অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/ভূমিকা
ভূমিকা
ভূত আর ভবিষ্যৎ—এই হল আমাদের যত গন্ডগোলের জায়গা। ভূত কথাটার দুটো মানে—একটা হল অতীত, আরেকটা হল প্রেত-প্রেতিনী ইত্যাদি। যে মানুষ বেঁচে আছে সে নিজের অতীতটা বেশ কিছুদূর দেখতে পায়, সেটুকু অনেকাংশে তার স্পষ্ট অভিজ্ঞতার জগৎ; পুরোটা হয়তো নয়। এইভাবে সে তার জন্মের ঘটনায় গিয়ে পৌঁছোয়—সেই হল তার চেতন-জীবনের প্রথম মুহূর্ত। মার পেটের উষ্ণ তরল অন্ধকারের স্নান থেকে হঠাৎ সে এসে পড়ল পৃথিবীর কড়া আলোয়—পাঁজর চিরে সে তীব্র একটা চীৎকার ছড়িয়ে দিল ‘অয়মঽং ভো’! কিন্তু তার আগে? বিজ্ঞান মানুষকে বলে দিচ্ছে তার আগে জননীজঠরে তার ভ্রূণাবস্থা। তার আগে? সেখানেও বিজ্ঞানীর উত্তর—পিতার শরীর থেকে মার জরায়ুতে প্রবিষ্ট ঘনতরল নির্যাসের অজস্র জীবনকণিকার মধ্যে ছিল তার অস্তিত্ব! আর তার আগে? বিজ্ঞানে তারও উত্তর আছে।
কিন্তু বিজ্ঞান এই উত্তর বার করেছে নেহাতই হাল আমলে, পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস কয়েক লক্ষ বছর গড়িয়ে যাবার পর। তার আগের মানুষেরা সে উত্তর জানত না। এখনও কোটি কোটি মানুষ এ সব উত্তর জানে না। যারা জানে, তারা অধিকাংশই আবার বিজ্ঞানের এ উত্তর মানে না, মানতে চায় না। এখানেও ‘ভূত’-এর প্রভাব—অতীতের অজ্ঞতার বিমূঢ় উত্তরাধিকার। লক্ষ বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষেরা যেকথা বিশ্বাস করে এসেছে, যে অন্ধতা লালন করেছে, বিচিত্র অলীক কল্পনা দিয়ে যে অজ্ঞতার প্রাসাদ তৈরি করেছে, তাকে এক কথায় গুঁড়িয়ে দিই কী করে? ছোট্ট একটি ভোঁতা পিন দিয়ে একটি মস্ত বেলুন ফাটিয়ে দিয়ে তার বেলুন জন্ম ঘোচানো সম্ভব হল, বিজ্ঞানের ঝকঝকে ছুরি দিয়ে অন্ধবিশ্বাসের নাড়ী কাটা সম্ভব হল না। ফলে ‘এলেম আমি কোথা থেকে’—এই ভূত জিজ্ঞাসা শেষ পর্যন্ত ভৌতিক বিশ্বাসে নিয়ে যায় আমাদের। জন্মের আগে ভূত, তার আগে আরেক জন্ম; আবার জন্মের পরেও ভূত, তারপরে আরেক জন্ম। জন্মান্তরবাদ—তার সঙ্গে ভূতজীবনের পর্যায় খানিকটা এইরকম—
জন্ম১ + ভূত১ + জন্ম২ + ভূত২ + জন্ম৩ + ভূত৩ ... জন্ম২ + ভূত২ + জন্ম১ কবে হল তা অবশ্য জানি না, শেষ জন্ম কবে হবে তাও জানি না। তবে দেখানেও ভূত থাকবে অর্থাৎ ভবিষ্যতেও ভূত।
ভূতরা যদি স্বর্গের কালা-আদমি হয় তো খাস বিলিতি বা আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ অভিজাতবর্গ হলেন দেবতারা। আমাদের কল্পজন্মান্তর অতিক্রম করে তাঁরা থাকেন, টুক টুক করে অমৃতপান করেন আর উর্বশী ঘৃতাচীদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেন। তাঁরা দিব্যি সুখবিলাসী জীবন। আমাদের জন্মমৃত্যু সুখদুঃখের সুতো নাকি তাঁদের হাতে। দানিকেন সাহেব এই সব দেবতাদের কীর্তিকলাপ এই পৃথিবীর বুকেও দেখেছেন। যাই হোক, আমাদের অতীতের অতীতেও নাকি এঁরা ছিলেন, আর ভবিষ্যতের ভবিষ্যতেও থাকবেন। এঁদের মধ্যে অন্ত্যজ ছোটলোক ওই ভূতেরা—তাদের মত ক্ষমতা নেই। তারা শুধু ভয়টয় দেখায়—ভালো কিছু করার মুরোদ তাদের কোথায়? দেবতারা দিব্যি পুজো পায়, কিন্তু ভূতেরা পায় ওঝার ঝাঁটার বাড়ি। কেন যে ভূতেরা স্বর্গে প্রোলেতারীয় বিপ্লব আরম্ভ করেনি জানি না।
অতীত যদি বা কিছুটা জানলাম, ভবিষ্যৎ তো আদৌ জানি না। পরের মুহূর্তে যদি মরে পড়ে যাই রাস্তায়? সন্তান যদি পরীক্ষায় ফেল করে? যাকে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী করার কথা ভাবছি সে যদি ‘আর কারে ভালবাসে’? দূরবিন দিয়ে স্থনাগতভাবে দূরের জিনিস দেখতে পাই, কিন্তু কালগত দূরত্বের মধ্যে নিজেকে নিক্ষেপ করে কিছুই দেখতে পাই না অস্পষ্ট অনুমানের বাইরে। কাজেই ছোটরে জ্যোতিষীর কাছে। এই হাতুড়ে গোবদ্যি দেয় হাতুড়ের ওষুধ—পলা, গোমেদ, নীলা—ভবিষ্যৎ অপঘাতের টোটকা। নইলে, ছোট্রে প্রভু বা গুরুর কাছে—যে কেত্তনের নেশায় আচ্ছন্ন করে, আবার আরেক শিষ্য মন্ত্রীকে বলে ছেলের চাকরির ব্যবস্থাও করে হয়তো। অলৌকিক ভূতের ব্যাখ্যা করে দানিকেন, ভবিষ্যতের অলৌকিক ব্যাখ্যা করে গ্রহ-গোবদ্যি আর নোস্ত্রাদামুসের দল ভবিষ্যৎ-বদ্যিদের পয়সা গুনে দাও, গুরুদেরও পয়সা গুনে দাও। ‘বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর।’ এই প্রশ্নটা কেউ করে না, কৃষ্ণ যদি সর্বশক্তিমানই হবে তাহলে তর্কে সে ধরা দেবে না কেন?
কিন্তু স্বর্গের দেবতাদের নিয়েই শুধু খুশি না আমরা, আমরা পৃথিবীর মানুষদেরও দেবতা বানিয়ে ছাড়ি—‘মা’, ‘বাবা’, ‘দাদা’, ‘ঠাকুর’ এইসব উপসর্গ নিয়ে হাজির হন তাঁরা। ধর্মের বিশাল ব্যবসাতে তাদের মনোহারি মালপত্রও সাজানো থাকে।
সাক্ষর মানুষ যদি পৃষ্ঠা পাঁচেক নৃতত্ত্ব আর পৃষ্ঠাদশেক বিজ্ঞান পড়ে, তাহলেই তার বুঝতে পারা উচিত ধর্ম নামক কী বিপুল এক অলংকৃত অন্ধতা হাজার হাজার বছর ধরে তার চোখে ঠুলি পরিয়ে তার পকেট কেটে এসেছে। আর পনেরো পাতা ইতিহাস পড়লে সে বুঝতে পারবে কীভাবে রাজকীয় স্বার্থ আর লোলুপতা শাসকের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ধর্মকে ব্যবহার করেছে শোষণের ছদ্মবেশী অস্ত্র হিসেবে। যুক্তির এই দীক্ষা স্কুলকলেজের ডিগ্রি থেকে অর্জন করা যায় না। হয়তো এর জন্যেও আর এক গুরু দরকার—রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’-এর জ্যাঠামশায়ের মতো এক গুরু। এমন এক গুরু যিনি দেখিয়ে দেবেন ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে চোরাকারবারি ধর্মের সংগঠিত সাম্রাজ্যের প্রান্তে সব বুনোদের বস্তি—জ্যোতিষ, তুকতাক, আর হাজারে কুসংস্কারের জঙ্গল।
এক পাল্টা গুরুর সম্প্রদায় তৈরি হোক দেশে। তাঁরা বলবেন না, ‘মেনে নাও মেনে নাও, মেনে নাও।’ তাঁরা বরং বলবেন, ‘প্রশ্ন করো, প্রশ্ন করো, প্রশ্ন করো। বিচার করো, পরীক্ষা করো, প্রত্যেকটা কথা যাচাই করে দ্যাখো। যা প্রত্যক্ষ যাচাই করা যাবে না, বিজ্ঞান আর যুক্তির আলোতে তার সংগত অনুমান তৈরি করো, পরোক্ষ প্রমাণ নাও। আমি বলছি বলে সব মেনে নিয়ো না। আমি তোমার হাতে প্রশ্নের দীপশিখা তুলে দিচ্ছি, তুমি তা থেকে মুক্তবুদ্ধির আগুন জ্বালো। ভূতকে ভাগাও, ভগবানকে ভোলাও, ভবিষ্যদবক্তাদের ভুলভুলাইয়াকে ভেঙে ফ্যালো।’
শ্রী প্রবীর ঘোষ এই পাল্টা গুরুর সম্প্রদায় তৈরির মহৎ ব্রত গ্রহণ করেছেন—এ তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত মিশন-এর জন্য তিনি শুধু অর্থ নয়, প্রাণও দিতে প্রস্তুত। ভারতবর্ষে তাঁর পাশাপাশি আরও অনেকে এগিয়ে এসেছেন এখন। ফলে এককালে যারা ছিল ফেরারি ফৌজ, তার এখন প্রকাশ্য উপত্যকায় কুচকাওয়াজ করছে, যুদ্ধের জন্য সদাপ্রস্তুত এক বাহিনী। তারা প্রবন্ধ লিখছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, পত্রপত্রিকা প্রকাশ করছে, বিজ্ঞান-প্রদর্শনীতে তথাকথিত অলৌকিকতা আর অন্ধবিশ্বাসের বস্ত্রহরণ করছে, এমন কী নাটকও নামাচ্ছে। এর ফলে পরিবারের মধ্যে নিঃসঙ্গতার ঝুঁকি আছে, সমাজে গোষ্ঠীতে ভুল বোঝার সুযোগ আছে, সংগঠিত ধর্ম ও বিশ্বাস-ব্যবসায়ীদের প্রত্যাঘাতের ভয় আছে।
তবু এই ভয়হীনের দল ক্রমশ বড় হচ্ছে—দেশের পক্ষে এইটে বড় আশার কথা। প্রবীরবাবুর প্রয়াস সার্থক হোক ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, বিজ্ঞান মঞ্চ বা গণবিজ্ঞান জাঠা এই সমবেত মুক্তবুদ্ধির অভিধানে সকলকে ডাক দিক—ধর্ম, গুরু, জ্যোতিষ, ভূতপ্রেত, আত্মা, অমঙ্গলের যাবতীয় অন্ধতা বিধ্বস্ত হোক। কেবল জেগে থাক ঋজু ও স্পর্ধিত মানুষ। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান বৌদ্ধ নয়—শুধু মানুষ। তার মাথা স্বর্গ ছাড়িয়ে মহাকাশ ছোঁয়, তার হাত সমস্ত বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে যায়, তার পা দাঁড়িয়ে থাকে প্রজ্ঞা ও বিচারবোধের কঠিন মাটিতে। সেই দিনের উদ্ভাস কামনা করে আমি শ্রীপ্রবীর ঘোষকে তাঁর বিস্ময়কর কাজ ও গবেষণার জন্য অভিনন্দন জানাই, অভিনন্দন জানাই তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রীমান পিনাকী ঘোষকে। আমার আয়ুষ্কালের মধ্যেই আমি তাঁদের এই গৌরবময় প্রয়াসের ব্যাপক সার্থকতা দেখে যেতে চাই। আমার বেঁচে থাকার গোড়ায় প্রাণ সিঞ্চন করুক এই প্রত্যাশা।
১০.২.১৯৯২ |