রাণীও তাকে দেখে রাজকুমারের মতই মন্ত্রমুগ্ধ। রাজকুমার তাকে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন এবং নিজে কিছু খাওয়ার বদলে সিণ্ডেরেলাকে খাবার দিতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বসে থাকতে থাকতেই সিণ্ডেরেলা ঘড়িতে পৌনে বারোটার ঘণ্টা শুনতে পেল। বেরোনোর জন্য উঠতেই রাজকুমার তাকে পরের দিন সন্ধ্যার নাচের আসরে আসার জন্য বার বার অনুরোধ জানালেন।
ঠিক সময়ে বাড়ি পৌছনোর জন্য তার ধর্ম-মা তার প্রশংসা করে পরের রাতে নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিলেন।
অত্যন্ত ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও তার বোনেরা তার ওপর দয়া দেখানোর বদলে সেই সব চমত্কার দৃশ্যগুলির কথা, বিশেষ করে সেই সুন্দরী রাজকুমারীর কথা বলে বলে তাকে জ্বালাতন করতে লাগল। এই সব শুনতে সিণ্ডেরেলার ভালোই লাগছিল। সে সেই রাজকুমারীর নাম জিজ্ঞাসা করতে তারা জবাব দিল যে কেউ তাকে চেনে না। তারা রাজকুমারীর এত প্রশংসা করল যে সিণ্ডেরেলা পরের আসরে সেই রাজকুমারীকে দেখতে চাইল; কিন্তু এতে তারা দুঃখী সিণ্ডেরেলার ওপর এত অখুশি হল যে তাদের সবচেয়ে খারাপ পোশাকও তাকে ধার হিসেবে দিল না।
পরের সন্ধ্যেবেলায় দুই বোন নাচের অনুষ্ঠানে গেল। আগের চেয়ে আরো সুন্দর পোশাক পরে সিণ্ডেরেলাও সেখানে গেল। সে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি খুশি আর রাজকুমারের কোমল কথাবার্তায় এতটাই সে মশগুল যে সময়ের দিকে তার আগের মত খেয়াল রইল না।
ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বাজতেই সে একছুটে নাচঘর থেকে পালিয়ে গেল; কিন্তু এক মুহুর্তের মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি আবার কুমড়োতে, ঘোড়াগুলি ইঁদুরে, সহিস ও গাড়োয়ান ধেঁড়ে ইঁদুরে, আর্দালিরা টিকটিকিতে এবং সিণ্ডেরেলার সুন্দর পোশাক পুরোনো ছেঁড়া কাপড়ে বদলে গেল। তাড়াহুড়োতে তার একটি কাঁচের চটিজুতো ওখানেই পড়ে রইল আর আরেকটি জুতো নিয়ে তার ধর্ম-মার দেওয়া সব উপহার ছাড়াই হাঁপাতে হাঁপাতে সে বাড়ি পৌছল।
নাচ থেকে ফেরার পর তার বোনেরা সেই অচেনা রাজকুমারীরই গল্প করতে লাগল। তারা সিণ্ডেরেলাকে বলতে লাগল যে রাজকুমারীর ফেলে যাওয়া ছোট কাঁচের চটিজুতো কিভাবে রাজকুমার তুলে রেখেছেন। আসরে সবাই বুঝল যে, রাজকুমার এই চটিজুতোর মালিককে যেমন করে হোক খুঁজে বের করবেনই; এর কিছু দিন পরেই ঘোষণা করা হল যে রাজকুমার তাকেই বিয়ে করবেন যার পায়ে এই কাচের জুতো একদম মাপে মাপে বসবে।
এই ঘোষণায় চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। রাজ্যের সব মেয়েরাই চটিজুতো পরে দেখার অনুমতি পেল, কিন্তু সেটা কারোর পায়েই মাপসই হল না। সিণ্ডেরেলা বলে উঠল, “আমি চেষ্টা করে দেখি—এটা আমার মাপে হতেও পারে।” এক মুহুর্তে সেটি পায়ে গলে গেল। দুই বোন এতে ভারী চটে গেল কিন্তু সিণ্ডেরেলা যখন আরেকটি চটিজুতো তার পকেট থেক বের করল, তখন তারা তো অবাক!
সেই মুহুর্তে, তার ধর্ম-মা হাজির। তিনি সিণ্ডেরেলার কাপড় ছড়ি দিয়ে ছুঁয়ে দিলেন। তার বোনেরা তখন দেখল যে, নাচের অনুষ্ঠানে যে সুন্দরীকে তারা দেখেছিল, এ সেই। তার পায়ে পড়ে তারা তখন ক্ষমা চাইতে লাগল।
কিছুদিন পর রাজকুমারের সাথে তার বিয়ে হতে রাজ্যের সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হল।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।
এই লেখাটি ক্রিয়েটিভ কমন্স অ্যাট্রিবিউশন শেয়ার অ্যালাইক ৪.০ আন্তর্জাতিক লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশ করা হয়েছে, যা বিনামূল্যে ব্যবহার, বিতরণ ও অভিযোজন করার অনুমতি দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত লাইসেন্সটি অপরিবর্তিত ও পরিষ্কার ভাবে বলা থাকে এবং মূল লেখককে কৃতিত্ব দেওয়া হয় — এবং আপনি যদি এই লেখাটি পরিবর্তন, রূপান্তর বা এর ওপর ভিত্তি করে কিছু তৈরি করেন, তবে আপনাকে অবশ্যই আপনার অবদান মূল লাইসেন্সের মত একই রকমের লাইসেন্সের আওতায় তা বিতরণ করতে হবে।