অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/দ্বিতীয় পর্ব/অধ্যায়: নয়


অধ্যায় নয়


সেঞ্চুরি—৮

সূচি :

 ১। কবিতা—১ : নেপোলিয়ন।

 ২। কবিতা—১৭ : কেনেডি ভাইরা।

 ৩। কবিতা—৬৪ : ব্রিটেন ও নাৎসিরা।

 ৪। কবিতা—৭৭ : তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী বা থার্ড অ্যান্টিগ্রাইস্ট।

 * থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট সম্বন্ধে আরও কিছু ভবিষ্যদ্‌বাণী।

কবিতা—১ (সেঃ—৮)

PAU, NAY, LORON Plus feu qu’s sang sera.
Laude nager, fuir grand au surrez.
Agassas entree refusera.
Pampon, Durance tiendra enserrez.

 অর্থাৎ কিনা :

পও, নে, লরন রক্তের থেকেও আগুন নিয়েই বেশি খেলা করবে।
বিখ্যাত মানুষটা পালাতে বাধ্য হবে সঙ্গমে।
তারা ম্যাগপাই পাখিকে ঢুকতে দেবে না রাজ্যে।
Pampon,[] আর ডুরেন্স তাদের সীমাবদ্ধ রাখবে।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : নেপোলিয়ন

 ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ সংখ্যা আনন্দমেলায় অভীক মজুমদার দাবি করেছেন যে, এই কবিতাতে নেপোলিয়নের কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে। এরিকা চিটহ্যামও তাঁর পুরনো বই—THE PROPHECIES OF NOSTRADAMUS এবং তাঁর নতুন বই—THE FINAL PROPHECIES OF NOSTRADAMUS-এ বোঝাতে চেয়েছেন যে এখানে নেপোলিয়ানের কথাই ভবিষ্যদ্বাণী করে রাখা আছে। এমনকী তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। ওই যে ‘পও, নে, লরন’, ওটাই তো ‘নেপোলিয়ান’। ‘নেপোলিয়ান’, আর ‘পও, নে, লরন’, কথা দুটোয় কত মিল না?

 আনন্দমেলায় শুধু প্রথম দুটো লাইনের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাও আবার ঠিকমতো অনুবাদ করা হয়নি। শেষ দু'লাইনের ব্যাখ্যা আনন্দমেলায় নেই। তবে এরিকা সবটাই অনুবাদ করেছেন। এবং ব্যাখ্যাও করেছেন।

 তৃতীয় লাইনের ব্যাখ্যাটা বেশ মজাদার। ‘ম্যাগপাই’ এক রকম পাখি; এদেশে পাওয়া যায় না; সাদা কালো রং; শালিখের মতো দেখতে; চকচকে জিনিস দেখলে আকৃষ্ট হয়। তৃতীয় লাইনে agassas মানে ম্যাগপাই পাখি। কিন্তু এরিকা বলেছেন ম্যাগপাই-এর ‘ম্যাগ’ বাদ দিলে থাকে ‘পাই’। আর ‘পাই’কে একটু বদলালে পাওয়া যায় ‘পায়াস’। ষষ্ঠ পায়াস, আর সপ্তম পায়াসকে বন্দি করেছিলেন নেপোলিয়ান। (কেমন হল ব্যাখ্যাটা?)

 ষষ্ঠ পায়াসকে ১৭৯৯ সালে হত্যা করা হয়েছিল রোন, আর ভ্যালেন্স নদীর সঙ্গমের কাছেই।

 তবে ডুরেন্স (একটা জায়গার নাম)-এর সঙ্গে এই কবিতার কোনো সম্পর্ক নেই। এই কবিতাতে ওই একটুই যা ভুল :—বলেছেন এরিকা।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 Agassas থেকে ম্যাগপাই। ম্যাগপাই থেকে পাই। পাই থেকে পায়াস। পায়াস থেকে ষষ্ঠ পায়াস, আর সপ্তম। বাঃ! স্বীকার করতেই হয় এরিকা ভাষা নিয়ে চমৎকার খেলতে পারেন। কিন্তু কিছু প্রমাণ করতে পারলেন কী? এরকম ভাষার খেলার বই তো বাজারে কিনতেই পাওয়া যায়। প্রয়োজন হলে আমরা তা কিনে নিতে পারব। এরিকার বইতে আমরা ভাষার খেলা নয়, যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ (authentic proof) চাই, নস্ট্রাডামুসের ক্ষমতার। এসব ছেলেভুলানো ব্যাখ্যা আর কত দেখাবেন এরিকা?

‘পও, নে, লরন’,—তিনটে ভিন্ন শব্দ। একটা নয়। ‘পও,
নে, লরন’ মানে যদি ‘নেপোলিয়ান’ হতে পারে,
তাহলে ‘এরিকা’ মানে 'একজন' এবং
‘চিটহ্যাম’ মানে ‘চিটিংবাজ’ও
হতে পারে! পারে না?


কবিতা—১৭ (সেঃ—৮)

Bien aisez subit seront desmis
Par trois freres le monde mis en trouble
Cite marine saisiront ennemis,
Faim, feu, sang, peste & de tous maux le double.

 এর অর্থ হল :

যারা সুখে ছিল, তাদের অবস্থার হঠাৎ অবনতি হবে
পৃথিবীকে বিপদে ফেলবে তিন ভাই,
তাদের শত্রু ছিনিয়ে নেবে সামুদ্রিক শহরটিকে,
ক্ষুধা, আগুন, রক্ত, প্লেগ, এবং পাপ হবে দ্বিগুণ।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : কেনেডি ভাইরা

 এরিকা চিটহ্যাম ধারণা পোষণ করেন যে, এই কবিতাতে হয়তো তিন কেনেডি ভাই, অর্থাৎ জন এফ কেনেডি, রবার্ট এফ, কেনেডি, এবং এডওয়ার্ড কেনেডির কথা বলতে চাওয়া হয়েছে। এরিকার এ-কথা বলার পেছনে যুক্তি হল এই যে, নামকরা তিন ভাই বলতে এদের নামই চট করে মাথায় আসে। দুর্ভাগ্যবশত (!) দুই ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। বেঁচে আছেন ছোটটি—এডওয়ার্ড কেনেডি। এরিকা বলেছেন, এই তিন ভাই বেঁচে থাকলে আমেরিকায় নানা গণ্ডগোল হবে; নাকি বলতে চাওয়া হয়েছে প্রথম লাইনে। দ্বিতীয় লাইন সম্বন্ধে বলেছেন যে,

ছোট ভাইটি, যিনি এখনও বেঁচে আছেন, তিনি হয়তো ভবিষ্যতে আমেরিকাকে বিপদে ফেলবেন। চতুর্থ লাইনের কোনো ব্যাখ্যা নেই।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 পৃথিবীর ইতিহাসে নামজাদা তিন ভাই বহু এসেছেন। কেনেডিরাই একমাত্র নন, বলা বাহুল্য। কেনেডিরা বেঁচে থাকাকালীন আমেরিকায় নানা গণ্ডগোল হবে—এতে আশ্চর্যের কী আছে? ছোট-বড়, নানা মাপের গণ্ডগোল তো পৃথিবীর সর্বত্রই সর্বদাই হচ্ছে। রোজই হচ্ছে। এই ভবিষ্যদ্বাণীর পেছনে নস্ট্রাডামুস বা এরিকা, কারোরই বিশেষ কৃতিত্ব দেখতে পাচ্ছি না।

 এরিকা বলেছেন পৃথিবীকে বিপদে ফেলবেন ছোট ভাই—এডওয়ার্ড কেনেডি কিন্তু কবিতাতে তো তিন ভাইয়ের কথা বলা হয়েছে। লাইনটা আবার দেখুন—“পৃথিবীকে বিপদে ফেলবে তিন ভাই”। তাছাড়া এডওয়ার্ড কেনেডির প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রে এক সময়ে থাকলেও, এখন প্রায় নেই। এই প্রভাবহীন মানুষটা ভবিষ্যতে আমেরিকাকে বা পৃথিবীকে বিপদে ফেলবেন, এমন ভাবাটা কষ্টকর।

কবিতা—৬৪ (সেঃ—৮)

Dedans les Isles enfans transportez,
Les deux de sept seront en desepoir,
Ceux du terrouer en seront supportez,
Nom pelle prins, des ligues fui l’espoir.

 এর মানে দাঁড়ায় এইরকম :

শিশুদের সরিয়ে ফেলা হবে দ্বীপগুলিতে,
সাতজনের মধ্যে দু'জন হয়ে পড়বে হতাশ,
যারা সেই দেশের বাসিন্দা, তারা পাবে সমর্থন,
‘pelle’[] নাম নিয়ে তারা কাজ করবে, কিন্তু অসমর্থ হবে।

 ব্যাখ্যাকারদের ব্যাখ্যা : ব্রিটেন ও নাৎসিরা

 আধুনিক ব্যাখ্যাকাররা (এবং এরিকা চিটহ্যামও) মনে করেন এখানে নাৎসিদের দ্বারা ব্রিটেন ঘেরাও-এর কথা কিছু বলতে চাওয়া হয়েছে। কী বলতে চাওয়া হয়েছে, তা তাঁরা খোলসা করে বলেননি। কী দেখে তাঁদের একথা মনে হল তাও বলেননি। লাইন ধরে ধরে পুরো কবিতাটার ব্যাখ্যাও নেই এরিকার বইতে। তিন লাইনের ব্যাখ্যাতে শ্রেফ এইটুকুই বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে যে, ‘pelle’ শব্দটার তাৎপর্য বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 কবিতাটার এরকম ব্যাখ্যা করার কারণ বোধগম্য হল না। কোথায় শিশু, কারা শিশু? ‘সাতজনের মধ্যে দু’জন’ কথাটারই বা তাৎপর্য কী? তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনই বা কী অর্থ বহন করে? গোটা কবিতাটাই তো ব্যাখ্যার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। কী দেখে ব্যাখ্যাকাররা সিদ্ধান্তে এলেন যে, কবিতাটা ব্রিটেন ও নাৎসি-সংক্রান্ত?

 বাংলা পত্রপত্রিকাগুলোতে নস্ট্রাডামুস-সংক্রান্ত লেখায় আসল কবিতাগুলি দেওয়া হয় না। যা খুশি বাংলা অনুবাদ পেশ করা হয়। কোনো কোনো বই ও পত্রিকায় আবার কবিতার বাংলা অনুবাদটুকুও দেওয়া হয় না। কেবল ফলাও করে বলা হয় যে, নস্ট্রাডামুস সফল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন হিটলার, নেপোলিয়ান, আয়াতুল্লা, ফরাসি-বিপ্লব...প্রভৃতি সম্পর্কে। বিশাল সংখ্যায় মানুষ এই গুলগুলিকে খেয়ে এসেছে। এবং হজমও করেছে। এখন আমার জোগাড় করা আসল ফ্রেঞ্চ কবিতা, এবং তার সঠিক বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মানুষকে এতদিন কীভাবে ঠকানো হচ্ছিল! কীভাবে ভুল বোঝানো হচ্ছিল! কীভাবে সাধারণ, পাগলাটে কবিতাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে অসাধারণ করে তোলা হচ্ছিল! এই হল নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যদ্‌বাণীর রহস্য।

কবিতা—৭৭ (সেঃ—৮)

L’antechrist trois bien tost annichilez,
Vingt & sept ans sang duerera sa guerre.
Les heretiques mortz, captifs, exilez,
Sang crops humain can rougi gresler terre.

 মানে হচ্ছে :

খ্রিস্টবিরোধী শীঘ্রই তিনজনকে শেষ করবে,
সাতাশ বছর তার যুদ্ধ স্থায়ী হবে।
অবিশ্বাসীরা মৃত, বন্দি বা নির্বাসিত হবে।
রক্তাক্ত শব, জল, লাল শিলাতে পৃথিবী যাবে ছেয়ে

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী বা থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট

 (নস্ট্রাডামুসের সেঞ্চুরিস-এ থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট এক উল্লেখযোগ্য নাম। এ নিয়ে একটু পরেই আলোচনায় আসছি। কেননা নস্ট্রাডামুসের বেশ কিছু কবিতায় বলা আছে তিনজন অ্যান্টিখ্রাইস্ট বা খ্রিস্টবিরোধী আসবেন। ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন, প্রথম দুজন হলেন নেপোলিয়ান এবং হিটলার। তৃতীয়জন এখনও আসেননি। ফলে তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীকে নিয়ে ব্যাখ্যাকারদের নানা জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হয়ে গেছে। উদাহরণ হিসাবে তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী-সংক্রান্ত একটি কবিতা আপনাদের সামনে পেশ করলাম।)

 শ্রীমতী চিটহ্যাম মনে করেন এ কবিতাতে নস্ট্রাডামুস থার্ড অ্যান্টিগ্রাইস্ট সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাঁর ধারণা এই থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট যে তিনজনকে শেষ করবে, তারা সম্ভবত কেনেডি ভাইরা। তবে প্রথম দুই কেনেডি-ভাই এখন মৃত। এবং তাঁদেরকে একই লোক হত্যা করেনি। তৃতীয় কেনেডিকেও যদি হত্যা করা হয়, তাহলেও তিনি প্রথম ও দ্বিতীয়’র আততায়ীর হাতে খুন হবেন না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত, কারণ এই দুই আততায়ী আমেরিকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে না। তবুও কী করে এরিকার মনে হল যে, থার্ড অ্যান্টিথ্রাইস্টই এই তিন ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ হবেন? তার জবাবও দিয়েছেন এরিকা। যদিও জবাবটা সন্তোষজনক নয়। এরিকা মনে করেন, থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট কোনো মানুষ নাও হতে পারে। হতে পারে কোনো আন্দোলন বা দর্শন। এই আন্দোলন বা দর্শনের সমর্থকরাই হয়তো এই তিন ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ হবেন। এরিকা অবশ্য তাঁরা এই ব্যাখ্যার সততার প্রতি নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন। “...অবশ্য মনে হয় নস্ট্রাডামুস থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট বলে কোনো মানুষের কথাই বলতে চেয়েছিলেন।” “মনে হল” এরিকা ওরকম ব্যাখ্যা করতে গেলেন কেন? এসব ঘটনা এরিকার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগাচ্ছে না কি?

 দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনের বক্তব্য পরিষ্কার। অবশ্য ‘অবিশ্বাসীরা' মানে ঠিক কারা, বুঝতে পারলাম না। যুক্তিবাদীরা কী? তাহলে বলতে হয় নস্ট্রাডামুস যুক্তিবাদী মানুষদের সম্বন্ধেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী কি মানুষ, না আন্দোলন, না দর্শন, সে ব্যাপারে এরিকার বক্তব্য স্পষ্ট নয়। ধোঁয়া-ধোঁয়া রেখে দেওয়াটা এরিকার চালাকি ছাড়া আর কিছু নয়। বক্তব্য ধোঁয়া-ধোঁয়া রেখে দিলে পরে তা পাল্টানো সহজ হয়। তাই এই কৌশল।

 ব্যাখ্যাটা এমন হলে কেমন হয়, সহৃদয় পাঠক-পাঠিকারা একটু ভেবে দেখতে পারেন :

 খ্রীস্টবিরোধী বা অ্যান্টিগ্রাইস্ট বলতে নস্ট্রাডামুস বাস্তবিকই এক দর্শন, এক মতাদর্শগত আন্দোলনের কথাই বলেছিলেন। আর এই দর্শনের নাম ‘যুক্তিবাদ’ এবং আন্দোলনের নাম ‘যুক্তিবাদী আন্দোলন’। এই আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৮৫তে ভারতে নব-যুক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা লগ্ন থেকে। চলবে ২৭ বছর ধরে এই সংগ্রাম। পরিণতিতে খ্রীস্টবিরোধী অর্থাৎ যুক্তিবাদী চিন্তাধারা শেষ করবে তিনজনকে অর্থে তিন বিজ্ঞান-বিরোধী, সত্য-বিরোধী পৃথিবীর প্রধান ধর্ম বিশ্বাসকে। ‘অবিশ্বাসীরা’ অর্থাৎ সত্যে যারা বিশ্বাস করে না, মানে ওই তিন অন্ধ-বিশ্বাসে আবদ্ধ ধর্ম-বিশ্বাসীরা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ঠেকাতে গিয়ে নিপীড়িত মানুষদের হাতে মরবে, বন্দি হবে, অথবা হবে নির্বাসিত। সাতাশ বছর ব্যাপী এই আদর্শ বনাম অনাদর্শের লড়াইতে পৃথিবী রক্তে লাল হবে। তবে জয় শেষ পর্যন্ত অ্যান্টিগ্রাইস্টরাই পাবে।

 যুক্তিবাদী আন্দোলন যেভাবে এগুচ্ছে, মনে হচ্ছে এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক এরিকা আমার এই ব্যাখ্যাটা একটু ভেবে দেখতে পারেন। পরবর্তী সংস্করণে তাঁকে এই ব্যাখ্যাটা ব্যবহার করার আগাম অনুমতি দিয়ে রাখলাম।

 থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট সম্বন্ধে আরও কিছু ভবিষ্যদ্‌বাণী

 উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় নস্ট্রাডামুসের ব্যাখ্যাকাররা ধেইধেই করে নেচে উঠে প্রচার করতে আরম্ভ করেছিলেন যে, সাদ্দাম হুসেনই তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী, বা থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট; এবং উপসাগরীয় যুদ্ধ চলবে ২৭ বছর। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে উপসাগরীয় যুদ্ধ শেষ এবং সাদ্দামের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের প্রচারের বেলুন ফুটুস করে ফেটে চুপসে গেছিল।

এরিকা চিটহ্যামের দ্বিতীয় বই THE FURTHER PROPHECIES OF NOSTRADAMUR-এ তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীকে নিয়ে তিনি একটা আলাদা দীর্ঘ অধ্যায়ই রচনা করে ফেলেছেন। সেই বই আবার বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। বইয়ের নাম, ‘নস্ত্রাদামুসের আরো ভবিষ্যদ্‌বাণী’। অনুবাদক — সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়। সন্তোষবাবু এরিকার বইটা প্রায় লাইন-টু-লাইন অনুবাদ করেও কোথাও স্বীকার করার সৌজন্যতাবোধটুকুও দেখান নি যে, তিনি এরিকা চিটহ্যামের THE FURTHER PROPHECIES OF NOSTRADAMUS থেকেই অনুবাদ করেছেন। এক জায়গায় স্রেফ ছোট করে লিখেছেন, ‘এরিকা চিঠাম অনুসরণে’। যাহোক, আসল কথায় ফিরে আসা যাক। এই বাংলা বইটিতেও স্বভাবতই তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীকে নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় রয়েছে। এই অধ্যায়ে তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীকে নিয়ে যেসব ভবিষ্যদ্‌বাণী করা হয়েছে বলে দাবি করেন এরিকা, তা এরকম :


 ১। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে নিউ ইয়র্ক শহরের আর রাজ্যের উপর প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ধ্বংস হয়ে যাবে নিউ ইয়র্ক। দায়ী—থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট? (সেঃ—৬; কবিতা—৯৭)

 ২। নিউ ইয়র্কের জল বিষাক্ত হয়ে পড়বে রাসায়নিক হাতিয়ারের আক্রমণের ফলে (সেঃ—১০; কবিতা—৪৯)

 ৩। তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী খ্রিস্টান হবেন না। সম্ভবত একজন ইসলামধর্মীয় এশিয়ার মানুষ (সেঃ—২; কবিতা—২৮)

 ৪। তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীর নাম হবে সম্ভবত ‘মেবাস’। (সেঃ—২; কবিতা—৬২)

 ৫। তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীর নাম ‘অ্যালাস’ও হতে পারে। (সেঃ—৬; কবিতা—৩৩)

 ৬। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগনও এই তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী হতে পারেন! (সেঃ—১০; কবিতা—৬৬)

 ৭। কোনো সন্দেহই নেই যে, তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী জন্মাবেন এশিয়াতে। (সেঃ—১০; কবিতা—৭৫)

 ৮। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ তে! (সেঃ—১; কবিতা—৫১)

 ৯। তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধী হবেন একজন মঙ্গলী, এবং তাঁকে আমরা দেখতে পাব ১৯৯৯ সালে। (সেঃ—১০; কবিতা—৭২)

 ১০। তৃতীয় খ্রিস্টবিরোধীই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য হবেন প্রধানত দায়ী; এবং এই যুদ্ধ চলবে ২৭ বছর ধরে! (সেঃ—৮; কবিতা—৭৭)

 ভবিষ্যদ্‌বাণীগুলো নিয়ে দু-একটা কথা :

 ভবিষ্যবাণীগুলি দেখলেন। তা বলে মনে করলেন না যে, ভবিষ্যদ্‌বাণীগুলি ঠিক এইরকমভাবেই লিখে গেছিলেন নস্ট্রাডামুস। তিনি লিখে গেছিলেন অন্য কিছু। তার ব্যাখ্যা করে এরিকা চিটহ্যাম এই দাঁড় করিয়েছেন। যেমন, নস্ট্রাডামুস একটা কবিতায় লিখেছিলেন—‘নতুন শহর’। এরিকা ব্যাখ্যা করলেন, নতুন শহর মানে New City| New city মানে New York। এইভাবেই নিউ ইয়র্ক নামটা ভবিষ্যদ্‌বাণীতে পাওয়া গেল। নতুন শহর মানে পশ্চিমবাংলার সল্টলেক কেন নয়, তা জানি না।

 আর ভবিষ্যদ্‌বাণীগুলিতে চূড়ান্ত স্ব-বিরোধিতা তো প্রকট। কোথাও বলা হয়েছে থার্ড অ্যান্টিগ্রাইস্টের নাম ‘মেবাস’ কোথাও ‘অ্যালাস’, কোথাও বা রোনাল্ড রেগন! থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট যদি এশিয়ান, মঙ্গলী এবং অ-খ্রিস্টানই হল, তাহলে তিনি রোনাল্ড রেগন কী করে হবেন?

 আর একটা কথা। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের উল্লেখ কিন্তু ‘সেঞ্চুরিস’-এর কোথাও নেই। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাকে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বলে কোথাও তকমা আঁটেননি নস্ট্রাডামুস। ও কাজটা করেছেন ব্যাখ্যাকাররা।

 ১৯৯৫, ১৯৯৯ অতিক্রান্ত। (বইটি তার আগে লেখা হয়েছিল।) বিশ্বযুদ্ধ লাগেনি। মঙ্গোলীয় অ্যান্টিখ্রাইস্টকেও ১৯৯৯ সালে আমরা দেখিনি।

 অপেক্ষা করে দেখুন থার্ড অ্যান্টিখ্রাইস্ট সংক্রান্ত ক'টা ভবিষ্যদ্‌বাণী মেলে।

  1. এই শব্দটার মানে কোনো ডিকশেনারিতেই পাওয়া গেল না। এটা ইংরেজি শব্দ তো নয়ই, ফরাসিও নয়, লাতিনও নয়। গ্রিক হতে পারে। কোনো জায়গার নাম নয়।
  2. pelle : এর কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি। এর অর্থ আজও অজানা। ভাষাতত্ত্ববিদরা বলেছেন এর কাছাকাছি শব্দ Montpellier-এর অর্থ ‘শাবল’। pelle মানে শাবল?