অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: ষোলো


অধ্যায় : ষোলো


কলির খনাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ,
পাল্টা চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়

২১ মার্চ ১৯৯০। সকালের ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকাটি হাতে পেয়েই জ্যোতিষ-বিশ্বাসীদের মন চনমন করে উঠল; আর জ্যোতিষীদের রক্তে উচ্ছ্বাসের জোয়ার। রঙিন ক্রোড়পত্রের প্রায় আর পৃষ্ঠা জুড়ে রঙিন ছবিতে ও সাক্ষাৎকারে মাতিয়ে রেখেছেন তিন জ্যোতিষী; মহিলা জ্যোতিষী। যদিও ছবি ছাপা হয়েছে চারজন জ্যোতিষীর, কিন্তু পারমিতার ছবি থাকলেও সাক্ষাৎকার ছিল অনুপস্থিত। সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখাটির শিরোনাম ‘কলির খনারা’। প্রথম সাক্ষাৎকারটি মণিমালা’র। সঙ্গীতশিল্পী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা। দশ বছর বয়েস থেকেই নাকি জ্যোতিষচর্চা এবং প্ল্যানচেটের সাহায্যে আত্মা নামানো শুরু। সতেরো বছরে বিয়ে হয় মণিমালার। এক সময় একটি জুয়েলারি দোকান থেকে ডাক আসে জ্যোতিষচর্চাকে পেশা হিসেবে নিতে। এক দিকে স্বামীর মতামত অন্য দিকে জ্যোতিষ-পেশার হাতছানি।

 ‘সেই সময় একদিন প্ল্যানচেটে বসলাম আর তখনই অনুভব করলাম যে জ্যোতিষই আমার উপযুক্ত প্রেফেশন হবে। স্বামীর কাছ থেকেও কোনও বাধা আসবে না। সেই শুরু।’

 ‘শুধু কি হাতের রেখা দেখেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেন?’ লেখিকা টুলটুল গাঙ্গুলি’র প্রশ্নের উত্তরে মণিমালা জানিয়েছেন, শুধু হাত দেখেই নয়, কারও ছবি দেখে মিডিয়াম নামিয়ে আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি।’

 মণিমালা শুধু অদৃষ্টই বলে দেন না, তার সঙ্গে অদৃষ্ট পাল্টাবার জন্যে স্টোনও প্রেসক্রাইব করেন। আবার অনেক সময় কাস্টমারদের অদৃষ্ট পাল্টাতে গোপালের কাছে তাঁদের নামে তুলসীও দেন।

 ফর্সা, দোহারা চেহারা, হাসি-খুসি মুখের লোপামুদ্রা বাংলায় এম.এ। পার্ট-টাইম গবেষণাও করছেন বাংলা নাটক নিয়ে। (অভিনয় সম্বন্ধে তবে জ্ঞান-গম্মি ভালই।) টুলটুল গাঙ্গুলির প্রশ্ন, ‘জ্যোতিষচর্চার সবটাই কি ইনটিউশন-নির্ভর?’

 লোপামুদ্রার উত্তর, ‘কখনই নয়, এটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক শাস্ত্র। তবে জ্যোতিষচর্চা করলে পুজো, যোগ, প্রাণায়াম এসব করাও দরকার। (জ্যোতিষশাস্ত্র ‘যদি পুজোর সঙ্গেই গভীর ভাবে সম্পর্কিত হয়, তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের ওইসব অংক-টংক ক্যার ভূমিকা কী?)

 ‘ভবিষ্যদ্বাণী কি সব সময় ঠিক ঠিক হয়?’ টুলটুল-এর প্রশ্ন।

 ‘বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই মিলে গেছে, হাত দেখে কোনও সন্তান সম্ভবা মাকে বলে দিতে পারি ছেলে কি মেয়ে হবে। একেবারে গ্যারান্টি। শতকরা ৮০ ভাগ মিলে যায়।’


মণিমালা

 আর এক খনা প্রিয়াংকার এখন রমরমা বাজার। দারুণ ব্যস্ত। না, ওই দুই জ্যোতিষীর মতো বড় বড় দাবি-টাবি করেননি এই সাক্ষাৎকারে। অথবা করলেও তা প্রকাশিত হয়নি। তিনি ক্লায়েন্টদের প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘পুরুষ, মহিলা সকলেই আসেন। সবার সঙ্গে গড়ে ওঠে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বিশেষ করে মেয়েদের শারীরিক, মানসিক এমন অনেক সমস্যা থাকে যা কোনও অচেনা পুরুষের কাছে বলাটা সংকোচের। কিন্তু আমার কাছে ওঁদের কোনও সংকোচ হয় না, খোলামেলা আলোচনার ফলে আমিও মূল সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারি, এতে গণনার সুবিধে।’ (কথায় কথায় জাতকের অতীত, বর্তমান জেনে নিয়ে ভবিষ্যতের অনুমান করার বিষয়ে মনে হয়, আমাদের সমিতির সদস্য সদস্যরা এঁদের চেয়ে

প্রিয়াংকা লোপামুদ্রা

 ভালই বলবেন। তারপর সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থাপত্র? সেটা অনেক সময়েই বুদ্ধি খাটিয়েই তৈরি করা যায়; এর জন্য যুক্তিবাদীদের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রয়োজন হয় না।)

 এই লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দবাজার পত্রিকায় আমাদের সমিতির তরফ থেকে একটি চিঠি পাঠালাম। চিঠিটা ১৩ এপ্রিল ‘সম্পাদক সমীপেষু’ কলমে প্রকাশিত হল। চিঠিটা এই:


কলির খনাদের প্রতি যুক্তিবাদীদের চ্যালেঞ্জ

 ‘কলির খনারা’ লেখাটি (২১ মার্চ) পড়ে জানলাম : মণিমালা দাবি করেছেন, তিনি শুধু হাত দেখেই নয়, কারও ছবি দেখে মিডিয়াম নামিয়ে ভবিষ্যৎ বলতে সক্ষম। আশা রাখি মণিমালা মিথ্যাচারী নন। তিনি তাঁর দাবির যথার্থতা প্রমাণ করে আমাদের নতুন আলো দেখাবেন।

 কোনও অলৌকিক ঘটনা, অলৌকিক ক্ষমতাধর মানুষ বা অভ্রান্ত গণনাকারী জ্যোতিষীর কথা শুনলে আমরা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ তাঁদের দাবির যথার্থতা জানতে সত্যানুসন্ধান চালিয়ে থাকি। মণিমালা নিশ্চয়ই একজন সৎ মানুষ হিসেবে আমাদের এই সৎ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর দাবির ক্ষেত্রে আমাদের সত্যানুসন্ধান চালাতে সমস্ত রকম সহযোগিতা করবেন।

 পরীক্ষার ব্যাপারটা এই রকম— মণিমালাকে চারজনের চারটি ছবি দেব। সঙ্গে দেব প্রত্যেকের অতীত সম্পর্কে চারটি করে প্রশ্ন। ষোলোটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলে ধরেই নেব, প্ল্যানচেট সত্যি, জ্যোতিষ সত্যি। অতএব খাঁটি যুক্তিবাদী মানসিকতার প্রমাণ রাখতে আমরা আমাদের কয়েক’শ সহযোগী সংস্থা ও শাখা সংগঠনসহ সমস্ত রকম অলৌকিক ও জ্যোতিষ-বিরোধী কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলব। সেই সঙ্গে মণিমালা করুণা করলে আমি তাঁর শিষ্য হয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। শুরু প্রণামী হিসেবে দেব ৫০ হাজার টাকা।

 এই চিঠিটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে মণিমালা আমাদের সত্যানুসন্ধানে সহযোগিতা করতে এগিয়ে না এলে আমরা অবশ্যই ধরে নেব—তাঁর দাবিগুলো পুরোপুরি মিথ্যা। তাঁর দাবির পিছনে রয়েছে সাধারণ মানুষকে প্রবঞ্চনা করার প্রয়াস।

 চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে তিরিশ দিনের মধ্যে তাঁকে দেব ছবি ও প্রশ্ন। তার দশ থেকে পনেরো দিনের মধ্যে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনেই তাঁর ক্ষমতার প্রমাণ নেব।

 জ্যোতিষী লোপামুদ্রা দাবি করেছেন : ‘সন্তানসম্ভবা মা-কে দেখে বলে দিতে পারেন সন্তান ছেলে হবে কি মেয়ে। একেবারে গ্যারান্টি। শতকরা ৮০ ভাগ মিলে যায়।’

 কথাগুলোর মানে বুঝলাম না। ৮০ শতাংশ মিললে ‘একেবারে গ্যারান্টি’ দেন কী করে? ছেলে বা মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা তো সব সময়ই কম-বেশি আধা-আধি। অতএব কখন-সখন ৮০ শতাংশ তো মিলতেই পারে। এতে কি প্রমাণ হয় জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান? আরও একটু পুজো-আর্চা, যোগ ও প্রাণায়াম করে যেদিন লোপামুদ্রা গ্যারান্টি দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীর দাবি জানাবেন, সেদিনের জন্য চ্যালেঞ্জটা তুলে রাখলাম।

 না, প্রিয়াংকা জ্যোতিষী হিসেবে কোনও দাবিই জানাননি। এবং লেখা পড়ে মনে হল : মন-টন নিয়ে চর্চা করেছেন, তাই এখনই জ্যোতিষীর ভান করে দু-একটার চেয়েও বেশি ক্ষেত্রে মিলিয়েও দিচ্ছেন। সত্য স্বীকার করার জন্য প্রিয়াংকাকে ধন্যবাদ।

 পারমিতার ছবি চোখে পড়ল, লেখা নয়। পারমিতা ’৮৫-র আকাশবাণীর বেতার অনুষ্ঠানে আমার কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পর আশা রাখি তিনি আমাকে এবং আমাদের সমিতিকে সযত্নে এড়িয়ে চলতে চাইবেন। এড়াতে না চাইলে, আবার তাঁর দাবির অসারতা প্রমাণ করার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি।

প্রবীর ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি,
৭২/৮ দেবীনিবাস রোড, কল-৭৪

 ২৭ এপ্রিল ১৯৯০ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক সমীপেষু বিভাগে আমাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চারটি চিঠি প্রকাশিত হল। তার মধ্যে একটি চিঠি সেই হস্তরেখাবিদ নরেন্দ্রনাথ মাহাতোর। পত্রগুচ্ছের শিরোনাম ছিল ‘জ্যোতিষী চ্যালেঞ্জ নিলেন।” চিঠি চারটি এই :

জ্যোতিষী চ্যালেঞ্জ নিলেন

 || ১ ||

 ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষের বক্তব্য ও চ্যালেঞ্জের কথা জানলাম (চিঠি, ১৩/৪)। ওঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই জানাই: ওঁর প্রদত্ত চারটি ছবির সহায়তায় ষোলোটি প্রশ্নের সঠিক জবাব আমি জ্যোতিষ পদ্ধতিতে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে দিতে চাই। তবে অবশ্যই প্রশ্নগুলিতে যেন প্রবীরবাবুর পূর্বের ক্রিয়াকলাপের মতো কোনও ভাওতাবাজি না থাকে।

 মণিমালা। ৩৫/১৭এ পদ্মপুকুর রোড, কলকাতা-২০


 || ২ ||

 ‘কলির খনাদের প্রতি যুক্তিবাদীদের চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে দুটি চিঠি (১৩/৪) পড়লাম। আমি যুক্তিবাদীদের জানাই : হস্তরেখাবিদ্যা একটি বিজ্ঞান এবং তা আমি প্রমাণ করে দেখাতে চাই।

 প্রবীর ঘোষ ও অন্যান্যেরা সত্যানুসন্ধানী বলেই জানি। সুতরাং আশা করি—তাঁরা আমার প্রস্তাবে রাজি হবেন এবং মে মাসের কোনও একদিন সাংবাদিক সম্মেলনে আমাকে আহ্বান জানাবেন।

 নরেন্দ্রনাথ মাহাতো। সুজাগঞ্জ, মেদিনীপুর


 || ৩ ||

 প্রবীর ঘোষের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে (১৩/৪) যুক্তিবাদী মানুষ হিসাবে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি:

 ‘যুক্তিবাদী’ বনাম ‘জ্যোতিষীর’ যে চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে তার অবসান কবে হবে কে জানে। কারণ, যে সরিষা দিয়ে (?) ভূত ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে সেই সরিষার মধ্যেই যদি ভূত ঢুকে থাকে তাহলে ভূত ছাড়ানো যাবে কি? তার একটি প্রমাণ পাঠালাম।

 ৩১ ডিসেম্বর ৮৮ তারিখে রেজিস্টার্ড উইথ এ/ডি (রসিদ নং ৫৭৭৩ ও ৫৭৭৪) ডাকযোগে প্রবীর ঘোষের বাড়ির ঠিকানায় এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ১নং স্ট্র্যান্ড রোড, প্রধান শাখা, কলকাতা-৭০০ ০০১, প্রবীর ঘোষের কর্মস্থলের ঠিকানায় চিঠির মাধ্যমে প্রবীর ঘোষকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম। এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল, আমার চিঠির (৩১/১২/১৯৮৮ তারিখের) যথাযথ জবাব নেই কেন?

 কাশীনাথ কংসবণিক। ১৬/১ নন্দলাল বোস লেন; কলিকাতা-৩


|| 8 ||

 ‘কলির খনাদের প্রতি যুক্তিবাদীদের চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে যুক্তিবাদী প্রবীরবাবু চিঠি পড়লাম। প্রবীরবাবুর সঙ্গে আমিও একমত। সাধারণ মানুষকে প্রবঞ্চনার কত রকম পন্থা আজকাল চলছে। আমিও বিজ্ঞানের ছাত্র। যুক্তি দিয়ে সকল কিছু বিচার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু যুক্তিবাদী মনও অনেক সময় ভাববাদে ভারিত হয়। আমার এ চিঠি লেখার উদ্দেশ্য প্রবীরবাবুর উদ্দেশে কোনও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া নয়। যুক্তিবাদী মনে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে ভাববাদের দ্বন্দ্ব তার অবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য এ চিঠির অবতারণা।

 বীরভূম জেলার নানুর থানার পাকুড়হাস গ্রামে এক ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছে যিনি বহু দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দিচ্ছেন। ইতি পূর্বে বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর ওষুধ হচ্ছে বাড়িতে অধিষ্ঠিতা দেবী দুর্গার মৃত্তিকা, ফুল ও চরণামৃত। অসুখ সারানোর জন্য তিনি কোনও অর্থের দাবি করেন না। ভক্তরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুঠো মুঠো অর্থ দিয়ে যান। বাড়িতে রোগীদের মেলা। যুক্তিবাদী প্রবীরবাবু নিশ্চয়ই উল্লিখিত বিষয়টির যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দেবেন। সব থেকে ভাল হয় তিনি যদি সরজমিনে পাকুড়হাস গ্রামে ঘুরে আসেন।

 বীরেন আচার্য। দিগড়া সারদাপল্লী, হুগলি।


 চিঠিগুলো প্রকাশিত হতেই সংবাদ শিকারী অনেক সাংবাদিক বন্ধুই জানতে চাইলেন, এবার আমাদের সমিতি কী করবে? এগিয়ে এলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘INDIA TODAY’ পত্রিকা। বিজ্ঞানকর্মী ও সাধারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল ‘তিন’ নম্বর চিঠিটি। আমি কেন কাশীনাথ কংসবণিক-এর দু-দুটি রেজিস্টার্ড ডাকে পাঠানো চিঠি পেয়েও উত্তর দিইনি?

 এ-সবেরই উত্তর নিয়ে আমাদের সমিতির পক্ষে আমার দেওয়া চিঠি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হল ৭ মে ১৯৯০। শিরোনাম, “যুক্তিবাদী ও জ্যোতিষী”।

যুক্তিবাদী ও জ্যোতিষী

 ২৭ এপ্রিল আমাদের সমিতি সংক্রান্ত চারটি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিগুলোর উত্তর প্রকাশিত না হলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে জেনে চারজনের উত্তর দিচ্ছি।

 (১) মণিমালার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। চারটি ছবি ও প্রশ্ন তাঁর কাছে এ মাসের মধ্যে পাঠিয়ে দেব। ছবি ও প্রশ্ন তিনি গ্রহণ করলে ১৬ জুন শনিবার বিকাল চারটের সময় আমরা কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সামনে মিলিত হব। সেখানেই তাঁর দাবির যথার্থতা প্রমাণ হবে। চিঠির শেষ লাইনে মণিমালা লিখেছেন : তবে অবশ্যই প্রশ্নগুলোতে যেন প্রবীরবাবুর পূর্বের ক্রিয়াকলাপের মতো কোনও ভাঁওতাবাজি না থাকে।” এর সঙ্গে অতীতের প্রসঙ্গ জড়িত। জ্যোতিষীদের ভাঁওতাবাজি ধরতে একটু ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নেওয়া আমার একান্তই প্রয়োজন ছিল।

 (আকাশবাণীর সেই কিংবদন্তি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী জ্যোতিষীদের সামনে জাতকদের পোশাকআশাক পাল্টে পেশ করেছিলাম; স্বীকার করছি। কিন্তু আমার এই ভাঁওতাবাজিতে তাঁরা কেন বধ হলেন? জ্যোতিষশাস্ত্র কি তবে জন্ম সময়ের চেয়ে জাতকের পোশাকআশাককে বেশি গুরুত্ব দেয়?)

 (২) হস্তরেখাবিদ নরেন্দ্রনাথ মাহাতো ২৮.১০.৮৮ তারিখে আমাকে প্রথমবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ১১ ডিসেম্বর ’৮৮ আমাদের সমিতির ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হতে আহ্বান জানাই এবং জামানত হিসেবে ৫ হাজার টাকা জমা দিতে বলি। জয়ী হলে তিনি প্রণামী ৫০ হাজার টাকাসহ মোট ৫৫ হাজার টাকা পাবেন। পরাজিত হলে ৫ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। শ্রীমাহাতো সাংবাদিক সম্মেলনে আসেননি। এই নিয়ে তৃতীয়বার তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে দেখছি। তিনি বাস্তবিকই সততার সঙ্গে হস্তরেখাবিদ্যাকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চান কি না, এ ব্যাপারে আমাদের সমিতির পরিপূর্ণ সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও আমরা আশা রাখব আমাদের সমিতির দেওয়া তৃতীয় ও শেষ সুযোগ তিনি গ্রহণ করবেন। শ্রীমাহাতো যেন ১৫ মে’র মধ্যে আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ৭২/৮ দেবীনিবাস রোড, কলকাতা-৭৪-এ জামানতের ৫ হাজার টাকা জমা দেবেন। ৫ জুনের মধ্যে তাঁকে ১০জন জাতকের হাত দেখতে দেব এবং ৫টি করে প্রশ্ন দেব। প্রত্যেক জাতকের অন্তত ৪টি করে প্রশ্নের উত্তর ঠিক দিতে পারলে পরাজয় মেনে নেব। প্রণামী দেব ৫০ হাজার টাকা, ফেরত দেব জামানতের ৫ হাজার টাকা। ভেঙে দেব সমিতি।

 (৩) কাশীনাথ কংসবণিকের চিঠি পেয়েছি, পড়েছি; কিন্তু উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। যতদূর মনে পড়ে : তিনি জানিয়েছিলেন—আমরা যেন একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকি, সেখানে তিনি আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখবেন। এই অদ্ভুত আবদার পড়ে পত্রলেখকের মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে সন্দেহ জেগেছিল। প্রায় প্রতিদিনই এমন চ্যালেঞ্জ জানানো চিঠি পাই। তাঁরা প্রত্যেকেই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার বায়না ধরেন এবং জামানতের টাকা জমা দিতে বললেই সরে পড়েন। শ্রীকংসবণিক ১৫ মে’র মধ্যে টাকা জমা দিলে তাঁর মুখোমুখি হব ১৬ জুনের সাংবাদিক সম্মেলনেই।

 (সেই সম্মেলনে শ্রীকংসবণিক যদি প্রমাণ করতে পারেন তাঁর বা তাঁর পরিচিত কারও অলৌকিক ক্ষমতা আছে অথবা জ্যোতিষীশাস্ত্র বিজ্ঞান, তবে জিতে নিবেন পঞ্চাশ হাজার টাকা; ফেরত পাবেন জমা রাখা পাঁচ হাজার।)

 (৪) বীরেন আচার্যের চিঠির উত্তরে জানাই : রোগ-নিরাময়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। শরীরের নানা স্থানের ব্যথা, হাড়ে, বুকে বা মাথায় ব্যথা, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে রোগীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে ঔষধ-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইঞ্জেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া যায়। একে বলে ‘প্লাসিবো’ চিকিৎসা পদ্ধতি।

 পাকুড়হাস গ্রামের দেবীদুর্গার মৃত্তিকা ও চরণামৃত খেয়ে যাঁরা রোগমুক্ত হয়েছেন তাঁদের আরোগ্যের পিছনে দেবীদুর্গার কোনও বৈশিষ্ট্য সামান্যতম কাজ করেনি, করেছে দেবীদুর্গার প্রতি রোগীদের অন্ধবিশ্বাস। শ্রীআচার্য একটু অনুসন্ধান করলেই দেখতে পাবেন, রোগমুক্তরা সেইসব রোগেই ভুগছিলেন, ‘প্লাসিবো’ চিকিৎসায় যে সব রোগ আরোগ্য সম্ভব। প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহযোগিতার জন্য শ্রীআচার্য আমাদের সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাধিত হব।

 প্রবীর ঘোষ। কলকাতা-৭৪


 ২৬ মে ১৯৯০ বরানগর পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্টার্ড উইথ এ/ডি (রসিদ নম্বর ২৯২৪) একটি চিঠি চারটি চিঠি ছবি সমেত পাঠালাম মণিমালাকে। ঠিকানা লিখেছিলাম ৩৫/১৭ এ, পদ্মপুকুর রোড, কলিকাতা- ২০, পিন ৭০০ ০২০। আপনাদের কৌতূহল মেটাতে চিঠিটি তুলে দিচ্ছি।


 মাননীয়া মণিমালা,

 আপনার অলৌকিক জ্যোতিষ-ক্ষমতা বিষয়ে আমাদের সমিতিকে পরীক্ষা চালাতে সহযোগিতা করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

 চারটি ছবি চিঠির সঙ্গে পাঠালাম। প্রতিটি ছবির পিছনে আমার স্বাক্ষর সহ ১ থেকে ৪ পর্যন্ত সংখ্যা লেখা রয়েছে।

 প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রে চারটি করে প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে হবে। প্রশ্নগুলো হলো—

 ১। বর্তমান শিক্ষাগত যোগ্যতা

 ২। বর্তমান পেশা

 ৩। বর্তমান আয়

 ৪। কোন সালে বিয়ে করেছে

 ১৬ জুন ’৯০ শনিবার বিকেল চারটের সময় কলকাতা প্রেস ক্লাবে আপনার মুখোমুখি হব, উত্তরগুলো তখনই শোনা যাবে। এবং উত্তরের যথার্থতা বিষয়ে প্রমাণ আমি হাজির রাখব। হাজির করা প্রমাণ মিথ্যে প্রমাণিত হলে আমি এবং ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ পরাজয় স্বীকার করে নেব। সাংবাদিক সম্মেলনে ছবি চারটি সঙ্গে আনবেন।

 আপনি ব্যর্থ হলে আশা রাখি একজন সৎ মানুষ হিসেবে জ্যোতিষী পেশা থেকে বিরত থাকবেন।

 শুভেচ্ছাসহ

 প্রবীর ঘোষ


 চিঠিটা ফেরৎ এলো NK লিখে। N/K অর্থে Not Known. অর্থাৎ ওই ঠিকানায় মণিমালা থাকেন না।

 তাহলে ব্যাপারটা কী হল? হল অনেক মজাই হল। মণিমালার চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ তারিখ। ২৯ তারিখ রবিবার বিকেলে গিয়েছিলাম মণিমালার দেওয়া ঠিকানায়। ওটা সংগীতশিল্পী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। কথা বললেন তরুণবাবুর স্ত্রী। আমি ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে দেখা করেছিলাম। সঙ্গী আশিস-এর পরিচয় দিয়েছিলাম প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে। তরুণবাবুর স্ত্রী জানিয়ে ছিলেন, এ বাড়িতে তো মণিমালা থাকে না। এক রত্ন ব্যবসায়ীর দোকানের ঠিকানা দিয়ে বললেন, ওখানে গেলে পেয়ে যাবেন। বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নম্বরও দিলেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য মণিমালাকে ধন্যবাদ জানালাম। মণিমালার মা বললেন, এই দু-দিনে প্রচুর মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছেন ওঁকে।

 পরের দিনই মণিমালার বাড়িতে ফোন করলাম মেদিনীপুরের এক জ্যোতিষী হিসেবে পরিচয় দিয়ে। চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য অভিনন্দন জানালাম এবং তাঁর লড়াইয়ে আমরা মেদিনীপুরের জ্যোতিষীরা এককাট্টাভাবে তাঁর পাশে আছি—এই প্রতিশ্রুতি দিলাম।


 মণিমালা বললেন, প্রবীর ঘোষকে প্রতিরোধ করার দরকার ছিল। অনেক আগেই দরকার ছিল। কোনও জ্যোতিষী সাহস করে যা করলেন না, আমি তাই করেছি।

আপনারা পাশে আছেন শুনে ভাল লাগল। প্রয়োজনে নিশ্চয়ই সাহায্য চাইব ভাই।


 কিন্তু মণিমালার চিঠি প্রকাশ ও আমার চিঠি প্রকাশের মধ্যেকার সময়ে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেল।

 ৫ মে’র দুপুর। মণিমালাকে ওঁর মানিকতলার বাড়িতে ফোন করলাম, মেদিনীপুরের সেই জ্যোতিষীর পরিচয়ে। জানালাম, “দিদি, আমার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কাল আপনাকে একটু প্রণাম জানাতে যেতে চাই। ওঁরা আপনাকে একটু চোখে দেখে নয়ন সার্থক করত চায়।”

 মণিমালা জানালেন, কাল সময় বের করাই মুশকিল।

 শেষ পর্যন্ত তোষামোদ আর বিনয় দিয়ে মন ভেজালাম। পরদিন সকাল দশটায় দেখা করার অনুমতি পেলাম।

 পরের দিন সময় মতো পৌঁছে গেলাম মণিমালার বাড়িতে, রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে বাড়ি। খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধে হলো না। দরজায় ‘নক’ করতে যিনি দরজা খুললেন, তিনিই মণিমালা। স্বাস্থ্যবতী, দীর্ঘাঙ্গী, মধ্যবয়স্কা, গলায় বিশাল রুদ্রাক্ষের মালা। দরজা খুলতেই পরিচয় দিলাম। পরিচয় পেয়ে চোখে-মুখে যেমন প্রচণ্ড অস্বস্তি প্রকাশিত হল এবং যে অতি বিরসভাবে ভেতরে আসতে বললেন, তাতে বুঝলাম, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে।

 আমরা ঢুকলাম, ‘আমরা’ অর্থে আমি ও আমার কয়েকজন সহযোদ্ধা। আমার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। গলায় বিশাল এক রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে একগুচ্ছ গ্রহরত্নের আংটি। কপালে গোলা সিঁদুরের দীর্ঘ টিপ। আর চুলে চশমায় কিছুটা অন্যরকম প্রবীর।

 ঘরে ঢুকে বুঝলাম, সতর্কতার জন্য মানিকতলা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা-ভাবে যে-সব সহযোদ্ধারা নানা অলস পথচারী কি মোটরবাইক ও স্কুটার দাঁড় করিয়ে কয়েকজন আড্ডাবাজ তরুণ-তরুণীর ভূমিকা পালন করে চলেছে, তা মোটেই অপ্রয়োজনীয় ছিল না। লক্ষ্য করলাম, চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ে মণিমালার ব্যবহারটাও কেমন পাল্টে গেছে। ঘরে তিনজন যুবক হাজির ছিলেন। তাঁদের মণিমালা “আমাদের পাড়ার ছেলে, ভাই আর কী” বলে পরিচয় দিলেন। তাদের চেহারা চালচলন দেখে তেমন ‘নিরীহ’ পাড়ার ছেলে বা ভাই বলে মনে হল না। আমরা গুছিয়ে বসে মণিমালাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভেতরের ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকলেন এক তরুণ। জানালেন, মণিমালাকে ভেতরে ডাকছেন।

 মণিমালা ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, প্রেস কনফারেন্সটা কবে হচ্ছে? সেটার তারিখ কি আপনিই ঠিক করবেন?

 মণিমালা তৎপরতার সঙ্গে জবাব দিলেন, “না না, সে-রকম কোনও ব্যাপার নেই। কনফারেন্সের ব্যাপারে আমার কোনও, মানে নিজস্ব মাথাব্যথা নেই এবং সেই বিষয়ে আমার কোনও মতামতও নেই। এটা কোনও ব্যাপারও নয়। সে বিষয় নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না।”

 মাত্র চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এমন কী ঘটল, যাতে মণিমালার কথাবার্তা ও ব্যবহারই গেল পাল্টে। তবে কি ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে মণিমালাকে জানিয়ে দেওয়া হল, জ্যোতিষীর ছদ্মবেশে সম্ভবত প্রবীরই এসেছেন? ভেজানো দরজার আড়ালে কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টি যে আমাদেরই দিকে, কথা বলতে বলতে দরজার ফাঁকে মাঝে-মধ্যে আলতো করে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

 বললাম, আমাদের যদি কোনও কিছু করণীয় বলেন, যদি গায়ে গতরে খাটতে বলেন, ঠিকানাই দিয়ে দিচ্ছি; আমাদের আসতে বললে আসব, আপনি যেখানে যেখানে পাঠাবেন, আপনার নেতৃত্বে যেমনভাবে বলবেন, তেমনভাবে কাজ করতে পারি।

 “আপনাদের অ্যাড্রেসটা রেখে যেতে পারেন।” কথা বললেন একটি ‘পাড়ার ছেলে’।

 আমি ওর কথা না শুনেই ভাবাবিষ্টের মতো, বা বক্‌বক্ করা আধ-পাগলা মানুষের মতো বলেই যেতে লাগলাম, “আমাদের যেমনভাবে বলবেন, আমরা সমস্ত রকমভাবে আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করব। এ-কথা আগেই বলেছি, আবারও বলছি।”

 “হ্যাঁ, সেটা তো বলেছেন।” বললেন, মণিমালা। আমি আবার শুরু করলাম।

 “হয়তো কিছুই লাগবে না; তা সত্ত্বেও যদি বলেন যে কিছু চাঁদা-পত্তর তুলে দিতে, আমরা তাও করব। আপনার নেতৃত্বে আমরা সবাই আছি। যে কথা আগেও বলেছি; আপনি বললেই আমাদের অঞ্চলের অনেক জ্যোতিষীকে নিয়ে আসতে পারব। এবং আপনাকে আমরা একটি অভিনন্দনও দিতে চাই।’

 আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে মণিমালা বললেন, “না, এটা যেটা বলছেন, অভিনন্দন দিতে চাই, আমি তো অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল কথাবার্তাগুলো ঠিক বাড়িতে খুব একটা বলি না, যা কিছু বলি চেম্বারেই বলি।”

 প্রমাদ গুনলাম, চেম্বার মানে সেই গড়িয়াহাটের রত্ন ব্যবসায়ী ‘ঘোষ ব্রাদার্স’-এর দোকান, যেখানে এক সময় ‘এযুগের খনা’ পারমিতা বসতেন। দোকানের মালিকের এক লক্ষ জেরার পাহাড় ডিঙিয়ে সেবার খনার মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম। বেতার অনুষ্ঠানের সময়কার সে সব স্মৃতি মুহূর্তে ভেসে উঠল। পারমিতা পরাজিত হতে দোকানের মালিক নাকি পারমিতাকে তাড়িয়ে মণিমালাকে আনেন। তিনিই কি তবে এমন নির্দেশ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন মণিমালাকে? মণিমালা কি তবে আমার চ্যালেঞ্জকে এড়িয়ে যাবার রাস্তার খোঁজ করছেন? আজকের কথাগুলো এমন বিদঘুটে কেন? সরাসরি ফয়সালার এমন একটা সুযোগ কি মণিমালার পৃষ্ঠপ্রদর্শনের জন্য ব্যর্থ হবে? শঙ্কিত হলাম। সত্যি বলতে কি, এমন আশঙ্কাও হল ভেজানো দরজার আড়ালে একজোড়া চোখের মালিক ওই জ্যোতিষ ব্যবসায়ী নন তো?

 মণিমালা বলেই চললেন, “আমি তো মহিলা একজন, সেই হিসেবে ক্লোজ ধরুন, এই আমার ভাই-টাইয়েরা এল, বা বোন টোনেরা এল। এছাড়া চেম্বারে আসুন। আমি যেটা বলছি, কনফারেন্স বা ইত্যাদি ব্যাপার, যে-সব ব্যাপার নিয়ে ঠিক এখন আমি কথা বলতে চাইছি না। তার কারণ আমি প্রস্তুতও নই, মানসিকভাবেও প্রস্তুতি আমার কোনও নেই।” (কথাগুলো হয়তো যথেষ্ট অগোছালো মনে হতে পারে, কিছু কিছু পাঠক-পাঠিকাদের পক্ষে। কেমন যেন ভাষার বাঁধুনির অভাব! কী করি বলুন? মণিমালা যেভাবে কথাগুলো বলেছিলেন, সে-ভাবেই আমার লেখায় যতটা সম্ভব তুলে ধরতে চাইছি টেপ বাজিয়ে শুনে শুনে।)

 “না, ওই যে একটা চিঠি যে বেরিয়েছে, সেই চিঠিতে তো, আপনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন যে প্রেস কনফারেন্সেই ফেস করবেন....” বলছিলাম আমি। কিন্তু আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়েই মণিমালা বললেন, “প্রেস কনফারেন্সে ঠিক ফেস করব বা কিছু বা করতে চাই, চিঠিটা সে ধরনের গেছে ঠিক কথাই, কিন্তু এর মধ্যেও অনেক ব্যাপার আছে।”

 “কী?” জিজ্ঞেস করলাম।

 “মানে, সেই ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছি না। এটা নিয়ে আমি, আপনারা দেখতেই পাবেন, এটা নিয়েই কিছু একটা বেরুবে। এটা নিয়ে এখন আমি কিছু বলতে চাইছি না। এটা নিয়ে কথাটা পরে আপনারা জানতে পারবেন। এর বেশি কিছু জানতে হয়, চেম্বারে চলে আসুন, চেম্বারে কোনও অসুবিধেই হবে না। কোনও আপত্তিও নেই। আপনি যাবেন ওখানে, ওখানে গিয়ে কথা বলবেন।”

 বললাম, “আপনি একা ভাবার কোনও দরকার নেই। এবং আপনি জয়ী হলে নিঃসন্দেহে আমাদের সবারই জয়। আপনার জয়ের আমরা শেয়ার করব অন্যভাবে।”

 “জয়ের কথা নয়। ব্যাপারটা জানেন তো, এরা মনে করে জ্যোতিষটা একটা বুজরুকি। অ্যাস্ট্রোলজিও একটা বিজ্ঞান। পাঁচজন মানুষ যে ছুটে ছুটে আজকে যাচ্ছে, এটার নিশ্চয় কোনও একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।” বললেন মণিমালা।

 গতকাল ফোনে মণিমালার সঙ্গে যে কথা হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ টেনে বললাম, “কালকেই তো আপনাকে বলেছি রেডিও প্রোগ্রামের ক্যাসেটটা আমরা করেছি। প্রয়োজনে আপনাকে ক্যাসেটটা দেব। আপনার যে-সব তথ্যের প্রয়োজন বলবেন; চেষ্টা করব সেগুলো আপনার কাছে হাজির করতে।”

 “আচ্ছা, আপনাদের অনেক রিসার্চ ওয়ার্ক আছে।”

 “কাল ফোনে তো আপনাকে বলেইছি, ওই রেডিও প্রোগ্রামটার ব্যাপারে; দিদি, আপনাকে যা যা বলা হয়েছে, ঠিক সে রকমভাবে কিছু হয়নি। আমি ফোনে বলেছিলাম, প্রবীরবাবু সাজিয়ে লোক হাজির করে অ্যাস্ট্রোলজারদের চিট করেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু আপনি যে বলছিলেন, প্রবীরবাবু প্রশ্নগুলোও হাজির করেছিলেন আলতু ফালতু; মানে—”

 “হ্যাঁ, কার ব্যাগে ক’টা পয়সা আছে? আমি এ-রকমই শুনেছি। আমি তো রেডিও প্রোগ্রামটা শুনিইনি।” বললেন মণিমালা।

 বললাম, “যাঁরা বলছেন, তাঁরা মিথ্যে কথা বলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অন্য রকম বলেন, তাতে লড়াই করতে আপনারই অসুবিধে হবে।”

 তারপর বেতার অনুষ্ঠানটিতে কী কী প্রশ্ন জ্যোতিষীদের কাছে হাজির করা হয়েছিল, তাঁরা কী জবাব দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কিছু কথা বললাম। এক সময় এও বললাম, “আপনি যদি নিতে চান, আমার ফোন নম্বর ও ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি।” তারপর আবারও জিজ্ঞেস করলাম। “প্রেস কনফারেন্সটা কবে নাগাদ হবে, কিছু—”

 “না, সেটা সম্বন্ধে কোনও আভাসও আমি পাইনি, সেটা আপনাকে বললাম। যদি কিছু জানতে পারি, যদি কিছু হয়, জানতে পারবেন।”

 মণিমালা আরও একটা কথা জানালেন, তাঁরা পত্রিকায় একটা চিঠি দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “ওই প্রেস কনফারেন্সের ব্যাপারে?”

 “প্রেস কনফারেন্সের ব্যাপারটা, বা যেটা আমি ‘চ্যালেঞ্জ’ মানে আমার নাম করে যেটা ‘চ্যালেঞ্জ’ বলে....’ দেওয়া হয়েছে। সে-ব্যাপার সম্বন্ধে ডিটেলভাবে আপনি জানতে পারবেন।” বললেন মণিমালা। (পাঠক-পাঠিকারা, অনুগ্রহ করে একটু লক্ষ্য রাখবেন, মণিমালা ‘আমি চ্যালেঞ্জ মানে আমার নাম করে যেটা চ্যালেঞ্জ বলে....’ কথাগুলো বলেছিলেন।)

 “তার মানে, কী, আপনার নাম করে যেটা দেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিক নয়?” জিজ্ঞেস করলাম।

 “সেটার মধ্যেও অনেক গণ্ডগোল আছে।”

 উপস্থিত একজন পাড়ার ছেলে মুখ খুললেন, “প্রবীরবাবু তো অ্যাকসেপ্টও করেননি।”

 “কাজেই সেই হিসেবে এখনও পর্যন্ত আমি ঠিক, মানে ডিসিশনে আসিনি যে কী করব। এই নিয়ে কথা চলছে। কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করছি।” জানালেন মণিমালা।

 “আপনি কিন্তু চ্যালেঞ্জ দিয়ে আবার পিছিয়ে আসবেন না।” বললাম আমি।

 “পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই। তবে এখানে শুধু আমি কেন? জেনারেলভাবে আজ যদি জ্যোতিষীদের একটা অ্যাসোসিয়েশন থাকত, তাহলে সেক্ষেত্রে কী হত? তখন সকলে মিলে সার্বিকভাবে জিনিসটা করতেন।” বললেন মণিমালা।

 “চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করায় অনেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন বলছিলেন।” একটু উস্কে দিতে চাইলাম।

 “হ্যাঁ, চেম্বারে অনেকে এসেছেন-টেসেছেন। এসে বলেছেন-টলেছেন। তবে আমি এখনও এটাকে এত সিরিয়াসলি নিইনি। তার কারণটা একটা জিনিস তো ঠিক, এটা তো একটা গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার তো বটেই। যতটা সুচারুভাবে বা যতটা নিখুঁতভাবে উত্তরটা দিতে পারা যাবে জ্যোতিষীদের, মানে আমাদের তরফ থেকে, ততটাই তো আমরা লাভবান হব। এ ব্যাপারটা নিয়েও আর একটু গবেষণা বা আরো চর্চার প্রয়োজন। সেই জন্যেই আমি একটু চুপ করে আছি।”

 “চুপ কোথায়? একেবারে তো বোমা ফাটিয়ে দিয়েছেন দেখছি।” বললাম।

 “ঠিক কথাই, তবে আপনারা শিগগিরিই এ ব্যাপারে জানতে পারবেন।”

 “কাগজে কি আপনার স্টেটমেন্ট কিছু বিকৃত করা হয়েছে?”

 আমার কথা শুনে একজন পাড়ার ছেলে বললেন, “মানে একটুখানি—ওটা ট্রাস্ট... একটা ব্যাপারে আমি হয়তো বিশ্বাস নাও করতে পারি। সেখানে আমি আপনার প্রফেশন নিয়ে আমি কেন ঘাঁটাঘাটি করব?”

 মণিমালা এবার আলোচনায় ছেদ টানতে চাইলেন, “আপনারা যেমনভাবে এলেন, আমার খুবই ভাল লাগল। আসলে এখানে ক-জন জ্যোতিষী রয়েছেন তো, তাঁরাও মানে এখানে একসঙ্গে মিলে আলোচনা করব।”

 বিদায় নিলাম আমরা।


 ৭ মে আমাদের সমিতির পক্ষে আমার চিঠি প্রকাশিত হতেই আবার একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন INDIA TODAY-র Principal correspondent উত্তম সেনগুপ্ত। উত্তমবাবুর কাছ থেকে এক নতুন খবর পেলাম। উনি মণিমালার সঙ্গে পত্রিকার তরফ থেকে দেখা করেছিলেন। মণিমালা এবং মণিমালা যে দোকানে বসেন, তাঁর মালিক নাকি উত্তমবাবুকে জানিয়েছেন প্রেস কনফারেন্সে প্রবীরবাবুর মুখোমুখি হওয়ার বা প্রবীরবাবুর পাঠানো প্রশ্ন ও চারজনের ছবি গ্রহণ করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। কারণ মণিমালার চিঠি বলে যে চিঠি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা নাকি মণিমালার চিঠিই নয়। উত্তরে উত্তমবাবু জানিয়েছিলেন, তবে আনন্দবাজারে চিঠি দিয়ে এই ধরনের চিঠি দেবেন কি না, সেটা ভেবে দেখছেন। এবং ওঁরা নাকি আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছেন।

 মণিমালার সঙ্গে আমার কয়েকদিনের কথাবার্তার ক্যাসেট শুনিয়ে বললাম, “চ্যালেঞ্জ যে মণিমালাই গ্রহণ করেছিলেন এটা তো বুঝলেন? এখন পরাজয় নিশ্চিত বুঝে চ্যালেঞ্জ এড়াবার রাস্তা খুঁজছেন। আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে জাল চিঠি ছাপার অভিযোগ এনে কেস করে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে দেবেন, এমন আহাম্মক ওরা কখনই হবে না। আবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মতো বোকামো করতেও নোরাজ।”

 তারপর দীর্ঘ বছর অতিক্রান্ত, আজ পর্যন্ত মণিমালার কোনও প্রতিবাদ-পত্র আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়নি। মণিমালা কোনও মামলাও আনেননি আনন্দবাজার পত্রিকার বিরুদ্ধে। আর আমার রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠানো চিঠি যে ফেরত এসেছিল, সে খবর তো আগেই জানিয়েছি।

 হায়, মণিমালা! এত বড় বড় কথা বলে জ্যোতিষী ও জোতিষে বিশ্বাসীদের মনে আশার সঞ্চার করে শেষ পর্যন্ত তাঁদের পথে বসিয়ে শকুন্তলাদেবীর মতোই পলায়নই বাঁচার একমাত্র রাস্তা বলে ধরে নিলেন? আপনি অন্যের ভাগ্য বিচার করেন, আর নিজের ভাগ্যটুকু বিচার করতে পারলেন না? আপনি ভূত নামিয়ে, অংক কষে এ কিছু জানতে পারেন; কিন্তু আর সব পরাজিত, বিধ্বস্ত, পলাতক জ্যোতিষীদের মতোই জানতে পারলেন না শুধু নিজের অপমানজনক পরিণতির কথা!

 বেতার অনুষ্ঠানে পরাজিত জ্যোতিষসম্রাট ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর লেখা বই ‘জ্যোতিষ-বিজ্ঞান কথা’র ভূমিকাতে লিখেছেন, “সেদিন ফাঁদ রচনাকারীরা সুকৌশলে চাতুরীর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে আমার অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যর্থতা প্রচার করে যে বিদ্রূপের হাসি হেসেছিলেন, তারই জ্বালা প্রশমনের জন্য সে রাতেই ভাগ্য দেবতা এগিয়ে দিল লেখনী”, তিনিও আপনারই মতো জ্যোতিষী হয়েও নিজ ভাগ্য বিপর্যয়ের আগাম খবরটাই জানতেন না? এমন কী, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এক মাস ধরে অনেক আঁক কযেও পোশাক-পরিচ্ছদের আড়ালে আসল মানুষগুলোর লুকিয়ে থাকা পরিচয় বের করতে পারলেন না?

 মণিমালা দেবী, আপনার সঙ্গে ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীর একটা দারুণ রকম মিল আছে। তিনিও চেয়ে আছেন ভবিষ্যতের দিকে। যেদিন আরো জ্যোতিষচর্চা ও জ্যোতিষগবেষণার মধ্য দিয়ে এমন একজন মহাজ্যোতিষীর আবির্ভাব ঘটবে, যিনি আমাকে ধ্বংস করে জ্যোতিষকণ্টক দূর করবেন, প্রতিষ্ঠা করেন জ্যোতিষশাস্ত্রকে। অসিত চক্রবর্তী তো তাঁর লেখা ওই বইটিতে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির প্রসঙ্গ টেনে সেই প্রত্যাশার কথাই লিখে ফেললেন। ১৫২ পৃষ্ঠায় লিখছেন “যখন প্রকাশক বইটি (অলৌকিক নয়, লৌকিক) প্রচারের জন্য “প্রকাশনার পর তিন মাস অতিক্রান্ত তবু চ্যালেঞ্জ জানাবার সৎ সাহস দেখাতে পারলেন না কেউ” বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন, তখন আমাদের মনে এসে যায় বাতাপি আর ইল্বলের কথা।”

 ‘বাতাপি’ ও ‘ইল্বল’ কে? বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড থেকে তুলে দিচ্ছি—ইল্বল প্রহ্লাদের গোত্রজাত অসুরবিশেষ। ইল্বল কোন ব্রাহ্মণের নিকটে ইন্দ্রতুল্য একটি পুত্র প্রার্থনা করে। ব্রাহ্মণ প্রার্থনা পূর্ণ না করায়, ইল্বল তদবধি ব্রহ্মঘাতক হয়। মায়াকৃত মেষরূপী বাতাপির মাংস ব্রাহ্মণকে খাওয়াইয়া ইল্বল পরক্ষণেই বাতাপির নাম ধরে ডাকতো ও বাতাপি উদর বিদীর্ণ করিয়া নির্গত হতো। এমনি ভাবে অনেক ব্রাহ্মণ নিহত হইলে, মহর্ষি অগস্ত্য মেষরূপী বাতাপিকে উদরস্থ ও হজম করিয়া ব্রহ্মকণ্টক দূর করেন।

 ভাল কথা। আপনাদের সাধ্যে তাহলে কুলোল না, অতএব আপনারা কোনও এক অগস্ত্য মুনির আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনুন, যেদিন তিনি এসে চ্যালেঞ্জার বাতাপিকে হজম করে যুক্তিবাদীদের মায়া থেকে আপনাদের উদ্ধার করবেন। আচ্ছা, একটি কথা বলতে পারবেন গুনে-গেঁথে—ওই অগস্ত্য আগমন কবে ঘটবে, এবং ঘটবে আপনাদের উত্তরণ? এখানেও আপনাদের গণনা, আপনাদের ভবিষ্যদ্বাণী চূড়ান্তভাবেই ব্যর্থ হবে। কারণ, আপনাদের অগস্ত্য কোনও দিনই আসবেন না। যদিও বা আসেন, ‘বাতাপি’র সিংয়ের গুঁতোয় ফাঁসবে তাঁরও পেট। আপনারা অনেক ব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য না শুনেই যে ভবিষ্যদ্বাণী শোনালাম, তা একেবারেই অব্যর্থ। আপনাদের ভবিষ্যৎ বলে সত্যিই কিছু দেখছি না। এক ‘বাতাপি’, ‘ইল্বলকে’ ঠেকানোই আপনাদের কম্মো নয়; এই বই যে হাজার হাজার ‘বাতাপি’, ‘ইল্বল’-এর জন্ম দেবে; তারা যে আপনাদের ঝাড়ে-বংশে শেষ করে দেবে মশাই!

 এদিকে নরেন্দ্রনাথ মাহাতোকে নিয়ে আর এক কেলেংকারি। এক দিনে একই সঙ্গে নরেনবাবুর পাঠানো দু'টি খাম পেলাম। দুটি চিঠিই উনি লিখছেন ৮ মে ১৯৯০ তারিখে। সঙ্গে ‘বিপ্লবী মেদিনীপুর টাইমস’ পত্রিকায় কিছু কপি, সেগুলোতে নরেনবাবুর ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। লাল ও নীল উড পেন্সিলে প্রায় প্রতিটি লাইনে ছাপার ভুল সংশোধন করে পাঠিয়েছেন নরেনবাবু। চিঠি দুটিতে ‘মজার ছত্রিশ ভাজা’ পরিবেশিত হয়েছে। শেষে এক জায়গায় জানিয়েছেন, তিনি নীতিগতভাবে জমানতের পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে রাজি নন। এবং তা সত্ত্বেও যেন ১৬ জুন ১৯৯০-এর প্রেস কনফারেন্সে আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই।

 উত্তরে জানিয়েছিলাম, চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিনা ঝুঁকিতে ফালতু কিছু কামানোর ধান্ধায় অনেকেই আমার সময়ের প্রচণ্ড অভাবের মধ্যে থাবা বসাতে চায়। তাদের সামাল দিতেই এই জামানতের ব্যবস্থা। জামানত রাখি না শুধু বিখ্যাতদের ক্ষেত্রে। তবে নতুন একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি পরাজিত হলে আপনার মাথার আধখানা কামিয়ে দেব। আর লিখিতভাবে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, আর কোনও দিনই হস্তরেখাচর্চা, জ্যোতিষচর্চা করবেন না। এতে রাজি হলে ওই দিনের সম্মেলনে আপনার মুখোমুখি হব।

 আবারও নরেন্দ্রনাথ রণে ভঙ্গ দিলেন। সাহস করে আধমাথা চুলের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে রাজি হলেন না।