অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: তেরো
অধ্যায় : তেরো
জ্যোতিষ-সম্রাজ্ঞী ও মানবী কম্পিউটর শকুন্তলাদেবী এবং একটি চ্যালেঞ্জ
কলকাতা তথা তামাম ভারতের জ্যোতিষীরা দ্বিতীয় বিশাল আঘাত পেলেন যখন মানবী কম্পিউটার এবং ভারতবর্ষের বৃহত্তম জ্যোতিষ সংস্থা ‘Indian Institute of Astrology’-র পৃষ্ঠপোষক, জ্যোতিষসম্রাজী শকুন্তলাদেবী আমার সরাসরি খোলামেলা চ্যালেঞ্জে সাড়া না দিয়ে কলকাতা ছেড়ে পালালেন। এতে তিনি ভরা-ডুবির হাত থেকে বাঁচলেও ডোবালেন তাঁর মুখাপেক্ষী কয়েক হাজার জ্যোতিষীকে।
শকুন্তলাদেবী বাস্তবিকই চতুর। প্রথমবার আকাশবাণীর ওই উল্লিখিত অনুষ্ঠানে তিনি আমার বিরুদ্ধে হাজির হননি। জানতেন হাজির না হওয়ার যে অপমান, তাঁর চেয়ে বহুগুণ বড় মাপের অপমান তাঁর জীবনে নেমে আসবে, যদি হাজির হয়ে পরাজিত হন। দ্বিতীয়বার আমার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গুছোন জ্যোতিষ-ব্যবসা ফেলে স্রেফ পালিয়েছিলেন। পালাবার তাড়ায় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে নিজের জিনিসপত্তর নিয়ে যাওয়ার মতোও সময় দিতে পারেননি।
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ কলকাতার সান্ধ্য দৈনিক ‘ইভিনিং ব্রিফ’-এর পাতা জুড়ে ‘দ্য মিসটিক্যাল লেডি অব দ্য কমপিউটার’ শীর্ষকে তথাকথিত ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ শকুন্তলাদেবীর ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় শকুন্তলাদেবী বলেছেন, ‘অ্যাসট্রোলজি ইজ অলসো ও পার্ট অব ম্যাথামেটিক্স’। অর্থাৎ জ্যোতিষ অংকেরই একটি শাখা। অন্যত্র বলেছেন, ‘অ্যাসট্রোলজি ইজ দ্য কিং অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স’; অর্থাৎ কিনা, জ্যোতিষ হল ব্যবহারিক বিজ্ঞানের রাজা।
শকুন্তলাদেবীকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কি কোনও অনুষ্ঠানে কখনও অংক কষায় ভুল করেছেন?”
শকুন্তলাদেবীর উত্তর, ‘আই হ্যাভ নেভার হ্যাড এনি সিলিপ্ আপস বিকজ আই অ্যাম টু কনফিডেন্ট অব মাইসেলফ্।’
আমি কখনও কোনও ভুল করিনি, কারণ আমার নিজের উপর অতিমাত্রায় বিশ্বাস আছে।
মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। সময়ে তাই অনেক কিছুরই বিস্মরণ ঘটে। কিন্তু, শকুন্তলাদেবীর স্মৃতি তো আজ কিংবদন্তি। গিনিজ বুক অব রেকর্ডস-এ তাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে। এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারিণী মহিলাটিকে বিনীতভাবে ১৯৭২ সালের একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়া দেওয়া যেতে পারে। দিনটি ছিল সম্ভবত ২ আগস্ট।
স্থান—কলকাতা জেনারেল পোস্ট অফিসের করেসপনডেন্স হল। শকুন্তলাদেবীকে ঘিরেই অনুষ্ঠান। তখনও শকুন্তলাদেবী পেশাদার জ্যোতিষী হয়ে ওঠেননি, হয়ে ওঠেননি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাসট্রোলজির সম্মানীয় পৃষ্ঠপোষক। সেদিনের অনুষ্ঠানে শকুন্তলাদেবী অংক কষতে গিয়ে বার বার পর্যুদস্ত হচ্ছিলেন, বিপর্যস্ত হচ্ছিলেন। এই অসাধারণ মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেল-সহ কয়েক’শ মানুষ।
শকুন্তলাদেবীর আগেও অনেকেই মুখে মুখে অংক কষার ক্ষমতা দেখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রামানুজন এবং সোমেশ বসুর নাম তো অংক-প্রিয়দের প্রায় সকলেরই জানা। শকুন্তলাদেবী এবং অন্য যাঁরাই মুখে মুখে বিশেষ ধরনের কিছু অংক কষেন তারা সেগুলো কষেন অংকের কিছু সূত্রের সাহায্যে। এই সূত্রগুলো জানা থাকলে এবং কঠোর অনুশীলন করলে ক্লাস এইটের মধুও ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ হয়ে উঠতে পারে।
শকুন্তলাদেবীর সাক্ষাৎকারটির পরিপ্রেক্ষিতে আমি পরের দিনই ‘ইভনিং ব্রিফ’ পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে জানাই শকুন্তলাদেবীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র এক নয়। জ্যোতির্বিদ্যার বিষয়, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি নিরূপণ করা। আর জ্যোতিষশাস্ত্রের বিষয় হল মানবদেহে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব নিরূপণ করা। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। বহু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বর্তমানে জ্যোতির্বিদ্যা বিজ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠিত। জ্যোতিষশাস্ত্রকে কিন্তু বিজ্ঞান স্বীকার করে না। শকুন্তলাদেবী জ্যোতিষকে ‘ব্যবহারিক বিজ্ঞানের রাজা’ এবং ‘অংকশাস্ত্রের শাখা’ ইত্যাদি মিথ্যে ও উদ্দেশ্যমূলক কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন, এবং বাড়াচ্ছেন নিজস্ব ব্যাংক ব্যালেন্স। শকুন্তলাদেবীকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, তিনি প্রমাণ করুন তাঁর কথাগুলো সত্যি। শুধু শুকনো আলোচনা নয়, শকুন্তলাদেবীকে কয়েকজনের হাত, রাশিচক্র বা জন্ম সময় দেখে তাঁদের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নগুলো হবে খুবই সহজ-সরল। জাতকের আয়ু, আয়, বিয়ে, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, এইসব প্রচলিত বিষয়েই তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখব। শতকরা ৮০ ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই তাঁকে আমি ৫০,০০০ টাকা দেব। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হলে শকুন্তলাদেবীকে জানামনত হিসেবে ৫,০০০ টাকা জমা দিতে হবে।
Evening Brief আমাকে দিয়ে একটি প্রতিজ্ঞাপত্র লিখিয়ে নিলেন, যা বাস্তবে একটি চুক্তিপত্র। Evening Brief কর্তৃপক্ষ সুনিশ্চিত ছিলেন, শকুন্তলাদেবী তাঁর বিশ্ব-বিখ্যাত ইমেজ ধরে রাখতে অবশ্যই আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। অপরপক্ষে আমি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দেওয়ার পর আমাকেও হালকাভাবে নিতে পারছিলেন না। অতএব তাঁরা যথেষ্ট রোমাঞ্চিত হলেন। শকুন্তলাদেবী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার পর সারা ভারতে হইচই ফেলে দিয়ে কী করে কোথায় আমাদের দু'জনকে মুখোমুখি করা যায়, তার পরিকল্পনাও সেইদিনই শুধু হয়ে গেল Evening Brief-এর প্রিয়ব্রত চ্যাটার্জির নেতৃত্বে। এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার রঞ্জন সেনগুপ্ত এই পরিকল্পনার আলোচনায় অংশ নিলেন। ওঁরা দু’জনেই একমত হলেন—আমার ও শকুন্তলাদেবীর এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক রূপ দিতে হবে। ব্যবস্থাপক হিসেবে ‘ইভিনিং ব্রিফ’, ‘এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানী’র সঙ্গে একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠিকেও শামিল করা হবে। আমন্ত্রণ জানানো হবে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বিদেশী দূতাবাসগুলোকে।
শেষ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে মতৈক্য আসা গেল, (১) শকুন্তলাদেবী যে তারিখ দেবেন সেই তারিখই আমাকে মেনে নিতে হবে। (২) সেদিন কোনওভাবে আমি বা শকুন্তলাদেবীর মধ্যে কেউ হাজির না হলে, অনুপস্থিত ব্যক্তিকেই পরাজিত ও পলাতক হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। (৩) চ্যালেঞ্জ হবে দুটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে চ্যালেঞ্জে উভয়ে মিলিত হবার বেশ কিছুদিন আগে আমি চারজন জাতকের জন্ম সময় শকুন্তলাদেবীকে পৌঁছে দেব। এই জাতকদের জন্ম সময়গুলো অবশ্যই হাসপাতাল বা অতি বিখ্যাত নার্সিংহোমের দেওয়া জন্ম সাল, তারিখ, সময় ও ঠিকানা সম্বলিত হতে হবে, যাতে প্রয়োজনে যে কেউ সুনির্দিষ্টভাবে ওই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারেন। (৪) প্রত্যেকের অতীত সম্পর্কে পাঁচটি করে প্রশ্ন রাখতে হবে আমাকে। (৫) ওই জাতকে সেদিনের (চ্যালেঞ্জের দিনের) অনুষ্ঠানে হাজির করতে হবে আমাকে। (৬) শকুন্তলাদেবীর উত্তর শোনার পর জাতকরা সেই প্রতিটি উত্তর বিষয়ে মতামত দেবেন; জানাবেন উত্তর ঠিক, কি ভুল। ভুল হলে জানাবেন সঠিক উত্তরটা কী। (৭) উত্তর শুনে শকুন্তলাদেবী বা আমি সন্দেহ প্রকাশ করলে তিনজন সাংবাদিক এবং আমার ও শকুন্তলাদেবীর পক্ষে একজন করে অর্থাৎ মোট পাঁচজনকে নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই। ওই কমিটি তিন দিনের মাথায় আবার একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁদের অনুসন্ধান রিপোর্ট পেশ করবেন। ওই রিপোর্ট আমাকে এবং শকুন্তলাদেবীকে মেনে নিতে হবে। (৮) শকুন্তলাদেবী মোট ২০টি প্রশ্নের মধ্যে ১৬টি বা তার বেশি প্রশ্নের উত্তর ঠিক দিতে পারলে শকুন্তলাদেবী জয়ী ঘোষিত হবেন। (৯) সাংবাদিক সম্মেলনের আগে ব্যবস্থাপকদের হাতে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা, এবং শকুন্তলাদেবীকে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। (১০) যিনি জয়ী হবেন তিনি মোট পঞ্চান্ন হাজার টাকার অধিকারী হবেন। (১১) এ-ছাড়াও শকুন্তলাদেবী রাজি হলে তাঁর সঙ্গে আমাকে “Astrology Vs Science” শিরোনামে একটি আলোচনায় অংশ নিতে হবে। (১২) এই আলোচনার মাধ্যমে কোনওভাবেই কারও পূর্ব-ঘোষিত জয়-পরাজয়ের পরিবর্তন হবে না।
আমি প্রতিটি শর্তেই রাজি হলাম। ফলে পরের দিন ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় Evening Brief-এর প্রথম পৃষ্ঠায় চারপাশে বর্ডার দিয়ে বড় বড় হরফে ছাড়া হলো “Shakuntala Devi challenged"|
Shakuntala Devi challenged
CACUTTA, Feb.6. – The "human computer"-turned-astrologer. Ms Shakuntala Debi, has been challenged by Mr Prabir Ghosh, a bank employee by profession and rationalist by choice. He has challenged Shakuntala Devi to make a perfect astrological calculation on the hypothesis provided by him.
Mr Ghosh, secretary of the Rationalists' Association of India, has pledged to pay Rs 50,000 if he fails to provide a rationalist explanation to any supernatured event. Astrology is not a science, it is false and vauge, Mr Ghosh said.
In his book “Aloukik Noy, Loukik”, Mr Ghosh has exposed the myths and mystiques of godmen. The second edtion of the book is being translated into English, French and Hindi.
Mr Ghosh's challenge has one precondition. The mathematical wizard has to make a security deposit of Rs 5,000 which, along with the prize money of Rs 50,000, will be refunded if Mr Ghosh is defeated. This is a pracautionary measure if she backs out. Shakuntala Devi has avoided him on previous occassions, said Mr Ghosh.–Sambad
একতলার রিসেপশন কাউন্টার থেকে সাংবাদিকদের বলা হয়, শকুন্তলাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে হলে দয়া করে এখানে থেকে তাঁকে ফোন করুন।
ফোন করে ‘ইভিনিং ব্রিফ’ প্রতিনিধি। শকুন্তলা দেবীর এক সহকারিণী জানান—শকুন্তলাদেবী চ্যালেঞ্জের খবরটা পেয়েছেন, কিন্তু ভালভাবে পড়ে উঠতে পারেননি। এখন কাস্টমারদের নিয়ে খুবই ব্যস্ত আছেন, পরে তিনি এই বিষয়ে মতামত ও প্রতিক্রয়া জানাবেন। এখন তিনি কারও সঙ্গেই দেখা করতে পারবেন না।
নাছোড়বান্দা সাংবাদিকরা আরও কয়েকবার ফোন করে কয়েকটা মিনিট সময় চাইলেন। সময় মিলল না। শকুন্তলাদেবীকে ফোনটা দেবার অনুরোধ জানালেন ‘ইভিনিং ব্রিফ’ এর প্রতিনিধি। অনুরোধ রক্ষিত হল না। ক্রুদ্ধ পত্রিকা প্রতিনিধি রাগে ফেটে পড়লেন। ফোনেই বললেন, “আমাদের কি তবে এমন অদ্ভুত কথাগুলো বিশ্বাস করতে হবে যে, শকুন্তলাদেবী তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর খবরটা ভাল করে পড়ার জন্য সময় দেওয়ার চেয়ে খদ্দেরদের ভবিষ্যৎ-গোনাকে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন? আর চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন কে? না, র্যাশানালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি প্রবীর ঘোষ। প্রবীরবাবু তো স্পষ্টতই অভিযোগ এনেছেন, শকুন্তলাদেবী এর আগে অল ইন্ডিয়া রেডিওর অ্যারেঞ্জ করা ডিবেটে পার্টিসিপেট করেননি হেরে যাবার ভয়ে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তিনি চুপ করে থাকলে এটাই কি আমরা ধরে নেব না, যে এবারও তিনি ভয়ে প্রবীরবাবুকে এড়াতে চাইছেন?”
“দুঃখিত, এর জবাব আমরা দিতে পারছি না। আপনাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতেও পারছি না।”
“ঠিক আছে, শকুন্তলাদেবীকেই ফোন দিন। তাঁকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করব, তিনি প্রবীরবাবুর এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক অথবা অনিচ্ছুক। ইচ্ছুক হলে পরে ডিটেলস্-এ বিভিন্ন ক্লজ অ্যান্ড কন্ডিশন নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
উত্তরে এবার শকুন্তলাদেবীর সহকারিণী জানালেন, “তিনি তো এখন ঘরে নেই। জরুরি ফোন পেয়ে এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। আপনাদের শুধু এইটুকুই বলতে পারি, শকুন্তলাদেবী তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর খবর পেয়েছেন। এই বিষয়ে ফিরে এসে মন্তব্য করবেন।”
“ওঁকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?”
“তা বলতে পারছি না, তবে এইটুকু বলতে পারি তিনি কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন। ফিরবেন সাত-আট দিন পর। তখনই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই বিষয়ে মতামত জানাবেন।”
“তাহলে যেসব ক্লায়েন্টরা এই ক'দিনের অ্যাপয়েনমেন্ট পেয়েছেন তাদের কী হবে?”
“সব বাতিল করে দেওয়া হল।” জানালেন সহকারিণী।
সেদিন সন্ধ্যায় আমিও সাংবাদিকদের সঙ্গী হয়েছিলাম। ঘটনাগুলো ঘটেছিল আমারও চোখের সামনে।
না, হোটেলের সামনের পথ ধরে শকুন্তলাদেবী বের হয়নি। সাংবাদিকদের চোখ এড়াতে পিছনের পথ দিয়ে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বেচারা, তাড়াহুড়োয় হোটেলের বিল মিটিয়ে সহকারিণীটিকে নিয়ে যাওয়ারও সময় সুযোগ পাননি। আর সেই পালানোর সময় পিছনের দরজায় নজর রাখা চিত্র সাংবাদিক কল্যাণ চক্রবর্তীর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে ‘সানন্দা’, ‘আলোকপাত’ সহ বিভিন্ন ভাষাভাষীর পত্রিকাতেই চ্যালেঞ্জের মুখে শকুন্তলাদেবীর পলায়নের উত্তেজক খবরের সঙ্গে কল্যাণের তোলা ‘স্বেচ্ছা নির্বাসনে শকুন্তলা’ ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল। হায়, জ্যোতিষসম্রাজ্ঞী! আপনিও শেষ পর্যন্ত পারমিতা, অসিত চক্রবর্তী, শুকদেব গোস্বামী ও পাগলাবাবার মতোই শুধু পরের অদৃষ্টই বিচার করে গেলেন; নিজের অদৃষ্ট বিচার করতে পারলেন না?
১৯৮৭-র ফেব্রুয়ারিই ছিল তাঁর কলকাতায় বাণিজ্য চালাবার, প্রতারণা চালাবার শেষ বছর। তারপর তিনি আর একটি দিনের জন্যেও কলকাতায় ব্যবসা চালাবার হিম্মত দেখাননি, বা আহাম্মুকি করেনি।
ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী পত্র-পত্রিকায় চ্যালেঞ্জের মুখে শকুন্তলাদেবীর নিশ্চিন্ত পরাজয় এড়াতে পালিয়ে বাঁচার দুর্বল চেষ্টার কথা প্রকাশিত হয়েছে এমনও হয়েছে, শকুন্তলাদেবী বোম্বাই বা মাদ্রাজের মত যে বড় শহরগুলোতে গুছিয়ে বসতে গেছেন, সেখানকার স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলোতেই শকুন্তলাদেবীর পালিয়ে বাঁচার চেষ্টার কথা প্রকাশিত হয়েছে। ফলে স্থানীয় সাংবাদিকদের বহু অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই সব সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকা ও সাংবাদিকরা যখনই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি ওখানে গিয়ে শকুন্তলাদেবীর মুখোমুখি হতে রাজি আছি কি না? প্রত্যেককে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে জানিয়েছি অবশ্য রাজি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শকুন্তলাদেবী সেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়া শহর ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য শহরে। শেষ পর্যন্ত তাড়া খেতে খেতে শকুন্তলাদেবী ভারতের পাট তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে নিউইয়র্ক থেকে এসেছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. রণজিৎকুমার দত্ত। ড. দত্ত নিউ-ইয়র্ক থেকে ‘Culural Association of Bengal’ কর্তৃক প্রকাশিত একমাত্র বাংলা পত্রিকা ‘সংবাদ বিচিত্রা’র সম্পাদক। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন শকুন্তলাদেবীর সঙ্গে আমাদের সমিতির পক্ষে আমার গোলমাল প্রসঙ্গে বাড়তি কিছু খবর। ‘বাড়তি’ বললাম, কারণ নিউইয়র্কে বসেই কিছু ভারতীয় পত্র-পত্রিকা পড়ে খবরটা আগেই জেনেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, এখনও আমি শকুন্তলাদেবীর মুখোমুখি হতে রাজি আছি কি না? জানিয়েছিলাম, “অবশ্যই। আপনারা আমার যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিলে ওখানে গিয়েই ওঁর মুখোশ খুলে দিয়ে আসব।”
জানি না, সুদূর নিউ ইয়র্কেও আক্রান্ত হলে শকুন্তলাদেবী কোথায় পালাবেন। পাঠক-পাঠিকাদের সামনে এই প্রসঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্পষ্ট ঘোষণা রাখছি—শকুন্তলাদেবীর কাছে আমি পরাজিত হলে আমাদের সমিতি সমস্ত শাখা সংগঠন-সহ জ্যোতিষ-বিরোধী অলৌকিক-বিরোধী সমস্ত রকম কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে। এই কথা আমি লিখছি আমাদের সমিতির একজিকিউটিভ কমিটির মতামত অনুসারে। জানি না, এর পরও শকুন্তলাদেবী আমাদের সমিতির পক্ষে দেওয়া আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মত সততা ও হিম্মত দেখাবেন কি না?
ঈর্ষায় জ্বলে উঠলেন খুদে হিটলার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়
এই প্রসঙ্গে একটি অদ্ভুত চিঠির উল্লেখ না করেই পারছি না। চিঠিটির লেখক ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখেছিলেন বর্তমানে তাঁরই কাছের মানুষ এক তথাকথিত বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীকে। উৎস মানুষের ছাপানো প্যাডে লেখা এই চিঠির কিছু অংশ আপনাদের অবগতির জন্য তুলে দিচ্ছি:
“Philipine-এর Faith healer বা শকুন্তলাদেবী কাউকেই “বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরাজিত” কেউ করতে পেরেছেন বলে মনে করি না। শকুন্তলাদেবী কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে উঠে কয়েকদিনে যে পরিমাণ টাকা উপার্জন করে যান, তাতে কলকাতার কোন্ এক বাঙালী বাবুর (তিনি আমাদের কাছে যত বিখ্যাত হোন না কেন) পঞ্চাশ হাজার টাকার চ্যালেঞ্জ ফুৎকারে উড়িতে দিতে পারেন।”
খুবই বাঁচোয়া যে, অশোকবাবুর মানা, না মানা; ইচ্ছে, অনিচ্ছের ওপর পৃথিবীর কোনও কিছুই নির্ভর করে না; যেমনটা নির্ভর করেনি হিটলারের ইচ্ছের ওপর। যা ফেথ হিলাররা স্বয়ং মেনে নিলেন, তাই মেনে নিতে পারলেন না খুদে ডিক্টেটর অশোকবাবু। ফেইথ হিলাররা আমার মুখ বন্ধ রাখার বিনিময়ে ১৯৮৬ সালে চেয়েছিলেন ১৫ লক্ষ টাকা। আজকের (২০০৭ সালে) বাজারদরের হিসেবে যা কম করে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। (এ বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে আছে।) ফেইথ হিলারদের পক্ষে প্রস্তাবদাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন অলোক খৈতান। আর এ-সব কথা অনেক পত্র-পত্রিকায় এবং বইতে প্রকাশিত হয়েছে প্রচণ্ড গুরুত্বের সঙ্গেই। প্রভাবশালী প্রস্তাবদাতা এই বিষয়ে আমার বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কোর্টে হাজির হওয়ার মত বোকা হিম্মৎ দেখাতে যাননি, কারণ এ-টুকু তাঁর মস্তিষ্কে অবশ্যই আছে প্রমাণ ছাড়া পা আমি ফেলি না। ফেইথ হিলারদের অস্ত্রোপচারের রক্ত সংগ্রহ করেছিলেন কলকাতা পুলিশের তৎকালীন জয়েন্ট কমিশনার স্বয়ং। ফরেনসিক রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে যখন সন্দেহাতীতভাবে ফেইথ হিলারদের বুজরুকি প্রমাণিত হয়েই গেছে, তখনও অশোকবাবুর এমন ধরনের যুক্তিহীন কথা শুনে এই মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে ষাটের দশকের দমদম মতিঝিল কলেজের এক অধ্যাপকের কথা। চাঁদে মানুষের পদার্পণেরঅ অনেক পরেও ওই অধ্যাপক বলতেন, “মানুষ চাঁদে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পদার্পণ করতে পরেছে বলে আমি মানি না।”
তার মানা, না মানার ওপর অবশ্য চন্দ্র-অভিযান বা মহাকাশ অভিযান, কোনও কিছুই থমকে থাকেনি। আমাদের কলেজের মাস্টারমশাই কথাগুলো বলতেন বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞতা থেকে, প্রাচীন বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা থেকে। অশোকবাবুর ক্ষেত্রে অজ্ঞতা, না ঈর্ষা—কোন্টা বেশি ক্রিয়াশীল, কে জানে?
মাননীয় অশোকবাবু, আপনি যাঁর হয়ে দালালি করছেন, তাঁকে একবার এই ‘বাঙালী বাবু’-টির সামনে হাজির করে দিন। তারপর দেখুনই না, কে কাকে ফুৎকারে ওড়ায়! আকাশবাণীর ‘জ্যোতিষ নিয়ে দু-চার কথা’ অনুষ্ঠানটির প্রসঙ্গও চিঠিতে এনেছেন ‘উৎস মানুষ’-এর অন্যতম সম্পাদক অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওঁর কথায়:
“অনুষ্ঠানে আর কেউ ‘contract’ পাননি তাই উনি “একা”—এতে বাড়তি কৃতিত্ব কোথায়? বিজ্ঞান বিভাগ না ডেকে প্রবীরবাবু ডাকলে পারমিতা, পাগলাবারা ect. কি আসতো?”
মাননীয় অশোকবাবু, আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আপনার এই ধরনের যুক্তিকে আশ্রয় করে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের কৃতিত্বকেই নস্যাৎ করা যায়? যেমন—“পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্থ সাহায্য না করলে সত্যজিৎ রায় কি পথের পাঁচালী তৈরি করতে পারতেন? ফিল্মটা তৈরি করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার অন্য কাউকে ‘contract’ দেয়নি, তাই সত্যজিৎ রায় “একা”—এতে সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্ব কোথায় ?”
এই একই যুক্তিতে ওলিম্পিক বিজয়ী থেকে শুরু করে কলকাতার ফুটবল লিগ বিজয়ীদের তামাম কৃতিত্বকেই আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলা যায় কি? সত্যিই তো আই এফ এ শিল্ড মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল যে-ই জিতুক, তাতে তাদের কৃতিত্ব কোথায়? আই এফ এ—তাই নয় কি? অন্তত অশোকবাবুর যুক্তি মানলে এমনটাই বলতে হয়। অশোকবাবু, বাস্তবিকই আমাদের ভয় হয়, আপনার মত একজন মানুষের হাতে একটি ‘যুক্তিনির্ভর’, ‘বিজ্ঞানমনস্ক' পত্রিকার সম্পাদনার ভার থাকলে সে পত্রিকা জনগণকে কী ধরনের পথ নির্দেশ দেবে, কোথায় নিয়ে যাবে ভেবে!
“যে যত বড় জ্যোতিষী, তত বড় প্রতারক
চ্যালেঞ্জ নিলেই বুজরুকি ফাঁস”