অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/দ্বিতীয় পর্ব/অধ্যায়: ছয়
অধ্যায় ছয়
সেঞ্চুরি—৫
সূচি :
১। কবিতা—৮ : বোমা।
২। কবিতা—১১ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
৩। কবিতা—২৪ : (ব্যাখ্যাকারের একটি ডিগবাজি।)
৪। কবিতা—৪৪ : অসফল ভবিষ্যদ্বাণী।
৫। কবিতা—৬৮ : ইরানের শাহ।

কবিতা—৮ (সেঃ—৫)
Sera laisse le feu vif, mort cache,
Dedans les globes horrible espouvantable,
De muict a classe cite en poudre lasche,
La cite a feu, l’ennemi favorable.
অর্থাৎ :
মৃত্যু আর আগুন লুকিয়ে থাকবে
ওই ভয়ানক গোলকগুলিতে,
রাতারাতি সৈন্যদল শহরগুলিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে,
জ্বলতে থাকবে শহর, উল্লাস করবে শত্রুরা।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : বোমা
চিটহ্যাম বলেছেন, এই কবিতাতে যে গোলকের কথা বলা হয়েছে, তা বোমা ছাড়া আর কিছুই নয়। বোমাই পারে শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে, আর একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে। ভবিষ্যতে বোমা তৈরি হবে—তাও জানতে পেরেছিলেন নস্ট্রাডামুস?
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
পাঠকরা, কবিতাটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে? মিলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে? কিন্তু না, আপনারা শুনলে হয়তো নিরাশ হবেন যে, নস্ট্রাডামুসের সময়েও গোলাবারুদ, কামান ইত্যাদি ছিল। এবং সেগুলি যুদ্ধে বিপুলভাবে ব্যবহার করা হত। নস্ট্রাডামুস যখন কামান, গোলাবারুদ দেখেইছেন, তখন তাঁর পক্ষে বোমা-গোছের কোনো বস্তুর আগমন কল্পনা করে নেওয়া কঠিন, বা অসম্ভব কাজ ছিল না, কেননা তিনি ছিলেন বেশ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। (কল্পনাশক্তি সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনা আছে সেঞ্চুরি-৩ এর কবিতা-১৩-র বিশ্লেষণে। প্রয়োজন অনুভব করলে দয়া করে সেই অংশটা আবার পড়ুন।
কবিতা—১১ (সেঃ—৫)
Mer par solaires seure ne passera,
Ceux de Venus tiendront toute l’Affrique :
Leur regne plus Saturne n’occupera,
Et changera la part Asiatique.
সূর্যের মানুষরা নিরাপদে সমুদ্র পারাপার করতে পারবে না,
শুক্রের মানুষরা দখল নেবে গোটা আফ্রিকার:
শনি তাদের রাজ্যকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না,
আর, এশিয়ার চেহারা অনেকটাই যাবে বদলে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
সূর্যে মানুষ থাকতে পারে না, তাই ‘সূর্যের মানুষরা' মানে আসলে জাপানের মানুষরা। এই সিদ্ধান্তে এসেছেন শ্রীমতী এরিকা চিটহ্যাম। কারণ জাপানের পতাকায় সূর্য আছে। প্রথম লাইনের ব্যাখ্যা হল এই যে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পরমুহূর্ত থেকেই জাপানের জাহাজগুলোর নিরাপত্তা গিয়েছিল কমে। সব সময়ে শত্রুর আক্রমণের ভয়ে তটস্থ হয়ে সমুদ্র পারাপার করতে হত জাপানি জাহাজগুলিকে।
দ্বিতীয় লাইনের ব্যাখ্যাটা আরও মজাদার। এরিকা বলেছেন, এখানে Venus মানে শুক্রগ্রহ নয়। এখানে ‘ভেনাস’ বলে নস্ট্রাডামুস আসলে ‘ভেনিস’ শহরের কথা বলতে চেয়েছেন। অর্থাৎ ইতালির কথা। অর্থাৎ কিনা ইতালি দখল নেবে গোটা আফ্রিকার।
এরিকা বলেছেন যে, তৃতীয় লাইনের অর্থটা একটু বুদ্ধি করে বুঝে নিতে হবে। তৃতীয় লাইনে আসলে বলতে চাওয়া হয়েছে যে, শনির প্রকোপের ফলে ইতালি বেশিদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না।
চতুর্থ লাইন—‘আর এশিয়ার চেহারা অনেকটাই যাবে বদলে। ‘চেহারা’ মানে আসলে ‘অবস্থা’ অর্থাৎ কিনা এশিয়াতে লোকজনের অবস্থা যাবে বদলে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, ইত্যাদি।
মোট কথা এই কবিতাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলতে চাওয়া হয়েছে।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ:
এই কবিতাতে এরিকা যেভাবে গাদাগাদা জায়গায় ‘এই মানে আসলে এই বলতে চাওয়া হয়েছে’—বলে গেছেন, তাতে ব্যাখ্যাতে আসল কবিতাটির ছিটেফোঁটাও স্বাদগন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার আশ্চর্য লাগছে, পৃথিবীর যে লক্ষ লক্ষ মানুষ এরিকার ব্যাখ্যা পরে প্রভাবিত হয়েছেন তাঁরা এরিকার প্রতারণার ফাঁদে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, সামান্য ফাঁক এবং ফাঁকিগুলোও ধরতে সক্ষম হননি। মানুষ অলৌকিক গল্প শুনতে ভালোবাসে, ভাবতে ভালোবাসে যে, অলৌকিক উপায়ে অবাস্তব ঘটনা ঘটানো সম্ভব। সেই জন্যেই এরিকার অপব্যাখ্যাগুলি তামাম দুনিয়ার মানুষ এত গোগ্রাসে গিলেছে, এবং বিশ্বাস করেছে।
সূর্যের মানুষরা মানে জাপানের মানুষই শুধু কেন? কেন বাংলাদেশের নয়? বাংলাদেশের পতাকাতেও তো সূর্য আছে; আছে কোরিয়ার পতাকাতেও। এর কোনো উত্তর নেই।
শুক্রগ্রহকে (VENUS) যেভাবে এরিকা ‘ভেনিস’ বুঝিয়েছেন, তা দেখে মনে হচ্ছে বুধ গ্রহকে (MERCURY) উনি ‘মরোক্কো’ (MOROCCO) দেশ বলে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। বলে রাখা ভালো যে, ইতালি কোনোদিনই গোটা আফ্রিকা কেন, আফ্রিকার অংশবিশেষকেও জয় করতে পারেনি।
‘শনির প্রকোপ’—এই কথাটা কতটা অসার, তা এই অলৌকিক নয় লৌকিক, ৩য় খণ্ডের প্রথম ভাগটা পড়লেই বোধকরি বুঝতে পারবেন। ‘....তাদের রাজ্যকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না’—এই দুটো কথা কি করে এক হয়? এরিকা বলেছেন একটু বুদ্ধি করে বুঝে নিতে হবে। কই, আমি তো অনেক বুদ্ধি খাটিয়েও বুঝতে পারছি না? আসলে বোধহয় আমারই বুদ্ধি কম!
চতুর্থ লাইনে ‘চেহারা’ আর ‘অবস্থা’ শব্দ দুটো নিয়ে একই কায়দা করেছেন এরিকা।
কবিতা—২৪ (সেঃ—৫)
(গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। কেননা কবিতা—১১র সঙ্গে এই কবিতাটার দারুণ মিল। অথচ ব্যাখ্যা একেবারে অন্যরকম)
Le regne & lois souz Venus esleve,
Saturne aura sus Jupiter empire :
La loi & regne par le Soleil leve,
Par Saturnins endurera le pire.
অর্থ :
শুক্রের শাসনকালে রাজ্যের অবস্থা, ও আইন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে,
শনির প্রভাব হবে বৃহস্পতির থেকে বেশি :
সূর্যের সময়ে রাজ্যের অবস্থা ও আইনের উন্নতি হবে,
শনির সময়টাই হবে সবচেয়ে খারাপ সময়।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : (ব্যাখ্যাকারের একটি ডিগবাজি।)
এরিকা এই কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটা জব্বর ডিগবাজি খেয়েছেন। এর ঠিক আগে যে কবিতাটা বিশ্লেষণ করেছি, অর্থাৎ কবিতা—১১, (সেঞ্চুরি—৫) সেটাতেও সূর্য, শুক্র, শনি ইত্যাদি শব্দগুলি আছে, আপনারা দেখেছেন। তার কী কী ব্যাখ্যা করেছেন এরিকা, তাও আপনারা দেখেছেন। এবার এই কবিতাতেও সেই একই শব্দগুলির কী কী ব্যাখ্যা করেছেন, দেখুন :
এরিকা বলেছেন তিনি এই কবিতার কোনো ‘সন্তোষজনক ব্যাখ্যা’ খুঁজে পান নি। বলেছেন এখানে সূর্য, শুক্র, বৃহস্পতি, শনি ইত্যাদি বলে বোধহয় কোনো একটা সময় বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। অবশ্য ‘সূর্য’ বলতে এখানে রাজা পঞ্চম চার্লস বা ক্যাথলিক গির্জার কথাও বোঝানো হয়ে থাকতে পারে।
এরিকার ব্যাখ্যা এখানেই শেষ। বেশ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। কিন্তু কোনো বিশেষ ঘটনাকে সম্পর্কিত করতে পারেননি তিনি।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
ডিগবাজিটা লক্ষ্য করেছেন? কবিতা – ১১তে ‘শুক্র’ মানে ইতালি, আর এখানে কবিতা—২৪এ ‘শুক্র’ মানে ‘শুক্রগ্রহ’? মজা তো! আর কবিতা—১১তে ‘সূর্য’ মানে জাপান, আর কবিতা — ২৪এ ‘সূর্য’ মানে পঞ্চম চার্লস, অথবা ক্যাথলিক চার্চ?
এরিকার এই বিভিন্ন কবিতায় একই শব্দের বিভিন্ন রকমের
মানে তৈরি করার স্বভাবের সঙ্গে আপনারা এতক্ষণে
নিশ্চয়ই ভালোই পরিচিত হয়ে গেছেন। নস্ট্রাডামুসের
কবিতাগুলিকে অভ্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী বলে চালানোর
জন্য, আর পাঠকদের বোকা বানানোর জন্য
এরিকার এই চালবাজিটা অত্যন্ত জরুরি।
কবিতা—৪৪ (সেঃ—৫)
(গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। কেননা কবিতা—১১র সঙ্গে এই কবিতাটার দারুণ মিল। অথচ ব্যাখ্যা একেবারে অন্যরকম)
Par mer le rouge sera prins de pirates,
La paix sera par son moyen troublee :
L’ire & l’avare commettra par fainct acte,
Au grand pontife sera l’armee doublee.
অর্থাৎ :
সমুদ্রের ওপর লাল-মানুষটিকে হরণ করবে জলদস্যুরা,
ফলে, আসবে অশান্তি, খারাপ সময় :
সে একটা মিথ্যে অভিনয়ের মাধ্যমে রাগ ও লোভ দেখাবে,
পোপ-এর সৈন্য দ্বিগুণ করা হবে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : অসফল ভবিষ্যদ্বাণী
এরিকা এখানে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ভবিষ্যদ্বাণী অসফল। অর্থাৎ তিনি তাঁর জানা কোনো ঘটনার সঙ্গে কবিতাটিকে জুড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। কবিতাটায় ‘লাল মানুষটি’ মানে পোপ[১]। ষোড়শ শতক পর্যন্ত পোপদের নিজেদের সৈন্যবাহিনী থাকত। এরিকা স্বীকার করেছেন, ষোড়শ শতক বা তারও পর অবধি কোনও পোপকে জলদস্যুরা হরণ করেননি। অতএব ভবিষ্যদ্বাণীটি অসফল। (বলে রাখা ভালো, সব সেঞ্চুরিতেই কয়েকটি করে কবিতাকে এরিকা ‘অসফল ভবিষ্যদ্বাণী’ বলে ঘোষণা করেছেন। আমি তাদের মধ্যে থেকে শুধু একটা বেছে নিলাম আপনাদের উদাহরণ দেবার জন্য।)
কবিতা—৬৮
Dans le Danube & du Rhin viendra boire,
Le grand Chameau ne s’en repentira :
Trembler du Rosne & plus fort ceux de Loire,
Et pres des Alpes coq le ruinera.
এর মানে দাঁড়ায় :
মস্তবড় উট আসবে দানিয়ুব, আর রাইন এর জলপান করতে,
এজন্য তার কোনো লজ্জা বা অনুতাপ হবে না :
রোন, আর লয়ার-এর লোকজন ভয়ে কাঁপবে থরথর,
আল্পস পর্বতের কাছে এক মোরগ তাকে করবে পরাজিত।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : ইরানের শাহ
আবার এরিকার ছোট্ট ব্যাখ্যা। মাত্র চার লাইনের। এই চার লাইনের এরিকার যা বক্তব্য, তা হল এই :
কবিতাটা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবে ‘উট’ বলে হয়তো কোনো আরব্য-নেতার কথা বলতে চাওয়া হয়েছে, কেননা আরব দেশগুলিতে অঢেল উট। এই নেতাটি হয়তো বা ইরানের বিখ্যাত শাহ। কেননা শাহ'র জীবনে ফ্রান্সের গুরুত্ব আছে। আর কবিতাতেও ফ্রান্সের একটা নদী (রোন)’র কথা বলা হয়েছে। তবে জার্মানির সঙ্গে শাহ'র যে সম্পর্কের কথা কবিতাতে বলা হয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। (রাইন জার্মানি দিয়ে বয়ে যায়।)
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
এরিকা কবিতাটার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। যেটুকু করেছেন, সেটুকুও নড়বড়ে। ‘উট’ মানে যদি আরব্য নেতাই ধরি, তাহলে ইরানের নেতার নাম করলেন কেন? ইরান আর আরব কি এক? আর ইরানের শাহ'র কথাই বলা হয়েছে বলে যদি ধরে নিই, তাহলেই বা গোটা কবিতাটার অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? দানিয়ুব, আর রাইন-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কী? দ্বিতীয় লাইনের ‘লজ্জা’ বা ‘অনুতাপ' এর প্রশ্নই বা উঠছে কেন?
সর্বশেষ সওয়াল, আল্পস্-এর কাছে মোরগটি কে? শাহ তো কখনও আল্পস্-এর কাছে কোনো যুদ্ধে পরাজিত হননি। তাহলে এমন ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন কী? এক কবিতার প্রায় সমস্ত বক্তব্যের সঙ্গেই তো শাহ’র জীবন একেবারেই মিলছে না। অথচ এরিকা’র বইয়ের পেছনের মলাটে কালোর ওপর সাদা দিয়ে লেখা :
“...তাঁর অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিতে দেখেছিলেন লন্ডনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এরোপ্লেন আবিষ্কার, জন এফ. কেনেডির হত্যাকাণ্ড, আয়াতুল্লা খুয়েমিনী, এবং ইরানের শাহ.....।”
- ↑ পোপ : বিশ্বের সমস্ত ক্যাথলিক খ্রিশ্চান ধর্মযাজকদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পদাধিকারী ব্যক্তি।