অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/দ্বিতীয় পর্ব/অধ্যায়: দশ
অধ্যায় দশ
সেঞ্চুরি—৯
সূচি :
১। কবিতা—৫১ : রাশিয়ান ও মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধ।
২। কবিতা—৬২ : জাদুবিদ্যা ও ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত কবিতা।
৩। কবিতা—৯২ : নিউ ইয়র্ক শহরের বিপদ।
৪। কবিতা—১০০ : পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ।কবিতা—৫১ (সেঃ—৯)
Contre le rouges sectes se banderont,
Few, eau, fer, corde par paix se manera,
Au point mourir, ceux qui machineront,
Fors un que monde sur tout ruinera.
অর্থাৎ :
লাল মানুষদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে,
আগুন, জল, লোহা, শান্তি এলে বাঁধন হবে আলগা,
চক্রান্ত-রচনাকারীরা একে একে মৃত্যুর মুখোমুখি হবে,
একজন বাদে; যে পৃথিবীকে শেষ করে দেবে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : রাশিয়ান ও মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধ
ব্যাখ্যাকার এরিকা চিটহ্যাম এই কবিতার যে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে বলেছেন, এখানে কোনো যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। যুদ্ধে ‘লাল মানুষরা' মানে নির্ঘাৎ রাশিয়ানরা। কারণ কমিউনিস্টদের পতাকা ইত্যাদির রং লাল। আর শেষ লাইনে বর্ণিত ব্যক্তিটি নির্ঘাৎ তৃতীয় অ্যান্টিখ্রাইস্ট। অর্থাৎ যুদ্ধটা হচ্ছে রাশিয়ান ও মুসলমানদের মধ্যে; কেননা অন্য একটা কবিতায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তৃতীয় অ্যান্টিখ্রাইস্ট হবেন সম্ভবত মুসলমান। তবে এ যুদ্ধে কারা জয়ী হবেন বলা যাচ্ছে না। ঘটনাটা ভবিষ্যতে ঘটবে।
ব্যস, ব্যাখ্যা বলতে এইটুকুই।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
কবিতার প্রথম আর শেষ লাইনের ব্যাখ্যা করলেই সব সমস্যা মিটে যায় না। মাঝেও দুটো বেয়াড়া লাইন আছে। সে দুটো লাইনের ব্যাখ্যা না করলে তো কবিতার মানে আমূল বদলেও যেতে পারে! সে দুটো লাইন কে ব্যাখ্যা করবে? লাল মানুষ মানে রাশিয়ান হবে কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। নস্ট্রাডামুসের সময়ে ব্রিটিশ সৈন্য, বা স্প্যানিশ সৈন্যদের পোশাক ছিল লাল। নস্ট্রাডামুস হয়তো এদের কারো কথা বলতে চেয়েছিলেন; এটাই স্বাভাবিক। রাশিয়া তো বরং লাল রং আর মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে বিদায় জানিয়েছে। ওরা তো এখন আর লালের প্রতীক নয়। ব্যাখ্যাকাররা এবং লাল বলতে ‘লাল চীন’, বা ‘লাল পশ্চিমবাংলা’র নামটা নতুন সংস্করণে রাখতে পারেন।
রাশিয়াই যেখানে লাল রং ছেড়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে মুসলমানদের সঙ্গে ‘লাল’-এর লড়াইয়ের ব্যাপারটাই তো মাঠে মারা গেছে
আরও একটা কথা। কবিতাতে কিন্তু ‘থার্ড অ্যান্টিথ্রাইস্ট’ কথাটা উল্লেখ করেননি নস্ট্রাডামুস। কাজেই আমরা কি করে ধরে নিই, কবিতাতে বর্ণিত যুদ্ধে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করবে? তাহলে ‘রাশিয়ান’ও মিলল না, ‘মুসলমান’ও মিলল না।
কবিতাটায় মিলল তাহলে কী?
কবিতা—৬২ (সেঃ—৯)
Au grand de cheramon agora
Seront croisez par ranc tous attachez.
Le pertinax Oppie, & mandragora,
Rougon d’October le tiers seront laschez.
মানে :
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : জাদুবিদ্যা বা ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত কবিতা
এই কবিতাটা স্রেফ উদাহারণ হিসেবে দিলাম। এটা সম্ভবত কোনও ভবিষ্যদ্বাণী নয়। এরকম জাদুবিদ্যা বা ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত কবিতা সব সেঞ্চুরিতেই কয়েকটা করে আছে। সবচেয়ে বেশি এরকম কবিতা আছে সম্ভবত সেঞ্চুরি চার-এ। এরকম কবিতা কেন সেঞ্চুরিস এ লিপিবদ্ধ করলেন নস্ট্রাডামুস, তা বলা মুশকিল। তবে করেছেন। ফলে এরকম কবিতার উদাহরণ আপনাদের দেওয়া উচিত মনে হল। তাই দিলাম। এর আগেও আপনারা সেঞ্চুরি এক-এর কবিতা-১ ও কবিতা—২ দেখেছেন। সেগুলিশ এই ধরনের জাদুবিদ্যা বা ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত।
এই কবিতাটিতে যে ঠিক কী বলতে চাওয়া হয়েছে, তা বোঝা খুব মুশকিল। তবে ‘চেরামন আগোরা’ একটা প্রাচীন এশীয়-শহরের নাম। এখন সে শহরের অস্তিত্ব নেই। নস্ট্রাডামুসের সময়ে ছিল। দ্বিতীয় লাইনের ক্রসগুলি কোনো জাদু বা আধিভৌতিক ব্যাপারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। (এসব কিন্তু এরিকা চিটহ্যামের কথা।) আফিম-গাছ বা ম্যানড্রেক : এগুলো জাদুসংক্রান্ত কাজকর্মে তখন ব্যবহৃত হত। চতুর্থ লাইনের অর্থ ঠিক পরিষ্কার নয়।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
এটা একটা উদাহরণ-কবিতা। এর কোনো বিশ্লেষণের সত্যিই প্রয়োজন নেই। শুধু একটা কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলাম বলেই এই ‘যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ’ হেডিংটা লিখতে হল।
কথাটা হল এই যে, এরিকা চিটহ্যামের ‘জাদু’ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই। জাদু যে সাধারণ কয়েকটা যান্ত্রিক ও হাতের কৌশলে হয়, তাই তিনি জানেন না। তাঁর ধারণা—জাদু মানেই মন্ত্রতন্ত্র, অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার। অন্তত কবিতার ব্যাখ্যা পড়ে তো তাই মনে হচ্ছে। যাঁর জাদু সম্বন্ধে সামান্যতম জ্ঞানটুকুও নেই, তিনি নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে আমাদের কী জ্ঞান দেবেন? যাঁর নিজের চিন্তাই অস্বচ্ছ, তিনি আমাদের স্বচ্ছ চেতনার উন্মেষ ঘটাবেন কী করে?
কবিতা—৯২ (সেঃ—৯)
Le roi vouldra dans cite neuf entrer
Par ennemis expugner lon viendra
Captif libere faulx dire & Perpetrer
Roi dehors estre, loin d’ennemis tiendra.
এর মানে :
রাজা প্রবেশ করতে চাইবেন নতুন শহরে
তাঁরা শত্রুদের হাত থেকে শহরকে ফেরত পাবার চেষ্টা চালাবেন
এক বন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হবে অভিনয় করতে ও কথা বলার জন্য
রাজা থাকবেন বাইরে, শত্রুদের হাত থেকে অনেক দূরে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : নিউ ইয়র্ক শহরের বিপদ
কবিতার বক্তব্য থেকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট, ভবিষ্যদ্বাণীতে রয়েছে কোনো একটি শহর শত্রু কবলে চলে যাবার আভাস। রাজা শহরটাকে ফিরে পেতে চেষ্টা করবেন, দূর থেকে।
এখন এরিকা ব্যাখ্যা করেছেন, শহরটা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক। কেন? কারণ নতুন শহর মানে New City, New City মানেই New York। বুঝুন ব্যাপার!
আর ‘রাজা’ মানে এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট। তিনি দূরে থাকবেন মানে এই যে, তিনি মাটির তলায় গুপ্ত কোনো আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। এসব ঘটবে সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। (আরও দু-একটা কবিতাতে এরিকা New City’র মানে করেছেন New York.)
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
নতুন শহর কীভাবে নিউ ইয়র্ক হল আপনারা দেখলেন। নতুন শহর মানে তো পশ্চিমবাংলার সল্টলেক বা নিউটাউনও হতে পারে। আরও শয়ে শয়ে নতুন শহর আছে, তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেসব তর্ক আর করছি না। সারা বইতে অনেক তো তর্ক করলাম। এবার এই ব্যাখ্যার বিশ্লেষণের জন্য আর তর্ক নাই বা করলাম। আপনারা তো এরিকার এবং অন্যান্য ব্যাখ্যাকারদের কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে এখন পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। তাই আপনারাই বিচার করে স্থির করুন, নতুন শহর মানে নিউ ইয়র্ক হতে পারে কি না।
আর একটা স্ববিরোধিতার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। সেঞ্চুরি ছয়ের ৯৭ নম্বর কবিতাতে (কবিতাটার সারমর্ম ‘থার্ড অ্যান্টিথ্রাইস্ট সম্বন্ধে আরও কিছু ভবিষ্যদ্বাণী’ হেডিং’এর ১ নম্বর পয়েন্টে লিখেছি। প্রয়োজন অনুভবে দেখে নিন।) এরিকা বলেছেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই নিউ ইয়র্ক আক্রমণ হবে, আর ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই যদি হয়, তাহলে এই কবিতাটা খাটে কি করে? এখানে তো বলা হয়েছে নিউ ইয়র্ক শত্রুদের দখলে চলে যাবে। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাকে ফেরত পাবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক ধ্বংস হবে না। তাহলে কোন ভবিষ্যদ্বাণীটা ঠিক?
কবিতা—১০০ (সেঃ—৯)
Navalle pugne nuit sera superee,
Le feu aux naves a l’Occident ruine :
Rubriche neufue la grand nef coloree,
Ire a vaincu, & victoire en bruine.
অনুবাদ করলে দাঁড়ায় :
এক রাতে একটা নৌযুদ্ধ শেষ হবে
পশ্চিমের জাহাজের ধ্বংসস্তূপে আগুন
বিশাল রঙিন জাহাজে নতুন সংকেত
পরাজিতরা হবে ক্রুব্ধ, জয় কুয়াশার মধ্যে।
ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ
পার্ল হারবারের কথা মনে আছে তো? ১৯৪১ সালে এই যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ করল জাপান। এর ফলেই আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং হিরোসিমা, নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ। এই সমস্ত ঘটনাই একের পর এক ছবির মতই ভেসে উঠেছিল নস্ট্রাডামুসের চোখের সামনে। নস্ট্রাডামুস তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় দেখে ছিলেন ভবিষ্যতে পার্ল হারবারের বোমা বর্ষণের দৃশ্য।
এরিকার ব্যাখ্যা : ভোরবেলায় জাপানি প্লেনগুলো এসে বোমাবর্ষণ করেছিল পার্ল হারবারে। জ্বলে উঠেছিল মার্কিনী রণতরীগুলো অর্থাৎ পশ্চিমী জাহাজগুলো। এমনটা যে ঘটবে সে কথা বহু আগেই বলে গিয়েছিলেন নস্ট্রাডামুস তাঁর এই কবিতায়। ‘এক রাতে’ মানে আসলে ‘ভোর’-এ। ‘রাত’ আর ‘ভোর’-এ এইটুকুই যা তফাত।
‘নতুন সংকেত' মানেটা স্পষ্ট নয়। তবে হতে পারে জাপানের এই আক্রমণের একটা সাংকেতিক নাম ছিল। হয়তো তাই বলতে চেয়েছেন নস্ট্রাডামুস।
‘রঙিন জাহাজ' বলতে কি জাহাজের ক্যামোফ্লেজ-রং[৩]-এর কথা বলতে চাওয়া হয়েছে?
শেষ লাইনের মানে : শেষ পর্যন্ত জাপান হবে পরাজিত এবং ক্রুদ্ধ; হিরোসিমা এবং নাগাসাকিকে হারিয়ে। আমেরিকার এ-জয় কিছুটা যেন কুয়াশার মধ্যে। (কেন ?)
যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :
জব্বর ভুলে ভরা লজ্ঝর ব্যাখ্যা। মাথা খারাপ করে দেওয়া ভুলগুলোর দিকে একটু দেখুন :
১। কবিতাতে স্পষ্টই বলা হয়েছে এক রাতে নৌযুদ্ধ শেষ হবে। পার্ল হারবারে নৌ-যুদ্ধই হয়নি, তার শেষ হবে কী? এখানে বোমাবর্ষণ করেছিল বিমান।
২। কবিতায় বলা হয়েছে ‘এক রাতে’, এরিকার বেলায়, তবে এর রাতে-কে দুপুর ভাবতেই বা অসুবিধে কোথায়? কারণ তখন তো পার্ল হারবারের বিপরীত গোলার্ধে ভর-দুপুরই।
৩। ‘পশ্চিম’ মানে ফ্রান্সের পশ্চিম দিকটা হওয়াই স্বাভাবিক, কেননা নস্ট্রাডামুস ছিলেন ফরাসি। ‘পশ্চিম’ মানে আমেরিকা হবার সম্ভাবনাটাই বরং কম। চিন্তাশীল পাঠকরা ক্ষেত্রে দেখুন।
৪। ‘নতুন সঙ্কেত’ আর ‘জাহাজের রং’—ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এরিকা হিমশিম খেয়েছেন। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়, যুক্তিগ্রাহ্য নয়; কেননা, পার্ল হারবারে ক্যামোফ্লেজ-রং করা কোনো জাহাজ ছিল বলে জানা যায়নি।
৫। আমেরিকার জয় কখন হল? ওই রাতে? আর তা কুয়াশায় আচ্ছন্ন জয়ই বা কেন, পরিষ্কার হল না।
- ↑ ম্যানড্রেক : এক রকম গাছ, যা খেলে নেশা হয়।
- ↑ Rougon : বোঝা যাচ্ছে না। ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন, কোনো অজানা জায়গার নাম।
- ↑ ক্যামোফ্লেজ-রং : আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে সমরবস্তুর রং করা হয় যুদ্ধের সময়, যাতে পরিবেশের সঙ্গে সেই সব সমরবস্তু যুদ্ধের সময় শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারে। এই ধরনের পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে রং করাকেই ক্যামোফ্লেজ-রং বলা হয়। সেনা-পোশাক, সেনা-গাড়ি, যুদ্ধবিমান ইত্যাদিতে ক্যামোফ্লেজ-রং হয়।