অলৌকিক নয়, লৌকিক (দ্বিতীয় খণ্ড)/অধ্যায় ছয়
ছয়
ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
ডাইনি লাগা
‘বর্তিকা’ পত্রিকার ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি-জুন সংখ্যার জন্য লেখার আমন্ত্রণ পেয়ে, অজিত সিং একটি লেখা পাঠান। লেখাটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক মহাশ্বেতা দেবী। অজিত সিং তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন। আপনাদের অবগতির জন্য লেখাটি এখানে তুলে দিলাম:
আপনার দেওয়া পত্র পাই, আপনার পত্রিকার জন্য চাওয়া বিষয় নিম্নে লিখিয়া পাঠাইলাম।
ডাইনি আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না, কারণ বিজ্ঞানের যুগ, —কিন্তু আমি করি। এ বিশ্বাস আমার জন্মেছে গল্প শুনে নয়, ডাইনি শক্তি চোখে দেখে।
চোখে কি দেখেছি—বলছি।
আজ থেকে কিছুদিন আগেকার ঘটনা। আমি দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলাম। বেশ জমানো তাস খেলা হচ্ছে। এমন সময় একজন এসে খবর দিল যে, ইন্দ্রের মাকে ডাইনি লেগেছে। সমাই খেলা ছেড়ে ইন্দ্রের বাড়ি গেল। গিয়ে দেখি ইন্দ্রের মা ভুল বকাবকি করছে। হঠাৎ এই অবস্থা দেখে কেউ যেন কূলকিনারা পাচ্ছে না। কারণ সবাই দেখছে ইন্দ্রের মা এখনি পুকুর থেকে স্নান করে গেছে।
এর আগে তো এমন দেখিনি। যারা ডাইনি বিশ্বাস করে তারা বলছে হয়তো জ্বর হয়নি, যারা বিশ্বাস করে না তারা বলছে হয়তো জ্বর তুলেছে, কিন্তু জ্বর তুললে তো গায়ের তাপ পরিবর্তন হয়। ইন্দ্রের মাকে দেখে মনে হয় না যে তার জ্বর তুলতে পারে, কারণ সে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। এই অবস্থায় দেখে গ্রামে এক ওঝা আছে, তাকে ডাকা হলো। ওঝাকে দেখে ইন্দ্রের মা যেন অন্য মূর্তি। ওঝা তার কাছে গিয়ে বসল। ওঝার কাছে ছিল একটি আলো এবং একটি হাড়ির লাটা। ইন্দ্রের মা তখন আলোর দিকে তাকায়নি, অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। “আলোটার দিকে একবার মুখ ঘুরা মা”–এই বলে ওঝা আলোটা তার মুখের দিকে নিয়ে যায়। তখন ইন্দ্রের মায়ের মুখ ঢাকা নিয়ে অন্য দিকে তাকায় এবং একটু করে হাসছে। তখন ওঝা বাইরে এসে ইন্দ্রকে বলে যে, “প্রকৃত ডাইনি ভর করেছে।” ওঝাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী করে বুঝলে যে ডাইনি ভর করেছে?” ওঝা তার উত্তরে আমাদেরকে বলল, তার কতগুলো নিয়ম আছে, “যেমন আলোর দিকে তাকায় না, আতা পাতা দিলে তার রাগ হয়। যদি না বিশ্বাস হয় যা দেখি একজন আতা পাতা নিয়ে তার কাছে দিয়ে আয়।” কিন্তু কে যাবে—সবাই এর মনে একটা ভয় আছে। গৌর নামে বছর ৩৫/৩৬-এর একজন লোক এই কথা শুনে কিছু আতা পাতা নিয়ে তার কাছে গেল। যেমনি বিছানার কাছে এসেছে, তেমনি সে তাকে তাড়া করে নিয়ে যেতে লাগল। গৌর তখন কি তার বিছানায় আতা পাতা দিবে- ভয়ে ঘর থেকে পালিয়ে এল। তারপর আবার সে বকাবকি আরম্ভ করে দিল। ওঝা বারণ করে বলল, “শুধু শুধু তার সঙ্গে লাগিস না।”
তখন আর কেউ না লাগিয়ে ওনার রহস্য দেখতে লাগল। ওঝা একটি পাত্রে কিছু আগুন রেখে, মুখে কি বিড় বিড় করে বলল, তারপর আগুনের মধ্যে কিছু ধুনা ফেলে দিল। ইন্দ্রের মা “ছাড়-ছাড়, আমি ঘর যাব”, এই বলে ওঝার কাছ থেকে চলে এল। কিছুটা গিয়ে ইন্দ্রের যা ফিরে এল। এইভাবে ওঝা তিন-চার বার করার পরেও যখন তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারল না, আবার সে ফিরে এল। ওঝা তখন বুঝতে পারল যে, এখন ডাইনির ভর তার গা থেকে যাবে না। সন্ধ্যার সময় যাবে। ওঝার এই কথা শুনে একজন বলল যে, কোথাকার ডাইনি, কোন ডাইনি ভর করেছে? ওঝা কোনো মতেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হয় নাই। কারণ তার বিশ্বাস ডাইনি সহজে তার নাম এবং বাড়ি কোথায় বলে না। বেশি আলতু-ফালতু জিজ্ঞাসা করলে কণ্ঠা ফেলে দেয়। তবু তাকে কোনো মতে রাজি করানো গেল। ওঝা তখন ইন্দ্রের মাকে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসা করছে যে, “তুমি কোথায় এসেছ?” এর উত্তরে ইন্দ্রের মা বলল, “কেন আমার পুত্রাবাড়ি এসেছি।” আবার “কি জিজ্ঞাসা করতে এসেছ?” “আমার দরকার ছিল তাই এসেছি।” “তুমি কবে এসেছ”, “কাল থেকে এসেছি।” এই কথা শুনে সবাই মনে ভাবতে লাগল কোথার ডাইনি কেউ বুঝতে পারছে না। ওঝা জিজ্ঞাসা করছে, “ঘর কখন যাবে?” “সন্ধ্যার সময় যাব।” “তোর কয় ছেলে মেয়ে?” “আমার তিন ছেলে এক মেয়ে।” “ইন্দ্রের বাবা তোর কে হয়?”—“ভাশুর হয়।” ওঝা তারই বাড়ির সামনের এক ছেলেকে লক্ষ্য করে বলল—“এ কে হয়? একে চিনতে পারলাম না।” তখন বুঝতে পারা গেল কোথাকার ডাইনি। ওঝা ইন্দ্রের বাবাকে কাছে ডাঞ্চল, কাছে যেতে ইন্দ্রের মা ভাশুর আসছে বলে মাথায় ঘোমটা তুলে ওঝার কাছ থেকে সরে যেতে লাগল।
ইন্দ্রের বাবাকে ওঝা বলল যে, “গ্রামের যারা ডাইনি বলে পরিচয়, তাদের কারো তো তিনটি ছেলে এবং একটি মেয়ে নেই। পাশাপশি গ্রামের যারা ডাইনি বলে পরিচয় তাদেরকে লক্ষ্য করলাম। সাতভাণ্ডারী গ্রামের একজনের তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে। কাল তাদের বাড়ি গিয়েছিল ধানের ব্যাপারে নিয়ে। সবাই জানে সে খুব শান্ত ডাইনি। যাক, এখন কিছু করার নেই। সন্ধ্যায় যা হবার হবে। সন্ধ্যার সময় ওঝা তার কাজ শুরু করল। চার পাঁচ জন লোক ডেকে বলল, “আমি এখন ধুনার ছাঁট মারব, তোমরা খুব শক্ত করে ধরবে। আর ছাড়া হয়ে গেলে তার পেছু ছাড়বে না। মাটিতে বেশি জোরে পড়তে দেবে না।” এই বলে ওঝা মুখে কি বিড়বিড় করে বলল, তারপর ধুনার ছাঁট মারল। ধুনার ছাঁট মারতে কি করে রাখব ছাড় ছাড় বলে, —ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল এবং রাস্তায় এসে দড়াম করে পড়ল। সেখান থেকে তুলে আনলে আবার ধুনা ছাঁট মারল, এবারও তাকে ভুলে আনল। তার ঘর কোথা জিজ্ঞেস করল না। তাকে ধরতে না পারলে ঘর জিজ্ঞাসা কী করে করবে। এবার খুব শক্ত করে ধরবে এবং ঘর জিজ্ঞেস করবে। এই বলে ওঝা মুখে কী বিড় বিড় করে বলল এবং মারল ধুনার ছাঁট তারা খুব শক্ত করে ধরে জিজ্ঞাসা করল, “তোর ঘর কোথা? ছাড় বলছি।” এবার তার গ্রামের দাম সাতভাণ্ডারী বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু নাম জিজ্ঞাসা করতে পারল না। তারপর রাস্তা থেকে তুলে আনল এবং আবার ধুনার ছাঁট মারল, কিন্তু আর কিছু হলো না। তখন ইন্দ্রর মা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ওঝা তখন বলল, তার গায়ে ডাইনি আর ভর করে নেই। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল এবং ইন্দ্রের বাবাকে বলল, কাল যদি এইভাবে বকাবকি করে বা কাউকে না চিনতে পারে, তবে ওঝাকে যেন ডাকে। স্বাভাবিক থাকলে ডাকতে হবে না। সহজেই এইভাবে ডাইনি ধরা যায়।”
এই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে ‘বর্তিকা’র ওই সংখ্যাটিতে প্রকাশিত শ্রীগঙ্গাধর মাহাত’র অভিজ্ঞতা আপনাদের শোনাতে চাই:
‘ডাইনি’ শব্দটা অশরীরী, অলৌকিক আর অলৌকিক মানেই তার কোনও বস্তুগত ভিত্তি নেই (অন্তত সাধারণের কাছে), আর আমরা যেহেতু ইলেকট্রনিক্স-এর যুগে বাস করছি সেহেতু স্বভাবতই এর পেছনে একটা বৈজ্ঞানিক ধারণা (যদিও মৌলিক নয়) চালাবার চেষ্টা করি আর সেখানেই আমরা সব থেকে বেশি ভুল করি বলেই আমার ধারণা। আমার অবশ্য বিজ্ঞান চিন্তাধারা অনেকটা সীমিত তবু এর মধ্যেই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি, কোনও দিন সফলকাম হতে পারিনি। মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করি এসব এক ধরনের রোগ কিন্তু কী রোগ তার কোনও সফল ব্যাখ্যা দিতে পারি না কারণ আমি নিজেও জানি না ব্যাপারটা আসলে কী?
একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি, কয়েকদিন আগে আমারই এক বন্ধুর বোন, বয়স ৯/১০ বছর হঠাৎ শুনলাম তার নজর লেগেছে। গ্রামের লোকের কথায় ডাইনি লেগেছে। তড়িঘড়ি করে ছুটলাম, আমার বাড়ির ৩০০ গজের মধ্যে তার বাড়ি। গিয়ে দেখি মেয়েটি মুখ ঢেকে হাত-পা ছুঁড়ছে, কখনো হাসছে কখনো কাঁদছে। মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম তখন তিন জন সমর্থ পুরুষ হিমশিম খেয়ে গেলাম তাকে সামলাতে। এবার গ্রামের প্রথামতো আতা পাতা বিছানায় দিলাম। তখন সেকি ঝটফটানি সামলে রাখা দায়। ছেড়ে দিলাম, সবিস্ময়ে দেখলাম সমস্ত পাতাগুলো ফেলে না দেওয়া পর্যন্ত তার যেন স্বস্তি নেই। সবাই একমত হলেন যে ওকে ডাইনি ভর করেছে ওঝা ডাকার ব্যবস্থা করা হলো। অবশ্য আমরা মানে আমি এবং আমার বন্ধু যারপরনাই চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। অবশেষে ওঝা এসে মন্ত্র পড়ে ধুনোর এ বামর (‘একটি পলতেতে আগুন জ্বালিয়ে সেই শিখার উপর দিয়ে ধুনোর গুঁড়োর ঝাঙটা মারা’ এতে অনেক সময় রোগিণীর চামড়া পুড়ে যায় চুল পুড়ে যায়) মারতেই সে চিৎকার করে উঠলো “ছেড়ে দে আমি যাব”। বলেই বিছানা থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে দৌড় লাগাল এবং একটি বাড়ির দরজার সামনে পড়ে গেলে। সেই বাড়ির একজন মধ্যবয়স্কা স্ত্রীলোক ‘ডাইনি’ বলে পরিচিত। এর কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে একবছর আগে, আমার মায়ের ক্ষেত্রে। সবেমাত্র টাইফয়েড ছেড়ে পথ্য করেছেন, দেহ বেশ দুর্বল, হাঁটা চলা করেন খুব কম। ঘরের পাশাপাশি সকাল বিকাল একটু বেড়ান। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। সেদিনটা ছিল শনিবার স্কুল থেকে ফিরে মাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য গিয়েছি। হাত ঘড়িতে তখন বেলা তিনটে। দেখি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মা শুয়ে আছেন আর বিড়বিড় করে কী বলছেন। শুনতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। গায়ে হাত দিয়ে একটু জোরের সঙ্গে ডাকলাম সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ঝাঁজের সঙ্গে উত্তর “কে তোর মা”। আমি আবার বললাম “মা আমি গঙ্গাধর”। “দূর শালা দিদি বলতে পারিস না? আমি তোর মা নই, আমি তোর দিদি।” ভয়ে বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোল না, প্রথমে ভাবলাম মা কি পাগল হয়ে গেলেন? পথ্য করার পর থেকে যিনি কথা বলতে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি এত জোরে কথা বললেন কী ভাবে। হাত ধরে ওঠাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু এত জোরে ঝটকা দিলেন আমি খাট থেকে নিচে নেমে এলাম। অবাক হলাম। যিনি হাঁটাতে পারে না এত জোর পেলেন কোথা থেকে। এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল মন সন্দিহান হয়ে উঠল। বাড়ির অন্যান্য লোকদের খবর দিলাম। তাঁরাও এনে বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। একই ধরনের উত্তর। যেমন কাকা এসে বউদি ডাকতেই বলে উঠলেন “দূর বেহায়া আমি তোর কাকী হই, লজ্জার মাথা খেয়েছিস।” সবার মনে সংশয় ঘনীভূত হল। এত কাণ্ডের মধ্যেও কিন্তু মুখ থেকে কাপড় একটুও সরাননি, বিড়বিড় করা অব্যাহত আছে। বাড়ির ও আশেপাশের প্রবীণ-প্রবীণারা আভা পাতা এনে বিছানায় দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পাতাগুলি ক্ষিপ্রতার সহিত উনি বিছানার নিচে ফেলে দিলেন। অতঃপর ওঝা এল, মন্ত্র পড়ল। মা খাট থেকে নেমে বাইরে গেলেন এবং একটি ঘরের দরজার পাশে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লেন। আমরা সবাই ধরাধরি করে খাটে এনে শুইয়ে দিলাম। প্রচণ্ড ঘাম হল আর তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আগেও বাঁর শক্তি আমাদের পরাভূত করেছিল তিনি এখন জ্ঞানহীন, সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় অল্পক্ষণেই জ্ঞান ফিরল। দুচোখ বড় বড় করে আমাদের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন মনে হল জন্য কোন গ্রহ থেকে আসা আগন্তুকদের দেখছেন।’
ভূতে পাওয়া নিয়ে আগে যে বিস্তৃত আলোচনা করেছি, সে আলোচনার আলোকে আপনাদের নিশ্চয়ই বুঝতে সামান্যতমও অসুবিধে হচ্ছে না যে তিনটি ক্ষেত্রেই মহিলা তিনজনই মানসিক রোগের শিকার হয়েছিলেন। এই মানসিক রোগ বিষয়ে ধারণা না থাকলে মনে হতেই পারে, ‘ভূতে ভর’ বা ‘ডাইনি পাওয়া’ বিষয়গুলোর পিছনে কোনো বস্তুগত ভিত্তি নেই বলে যে সব ইলেকট্রনিকস যুগের মানুষ বিষয়টা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরা ভুল করছেন।
এও ঠিক, আমরা সাধারণ মানুষের কাছে এই বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা অর্থাৎ প্রকৃত তত্ত্ব ও তথ্য তুলে দিতে পারিনি। কিছু কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে যতটুকু কাজ করেছেন, প্রয়োজনের তুলনায় তা এতই অপ্রতুল যে মানুষের মনের ‘ভূত-প্রেত-ডাইনি’ মন ছেড়ে নির্বাসনে যায়নি। এই বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার, জানানো ও বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু বর্তায় প্রধানত বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মী, যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী, সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সরকারি প্রশাসনের।
সাঁওতাল সমাজের ডাইনি বিশ্বাস
সাঁওতাল সমাজে ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে বিশ্বাস সমুদ্র-গভীর। এই সমাজের যাঁরা শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত তাঁদেরও সংখ্যা-গরিষ্ঠদের মধ্যেও ডাইনিদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বিষয়ে বিশ্বাস গভীর। একই সঙ্গে তাঁরা জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতায় ও তাঁদের ডাইনি খুঁজে বের করার ক্ষমতায় আস্থাশীল।
যাঁরা ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই এই বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত: বাস্তবিকই ডাইনি ও জানগুরুর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে? কী, নেই?
সিংরাই মুর্মু বাঁকুড়া জেলায় ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন সিংরাই মুর্মুর কথায়—
আমাদের সমাজে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি আছে, আদিবাসী ভাষায় এদের সানি ও ও সখা বলে। ভালো কথায় জানগুরু। ইতি ভূত প্রেত ধরতে জানেন এবং কেউ ডাইনি হলে ঠিক রকম বলতে পারলে কিন্তু ডাইনি ছাড়াতেও পারে অবশ্য সেই জন্য মোটা টাকা দক্ষিণা হিসেবে দাবি করে। এবং ডাইনি কাউকে করিলে জরিমানা করা হয় বা দিতে হয়। কিন্তু যার দু মুঠো অন্ন সময়ে জোটে না, জীবন শেষ হয়ে যায় তার পক্ষে মোটা টাকা দেওয়া কি রকম কষ্টকর তা সহজেই অনুমেয়। এই ব্যাপারে আমরা বহু সমাজ সমিতি করেছি এবং বহু জায়গায় আমরা আদিবাসীর সমাজে সে আলোচনা করেছি কিন্তু তাতেও কোনো পড়েনি—বেশির দিকে চলে যাচ্ছে এবং এই ডাইনি বাংলার বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের বহুবার তুলে দিয়েছিলাম। কি ভারতবর্ষে সমাজ দিককে নিপুগ্ধকর এবং পুলিশদের হাতেও এই ব্যাপারে তুলে দিয়েছিল, কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি। সে জন্য আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে দুঃখিত। আমার জীবনের যাত্রাতে এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা হলো বাংলা ১৩৭৫ সাল ১৫ আশ্বিন। আমাদের গ্রামে একটি বৃদ্ধা মহিলা মুড়ি ভাজতে গিয়ে তাঁহার বাঁ পাটি উনুনের ভিতর চলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাঁ পায়ের বাইরের চামড়া আগুনের তাপে ঝলসে যায়। জ্বলে যাবার পর স্থানীয় ডাক্তারের অভাবে তাঁহার পরিবারের লোকেরা জঙ্গলের মধ্যের শিকড়-বাকড়ের ওষুধ বেঁধে সেই ঘায়ের উপর লাগাল। কিছুদিনের পর দেখা গেল ঘা-টি আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে এবং নতুন চামড়া গজাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার সেই বৃদ্ধ মহিলা আর স্থির হতে পারছেন না, চলাফেরার জন্য অস্থির। কোনো রকমে আর রাখা গেল না। যেমনি চলাফেরা করলেন তেমনি তাঁর পায়ের চামড়া ফেটে ঝরঝর করে রক্ত বেরোতে লাগল। পায়ের অবস্থা আরও মন্দ হয়ে দাঁড়াল। সেই মহিলার একটি ছেলে, যে হচ্ছে একজন প্রথম শ্রেণির শিক্ষক। মায়ের কেটে যাওয়া যা দেখে তার মধ্যে একটা সন্দেহ ফুটে উঠল। আমার মা আর ভালো হবে না এবং আমার মাকে ডাইনি আক্রমণ করেছে। এত ওষুধ লাগাচ্ছি ভালো হচ্ছে না কেন? তাহলে ডাইনি ছাড়া কোনো কিছু আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু এইটুকু শিক্ষক মশাই বুঝতে পারলেন না, মায়ের ঘা এখনও শুকোয়নি। চলাফেরা বন্ধ হোক। কিন্তু তা সে করল না। তিনি সোজা গ্রামের মোড়লকে আবেদন দিলেন, মায়ের ঘাটি ভালো হতে হতে কেন রক্তঝরনা হয়? এতে নিশ্চয়ই কিছু আছে।
মোড়ল শিক্ষক মহাশয়ের আবেদন শুনে ঠিক করল, তাড়াতাড়ি পাড়ার লোককে ডেকে এবং মাস্টার মহাশয়ের ব্যাপারটার একটা সিদ্ধান্ত নেন। আমরা সবাই মোড়লের নির্দেশ অনুযায়ী সব ব্যাপারটা হ্যাঁ করলাম কারণ তাঁর কথা অমান্য করা মানে সংসারে আগুন ফেঁকা। কাজেই মোড়লের আদেশ অনুযায়ী আমরা সবাই পাড়ার লোক তেল ও খড়ি দেখব। কী কারণে মায়ের যা ভালো হচ্ছে না। সবাই এক হয়ে একটি ওঝার কাছে যাওয়া গেল। তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন আমাদের শিক্ষক মহাশয় এক মুঠো শালপাতা এবং ২৫০ গ্রাম তেল। সেই তেল দিয়ে ওঝাবাবু আমাদের দেবতাকে ধরবে। ওঝাবাবু শালপাতায় তিন ফোঁটা সরিষার তেল নিয়া পানের মতন মুড়ে নিজের গায়ে বুলিয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে রাখলেন। মিনিট পাঁচ পরেই সেই শালপাতায় নানারকম ছবি দেখা গেল। এতে আমাদের কাছে পরিষ্কার ভাবে দেখিয়ে দিলেন, তোমাদের সমস্যাটা পুরোপুরি জানলাম। এটা কোনো পাড়ার যোগতী তেল নয়, এটা একটা মালিকের তেল এবং মালিক পাড়ার সহযোগিতা নিয়েছে। সবাই আমরা হাঁ করি এবং পরিষ্কার ভাবে ওঝাবাবু দেখিয়ে দেন, ঘরের পশ্চিম পাশে একটি আধাবয়স্ক মহিলা আছে। সে বিধবা, সেই মায়ের ওপর অত্যাচার আক্রমণ চালাচ্ছে। পরিষ্কার আমাদের মোড়ল থেকে পাড়ার সবাইকে ওঝাবাবু খুশি করিয়ে দেয় কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না কারণ একে সবার চেয়ে বয়েছে ছোট তাই বলার কোনো সুযোগ নাই। পরে সবাই আমরা ওঝাবাবুর মতামত শুনে তাঁকে দশটাকা দক্ষিণা দিয়া সবাই আমরা ওখান থেকে সরে যাই। কিছু কিছুদূর আসার পর আমাদের মোড়লবাবু একটা আদেশ করেন। কী ব্যাপার, কতটা সত্য আরও অন্য দুই জায়গাতে দেখা যাক। পরে আমরা একটা আলো নিয়ে আসব।
সেদিন সকাল থেকে খাওয়া-দাওয়া নাই সন্ধ্যা পর্যন্ত। আমরা অন্য আরও দুই জায়গাতে দেখলাম। ব্যাপারটি সন্দেহজনক, কিন্তু আমি সন্দেহ করি না। কারণ যদি মহিলাটি ডাইনি হতেন—তাঁর সন্তানের আমার মতো বয়স, এবং সে ছেলে আনার সঙ্গে ঘোরাফেরা করেছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে। সবাই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু উপায় ছিল না। সেদিন আমরা পাড়ার লোক গ্রামে ফিরে আসার পর মোড়লবাবু আর একটি আদেশ করলেন। আমরা যে তিন জায়গাতে ভেল খড়ি করলাম আরল আশপাশে তিনটি গ্রামে দিতে হবে। সবাই আমরা আরও তিনটি গ্রামে তেল খড়ি পৌঁছিয়ে দিলাম এবং সবাইকে এক দুই দিনের মধ্যে Result চাইলাম যথাক্রমে আমরা একই দিনে সব লোকের তেল ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম ঐ পশ্চিম পাশের মহিলাটি ডাইনি বলে, আমাদের তেল খড়িতে বেরিয়েছে। আর কোনো কথা নাই—সবাই গেলাম গুঝাবাবুর কাছে। দিন ঠিক করা হল এবং মোড়লবাবুর আদেশ অনুযায়ী আমরা সবাই সখাবাবুর কাছে খাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু যাবার আগে মোড়লবাবু একটি কথা ঘোষণা করেন যেন আমরা সবাই সখাবাবুর কাছে যাব। যাবার আগে আমি একটা কথা ঘোষণা করছি—“আমাদের মধ্যে কেউ যদি ডাইনি হয়, তাকে জরিমানা হিসেবে ৩০০ টাকা দিতে হবে নইলে পাঁচ বিঘা জমি আমরা দখল করে নেব।” আমার কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তামত! আমার সন্দেহ একান্ত বৃথা। মোড়লের আদেশ অনুযায়ী সকাল ১০টার সময় সখাবাবু মন্দির মুখে জপ করছিল। আমাদের দলবল দেখে সখাবাবু হাসিমুখ করে কিন্তু আমার মুখ শুকনো। আমরা সবাই সখাবাবুর চরণধুলো মাথায় নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষক মহাশর ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল সখাবাবুর হাতে তুলে দিলেন। সখাবাবু নিজের দেবতাকে তাঁর ভাষায় কিছু বলিলেন। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ফলাফল জানালেন। “তোমাদের তেলের ভিতর দোষ আছে। যদি তোমরা তেল পরিষ্কার করতে চাও তাহলে আমার দক্ষিণা হিসেবে ৩,০০০ টাকা আমার মন্দিরে রাখো এবং আমি তোমাদের সব কিছু পরিষ্কার করে দেব। কোনো চিন্তা নাই।” কিছুক্ষণ পরে সখাবাবু “বললেন, “ঘরে একটি বিপদ কিছুদিন আগে হয়েছে কিন্তু তোমরা অনেক কিছু করেছ এতে ঠিক হরনি। যাক ঠিক হয়ে যাবে।” আমরা চাঁদা করে ৩,০০০ টাকা দক্ষিণা হসেবে মন্দিরে রাখলাম এবং সখাবাবুর কথা অনুযায়ী মাকে কিছুদিন চলাফেরা বন্ধ করা হলো। একটা ওষুধ দিলেন, দিনে দুবার লাগানোর জন্য—মা কালীকে স্মরণ করে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই। ভালোভাবে ভুঁড়িটি ভরে দিলেন। আমার করার কিছুই ছিল না। পরে বুঝলাম সব। কিছুদিন পরে বৃদ্ধা ভালো হয়ে যান।
ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনের শরিক এবং ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের অধ্যক্ষ গুরুচরণ মুর্মুর কথায় “সাত্তাড়দের (সাঁওতালদের) পুরাতন বৃদ্ধ কথায়” (সাঁওতালি ভাষায়—‘হড় করেন মারে হাপড়ামক রেয়াওকথা’) আছে কিভাবে একজন জ্ঞানী ‘জানগুরু' তাঁর অদ্ভুত সব ক্ষমতার পরিচয় দিতেন। জানগুরু তাঁর আলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যে বলে দিতে পারতেন রোগীর নাম, রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের নাম। রোগিণী বিবাহিতা হলে তাঁর স্বামীর শ্বশুর-শাশুড়ির নাম পর্যন্ত বলে দিতে পারতেন। অথচ রোগী বা রোগিণী হয় তো দূর গ্রামের বাসিন্দা, বলতে পারতেন, রোগের কারণ অপদেবতা না ডাইনি। অপদেবতা বা ডাইনির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায়ও বলে দিতে পারতেন।
গুরুচরণের কথামতো, “তখনকার জানদের (জানগুরুদের) বিশ্বাস করানোর মতো কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তবে কি ডাইনিও ছিল? উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে কোনো লোকের যদি আলৌকিক ক্ষমতায় ভাল করার শক্তি থাকে তাহলে অলৌকিক ক্ষমতায় ফদ করার শক্তিকে অস্বীকার করা অযৌক্তিক। একজনের অলৌকিক শুভ শক্তিকে স্বীকার করলে অন্য আর একজনের অলৌকিক অশুভ শক্তিকেও স্বীকার করতে হয়। তন্ত্র সাধনার গভীরতায় না গিয়েও বলা যায় ষটকর্মের স্তম্ভন, বিদ্বেষ, উচাটন-মারণের কথাও অনৈতিকহাসিক নয়।”
সুখের সাঁতরা ডাইনি প্রথার বিরোধী। তাঁর ধারণায়, এইসব ডাইনির মতো মধ্যযুগীয় প্রথাগুলো তাঁদের সমাজে আরও বহুদিন প্রচলিত থাকবে। থাকবে না কেন, যে সমাজের তিন ভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে আর অশিক্ষা-কুশিক্ষার মধ্যে বাস করে সেই সমাজ থেকে এই অন্ধ সংস্কারের জগদ্দল পাথরকে ঠেলে সরাবার মতো মহাজন কোথায়?
এই সবই সুখেনের কথা। আবার এই সুখেনই বলেন, “রোগীরই অর্ধেক রোগ সেরে যায়। এই রকম ভাবে কারো পেটে সারা হলে পেট ভুটভাট করলে পাড়ায় পাড়ায় বুড়ো-বুড়িদের নুনপড়া দিতে দেখেছি। অর্থাৎ খানিকটা নুন নিয়ে মন্ত্র পড়ে দেয়, সেটা জল দিয়ে তিন দিন খেতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি পেটে বায়ু জমা রোগীর পক্ষে নুন জল খুব উপকারী। সেইরকম ভাবে শরীরে কোথাও মোচড় লেগে গেলে তেলপড়ার বিধান। অর্থাৎ, মন্ত্রপূত সরষের তেল দিয়ে মালিশ। এক্ষেত্রে ঐ রোগীর সরষের মালিশটাই কাজ করে। আবার শোয়ার দোষে ঘাড়ে ব্যথা লাগলে বোতলে করে গরম জল ভরে ঘাড়ে তাপ দিতে দিতে মন্ত্র পড়তে দেখেছি। ঐ তাপটাই ঘাড়ের ব্যথা উপশমের কাজ করে এখানে।
এমনি আরো বহুরকম রোগের বহুরকম ঝাড়ফুঁক তুকতাকের ব্যাপার আছে যেগুলোর সঙ্গে আবার কোনোরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই মেলে না। যেমন কাউকে সাপে কাটলে আমি গাঁ-গঞ্জের বহু রোজাকে দেখেছি কেবল মন্ত্র ঝাড়ফুঁক করেই তার বিষ নামিয়ে দেয়। সে বিষধর সাপ হলেও। এই তো কিছুদিন আগে আমার মাকে রাত্রিবেলা চন্দুরে বোরা কামড়ে দিল। বিষের জ্বালায় মায়ের শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগল, চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলেন। এইরকম একটি রোগীকে আমাদেরই পাড়ার একটি বউ কী একটা গাছের শিকড় দিয়ে (ওরা নাম বলতে চায় না) হাত চেলে আর ঝাড়ফুঁক দিয়ে মাত্র ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে সারিয়ে তুলল। আমাকে অসংখ্যবার নানা ধরনের সাপে কেটেছে। কিন্তু আমি কখনো হাসপাতালে যাইনি ঐ ঝাড়ফুঁকেতেই ভাল হয়েছি।
আবার সাপে কাটা রোগীকে থালা পড়া, সরা পড়া দিয়েও ভাল করতে দেখেছি। তেমন রোজাও আমাদের গাঁয়ে এখনো আছে। পিতলের থালায় মন্ত্র পড়ে রোগীর পিঠের ওপর ছুড়ে দেয়। সেই থালা চুম্বকের মতো রোগীর পিঠের ওপর টেনে ধরে। যতক্ষণ না বিষ নামে থালা ছাড়তে চায় না। সরা পড়াটা আবার আরো আশ্চর্যের ব্যাপার। রোজা একটা মাটির সরায় মন্ত্র পড়ে দিয়ে রোগীকে ঝাড়ফুঁক করতে থাকে। এবার যতক্ষণ না রোগীর দেহ থেকে বিষ নামবে ততক্ষণ ঐ সরা আছাড় মেরেও কেউ ভাঙতে পারবে না। তবে কোনো সাপে কাটা রোগীকে যদি কোনো ডাইনি ভেড়ে দেয় তাহলে কোনো রোজার বাপের সাধ্যি নেই বিষ নামায়। এইজন্য কাউকে সাপে কাটলে সে কথা রোজার কাছে ছাড়া কারো কাছে প্রকাশ করতে নেই। বলা যায় না কার পেটে কী আছে, যদি ভেড়ে দেয় তখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি। ডাইনিকে তো আর আলাদা করে চেনা যায় না। আমাদের মতোই মানুষ সে। সুতরাং চেনা দায়। আমাদের পাড়াতেও তো এমনি এক ডাইনি বুড়ি আছে। গরুর বাচ্চা হলে এরা বাঁটের দুধ শুকিয়ে দের মন্ত্র দিয়ে। সদ্য প্রসূতি মায়েদের এমন মাখ ভেড়ে দেবে ছেলে আর মাই খাবে না। মাইয়েতে যন্ত্রণা হবে। তখন আবার রোজার কাছে যাও, সে জলপড়া দিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে তবে ভাল করবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা মাদুলিও দিয়ে দেয় পাঁচসিকে আড়াই টাকা দাম মূল্য নিয়ে, যাতে ঐ ডাইনিতে পুনর্বার আর মাই না ভাড়তে পারে। গরুর গলাতে জিওলের বোল বেঁধে দিলেও ডাইনিরা আর ভাড়তে পারে না। আবা কারো গায়ে ঘা-ছি হলেও রক্ষে নেই। অমনি ডাইনিরা পাকা আমের মতে গন্ধ পায়। সঙ্গে সঙ্গে ভেড়ে দেয় তারা। তখন সেই যা আর মোটে সারতে চায় না।
তবে ডাইনিদেরও জব্দ করার রাস্তা আছে। নিজের পায়খানা নিয়ে ওকে খাইয়ে দাও, ব্যস, ডাইনি তার মন্ত্র ভুলে যাবে। এমনি একবার এক ঘটনা ঘটেছিল—এক বউয়ের শাশুড়ি ডাইনি ছিল। তা বউয়ের পায়ে হোঁচট লেগে খানিকটা কেটে গেছিল। অমনি ডাইনি তা থেকে পাকা আমের গন্ধ পেল। সে আর লোভ সামলাতে পারল না। নিজের বউকেই ভেড়ে দিল। তা বউ তো ডাক্তার বদ্যি দেখিয়ে সারা। কত পয়সা খরচ হতে লাগল, কত ওষুধ খেল কিন্তু সেই ঘা আর ভাল হতে চায় না। হবে কী করে, ঘরেতেই যার ডাইনি। বরং দিনে দিনে তার ঘা আরো বাড়তে লাগল। বউ তো মহাচিন্তায় পড়ল। সোয়ামিকে বললে বলে—তোমার জন্যে কি আমি মাকে দূর করে দোব।
চিন্তায় চিন্তায় বউ তো শুকোয়। তখন গাঁয়ের এক তিন মাথা বুড়ি তাকে পরামর্শ দিল। বলে—ওলো বউ, তুই বরং এক কাজ কর, তোর শাউড়িকে ডালের সঙ্গে গু খাইয়ে দে, দেখবি ও ওর ডাইনি মন্ত্র ভুলে যাবে। নিরুপায় বউ তাই করল। ডাইনিও তার মন্ত্র ভুলে গিয়ে দিনে দিনে রুগ্ণ হয়ে একদিন মরে গেল। সেজন্য অবশ্য বউ ডাক ছেড়ে খুব কেঁদেছিল। কারণ শাউড়ী ডাইনি হলেও তার মরণ তো সে চায়নি।”
ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর ‘আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার’ লেখাটিতে এক জায়গায় বলছেন, ‘এটাকে (ডাইনি প্রথাকে) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ।
অর্থাৎ শ্রীবাস্কের ধারণায়—ডাইনির মতো একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। ক্ষতিকারক মানে? ডাইনি বিদ্যার সাহায্যে, ডাইনি ক্ষমতার সাহায্যে মানুষের ক্ষতি করা সম্ভব? অর্থাৎ ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে? শ্রীবাস্কে আরও বলছেন, ‘অনেক আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস, তুর্ক-তাক ও ইন্দ্রজাল (black magic) বিদ্যায় মেয়েরাই পারদর্শী হয়। স্বাভাবিক কারণেই তারা দুর্বল। সমাজে নানা কাজে পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাদের অনেক কিছু স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না। বিশেষ করে ঋতুবতী নারীর সম্পর্কে কিছু কিছু সংস্কার পৃথিবীর সব সমাজেই প্রচলিত আছে। এই অবহেলার জন্য অনেকে ক্রুদ্ধ হয় আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এ বিদ্যা আয়ত্ত করে থাকে।”
নদীয়া জেলার জনৈক জনগুরু বাস্তবিকই কি 'ডাইনি-বিদ্যা'র অস্তিত্ব আছে? ডাইনি-বিদ্যায় অন্যের মধ্যে রোগ সংক্রামিত করা যায়? উচাটণ-মারণ মন্ত্রে যে কোনও প্রাণীর মৃত্যু ঘটানো সম্ভব?
শ্রী বাস্কের প্রগতিশীল সংগ্রামী মন অবশ্য সেইসঙ্গে একথাও বলে, ‘এ সব মেয়েরা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করে এবং তারা মনে করে যে অন্যের ক্ষতি করার স্বাভাবিক ক্ষমতা তাদের আছে। এ ক্ষতি হয়তো কোনো অলৌকিক উপায়ে ঘটে না, কৌশলে কার্যকারণের যোগসাজশেই এ সব হয়তো ঘটিয়ে থাকে।’
শ্রী বাস্কের মনেই সংশয় থেকে গেছে—হয়তো ডাইনিরা অলৌকিক উপায়ে ক্ষতি সাধন করে না। অর্থাৎ ডাইনিরা হয়তো অলৌকিক উপায়েই ক্ষতি সাধন করে। শ্রীবাস্কের মনেই যদি ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে কি নেই—এই বিষয়ে সংশয় থাকে তাহলে সাধারণ সাঁওতাল সমাজের মানুষের ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক।
শ্রীবাস্কে ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে কতকগুলো উপায় উল্লেখ করেছিলেন। তার মধ্যে ডাইনি বিদ্যার অপকারিতা সম্পর্কে নাটক মঞ্চস্থ ও তথ্যচিত্র তোলার কথা ছিল। কিন্তু ডাইনি বিদ্যা বলে বিদ্যাই যেখানে কল্পনা মাত্র, সেখানে ডাইনি বিদ্যার পক্ষে বা বিপক্ষে বলার প্রশ্নই উঠতে পারে না। বাস্তব সত্যকে সাধারণের সামনে তুলে ধরা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং আদিবাসী সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য সহজসরল যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে—ডাইনি বিদ্যা বলে কোনও বিদ্যার অস্তিত্ব নেই। জানগুরু, সখা বা ওঝাদেরও নেই কোনও অলৌকিক ক্ষমতা।
ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যাঁদের কথা এতক্ষণ আলোচনা করলাম, তাঁদের প্রত্যেকের প্রচেষ্টায় ও আন্তরিকতায় আমি শ্রদ্ধাবনত। শুধু এটুকু মনে হয়েছে—তাঁদের আন্তরিকতার সঙ্গে অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে দৃষ্টির স্বচ্ছতা যুক্ত হলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। ডাইনি প্রথা বিরোধী আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে পত্রিকা ও প্রচারপত্র মারফত দাবি জানিয়েছেন সারদাপ্রসাদ কিসকু, সভাপতি, ‘সাঁওতাল সাহিত্য পরিষদ’, মহাদেব হাঁসদা, সম্পাদক, ‘ভেতরে’, মাসিক পত্রিকা কলেন্দ্রনাথ মাণ্ডি, সম্পাদক ‘সিলি’ দ্বিমাসিক পত্রিকা; গুরুদাস মুর্মু, সম্পাদক, ‘খেরওয়াল জারপা’; বালিশ্বর সরেন, সম্পাদক, ‘জিরিহিরি’।
দাবি-পত্রে তাঁরা জানিয়েছিলেন, ... ভণ্ড জানগুরুদের কথায় বিশ্বাস করে কত যে অপরাধ, অন্যায়, অবিচার সংগঠিত হচ্ছে, তা বলে শেষে করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে ডাইনি প্রথা একটা অন্ধ-বিশ্বাস ও কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। এর কোনো বৈজ্ঞানক ভিত্তি তো নাই-ই, পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে কোনো উপকার পাবার প্রশ্নও নেই। এর মূল সমাজের এত ভিতরে প্রবেশ করেছে যে, এক্ষুণি এর অবসান ঘটানো সাধারণের ক্ষমতার অতীত। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দীর্ঘদিন পরেও ভারতের মতো একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের এ ধরনের কু-প্রথার অস্তিত্ব বিস্ময়জনক।
এই কুপ্রথার উচ্ছেদকল্পে সরকার যদি আইন প্রণয়ন করেন,
অন্তত ভণ্ড জানগুরুদের বে-আইনি বলে ঘোষণা করেন,
তাহলেই এই ক্ষতিকারক প্রথার উচ্ছেদ সাধিত হতে
পারে। আমরা এ বিষয়ে রাজ্য সরকার ও
কেন্দ্রীয় সরকারের সহানুভূতি কামনা
করছি এবং আশু ডাইনি প্রথা
বিরোধী আইন প্রণয়নের
জন্য অনুরোধ
জানাচ্ছি।
যুগ যুগ ধরে যে বিশ্বাস আদিবাসীদের শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে রয়েছে তা কয়েকজনের ব্যক্তি প্রচেষ্টায় বা কয়েকট স্বেচছাসেবী সংস্থার চেষ্টায় (সে চেষ্টা যতই আন্তরিক ও ব্যাপক হোক না কেন) নিমেষে যাবার নয়। এ জন্য আরও বেশি করে সমাজসচেতন মানুষ ও সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সরকারি প্রশাসনকে। দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বহুজনের চেষ্টাতেই সম্ভব এই অবস্থা থেকে উত্তরণ। কিন্তু বহুজন কবে এগিয়ে আসবে এ আশায় বসে না থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। আমার কথার কাজ হচ্ছে, কাজ চলছে। বহু আদিবাসীও এ কাজে এগিয়ে এসেছে। এগিয়ে এসেছে কিছু প্রতিষ্ঠান! আমাদের সমিতিও সীমিত ক্ষমতায় আদিবাসীদের অন্ধ সংস্কার থেকে মুক্ত করতে কাজ করছে বিভিন্ন ভাবে। সাড়াও পাচ্ছি বিপুলভাবে আমরা হাজির হচ্ছি একটু নতুন ভাবে। আমাদের সমিতি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামে অনুষ্ঠান করতে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে প্রতিনিয়ত যাচ্ছে, তার মধ্যে আদবাসীপল্লিও পড়ে। যখন যাই তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই স্থানীয় বিশাল অঞ্চল জুড়ে যত জানগুরু, সখা, সৎসখা, দিখলী, ওঝা (সচরাচর সাঁওতাল সমাজ যাদের ‘জানগুরু’ বলে বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায় তারাই এ সব নামে পরিচিত) ও অবতারদের বিষয়ে খবর নিই—তারা কী কী ধরনের অলৌকিক ক্ষমতার (?) অধিকারী। অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ফলে আশপাশের গাঁয়ের মানুষ নানা অলৌকিক ঘটনা দেখার উৎসাহে হাজির হন। স্থানীয় অলৌকিক ক্ষমতাবানদের এতদিন ধরে ঘটানো ঘটনাগুলোই আমাদের সমিতির সভ্যরা অনুষ্ঠানে ঘটিয়ে দেখাচ্ছেন। ঘটনাগুলো দেখবার পর বোঝাচ্ছেন—এগুলো কোনও অলৌকিক ঘটনা নয়, কৌশলে ঘটাচ্ছি। আপনারাও যে কেউ চেষ্টা করলেই করলেই এমনটা ঘটাতে পারবেন, তারপর দর্শকদের দিয়েও ঘটনাগুলো ঘটানো হতে থাকে। উৎসাহী গ্রামবাসীরা হুড়মুড় করে এগিয়ে আসতে থাকেন। এবং অদ্ভুত সব ঘটনা হাতে-কলমে করার কৌতূহলে, আনন্দে, এতদিনের দেখা জানগুরুদের ঘটানো ঘটনাগুলো যে ওঁরাও ঘটাতে পারেন, এই প্রত্যয় বহুর মধ্যে সংক্রামিত হয়। আমরা ঘোষণা করি—আপনারা তো কৌশলগুলো জেনে গেলেন, এবার জানগুরুদের এইসব কৌশল গ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দিন, দেখতে পাবেন ওদের সব জারিজুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো ঘটানোর কৌশলগুলো আপনারা জানতেন না, ওরা জানত। সেই কৌশল দিয়ে এতদিন আপনাদের ঠকিয়ে টাকা-পয়সা রোজগার করেছে, টোটকা ওষুধে অসুখ সারাতে না পারলে নিজের দোষ ঢাকতে আপনাদেরই কারো পরিবারের নিরীহ মেয়েদের ডাইনি বলে ঘোষণা করেছে। ওরা যা করে সব কৌশলেই করে, অলৌকিক ক্ষমতায় নয়।
আরো একটা কাজও আমরা করি। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা প্রকাশ্যে এবং ব্যাপক প্রচার চালিয়েই স্থানীয় অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসেন। চ্যালেঞ্জের জবাবে কেউ হাজির হলে তাঁরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবশ্যই পরাজিত হন। হাজির না হলে গ্রামবাসীদের উপর তাঁদের প্রভাব প্রচণ্ড কমে যায়। ওঝা, জানগুরু, সখাজাতীয় অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের বুজরুকি বন্ধ হলে ডাইনি চিহ্নিত করার কাজও বন্ধ হয়, কারণ এঁরাও ডাইনি চিহ্নিত করেন। অবশ্য এরই পাশাপশি আরো বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার আশু প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতায় কিছু কিছু পর্যায়ে কাজও করছি।
বিভিন্ন জানগুরুর ক্ষমতার কৌশল নিয়ে পরে আলোচনা করব। এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আপাতত কী কী করা যেতে পারে সে প্রসঙ্গেও আসব। কিন্তু তার আগে 'ডাইনি' নিয়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি। সমস্যাটির বিষয়ে মোটামুটি ধারণা না দিয়েই সমাধানের বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়াটা বোধহয় সমীচীন হবে না।
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
ডাইনি
ডাইনি হলো আমাদের ‘হড়হপনে’র (সাঁওতালদের) মস্ত জ্বালা। ডাইনির জন্য লোকে শত্রু হচ্ছে। কুটুম্বদের দুয়ার বন্ধ হচ্ছে। বাপে-ছেলেতে ঝগড়া হচ্ছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ হচ্ছে। ডাইনি না থাকলে আমাদের অনেক সুখ থাকতো। সাহাব লোকেরা সবই ভাল বিচার করেছেন যতদূর জানা যায়; কিন্তু ডাইনি সম্বন্ধে কি করে যে অন্ধ হচ্ছেন, বুঝতেই আমরা পারি না। ডাইনিরা আমাদের খায়। আমরা ধরে একটু হুড়ুম হুড়ুম করলে, উল্টো আরও হাকিমরা হাজতে দিচ্ছেন; মহা জ্বালায় পড়েছি, কি করলে আমাদের ভাল হবে, দিশেহারা হ'য়ে গেছি। হাকিমদের বুঝালেও তাঁরা বিশ্বাস করেন না। বলেন, কৈ দেখি আমার আঙ্গুল খাক, তবে তো বিশ্বাস করব, ডাইনি আছে বলে—তারপর তোমাকে কয়েদ ক'রে বসল। খাপরি ছুটি নিয়ে ত ডাইনিরা খাচ্ছে না, বিদ্যার জোরে পরপারে পাঠিয়ে দেয়। কি আর একেবারে সোজা। আগে মাঝি, পারানি করা দমন করছিলেন, আর ভাল না হলে, পাঁচ জনে মিলে বে-আবরু করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে ছিল, আজকাল হাকিমদেরই বশ করে শেষ করল। সেইজন্য সব পুরুষেই ভয়ে পিছিয়ে গেছে। পুরুষ মানুষের কথা আর চলছে না, এখনকার যুগে মেয়েরাই রাজা হয়ে গেছে। একটু বেশী কিছু বলেছ কি টক ক’রে মুখে পুরেছে, সেই ভয়ে চুপ করে থাকে। ডাইনিরা রাত্রে জমা হয়, কোন বনে কি মাঠে। যাবার সময় ঠুটো ঝাঁটা কি কোন কিছু পুরুষের কাছে রেখে যায়, আর তারা মনে করে, ঘরের মানুষ আমার আছেই, কেবল ধাঁধাঁতে ঐ ঝাঁটাকে নিজের লোকের মত দেখে তা না হ’লে ওরা দেবতার কাছে বিয়ে হবার জন্য চলে গেছে। জানেন, হেঁটে ওরা যায় না, কোনো গাছে চড়ে বিদ্যার জোরে হাওয়ার মত যায়। দেবতাদের আখড়ায় নেমে, দেবতাদের সঙ্গে নাচে, সিংহদের ডাকে। চুল আঁচড়িয়ে দেয়, চুমা খায়, তারপর দেবতাদের কাবু করে দিব্যি দেয়, যেন কোন রকমে খড়ি দেখার সময় না উঠে। এইসব কার মুরগী ডাকের সময় ঘরে ফিরে আসে।
ডাইনিরা অনেক শিষ্য করে। ছোট ছেলেমেয়েদেরও ভুলায় তারা মরে গেলে বীজ যেন থাকে। প্রদীপ নিয়ে রাত্রে ঘুরে লোকের বাড়িতে ঢুকে শিষ্যা করার জন্য মেয়েদের তুলে আর তারা স্বীকার না করলে বলে; না শিখলে তুমি মারা যাবে, তা না হলে সিংহে খাবে। সেইজন্য ওরা ভয়ে তাড়াতাড়ি শিখে। চেলাদের জাগিয়ে ডাইনিরা ঝাঁটা পরে, আর ভাঙা কুলা কাঁখে নিয়ে জাহেরে যায় প্রদীপ নিয়ে। সেখানে মুরগী পূজা করে আর খিচুড়ি পিঠা তৈরি করে খায়। চেলাদের সিংহের চুল আঁচড়ান করায়, আর তারা ভয়ে স্বীকার না করলে বলে, কিছুই করবে না, বোন! ভয় করো না, তারপরে মন্ত্র আর মাড়ানি গান শিখিয়ে দেয়, তারপর দীক্ষা দিবার জন্য বলে যাও বোন, বাবাকে তোমার বড়দাদাকে খাও। স্বীকার না করলে জ্বর হওয়ায়, কিংবা পাগলী করে দেয়। ‘কাটকম চারেচ’ (একরকমের ঘাস) এর দ্বারা কালিজা খুঁটে বার করে, আর সেটা সিদ্ধ করে প্রথমে চেলাদেরই আগে খাওয়ায়। সেইদিন থেকে সমস্ত দয়া-মায়া শেষ হবে; রেগে গেলে ছেলে কি বাবা ভাইদেরও খাবে, আর নিজেদের স্বামীদেরও মারা করে না, খেয়েও ফেলে।
প্রবাদ আছে যে, পুরাকালে দুটি ছোকরার কলিজা ডাইনিরা বার করে নিয়ে গেল, আর হাঁড়ি হাঁড়িয়া চাল, নুন, হলুদ, হাঁড়ি, খলা তাদের বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে গেল জাহের। সেখানে নিয়ে গিয়ে সেই কলিজা সিদ্ধ করে, সেই ছোকরা দুজনকেও বকরা দিল খাবার জন্য। কিন্তু ওরা খেল না, কোঁচড়ে লুকিয়ে রাখল, শুধু হাঁড়িয়াটুকু খেল। দেবতাদের সঙ্গে নেচে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এল। পরদিন সকাল হতেই কলিজা বার করা ছোকরা মূর্ছা গেল। যে সব লোকে দিশেহারা হলো, বলতে লাগল: শেষ হয়ে গেল? ঐ ছোকরাদের মায়া হল। সেইজন্য বলল: যাও অমুক অমুক মেয়েদের ধর তাহলে মানুষটি ভাল হবে। তারপর মাঝির বৌ ইত্যাদি ভাল ভাল লোককে ধরে নিয়ে এল ওদের কথামতো। ওরা এসে স্বীকার করতে চায় না, গালাগালি দিতেই চাইছে আর তাদের স্বামীরাও রাগে গরগর করছে, বলছে: প্রমাণ করে দাও তা না হলে ভাল বলছি না। তখন সেই ছোকরা দুটি তাদের দেওয়া ভাগ পাঁচজনের সামনে খুলে বলল: এই যে, বাবা বামাল। সেটা দেখে ডাইনি আর তাদের স্বামীরা চুপ।
তারপর পারগামাকে নিয়ে এল। সে হুকুম দিল: যাও টাঙ্গি নিয়ে এসো, আনিল। সেই সময় পারগামা ডাইনিদের বলল: যাও ভাল কর, তা না হলে কেটে ফাঁক করবো, তোমরা হলে কাঠ ওহোল মরা। তারপর ভয়ে ভালো করে দিল। ভাল না করে দেওয়ার জন্য বহু জায়গায় কেটে দিয়েছে। মাঝির স্ত্রীকে পারামিকের স্ত্রী ডাইনি থাকলে প্রমাণ করা বড় শক্ত, কেন না তাদের স্বামীরা গড়াতে দেয় না। পূর্বে যেমন, একজন ওঝা মানুষ রেগে গিয়ে মাঝি আর পারামিকদের স্ত্রীদের ডাইনি বলেছিল। মাঝিরা তাকে বলল: এটা তুমি প্রমাণ না করলে তোমার মাথা রাখব না। উত্তর দিল: একদিন চোখে দেখিয়ে দিব। তারপর চুপচাপ হল। ওঝা একদিন সন্ধোবেলা খেয়ে দেয়ে তীর ধনুক নিয়ে জাহেরে চলে গেল। সেখানে একটি গাছে উঠে ওৎ পেতে রইল। সন্ধ্যায় খায়া দাওয়া শেষ হওয়ার পরই যাদের দোষ দিয়েছিল সেই ডাইনি মেয়েরা জাহেরে গেল। গিয়েই একপাক নেচে ঘুরল। তারপর তাদের একজন ‘রুম’ (ঝুঁপার) হল। তারপর সিংহকে ডাকল, লুক্ষু নামে নাম ধরে সিংহকে দুইবার শিস দিয়ে ডাকল, তারপর দুইটিই চলে এল। তারপর চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, চুমু খাচ্ছে, সেই সময় ওৎ পেতে বসা একটি বড় সিংহটিকেই তীর মারল। তখন সিংহ মনে করল যে, এরাই আমাকে কিছু করল বোধ হয়। সেই রাগে এক এক করে এলোপাথাড়ি কামড়িয়ে মেরে ফেলল ডাইনীদের আর অন্য সিংহটিকেও বিঁধে মেরে ফেলল, তারপর ঘরে ফিরে গেল।
পরদিন সকাল হলে দেখল, তাদের নাই; তখন ঘরে ঘরে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করছে যে আমাদের সব কোথায় গেল বলে। তখন ওঝা লোকটি তাদের বলল: জাহেরের দিকেই দেখে এস, ওইদিকেই যেতে দেখেছিলাম। তারপর গেল, দেখে যে, “বিলিয়া বিতিদ” সিংহ দুটি কামড়িয়ে তাদের মেরে ফেলেছে আর তারা পড়ে আছে। তখন চারদিকে গোলমাল হতে ধারে পাশের লোক জমা হয়ে তাদের দেখল। তখন থেকে বিশ্বাস করে আসছি ডাইনির কথা।
পূর্বপুরুষেরা বলতেন যে, মারাং বুরু বেটাছেলেদের ডাইন শিক্ষা দিচ্ছিলেন কিন্তু মেয়েলোকেরা কোরফান্দী ক’রে গুণ (বিদ্যা) আগেই নিয়ে নিল। একদিন যেমন, বেটাছেলেরা জমা হ’ল পরস্পরকে শিক্ষা দিবার জন্য, নিজেদের ঝগড়াটে বৌদের কি করবে বলে। বলিল: আমরা হলাম বেটাছেলে, কী ক’রে আমাদের কথা বলছে না? দুই এক কথা মেয়েলোকদের বললে বিশ বাখান গাল দিতে আরম্ভ করে, এ রকম সহ্য করব না। তারপর ঠিক করল, চল মারাং বুরুর কাছে যাই; তার কাছে গুণ শিক্ষা করে আসি, যেমন করেই হোক এই মেয়েদের যেন কাবু করতে পারি। তারপর দিন ঠিক করল যে, মাঝ রাত্রে কালনা বনে জমা হবে। গেল। মারাং বুরুকে মিনতি জানাল, ডাকল: ও ঠাকুর্দা, একবার আসুন, বহু লোক এসেছি আপনার কাছে নারাজ হয়ে। মারাং বুরু চলে এলেন, জিজ্ঞাসা করলেন: কী দুঃখ তোমাদের আছে নাতি? তারপর তাদের দুঃখ জানাল আর মিনতি করল যেন গুণ (বিদ্যা) শিখিয়ে দেন নিজেদের বৌদের শায়েস্তা করতে।
মারাং বুরু বলিলেন: শিখাতে পারি, কিন্তু এই সমস্ত পাতায় তোমাদের রক্তে লিখলে তবে। সেই সব শুনে বিস্তর ভয় পেয়ে বলিল: কাল কিরে এসে লিখে গুণ নিব। তারপর চলিয়া গেল। কিন্তু তাদের স্ত্রীরা লুকিয়ে এসে আড়াল থেকে সব কথা ঠিক শুনে নিল। তখন তারা বলিল: এই পুরুষদের ধর্ম হচ্ছে এই, আমাদিগকে বিয়ে করার আগে কুকুরের মত গোঁসাই গোঁসাই করে পছনে ঘুরে বেড়িয়েছিল; এখন বুড়ি হয়েছি বলে খারাপ দেখছে, মেরে ফেলতেই চেষ্টা করছে: আচ্ছা দেখে নেব, কে কাকে মারতে পারে। এইসব যুক্তি করে গলি রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলে গেল। রাস্তায় ঠিক করে নিল কী করবে বলে। পুরুষেরাও পরে ঘরে ফিরে এলো। ফিরে আসামাত্র মেয়েরা তাদের স্বামীদের সোহাগের সঙ্গে অভ্যর্থনা করল, তাতে বেটাছেলেরা মনে করল, নিজে নিজেই ভালো হয়েছে, কি জন্যই বা যাব? পরদিন মেয়েরা নিজেদের স্বামীদের ভাল করে ভাত তরকারি করে দিল, আর বেশি করে সন্ধ্যাবেলা হাঁড়িয়া দিল। পুরুষেরা খেয়ে মাতাল হয়ে বেহুস হল, তখন মেয়েরা একত্র হয়ে ধুতি পাগড়ি পরে আর ঠোঁটে ছাগল চুল লাগিয়ে জঙ্গলে মারাং বুরুর কাছে চলল। ডাকিল: ও ঠাকুর্দা, আসুন শীঘ্র তাড়াতাড়ি, আমাদের স্ত্রীরা দিনরাত জ্বালিয়ে মারছে।
মারাং বুরু চলে এলেন। তখন তাকে বলল: দিন আপনার পাতা বার করুন, নিজে নিজের দাগ কাটব (লিখব), আর সহ্য করতে পারি না মেয়েদের অত্যাচার। মারাং বুরু তাঁর শাল পাতা বাহির করিলেন, আর তারা কুঁড়ে রক্ত দিয়ে নিজের নিজের পুরুষের ছবি আঁকিল। তারপর মারাং বুরু মন্ত্র আর চাড়ানি শিখিয়ে দিলেন, সিদ্ধাই দিলেন লোক খাওয়ার জন্য। মুচকি মুচকি হেসে তারা বাড়িতে ফিরে এলো।
পরদিন সকালে পুরুষেরা তাড়াতাড়ি উঠছে না বলে ভীষণ গালাগালি দিয়ে মুখ শুকনো করে দিল। পুরুষেরা আঁধা খুঁদা উঠে চোখ রগড়াতে লাগল, ঘুমও ভেঙে গেল, আর মেয়েরা শান্ত হচ্ছে না তা বুঝতে পারল। তারপর টলমল বৈঠক বসাল। সেখানে ঠিক করল: চলতো যাই। মারাং বুরু বাই বলুক, গুণ নিশ্চয়ই শিখব তারপর রাত্রে জঙ্গলে গেল, আর কাক-শকুনের মত বিস্তর মিনতি মারাং বুরুকে করল: দাও বাবা, নিশ্চয়ই শিখিয়ে দাও, মেয়েরা আমাদের ভয়ানক জ্বালাচ্ছে।
সেইসব শুনে মারাং বুরু আশ্চর্য হয়ে তাদের বলিলেন: গুণতো তোমাদের দিয়ে দিয়েছি, কী চাইছ ঘন ঘন? তখন পুরুষেরা একসঙ্গে বলে উঠল: কৈ কখন দিলেন আমাদের? সেদিন থেকে আমরা তো আসি নাই। সে সব শুনে মারাং বুরু মহা চিন্তায় পড়লেন, বললেন: তোমাদের দিয়েছি না তো কী করেছি? এই যে তোমাদের দাগ দেখতো। পুরুষেরা নিজেদের নিজেদের দাগ দেখে বলল: দাগ যেন আমাদেরই কিন্তু আমরা তো দাগ কাটি নাই, কারা যেন আমাদের দাগ কেটেছে (ছবি এঁকেছে)।
তখন মারাং বুরু গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, তারপর বুঝতে পারলেন যে, মেয়েরা আমাকে শুদ্ধ ছেলেমানুষ করে ফেলল। তারপর রেগে গিয়ে ঐ পুরুষদের বলেন: নাও, এখানে তাড়াতাড়ি দাগ কাট, ঐ বদমাইস মেয়েদের দেখে নিব। দাগ দিল, আর তিনি ওঝা আর ডান হবার সিদ্ধাই দিলেন, যেমন করেই হোক ডাইনিদের ধরে যেন সাজা দিতে পারে। তখন থেষক ডাইনি আর ওঝা কী জানদের ভীষণ শত্রুতা আছে। কিন্তু ওঝা আর জানেরা পারছে না; কেননা ডাইনিরা ওদের দেবতাদের সহজেই কাবু করছে। সেইজন্য সহজে ধরতে পারে না, অন্য লোকই খড়ি মাটিতে (খড়ি গুণা) উঠেছে, আর জানেরা আঁধা হয়ে অন্য লোকদের বলছে (দোষ দিচ্ছে)।
কতক লোক বলে যে, ডাইন, ওঝা আর জান সকলেই কামরু গুরুর কাছে শিখেছে। হ্যাঁ বহু পূর্বে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। ওঝা হওয়ার কথা সত্যই; কেননা ওঝা লোকেরা প্রথমেই তাঁর নাম দেন, তা না হলে ডাইন আর জানের কথা জানি না, কামরু গুরুর কাছে শিখেছে কি না জানি না। দোহায়টুকু তাঁর দোহায় দেয় না, সেইজন্য বলছি, তাঁর কাছে শিখে নাই।
ওঝাকো (ওঝারা)
ওঝারা সত্যি কামরু গুরুর কাছে শিখেছে বহু পূর্বে। তাঁর দেশ আর আমাদের দেশ লাগালাগি ছল, মুরুব্বিরা সেকথা আমাদের বলেছেন। ওঝাদের কাজ হল ছয়টি: (১) খড়ি দেখে, (২) চাল ছড়ায়, (৩) কামড়ায় কিংবা 'লুণ্ডা' করে, (৪) দেবতা খুঁড়ে, (৫) দেবতা ছাড়ায়, (৬) লোককে ওষুধ দেয়। রোগী ঔষধে যদি ভাল না হয়, গ্রামের লোক ওঝাকে দিয়ে খড়ি দেখায়। তেল আর শালপাতা নিয়ে আসে, আর সে বসে দুটি পাতাতে তেল মাখাবে, আর মন্ত্র বলতে বলতে ঘষবে ‘তেল তেল রায়ে তেল, মাম তেল, কুসুম তেল, ই তেল পড় হায়েতে, কি উঠো, ডাম উঠো, ভূত উঠো, ফুগিন উঠো, বিষ উঠো, কে পড়ছে, গুরু পড়ছে, গুরু আগতা মাত্র পড়ছে। এরপর মাটিতে একটু রাখবে। তারপর খুলে দেখবে। লোক ওঝাকে জিজ্ঞাসা করবে: দেন বাবা অনুগ্রহ করুন, কী সব পেলেন? বললে তবে তো আমরা বুঝব। ওঝা খড়ি দেখবারই আগে ঠিক করে রেখেছে যে, এখানে হল জান, এখানে হল ঘরের দেবতা, এখানে হল বাইরের দেবতা, এখানে হল দুঃখ আর এখানে হল বিষ। পাতার যে ঘরের দাগ উঠবে হিজিবিজি, সেইটি বলে দেয়, ডাইন হলে ডাইন, দেবতা হলে দেবতা, দুঃখ হলে দূঃখ, আর বিষ হয়ে বিষই। ডাইন যদি উঠে, মাঝি পারামিক সন্ধ্যাবেলা বলে যায়। শুন অমুক, ভামুকের অসুখ করেছে, ভাল যেন হয়, তোমাকেই ধরেছি, ভাল না হলে তোমাকে বলছি না। তাতে ভাল হলে ভালই। তা না হলে দুইজন করে মাঝি চারদিকে তেল দেখাতে পাঠাবে। সন্ধ্যাবেলা জমা হয় আর তেল দেখাতে যে সব লোক গিয়েছিল তাদের একে একে জিজ্ঞাসা করবে। তিন দিক থেকে ডাইন ঠিক করে আনলে বাছবার জন্য ডাল পুঁতবে, আর যদি মিল না হয়, আরও পুনরায় খড়ি দেখিয়ে আসবে।
ঘরের দেবতা যদি ওঠে তাহলে রোগীকে বলবে: নাও তোমার ঠাকুর সামলাও। তারপর জল দিয়ে মানৎ করবে যে ভাল হলে পূজা করব। বাইরের দেবতা উঠলে ওঝা মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে দেবতাকে চাল ছড়িয়ে দিবে, (নে তবে কালনা বঙ্গা বুল মায়াম সিটকা ময়াম এমাম্ চালাম কামাঞ করিয়াক—ক কাটিক্ মায়, অকোরে আচু লেং মেয়া ডোডে লেং মেরা উনিরেন সিরা হগমণে সঠুক সামবাড় কেম্, তেঁঞে খা—দ নিয়া অড়া: দ ছিকেম হাড়িকেম, ওকাড়েতাম মাম বা থাম সেকজং বেরেৎজং মে।) মাও তরে কাল না বঙ্গা জাং এর রক্ত শিরায় রক্ত দিচ্ছি, ভাল যেন হয়ে যায় যে তোমাকে লাগয়েছিল তার সেরা ছেলেই সাবাড় করুন, আজ থেকে এ বাড়ি ছেড়ে দেন, নিজের খানে চলিয়া যান। মারাং বুরু আর পারগামাকেও চাল ছড়ায়ে ‘বাঁখেড়’ (মিনতি) করবে, এই যে অমুক মাঝির ঘরে 'জঙ্গম বঙ্গা' (যে দেবতা মানুষকে খায়।) জজম বুরু লেগেছিল পড়েছি, ধরে সাবুদ করলাম খুদ চাল তার দিয়ে দিলাম, তারই সাক্ষী সভা করুন, আজ থেকে যেন ভাল হয় রোগী। এইরূপ আলাদা মারাং বুরু আর পারগামাদেরও ওঝা মিনতি করে। শেষে মুড়া চড়া সীমা আইলের দেবতাদের চাল ছড়িয়ে মিনতি করে: এই নিন তবে আপনারা মুড়ার খুঁটির, লাটার লোপাকের সিমার আইলের বড় ছোট ঝুলি কাঁধে, খড়ম হাতে যোগি ইত্যাদি যাদের চলে তাঁরা আসুন, যাঁদের চলে না তাঁরা দূরে থেকে সাক্ষী শোভা করুন। দুঃখ উঠলে ওষুধ বাঁটিয়া খাওয়ায় আর বিষ হলে কামড়ার আর লুণ্ডা করে (ওষুধের গোলা তৈয়ার করে সেটা দিয়ে মালিশ করে)। ওঝারা প্রথমে এক জায়গায় মন্ত্র দ্বারা ঝেড়ে জমা করে, তারপর মুখে কামড় দিয়ে বার করে পাতার খলাতে ফেলবে। কী যেখানে রোগ আছে, গুঁড়ির গোলা তৈরি করে মন্ত্র পড়ে লুণ্ডা করে। লোকটি ভাল হলে ওঝাকে ‘সাকে’ (মানসিকের) ঘুরগি দেয়। সেগুলি বলি দিয়ে খায়, আর গ্রামের দুই একজনকে ভাগ দেয় ৷
ঢাউরা : বিৎ ‘ডাল’ পোঁতা
ঢাউরা বিৎ হচ্ছে এই রকম: ডাইন কি দেবতা। কি দুঃখ খড়িতে উঠলে, সেটা সঠিক করবার জন্য জলাশয়ের পাড়ে ভাল পোঁতে। সাক্ষী হিসেবে একটি ডাল মাঝখানে প্রথমে পোঁতে তারপর ঘরের দেবতার নামে একটি, তারপর ‘মাইহার’ এর (শ্বশুরবাড়ির) দেবতার নামে একটি, তারপর ভায়াদি কুটুমের নামে একটি, ওটার পর মেয়ে, বোনদের নামে একটি, সেটার পর প্রতি ঘরের নামে একটি ডাল পোঁতে। প্রতি ডালে সিন্দরুর দিয়ে যায়। তারপর চাল ছড়িয়ে ‘বাঁখেড়’ করে: প্রণাম তবে সিঞবঙ্গা (সূর্যদেব)। বেড়ার মত চারদিক ঘিরে রেখেছে, চারখুঁট, সারা পৃথিবী ভয়ে রয়েছে তবে এই যে ডালী কালী করছে, দোষেরই দোষ করে, সেইটাই যেন শুকনো হয়ে ঝরে যায়, সাক্ষী রহিলেন আর যদি না হয়, সবুজ হয়ে নতুন পাতা বাহির হবে, সোনার মত সুন্দর থাকবে (বলে ডাল পুঁভবে)।
আরও বলে: যদি দেবতা হয়, এটাই যেন শুকনো মচমচে হয়ে যায়, যদি না হয় সোনার মত সত্যই (খাঁটি থাকবেন) সাক্ষী রইলেন। সেইরূপ প্রত্যেকের নামে প্রতি ভালে ‘বাঁখেড়’ করবে। এইসব করার পর ঘরে চলে যায়। পাঁচ ঘণ্টা পরে ফিরে আসে ডাল দেখবার জন্য। যে নামের ডাল মরেছে, সেটাই ঠিক হবে। ডাইনে যদি ঠিক হল, যত ঘরের মরে যাবে ওরাই ডাইন হবে। তারপর অন্য গ্রামের পুনরায় সেইরূপ ‘সুহি’ (বাছাই) করিবে দুই তিন জায়গায়। তারপর সেই দুঃখ পাওয়া লোকটিকে বলবে: এই যে এইটি তোমাকে ঠিক করে দিলাম, এখন গুরুর কাছে নিয়ে যাচ্ছ, না ভাল হয়ে গেছ? সে উত্তর দিবে: কমছে না, গুরুর কাছ থেকে যাচাই করে নিয়ে আসি। দিন ঠিক করে জানের কাছে চলে গেল।
জানকো (জানদের)
জান হচ্ছে আমাদের ডাইনের হাইকোর্ট। ঐ যে যারা ডাইন হয়, ওদেরই সত্যিই ডাইন বলি। কি জানি সত্যিই পায়, না মিথ্যা আমরা বিশ্বাস করি সত্যিই পায় বলে, কেননা মারাং বুরুর কাছে সিদ্ধি লাভ করেছে। আর পরীক্ষাও করছি, দেবতার শক্তিতেই বলে না ফাঁকিবাজি করে জান হচ্ছে।
কোন লোক ওষুধে ভাল না হলে ওঝার কাছে নিয়ে খাড়ি (গুটি চালা বা খড়ি দেখা) করাই; তারপর গ্রামে গ্রামে ডাল পুঁতি, অতঃপর জ্ঞানের কাছে যাই, গ্রামশুদ্ধ লোকের অসুখ করলে, মাঝি সমস্ত পুরুষ মানুষদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, আর একজনের অসুখ করলে সেই মাঝির কাছে কাঁদবে, তারপর রোগীর তরফের দুই একজন আর গাড়িতে যাকে পাওয়া গেছে তার স্বামী বা ভাই আর গ্রামের পাঁচ ছয়জন সাক্ষী জানের কাছে যাবে। এক সঙ্গেই থাকবে, যেন কেউ লুকিয়ে জানকে কিছু না বলতে পারে। জানের কাছে একবারে যাবে না (সোজাসুজি যাবে না), বাইরে ডেরা বাঁধে। কোথাকার লোক, কি জন্য এসেছে, কার জন্য এসেছে, আর কি অসুখ, সে সবের কথা কাউকে কিছু বলে না। জানের গ্রামের মাঝিকে বলবে: ওগো বাবা, গুরুর কাছে তেল, পূজা করতে দাও। তারপর সে জিজ্ঞাসা করবে: কতজন পূজা করবে (দেখাবে)? বলিল: এতজন অতজন আছি। সেই মাঝি জানের কাছে নিয়ে যাবে। মাঝি তাদিগকে পূজার জিনিস হাজির করাবে, যেমন: একটি সুপারি, একটি ভাউনিচ (পাতার খলা বা বাটি) আতপচাল, তেল সিন্দুর, ধূনা আর বেলপাতা।
তখন জান বলিবে: আচ্ছা এসো তবে পরে এই এই বেলা। তারা ভেরায় ফিরে যাবে। সেখানে গ্রামের কোনো লোক এসে কিছু জিজ্ঞাসা করলে কথা বলবে না, অন্য দেশ আর অন্য গ্রামই বলবে। ধার্য সময়ে জানের কাছে যাবে। জান কখনও তার ঘরেরই দোষ দেয়, আর কখনও ‘জাহেরে’ কি বাইয়ে। তারা চুপচাপ বসে আছে, আর নিজ আতপ চাউল অনেক জায়গায় দেবতার নামে রেখে রেখে যায়, আর বেলপাতা তাতে রেখে যায়; এর পর চাল রাখা জায়গাতে সিন্দুর দিয়ে যাবে তেলে গুলে; আর ধূপের সরার আগুনে ধুনা ফেলে রাখবে, শাঁখ বাজাবে আর পূজার ঘণ্টা বাজাবে আর দেবতাদের পূজা করে তারপর ভর দেয়, ভর দিয়ে বকতে থাকে।
প্রথমে তাদের দেশের নাম বলবে, ওটার পর গ্রাম, তারপর কুলহি (গ্রামের রাস্তা) কোন কোন দিকে আছে, সেই সব বলে: তারপর মাঝি, ওটার পর ফরিয়াদী লোক, ওটার পর তার কাকা, জ্যেঠা, ভাই, ভগিনীদের ছেলেদের, মেয়ে আর ওরা যতজন আর সকলের নাম বলবে।
তারপর জিজ্ঞাসা করবে: কী বাবা এই সমস্ত ঠিক বলেছে কি না? তারপর তারা বলবে: ঠিকই বিশ্বাস করলাম, এবারে ভেঙে বলে দেন। জান উত্তর দেয়: দাও ‘বুন্দা’ (ঠাকুরের টাকা) দাখিল কর; তবে তো বলবো। তারপর একটি করে টাকা দেয়। আর চুক্তি করে গিয়ে থাকলে, যত টাকা চুক্তি করেছে, সেটাও চেয়ে নিবে; সে সব দিলে পরে তবে বলবে ডাইন কি দেবতা, আর তারা কারা। তারপর জান বলবে; এত এত জায়গায় ‘ঠালি ঢাউরা’ করেছ, এটা-ওটা ঠিক করে ছিলে কী না? তাহার জবাব দিবে হেঁ বাবা ঐগুলিই! তখন জান তাদের বলবে: যদি তৃপ্ত না হয়ে থাক তাহলে সাত সখার কাছে (সাত জায়গায়) বুঝে দেখ। সাত সখার আলাদা হলে বুন্দা টাকা ফেরৎ দিয়ে দিব। তারপর ঘরে ফিরে আসবে। বঙ্গা ধরা হলে অসুস্থ লোক বাজী মানত করবে, আর ডাইন ধরা হলে হুড়ুম দুড়ুম করে জরিমানা করে আর বে-আবরু করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। এক জানের কাছে ডাইন হয়েছে, লোক খুশি না হলে অন্য জানের কাছে নিয়ে যায়, পুনরায় প্রমাণ করবে বলে কিন্তু সেটা আজকাল, কিন্তু ডাইনেরা এক জায়গায় দোষী হলে, হাজার জনের কাছে গেলেও সেই কথাই বলে। শুধু দুই একজন ডাইনী গুণে (বিদ্যায়) জানদের কথা গড়বড় করতে পারে মাঝির স্ত্রী ডাইনি ধরা হলে তাড়াতে পারে না; নিজেই উল্টে যে লোকটিকে খাচ্ছে তাকে বলবে: যাও দেখে নাও কোন দিক, সুখ যদি না হচ্ছেত, আমি গ্রাস করেছি; আমি কোথায় যাব?
আজকাল জানেরা ভীষণ ঠকাচ্ছে। পূর্বের মত ধরম জানদের (ধার্মিক জানদের) মত সত্য এদের নাই। পূর্বে জানেরা জান শিক্ষা করে নাই, আপনা হতেই পেয়েছিল। তারা ভার দিচ্ছিল না, রাত্রের বেলা স্বপ্নে পেত কী দিনের বেলা জলে দেখে। দেবতা এসব বলে দেয় যে, অমুক অমুক অমুক আসছে এটা ওটার জন্য, তুমি তাদের এইরকম বলবে। আজকাল সে রকম জান নাই, বেশির ভাগই ফাঁকিবাজি করে সূত্র জিজ্ঞাসা করছে, টাকা খাচ্ছে। সেইজন্য ‘ফুলধারিয়া’ (পূজার ফুল যোগাড় করে জানের পূজা ইত্যাদিতে সাহায্য করে) রেখেছে বেড় কাটাবার জন্য। আর যে জানের ‘ফুলধারিয়া’ নাই তারা দেখে শুনে বলে। আধা নাম বলে দেখে, আর জান করতে আসা লোকদের দিকে তাকায়, ঠিক কিনা আর বেঠিক হলে আরও নাম বলে দেখবে। সেইজন্য আল জানদের মিল খাচ্ছে না। ‘ফুলছারিয়া’ রাখা জান সহজেই বের করে নিতে পারে সেরকম জান ঠিক না বলতে পারলে বলে: বাবা বেড় আছে, ওটা সরান করাও। তারপর ফুলধারিয়ার কাছে যায়। বেড় কাটাবার জন্য কি কি লাগিবে, সেসব জান বলে দিয়েছে। ফুলধারিয়া সেসব পূজা করবে, মুরগি ফড়িং কি ব্যাং কি শেওলা কি সাদা বিড়াল। পূজা করবার আগে জিজ্ঞাসা করে: কার নামে বেড় কাটব? তখন মাঝি পারানিকদের নাম বলে দেয়, ফরিয়াদী লোকের নামও বলে, আরও দুই এক কথা বলে দিয়ে পূজা করবে। তারপর তাদের বলবে: সন্দেহ তোমাদের থাকলে আমাকে পাহারা দিতে পার, জানের কাছে যাব না। কিন্তু নিজের ঘরে যাবেই, আর তার ঘরের লোক আর জানের ঘরের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা হতে পারে, তাহলে অনেক চালাকি হতে পারে।
আদিবাসী সমাজ
সাঁওতাল সমাজের পরম্পরাগত নেতাকে বলা হয় ‘মাঝি’। সামাজিক কোনও কাজকর্ম বা পূজো মাঝির অনুমতি ছাড়া হতে পারে না। বলতে গেলে মাঝি গ্রামের পুরোহিতের চেয়ে কিছু বেশি। বিয়ে দিতে মাঝির অনুমতি নিতে হয়। গ্রামে নতুন বউ এলে বউয়ের বাবা জামাতার গ্রামে মাঝিকে প্রণামী দেন। গ্রামে বর বিয়ে করতে ঢুকলে বরযাত্রীরা বউয়ের গ্রামের মাঝির বাড়িতে আগে যাবেন, সেখানে মাঝিকে সম্মান জানিয়ে তারপর যাবে বিয়ের আসরে। ‘পরবে’ (উৎসবে) নাচ শুরু হবে মাঝির বাড়ি থেকে। শিকার উৎসবে নিহত পশুদের ভাগ দেওয়া হয় মাঝিকে। সমাজের কেউ কোনও সমস্যা নিয়ে হাজির হলে বা সম্পত্তি বণ্টনের জন্য পরামর্শ চাইলে মাঝি প্রয়োজন মনে করলে ‘কুলহি দুরুপ’ ডাকবেন। ‘কুলহি দুরূপ’ হল পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের নিয়ে সভা। এই সভায় সকলেই আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু শেষ কথা বলবেন মাঝি। মাঝিকে সাহায্য করবেন সমাজের পাঁচজন, যাঁদের বলা হয় ‘মোরে হড়’ (মোরে-পাঁচ, হড়-মানুষ)। মাঝির অনুমতি পেলে সমাজের কেউ পুলিশের কাছে যান বা আদালতে যান। গ্রামে কোনও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে সাধারণত মাঝিই থানায় খবর দেন। থানা থেকে কেউ গ্রামে এলে প্রথমে মাঝির সঙ্গেই দেখা করেন।
গ্রাম পত্তনের সময় আদিবাসী সমাজের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা মাঝি সহ আরও কিছু সমাজ নেতা নির্বাচন করেন। পদটি সাধারণত বংশানুক্রমিক হলেও ‘মাঝি’ বড় ধরনের ‘ডাইনির নজর’-এর সন্দেহের কথা জানান। মাঝির নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা ওঝা বা জানগুরুর কাছে হাজির হন; জানগুরু কাউকে ডাইনি বলে ঘোষণা করলে ঘোষিত ডাইনির বিরুদ্ধে শাস্তিদানও মাঝির নির্দেশেই হয়।
জগমাঝি হলেন সমাজের আর এক প্রধান। জগমাঝি দেখেন জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সহ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো সামাজিক বিধানমতই সমাজের মানুষেরা পালন করছেন কিনা। গ্রামের ছেলে মেয়েদের নৈতিক ভ্রষ্টাচার, যৌন-ভ্রষ্টাচার রোধ করা এবং প্রয়োজনে তার বিচারের প্রশ্ন এলে বিচারের দায়িত্ব পালন করেন জগমাঝি।
জগমাঝিকে এসব প্রতিটি কাজে সহকারীরূপে যিনি সাহায্য করেন, তাঁকে বলা হয় পারানিক।
‘নাইকে’ সাঁওতাল সমাজের পুরোহিত। পদটি বংশানুক্রমিক। সাঁওতাল সমাজের বোঙ্গারা (দেবতারা) দুধরনের বলে সমাজের বিশ্বাস। শুভকারী বোঙ্গা ও অশুভকারী বোঙ্গা। শুভকারী বোদ্ধাদের পুজো নাইকের প্রধান কাজ পুজোয় বলি দেওয়া পশুর মাথা নাইকে দেওয়া হয়। শিকার উৎসবে যোগদানের আগে গ্রামবাসীরা বোঙ্গার পুজো দেন এবং নাইকেকে এ জন্য দেওয়া হয় পাঁচটা মোরগ।
কুজম নাইকে হলেন নাইকের সহকারী। অর্থাৎ সহকারী পুরোহিত। কুজম নাইকে অশুভকারী বোঙ্গাদের পুজোর অধিকারী। সমাজের বিশ্বাস অশুভকারী বোঙ্গারা গ্রামে মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। তাই তাদের তুষ্ট করতে পুজো দেন।
সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের পাঁচজনকে নিয়ে ‘মোরে হড়’ তৈরি হয়। ‘মোরে হড়’-এর প্রতিপত্তি সমাজে যথেষ্ট। সামাজিক অপরাধ, বিবাহ-বিচ্ছেদের বিচার করেন মোরে হড়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারে দোষীদের জরিমানা হয়। অভিযোগকারী পান জরিমানার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক মাঝির হাতে তুলে দেওয়া হয়। মাঝি তার থেকে সামান্য রেখে বাকি টাকায় হাঁড়িয়া কিনে সমাজের সকলে এক সঙ্গে পান করেন।
‘গোড়েৎ’-এর কাজ মাঝির ডাকা সভার খবর গ্রামে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া।
সমাজের ধর্মীয় জীবনে জানগুরুর কোনও স্থান নেই। আদিবাসী সমাজে পুজো-পার্বণের ভার কখনই জানগুরুকে দেওয়া হয় না। ওঝা বা জানগুরু অথবা আর যে নামেই পরিচিত হোন না কেন এরা সমাজের মানুষের ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধা আদায় করে। নানা কারণে মানুষ ওঁদের পরামর্শ নিতে হাজির হন। রোগের কারণ ও রোগমুক্তির জন্য, বন্ধ্যা রমণী মা হওয়ার বাসনা নিয়ে, চুরি যাওয়া জিনিসের খোঁজে, গৃহপালিত পশুর অসুখের সমস্যা নিয়ে, সন্তান-সম্ভবার সন্তান যেন ভালভাবে হয় এই প্রার্থনা নিয়ে, ডাইনি ধরেছে সন্দেহ করলে, ডাইনির নজর পড়েছে সন্দেহ করলে অথবা ডাইনিকে খুঁজে বের করার আবেদন নিয়ে সমাজের বিভিন্ন মানুষ উদ্ধার পেতে জানগুরুর শরণাপন্ন হন।
সমাজের বিশ্বাস, জানগুরুরা এক বিশেষ ধরনের বোলার মাধ্যমে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। এইসব বোদ্ধাদের সাহায্যে জানগুরু ডাইনিদের এবং অনিষ্টকারী আত্মাদের প্রভাব নষ্ট করতে সক্ষম। জানগুরুরা বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন বোঙ্গাদের কাজে লাগিয়ে অনিষ্টকারী বোঙ্গা, আত্মা, ডাইনিদের নিয়ন্ত্রণ করেন। দু একটি উদাহরণ বরং দিই। প্রসূতির হিতার্থে ভালুয়াবিজয় বোঙ্গা, উলুমপাইকে বোঙ্গা, জুলুমপাইকে যোঙ্গা, খোস-পাঁচড়ায় গোসাী-এরা বোঙ্গা, পাগল ভাল করতে নাশনচণ্ডী বোঙ্গা, দুরিয়া বারদো বোঙ্গা, গৃহপালিত পশুদের অসুখে জাহের এরা বোঙ্গাও নাগ-নাগিন বোঙ্গাদের তুষ্ট করে কাজে লাগান হয়। জানগুরুদের বোঙ্গাদের মধ্যে কিছু হিন্দু দেব-দেবীও আছেন। যেমন গঙ্গা, কালী, দিবি (দুর্গা)।
আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস, জাদু দুরকমের- হিতকারী ও অনিষ্টকারী। জানগুরুরা হিতকারী জাদু ক্ষমতার অধিকারী এবং ডাইনি বা ডাইনরা অনিষ্টকারী জাদু ক্ষমতার অধিকারী। সমাজ বিশ্বাস করেন একমাত্র জানগুরুরাই ডাইনির মন্ত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা রাখেন। যদি কোনও ডাইনির শক্তির কাছে একজন জানগুরু পরজিত হন অন্য জানগুরু আসবেন। জানগুরুরা সমাজের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ।
ডাইন প্রসঙ্গে বহু জানগুরুর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অনেকের মত—ডাইনি যার উপর নজর দিয়েছে, তার গু ডাইনিকে খাওয়ালে ডাইনির ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেকের মতে ডাইনি যতক্ষণ জীবিত থাকে, ততক্ষণ তাদের ক্ষমতাও কাজ করে।
দ্বিতীয় মতটি সমাজের মানুষদের প্রভাবিত করে বলেই ভীত মানুষগুলো রোগ থেকে নিজে বাঁচতে বা আত্মীয়কে বাঁচাতে জানগুরু যাকে ডাইনি বলে ঘোষণা করে তাকে অতি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করতে সামান্যতম কুণ্ঠিত হয় না। বরং অনেক সময় হত্যাকারীরা মনে করেন, ডাইনি হত্যা করে সমাজের উপকারই করেছেন, ভবিষ্যতে কাউকে ডাইনির নিষ্ঠুরতার বলি হতে হবে না। এ ধরনের ঘটনাও বহু ঘটেছে, ডাইনি হত্যাকরী নিজেই বীরের মত থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন।
সমাজ অবশ্য সাধারণভাবে বিশ্বাস করে, ডাইনি ইচ্ছে করলে তার মন্ত্র ফিরিয়ে নিতে পারে।
ধর্ম
সাঁওতাল সমাজের কাছে সিং বোঙ্গার (সূর্যের) স্থান সবচেয়ে উঁচুতে। সিং বোঙ্গা রোজ পূর্ব দিকে দেখা দেন বলে সমাজের কাছে পূর্ব দিক পবিত্র দিক। পুজো-পাঠ হয় পূর্ব দিকে মুখ করে। নির্দিষ্ট সময় মেনে সিং বোঙ্গার পুজো হয় না। সিং বোঙ্গার করুণা পেতে পাঁচ-সাত-দশ বছরে একবার পুজো দিলেই হলো। পুজোতে সাদা মোরগ অথবা পাঁঠা বলি চড়ান হয়। ‘মারাং বুরু’ (আক্ষরিক অর্থে বড় পাহাড়) বোঙ্গাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মারাং বুরু জাতির ও সমাজের পালনকর্তা। ইনিই আদিম মানব-মানবীকে পালন করেছিলেন, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন হাঁড়িয়া তৈরির পদ্ধতি!
শুরুতে মারাং বুরুর পুজোয় দেওয়া হত হাঁড়িয়া বা বাড়িতে তৈরি মদ। পরবর্তীকালে মুণ্ডাদের প্রভাবে মারাং বুরুর কাছে বলি দেওয়া হতে থাকে। মারাং বুরু কোন কোন খুঁটের (উপগোষ্ঠীর) গৃহদেবতা। বীরহোর, ভূমিজ, হো বা মুণ্ডাদের কাছেও পুজিত হন মারাং বুরু।
‘জাহের-এরা’ জাহের থানের (পবিত্র কুণ্ড্র, যেখানে সমাজের সার্বজনীন দেবতারা অবস্থান করেন) অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অনেকের ধারণা। জাহের-এরাকে মুণ্ডারা জাহের বুড়ি বলেন, ওরাওঁরা জাহের এরাকে বলেন ঝাকড়া বুঢ়িয়া বা সরণা বুঢ়িয়া। ফাগুয়া বা দোলের দিন জাহের এরার বিশেষ পুজো হয়। দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয় যেন গ্রামের ছেলেমেয়েরা সুস্থ থাকে, খারাপ বাতাস রোগ না করে আনে।
‘গোঁসাঞী-এরা’ ঘা-পাঁচড়া ইত্যাদি চর্মরোগের বোঙ্গা। সাদা মোরগ বলি দিয়ে গোঁসাঞী-এরাকে সন্তুষ্ট রাখা হয়।
‘মোরাইকো-তুরুইকো’ (আক্ষরিক অর্থে পাঁচ ছয়) বোঙ্গা একজন বোঙ্গা হিসেবেই পুজো পান। মোরাইকো-তুরুইকো গ্রামের ভাল মন্দের দেখাশোনা করেন; শস্যের ফলন, বৃষ্টি, খরা, মড়ক ইত্যাদির নিয়ন্ত্রক।
সমাজ বিশ্বাস করে ডাইনি ও ডাইনদের উপর ‘পরগনা বোঙ্গা’র নিয়ন্ত্রণ আছে। ডাইনির নজর পড়ে অসুখ-বিসুখ হচ্ছে বলে জানগুরু ঘোষণা করলে ডাইনিদের মন্ত্রকে কাটান দিতে জানগুরুরা পরগনা বোঙ্গার পুজো করেন। গ্রামের প্রান্তে থাকে জাহের থান বা পবিত্র কুঞ্জ। এই পবিত্রকুঞ্জে সমাজের বোঙ্গা বা দেবতারা থাকেন। পাশাপাশি তিনটি শালগাছের তলার তিনটি পাথর মারাং বুরু, জাহের-এরা ও মোরেইতো-তুরুইতো নামে পূজিত হয়। সমাজের বিশ্বাস পাথরগুলো বোঙ্গারাই রেখে গিয়েছেন। দুটি মহুয়া গাছতলা হয় ‘গোঁসাঞী’-এরা ও পরগনার খান।
জাহেন থানে বোঙ্গারা প্রধান প্রধান পরবের বা উৎসবের সময় পুজো পান। প্রধান উৎসবগুলো হলো ফসল তোলার উৎসব 'সোহরাই', ফসল বোনার উৎসব ‘এরোক সিম’ পুষ্প উৎসব ‘বাহা’ ইত্যাদি।
জাহের থানের বোঙ্গারা ছাড়া গ্রামের মাঝে থাকে ‘মাঝি বোঙ্গা’র খান। মাঝি বোঙ্গাকে ‘মাঝি বুড়ি’ বা ‘মাঝি হুড়ম’ নামেও ডাকা হয়। মাঝি থানের অবস্থান গ্রামের মাঝির বাড়ির সামনে। মাঝি বোঙ্গা গ্রামের মাঝির আধ্যাত্মিক উপদেষ্টার কাজ করে।
মাঝি বোঙ্গা গ্রামের ভাল-মন্দ দেখাশোনা করেন। জাহের থানের বোঙ্গাদের পুজো দেবার আগে মাঝি বোঙ্গার পুজো দেওয়া হয়। মাঝি বোঙ্গার পুজো করেন মাঝি স্বয়ং। পুজোয় মাঝি বোঙ্গাকে নিবেদন করা হয় হাঁড়িয়া, বলি দেওয়া হয় দুটি পায়রা|
সমাজের বিশ্বাস মাঝি বোঙ্গা ও পরগনা বোঙ্গার অন্যান্য বোঙ্গাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব আছে।
যদিও জাহের বোঙ্গারা আদিবাসী অনেক জনজাতির কাছে পূজনীয়, কিন্তু এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামের জাহের থানে পূজো দেন না। যদি এক গ্রামের মানুষ স্থায়ীভাবে অন্য গ্রামে বসবাস শুরু করেন, তবে তিনি নতুন গ্রামের জাহের থানে পুজো দেওয়ার অধিকার পান।
এসব ছাড়াও প্রতিটি খুঁটের বা উপগোষ্ঠীর রয়েছে, নিজস্ব দেবতাও৷
সাধারণত এঁদের বলা হয় আগে বোঙ্গা। আগে বোঙ্গার পুজোর প্রসাদ মেয়েদের খাওয়ার বা ছোঁয়ার অধিকার নেই। প্রসাদে মেয়েদের ছোঁয়া লাগলে দ্বিগুণ নৈবেদ্য দিয়ে আগে বোঙ্গার পুজো দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
সমাজের বিশ্বাস আত্মা অমর। দেহত্যাগের পর যতদিন তাঁদের কথা বংশধররা মনে রাখেন ততদিন আত্মা বিপদে-আপদে তাঁদের সাহায্য করে। কেউ দেহত্যাগ করার পর বোঙ্গা হয়ে যান। পারলৌকিক কাজ শেষ হওয়ায় পর আত্মার বোঙ্গা সাঁওতালদের বাড়িতে স্থান পান। আত্মার এই বোঙ্গাকে বলে হপ্রামপো বোঙ্গা। প্রতি পরবে পরিবারের লোক হপ্রামপো বোঙ্গাকে নৈবেদ্য দেয়।
‘দিশম সেন্দ্রা’ বা বার্ষিক শিকার পরবের সময় সাঁওতাল সমাজ জঙ্গল মহাসভা বা লো বীর’ ডাকে। ‘লো বীর’-এর নির্দেশ সমাজের সকলেই মান্য করেন। ‘ডিহরি’ হলেন লো বীর পরবের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। ফাল্গুন মাসে বাহা পরবের পর 'লো সেন্দ্রা' অনুষ্ঠিত হয়। জিহরি শিকার পরবের দিন ঠিক করেন ও কোথায় কোথায় শিকারীরা রাত্রিবাস করবেন, তাও ঠিক করেন। বিভিন্ন হাটে দূত পাঠান ডিহরি। দূতদের হাতে থাকে ‘ধারওয়াক’ (পাতাসমেত শালগাছের ডাল)। হাটের লোকজন ‘ধারওয়াক’ হাতে কোনও লোক দেখলেই বুঝতে পারেন ডিহরির দূত এসেছেন। সমাজের লোকেরা দূতের কাছ থেকে জেনে নেন শিকারি পরবের দিনক্ষণ ও অন্যান্য খুঁটিনাটি।
গ্রামের নাইকে পরবে যাওয়া শিকারীদের কল্যাণ কামনায় পাঁচটা মোরগ উৎসর্গ করে পুজো দেন ডিহরি, শিকার পরবের কয়েকদিন আগে থেকেই সহবাস বন্ধ রাখেন, শয্যা নেন ভূমিতে। শিকার পরবের আগে সন্ধ্যায় পিতলের পাত্রে জলে দুটি শাল-পল্লব রেখে দেন। পরদিন ওই পল্লব-দুটি তাজা থাকলে শুভ লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়, শিকারীরা আসার আগেই ডিহরি তাঁর স্নান সেরে ফেলেন। শিকারীরা হাজির হওয়ার পর ডিহরি বোঙ্গাদের পুজো করেন। বলি দেওয়া মোরগ চালের সঙ্গে রান্না করা হয়। এই খেয়ে ডিহরি তাঁর উপোস ভাঙেন। শিকারীরা বেরিয়ে পড়েন শিকারে।
সারাদিন শিকার করার পর সন্ধ্যায় তাঁরা সমবেত হন। এক এক গ্রামের মানুষ এক এক জায়গায় বসেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকতে যাঁরা ‘লো-বীর’ সভায় যাবে তারা ছাড়া সকলে মিলে নাচ-গান-বাজনা শুরু করবে। এই প্রমোদ আসরকে বলে ‘তোরিয়া’। শিকারের দেবী ‘রঙ্গো রুজি’ বোঙ্গাকে খুশি করতেই তোরিয়ার আয়োজন। নাচ-গানে রাত শেষ হবে। ডিহরি ভোর বেলায় স্নান সেরে পুজো করবেন, বলি চাপাবেন। শুরু হবে শিকার। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় শিকার পরব শেষ হয়। শিকারীরা গ্রামে ফেরেন। শিকারীদের স্ত্রীরা স্বামীদের পা ধুইয়ে স্বাগত জানান।
শিকার পরবের সময় বিবাহিতেরা চুলে ফুল গুঁজতে পারেন না, হাতে পরেন না লোহার বালা। শিকারীরা না ফেরা পর্যন্ত গ্রামে পশু বা মোরগ মারা নিষিদ্ধ।
আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে নারী
সাঁওতালদের বহু লোককথায় পুরুষদের বীরসুলভ সরলতা ও নারীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সমাজের নারীদের সম্মানরক্ষাকে পুরুষরা তাদের বীর-ধর্ম বলে মনে করেন। এগুলো যেমন সত্যি, পাশাপাশি এ-ও সত্যি পুরুষরা মহিলাদের বিশ্বাস করেন না। সমাজ বিশ্বাস করে যন্ত্র বা অলৌকিক ক্ষমতা দখল করার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রণী। নারীদের বোঙ্গার পুজোর অধিকার দিলে ছলাকলায় তাঁরা বোঙ্গাদের হৃদয় জয় করে নেবেন। নারীরা রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী হলে সমাজের ক্ষতিই হবে।
নারীদের রহস্যময় ক্ষমতাকে ভয় পাওয়ার হদিশ পাওয়া যায় লোকগাথাতেই।
অনেক অনেক আগের কথা। সমাজে বাস করতেন এক গুণীন। তাঁর ছিল অলৌকিক সব ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার জোরে অনেক অনেক মৃত আদিবাসীদের নতুন জীবন দিয়েছিলেন। গুণীনের গুণগ্রাহী জুটলো। গুণীন ঠিক করলেন, তাঁদের দীক্ষা দেবেন। গুণীন বুঝেছিলেন তাঁর আয়ু বেশিদিন নয়। ভক্তদের ডেকে বলেছিলেন, তোদেরই তো দীক্ষা দেবো। কিন্তু মনে হচ্ছে, সব কিছু শেখাবার আগেই আমার মৃত্যু হবে। তোদের কয়েকটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন, আমি মারা গেলে আমার মৃতদেহ যেন অবশ্যই দাহ করিস তোরা। চিতা থেকে এক সময় লাফিয়ে উঠবে আগুনের গোলা। আগুনের গোলা দেখে ভয় না পেয়ে তোরা গোলাটাকে গ্রহণ করিস। তাহলেই আমার সমস্ত মন্ত্রশক্তি, অলৌকিক ক্ষমতা তোরা পেয়ে যাবি।
ভক্তদের দীক্ষা দেওয়ার দিন ঠিক হলো। দীক্ষার দিন শুরু যখন ঘর থেকে বেরি হচ্ছেন তখন একটা সাপ কামড়াল গুরুর মাথায়। গুরুকে বাঁচাবার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। গুরুকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে চিতা সাজিয়ে তার উপর শোয়ানো হলো। চিতায় আগুন জ্বলে ওঠার কিছু পর বিশাল শব্দ করে একটা আগুনের গোলা শূন্যে উঠে গেল। ভীত ভক্তরা সেই শব্দে ও গোলার আগুনের তীব্রতায় পালিয়ে গেলেন। কাছের মাঠে কিছু মেয়ে শুকনো কাঠি কুড়োচ্ছিল। আগুনের গোলাটা তাদের কাছে পড়তেই তারা গোবর লেপা ঝুড়ি দিয়ে চাপা দিল। ফলে মেয়েদের মধ্যে সঞ্চারিত হলো গুণীনের অলৌকিক শক্তি ও ক্ষমতার বড় অংশ। পরের যে ছোট আগুনের গোলাটা শূন্যে উঠে মাটিতে এসে পড়েছিল, সেটা সংগ্রহ করেছিলেন ভক্তেরা। ভক্ত পুরুষদের মধ্যেও সংক্রামিত হলো গুরুর শক্তি, তবে তা খুবই কম।
কোন কোন ক্ষেত্রে সাঁওতাল সমাজের মেয়েরা কিছু কিছু হিন্দু দেব-দেবীর পুজো করছেন বটে। (কালী, কৃষ্ণ ইত্যাদি) কিন্তু এগুলো বিরল ব্যতিক্রম। হিন্দু দেব-দেবীদের পূজোর বাইরে কিন্তু সাঁওতাল সমাজ তাঁদের নারীদের বোঙ্গা পুজোর অধিকার স্বীকার করে নেয়নি।
ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কী করা উচিত
লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে সব বছর ভাল ফসল হয়, সমাজে অভাব অনটন কম, সেসব বছর ‘ডাইনি’ হত্যা বা ‘ডাইনি’ বিচারের ঘটনা কম ঘটে। যেসব বছর ফসল ভাল হয় না, গো-মড়ক দেখা দেয়, সেসব বছরগুলিতে ডাইনি নিয়ে অভিযোগ ওঠে বেশি।
জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস সাধারণ মানুষদের এমনি আসেনি। তাঁরা দেখেছেন জানগুরুদের ‘অলৌকিক’ সব কাণ্ডকারখানা। জানগুরুরা আত্মা, ভূতদের নিয়ে আসতে পারেন, কাজে লাগান। ভূতেরা গ্লাস থেকে তাড়ি খায়। কঞ্চি চালান করে, নখদর্পণ, আটার গোলা ভাসিয়ে হাতে ছাই ঘয়ে নাম ফুটিয়ে চুরি যাওয়া জিনিসের হদিশ দিচ্ছেন। যেভাবে এসব ঘটনা জানগুরু ঘটাচ্ছেন, সেগুলোর ব্যাখ্যা সাধারণ বুদ্ধিতে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই ঘটনাগুলোকে অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ থাকছে না। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজের শিক্ষিত স্নাতক, শিক্ষকরাও জানগুরুদের নির্দেশকে অভ্রান্ত মনে করে ডাইনি হত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
ডাইনি হত্যার পিছনে রয়েছে ডাইনিদের এবং জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি সাধারণের অন্ধ বিশ্বাস। অন্ধ বিশ্বাস কিন্তু শিক্ষার সঙ্গেই শুধুমাত্র সম্পর্কিত নয়। যাঁরা মনে করেন আদিবাসী সমাজকে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ সুবিধে দিলেই ডাইনি হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে, তাঁরা প্রকৃত সত্য বিষয়ে বা সমস্যার গভীরতা বিষয়ে ঠিক মত অবহিত নন, এ কথা অবশ্যই বলা চলে। ডাইনি ও জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যাতেই দূর করা সম্ভব বলে যাঁরা মনে করেন তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, কুসংস্কার ও অন্ধ-বিশ্বাসে আচ্ছন্ন শিক্ষিতের সংখ্যাই যে আমাদের দেশের শিক্ষিতদের মধ্যে সংখ্যাগুরু, এ সত্যকে কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, বিজ্ঞান পেশার মানুষ, শিক্ষক, অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী এমনকী স্বীকৃত মার্কসবাদীদের মধ্যে কি আমরা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের সাক্ষাৎ পাই না? বাস্তব সত্যটি এই যুক্তি দিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে বোঝালে শুধুমাত্র শিক্ষার সুযোগ পাওয়া মানুষরাই নন, শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত মানুষরাও সংস্কার মুক্ত হন। এই কথাগুলো কেবলমাত্র কল্পনাপ্রসূত বা ধারণাপ্রসূত নয়, বরং বলতে পারি হাতে-কলমে কাজ করার মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি। মানুষ শৈশব থেকেই বেড়ে উঠছে অলৌকিকের প্রতি আস্থাশীল পরিবারে, সমাজে পরিবেশে। পড়ার বই ও গল্পের বইয়ের মাধ্যমেও অলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাস ও ভুল ধারণাই প্রতিনিয়ত সঞ্চারিত হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে। বিপরীত কোনও যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পাওয়ার ফলে অলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাসগুলোই দিনে দিনে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে। মানুষ যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেলে যে আন্তরিকতার সঙ্গে যুক্তিকেই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন এই সত্যটুকু যুক্তিবাদী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে উপলব্ধি করেছি।
শত শত বছর ধরে ভাববাদী দর্শন যে অন্ধ-বিশ্বাসগুলোকে, আমাদের চিন্তার জগৎকে, প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে চলেছে যুক্তিবাদী দর্শন মুহূর্তের চেষ্টায় কোটি কোটি মানুষকে সেই প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে, এমনটা ভাবা বাতুলতা মাত্র। আমাদের দেশে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। শিক্ষিতদের মধ্যেও অতি প্রয়োজনীয় (লেখাপড়া শিখতে যতটুকু না কিনলেই নয়) বই কেনা ছাড়া বই কেনার অভ্যাস খুবই কম। অন্ন-বস্ত্রের মত বই কেনাকে বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজন বলে মনে করেন না। কিনলেও সাধারণভাবে ‘শেষ পারানির কড়ি’ হিসেবে ধর্মগ্রন্থই সেখানে গুরুত্ব পায়। কুসংস্কার মুক্তির কাজ এক বা কয়েকজন ব্যক্তির কিছু লেখাতেই সমাধান হয়ে যাবে এমন ভাবাটা একান্তই অমূলক। যুক্তিবাদী লেখা-পত্তর কিছু মানুষ বা কিছু সংগঠনকে যুক্তিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চিন্তার স্বচ্ছতা আনতে সাহায্য করতে পারে, দিশা দিতে পারে মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। স্বচ্ছতাপ্রাপ্ত মানুষরা বিভিন্ন গণসংগঠন করে যেদিন অক্ষরজ্ঞানহীন, শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া মানুষদের স্বচ্ছ যুক্তির আলোতে উদ্ভাসিত করতে পারবেন, সেদিনই যুক্তিবাদী আন্দোলনে নতুন মাত্রা নতুন গতি যুক্ত হবে।
শিক্ষিত এবং ডাইনি হত্যা বিরোধী মানুষদের লেখাতেও আমরা কিন্তু বার বার লক্ষ্য করেছি স্বচ্ছতার অভাব। নেতৃত্বের স্বচ্ছতার অভাবই ডাইনি হত্যা বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার পক্ষে প্রবলতর বাধা। শরৎচন্দ্র রায়ের বিখ্যাত বই ‘ওরাওঁ রিলিজিয়ন অ্যাণ্ড কাস্টমস্’-এ শ্রী রায় এ কথাও লিখেছেন, জনগুরু সম্প্রদায়ের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী মানুষগুলো এ সব বিদ্যা শেখে কখনও ভালবেসে, কখনও আয়ের পথ হিসেবে। এরা বুঝতে পারে কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা অতিপ্রাকৃত। এরা অলৌকিক বিদ্যার পাশাপাশি, ভেষজ বিদ্যাও শেখে।
রেভারেণ্ড পি.ও. বক্তি ‘ট্যাৰু কাস্টমস অ্যামাং দি সানতালস’ গ্রন্থে একথাই বলেছেন, মেয়েরা সে ভাল বা মন্দ উদ্দেশ্যেই হোক, অলৌকিক ক্ষমতাগুলোর কাছে পৌঁছাতে চায়। সেটা প্রকাশ্যে পারে না। কারণ পুরুষেরা মত দেয় না। তাই গোপনে ডাইনি বিদ্যার অনুশীলন করে।
অসিতবরণ চৌধুরীর ‘উইচ কিলিং অ্যামাং দি সানতালস্’ বইটি পড়লে কোথাও এমন কথা পাই না যাতে মনে হয় ‘জান’ এবং ‘ডান’ কারোই কোনও অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা বলে কিছু নেই। বরং শ্রীচৌধুরীর কথায় সন্দেহ জাগে এ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস রয়েছে দোদুল্যমান অবস্থায়।
শ্রী চৌধুরীর বিভিন্ন লেখা পড়েও এ বিষয়ে তাঁর মতামত বুঝে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর কথায়, ‘মন্ত্র-তন্ত্রসমন্বিত জানগুরুর কার্যকলাপকে আমরা হিতকারী জাদু বা white magic বলে অভিহিত করতে পারি। অনুরূপভাবে, অনিষ্টকারী যেসব ব্যক্তি মন্ত্র-তন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কার্যকলাপকে অহিতকারী জাদু বা black magic আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। সাঁওতাল সমাজে যারা black magic করছে বা জাদু করছে, তাদের ‘ডান আখ্যা দেওয়া হয়।’
তার মানে? তিনি কি ‘ডান’ সত্যিই আছে কি না’র উত্তরে জানাচ্ছেন ‘ডানরা black magic করছে’? এ তো ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তীর মত ‘ওয়ার্ল্ড উইচ ফেডারেশন’-এর সর্বময়কর্ত্রী বলবেন। অসিতবরণ চৌধুরীর লেখা-পত্তরকে যেখানে আমাদের সমাজের উচ্চকোটির মানুষ ও পত্র-পত্রিকা মূল্যবান বলে মনে করেন, সেখানে তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তিগুলো কী? এ বিষয়ে জানার আগ্রহ যে কোনো যুক্তিবাদী মানুষেরই স্বাভাবিক।
শ্রীচৌধুরী লেখাটিতে ঠিক পরের লাইনটিতেই বলেছেন, ‘এখানে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে সাঁওতাল অধ্যুষিত সব জেলাতেই বহু প্রাণহানি ঘটেছে ‘ডান’ হওয়ার অভিযোগে।’
না। ‘ডান’ প্রথা বন্ধে এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। বরং মনে হয়েছে—যেহেতু তাঁর লেখা-পত্তর ‘ডান’ প্রথা বিরোধী বলে প্রচলিত, তাই এ বিষয়ে তাঁর আরও সতর্কতা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিল।
ডাইনি প্রথার মতো একটা অমানবিক প্রথার অবসান প্রতিটি মানবিকতায় বিশ্বাসী যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী আন্তরিকভাবেই চান। যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী, সাংস্কৃতিক আন্দোনকর্মী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রগতিশীল বিভিন্ন সংস্থা ও মানুষ ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে যাতে আন্দোলনকে সার্থক করে তুলতে পারেন, সে দিকে লক্ষ্য রেখেই সাঁওতাল সমাজ বিষয়ে কিছু আলোচনায় গিয়েছিলাম। আলোচনা অনেকের কাছে নিরস মনে হতেই পারে, কিন্তু যাঁরা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী, তাঁদের আগেই জেনে নেওয়া উচিত, স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত, কাদের জন্য করছি? কী তাদের সমাজ জীবন? কী তাঁদের সমস্যা ইত্যাদি। যাঁদের সামাজিক-অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবন ও সমস্যা বিষয়ে আমরা অন্ধকারে থাকব, তাঁদের সঠিক আলোর সন্ধান দেওয়া দুরূহ।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করার ইচ্ছেতে রাশ টানতে পারলাম না। সম্প্রতি মদনপুর থেকে একটি তরুণ এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তিনি একজন যুক্তিবাদী। যুক্তিবাদ বিষয়ক কিছু লেখা লিখতে আগ্রহী। তাঁর ইচ্ছে ‘যুক্তিবাদীর চোখে স্বামী বিবেকানন্দ’ এই নামে একটি বই লিখবেন। বললেন, এই বিষয়ে নিরঞ্জন ধরের একটি বই পড়েছেন। আর কী কী বই পড়লে লেখার খোরাক পাবেন, এই বিষয়ে আমার মতামত চাইলেন। বলেছিলাম “আপনার উচিত সবার আগে স্বামী বিবেকানন্দকে জানা। তাঁর লেখা-পত্তর ও কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। তারপর আপনার যুক্তিতে স্বামীজির লেখাপত্তর বা কাজ কর্মের যেগুলোকে যুক্তিহীন বা যুক্তিবিরোধী মনে হবে, সেই বিষয়ে আপনি আপনার যুক্তি দিয়ে পাঠকদের বোঝাতে চেষ্টা করুন, কেন আপনার চোখে স্বামী বিবেকানন্দের ওই সব কাজকর্ম যুক্তিবিরোধী।” তরুণটি বললেন, বিবেকানন্দ রচনাবলি তাঁর পড়া আছে। বললাম, “তাতে কোনও কিছু যুক্তিবিরোধী মনে হয়েছে কী?”
তরুণটি বললেন, —না, তেমন কিছু চোখে পড়েনি। বিবেকানন্দ রচনাবলী থেকেই কিছু কিছু কথা বলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এসব বিবেকানন্দেরই কথা, আপনি কি মনে করেন, এগুলোর পিছনে যুক্তি আছে? তরুণটি বললেন, “বিবেকানন্দ এ ধরনের কোনও কথা বলেছেন বলে তো কোনও বইতে পাইনি।” একটা ডায়রির পৃষ্ঠা খুলে কলম বাগিয়ে বললেন, “ঠিক লাইনগুলো কী একটু বলুন না? অথবা বইটার নাম? পৃষ্ঠা সংখ্যা?”
বলেছিলাম, ‘বিবেকানন্দ রচনাবলী’ থেকেই কথাগুলো বললাম। আপনি রচনাবলী ভালমতো পড়লে কথাগুলো অপরিচিত মনে হত না। বাস্তবিকই যুক্তিবাদী মানসিকতা নিয়ে লিখতে চাইলে যে বিষয়ের বিরোধিতা করতে চান, সেই বিষয়টিকে আগে ভালমতো জানার চেষ্টা করুন। তার দোষ-ত্রুটি, দুর্বলতা, যুক্তিহীনতাকে খুঁজে বের করুন, তবে তো ভাল লেখা হবে। আপনি যদি লেখার শর্ট-কার্ট কিছু রাস্তার খোঁজে আমার কাছে এসে থাকেন তো বলব সে বিষয়ে সাহায্য করতে আমি অক্ষম।”
এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ৮১-র জানুয়ারি। একটি বিজ্ঞান ক্লাবের অলৌকিক বিরোধী শিক্ষণ শিবির পরিচালনা করতে গিয়েছি। এই উপলক্ষে দু-দিনের একটি বিজ্ঞান মেলারও আয়োজন করা হয়েছে। বড়-সড় মেলা। আশেপাশে কয়েকটি জেলা থেকেও এসেছে অনেক বিজ্ঞান ক্লাব। ব্যবস্থাপক বিজ্ঞান ক্লাবের সম্পাদক এক তরুণ শিক্ষক। আমাকে সম্পাদক জানিয়েছিলেন, শিক্ষণ শিবিরে আমি যেন আত্মা, জাতিস্মর, প্ল্যানচেট, সম্মোহন, ভূতে ভর, ঈশ্বরে ভর এইসব বিষয়ের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি। জ্যোতিষ নিয়ে আলোচনার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে ক্লাবের সভ্যদের জ্ঞান যথেষ্ট গভীর। মনে আছে আমি একটু মজা করতেই বলেছিলাম, “জ্যোতিষ শাস্ত্রের পক্ষে বক্তব্য রাখি, আমাকে আপনারা হারাতে পারবেন তো?” সম্পাদক দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘অবশ্যই’।
মাঠের তিন পাশ ঘিরে রঙিন কাপড় দিয়ে তৈরি এক একটি ঘরে এক একটি বিষয় নিয়ে মডেল ও ছবির সাহায্যে বিজ্ঞান বোঝাবার প্রদর্শনী চলছিল। প্রথম দিন বিকেলেই জ্যোতিষ বিষয়ক প্রদর্শনী কক্ষে যুক্তির আক্রমণ চালালেন দুই জ্যোতিষী। একজন স্থানীয় এবং একজন নৈহাটির জ্যোতিষ। ওই কক্ষে টাঙান দুটি চার্ট দেখিয়ে জ্যোতিষী দুজন ক্ষোভ প্রকাশ করে জানালেন, এই পোস্টার দুটিতে দেওয়া তথ্যগুলো ভুল। এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রকে মিথ্যা প্রমাণ করতেই মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ক্লাবের অনেকেই বিতর্কে অংশ নিলেন, অংশ নিলেন সম্পাদক স্বয়ং। শেষ পর্যন্ত সম্পাদকই আমাকে ওখানে ডেকে নিয়ে গেলেন। জ্যোতিষী দুজনের অভিযোগের উত্তরে বিনীতভাবেই স্বীকার করে নিলান, পোস্টার দুটিতেই ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। একই জন্ম সময় নিয়ে বিভিন্ন জ্যোতিষী বিভিন্ন ধরনের গ্রহ অবস্থান দেখিয়ে ছক করেছেন এটা অবিশ্বাস্য। বরং এই ছক তিনটি দেখলে সন্দেহ জাগে, জ্যোতিষ শাস্ত্রকে এবং জ্যোতিষীদের হাসির খোরাক করতে গিয়ে নিজেরাই মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নিয়েছেন। দ্বিতীয় পোস্টারটিতে কয়েকটি গ্রহরত্ন বিষয়ে তথ্যগত ভুল ছিল। সম্পাদক জানালেন, তাঁরা এই তথ্যগুলো একটি বিজ্ঞান পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। শর্টকার্ট-এ বাজিমাত যে করা যায় না, অন্তত নেতৃত্ব দিতে গেলে প্রতি-আক্রমণের মুখে সামাল দিতে, যাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হানব, তাদের বিষয়ে যথেষ্ট স্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন। এর কোনও ব্যতিক্রম সম্ভব নয়। নতুবা তেমন আঘাতের মুখে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
আবার আমাদের মূল আলোচনায় ফেরা যাক। আদিবাসীদের বা সাঁওতালদের মধ্যে যাঁরা খ্রিস্টান বা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন তাঁরাও কিন্তু ডাইনি বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে পারেননি। কারণ, সমাজের আশেপাশের মানুষদের ডাইনির প্রতি বিশ্বাস তাঁদের চিন্তা ও বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল। এও দেখেছি সাঁওতাল গ্রামের আশেপাশের শহরের বা গ্রামের ব্রাহ্মণরা পর্যন্ত জানগুরুদের কাছে দৌড়োন নানা বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশায়।
ডাইনি ও জানগুরুর অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি যে বিশ্বাস বংশপরম্পরায় সমাজজীবনে চলে আসছে, তারই পরিণতিতে ঘটে চলেছে ডাইনি হত্যার মতো বীভৎস প্রথা।
এ সমস্যা সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা। এর জন্য শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। অন্ধ-বিশ্বাসী মানুষগুলোকে বোঝাতে হবে ‘ডান’ বা ‘জান’ কারও কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। এসব বোঝাতে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে জানগুরুদের তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য ফাঁস। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেকেই উদ্যোগ নিয়ে ডাইনি বিরোধী নাটক লিখছেন।
যদি এমন নাটক আদিবাসী সমাজের কাছে হাজির করা হয়
যাতে সেই এলাকার জানগুরুদের ঘটানো তথাকথিত
অলৌকিক ঘটনার কৌশলগুলো বুঝিয়ে দেওয়া
হবে, তবে সে নাটকই হবে জানগুরুদের
প্রতি সবচেয়ে বড় আঘাত। জানগুরুদের
প্রতি ছুড়ে দেওয়া এই চ্যালেঞ্জ
তাদের অস্তিত্বকেই
বিপন্ন করে তুলবে
জানগুরুরা বুজরুক, জানগুরুদের কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই, যুক্তি দিয়ে এই বিশ্বাস মানুষের ভিতর যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবে ডাইনি হত্যা বন্ধের ক্ষেত্রে অনেকটাই এখনো যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বলা সোজা, কিন্তু করা কঠিন, কারণ জানগুরুদের কৌশলগুলো জানব কেমন করে? উৎসাহী আন্দোলনের সাথীদের উদ্দেশে বিনীতভাবে জানাচ্ছি, আমার সঙ্গে আমাদের সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে কৌশলগুলো অবশ্যই তাঁদের হাতে কলমে বুঝিয়ে দেব। ডাইনির ভর, ডাইনির নজরলাগা মানুষগুলোর ‘আতা-পাতা’ সহ্য করতে না পারার কারণ বিষয়েও নাটকে ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আদিবাসী সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব যাঁদের উপর তাঁদের নিয়ে শিক্ষণ শিবির করে শেখাতে হবে ভূতে ভর, জিনের ভর, ডাইনির নজর লাগা, জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য। ছাত্র-ছাত্রীদের এই বাস্তব সত্যকে জানালে কার্যকর হবে। এই বিষয়ে আমি ও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি সমস্ত রকমের সাহায্য ও সহযোগিতা করতে তৈরি আছি।
ডাইনি প্রথা রোধে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার যদি আন্তরিক
ও নির্ভীক হয় তবে এই বিষয়ে নিশ্চয়ই কার্যকর ভূমিকা
নেবে এবং আমাদেরও সহযোগিতা গ্রহণ করবে।
সরকারের যদি এই ধারণা হয় আদিবাসী
সমাজের এই অন্ধ-বিশ্বাসের (যেগুলো
ওঁদের ধর্মের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার
হয়ে রয়েছে) উপর আঘাত হানলে
আদিবাসী সমাজ ক্ষেপে উঠবে
তাহলে স্পষ্টভাবে জানাই,
এ ধারণা আদৌ
সত্য নয়।
সাঁওতাল সমাজের অনেকেই আজ এই প্রথা থেকে সমাজকে মুক্ত করতে আন্তরিকভাবেই আগ্রহী। সরকার তাঁদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে অবশ্যই ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি যুক্ত হবে। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, জানগুরুদের অর্থের লোভ বা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে অনেক ব্যক্তি রা রাজনীতিক তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ডাইনি-বিশ্বাসকে কাজে লাগাচ্ছেন। এই স্বার্থভোগীরা যে ডাইনি প্রথা বিরোধী আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে সচেষ্ট হবে এই কথা স্পষ্টভাবে মাথায় রেখেই সরকারকে এগুতে হবে।
ডাইনি হত্যা বন্ধে সব
পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিত
তথ্যচিত্র ও স্লাইড দেখিয়ে আদিবাসী সমাজের মানুষ ও পশুদের নানা রোগ ও তার প্রতিকারের উপায় বিষয়ে বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে খরা, অজন্মার পিছনে কারণগুলি কোনও সময়েই অতিপ্রাকৃতিক নয়। বোঝাতে হবে অপুষ্টি থেকে হওয়া শিশু রোগ ও বিভিন্ন ‘ভর' বিষয়ে। দেখাতে হবে জানগুরুদের অলৌকিক কার্যকলাপের গোপন রহস্য। এ সবের মধ্য দিয়ে মানুষের বিজ্ঞান চেতনা বাড়াতে হবে।
শিক্ষার, বয়স্ক শিক্ষার, নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের পরিকল্পনা নিতে হবে। এই বিষয়ে সরকারকে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে।
জানগুরুদের ব্যবসার বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টার পাশাপাশি প্রয়োজনে পুলিশ ও প্রসাশনকে জানগুরুদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জানগুরু কাউকে ডাইনি বলে ঘোষণা করলে জানগুরুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা না দিয়েই ঝাড়ফুঁক, মন্তর-তন্তরে রোগ সারে না, অতএব তোমরা ওঝা, গুনিন, জানগুরুদের কাছে যেও না বললে কিছুতেই কাজ হতে পারে না। “কেরোসিনের কম আলোয় কাজ করলে বা পড়লে চোখের ক্ষতি হয়” এ উপদেশ তখনই দেওয়া সাজে যখন কেরোসিনের বিকল্পে প্রায় সমমূল্যে বিদ্যুৎ সেইসব মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
রোগ সারাতে ঝাড়-ফুঁকের বিকল্প হিসেবে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা (অবশ্যই বিনামূল্যে) না দিয়েই ঝাড়-ফুঁকের বিরুদ্ধে যতই ক্তব্য রাখি, তা কার্যকর হবে না।
একই সঙ্গে এ-ও সত্যি—স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে দিলেই আদিবাসী মানুষরা তাঁদের এতদিনের গড়ে ওঠা বিশ্বাস বর্জন করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৌড়াবেন না। সহযোগী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে যে খবর পেয়েছি এবং প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যতটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তাতে এটুকু বলতে পারি, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধে যেখানে দেওয়া হচ্ছে সেখানকার আদিবাসী মানুষেরা ধীরে ধীরে সেসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতেও শুরু করেছেন। আদিবাসী সমাজের উন্নতির জন্য পরিকল্পনা মাফিক সমস্ত কাজ-কর্ম একযোগে শুরু করলে আদিবাসী সমাজের মানুষদের কাছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো আরও বেশি বেশি করে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে থাকবে।
পানীয় জলের প্রচণ্ড অভাব এবং তার দরুন জলবাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণের শিকার হন এইসব বঞ্চিত মানুষজন। এ বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রশাসনকে নিতে হবে।
বহির্জগতের সঙ্গে আদিবাসীদের মেলামেশা, যোগাযোগ যাতে বাড়ে, সে বিষয়েও দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারি তত্ত্বাবধানে আদিবাসীদের জমির মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে।
জ্ঞানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
রেভারেণ্ড পি ও বডিং-এর লেখা থেকে ব্রিটিশ আমলের সাঁওতাল পরগনার এক সহকারী কমিশনারের কথা জানতে পরি, যিনি অদ্ভুত কৌশলে অনেক ঘোষিত ডাইনির জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ঘটনাটা ঘটাতেন অনেকটা সীতার অগ্নি পরীক্ষার ধাঁচে। সহকারী কমিশনার সাহেব ব্যাটারি চালিত বিদ্যুৎ সৃষ্টির একটি জাদু-দণ্ড তৈরি করিয়েছিলেন। কাউকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছে খবর পেলেই জাদু-দণ্ডটি নিয়ে সেই গ্রামে হাজির হতেন। যে জানগুরু বা জানগুরুরা ডাইনি ঘোষণা করেছে তাদের হাজির করতেন আদিবাসীদের সামনে। আনা হতো ঘোষিত ডাইনিতেও। সাহেব এবার জনসমক্ষে জানাতেন এই আশ্চর্য দণ্ড কোনও মিথ্যাচারী স্পর্শ করলে তার শরীরে আকাশের বস্ত্র এসে আঘাত করবে। মৃত্যু না হলেও অনুভব করবে মৃত্যুযন্ত্রণা। সত্যভাষীদের এই দণ্ড স্পর্শে কোনও বিপদ ঘটবে না। তারপর সাহেব জানগুরুদের দিয়ে ঘোষণা করাতেন কে ডাইনি। ঘোষণার পর জানগুরুরা দণ্ড ছুঁতেন। সাহেব দণ্ডে প্রবাহিত করতেন বিদ্যুৎ। জানগুরুরা বিদ্যুৎ তরঙ্গের আঘাতের আকস্মিকতায়, তড়িদাহত বিষয়ে অজ্ঞতায় ভীত, আতঙ্কিত হয়ে আর্তনাদ করে উঠতেন। এবার ঘোষিত ডাইনিকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, “তুমি কি ডাইনি?” মেয়েটি জানাতেন, “না”। এবার মেয়েটিকেও দণ্ডটি স্পর্শ করতে হতো। সাহেব এবার দণ্ডে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করতেন না। আদিবাসী সমাজ এমন একটা অসাধারণ প্রমাণ পেয়ে বিশ্বাস করে নিতেন, মেয়েটি নির্দোষ। জানগুরুরা মেয়েটির প্রতি কোনও আক্রোশ মেটাতে ডাইনি বলে ঘোষণা করেছিল।
সাহেব নাকি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই কৌশল প্রয়োগ করে ঘোষিত ডাইনিদের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এবারের ঘটনাস্থল নদীয়া জেলার বেথুয়াডহরি। সময় ’৮৯-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। গিয়েছিলাম বেথুয়াডহরি বিজ্ঞান পরিষদ আয়োজিত একটি বিজ্ঞান মেলায় বিজ্ঞান শিক্ষণ শিবির পরিচালনা করতে। খবর পেলাম বেথুয়াডহরির উপকণ্ঠে এক সাঁওতাল পল্লিতে এক রমণীকে ‘ডাইনি’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই নিয়ে গ্রামে যথেষ্ট উত্তেজনা রয়েছে। বিজ্ঞান পরিষদের সক্রিয় তরুণের সংখ্যা প্রচুর। তাঁরা ওই গ্রামের কয়েকজন মাতব্বরকে হাজির করলেন আমার কাছে। ওঁদের কাছে আমার পরিচয় দিয়েছিলেন কলকাতার বড় গুনিন হিসেবে। কথা বলে জানলাম, গত ছয় মাস ওদের পল্লির সাত জন মারা গেছেন। ডাইনিই নাকি ওদের খেয়েছে। এক জানগুরুর কাছে ওঁরা গিয়েছিলেন গাঁয়ের মাঝিকে নিয়ে। জানগুরুকে তেল-সিঁদুর দিতে শালপাতায় তেল ছিটিয়ে, ধুনো জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে মন্ত্র পড়ে শেষে শালপাতা দেখে জানিয়েছেন মৃত্যুর কারণ ডাইনি। যাঁর বউকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছিল তিনিও এসেছিলেন। ওঁদের বললাম, “আমি কাল দুপুরে যাব, তোমাদের গায়ের সকলকে হাজির থাকতে বোলো।”
পরের দিন গেলাম। সঙ্গী বিজ্ঞান পরিষদের বহু তরুণ, আমার পুত্র পিনাকী ও স্ত্রী সীমা। আমরা ঘুরে ঘুরে ওদের ছোট্ট গ্রাম দেখছিলাম। পরিচ্ছন্ন গ্রাম। গ্রামের মানুষ ভিড় করে এলেন। একটা খাটিয়া পেতে দিলেন পরম যত্নে। বসলাম। ওঁদের সঙ্গে গল্প করলম। ওঁদের গান গাইতে অনুরোধ করলাম। গান শুনলাম, মাদলের তালে তালে। এবার শুরু করলাম যে জন্য আসা, সে কাজের প্রস্তুতি। একটা মাটির পাত্র দিতে বললাম। পাত্র এলো। পাত্রের উপর স্তূপ করলাম আখের শুকনো ছিবড়ে। একটা ছোট্ট বাটিতে করে জল দিতে বললাম, জল এলো। এবার একটা আতা পাতা ছিঁড়ে বিড়বিড় করতে করতে গ্রামের চারপাশটা ঘুরলাম, আর মাঝে মাঝে আতা পাতায় জল তুলে মাটিতে ছেটাতে লাগলাম। ঘোরা শেষ হতে এসে বসলাম মাটির সরার কাছে। পাশে রাখলাম জলের বাটিটা। জানালাম সত্যের অগ্নি-পরীক্ষা নেব। কিছুক্ষণ ‘অং-বং’ মন্ত্র পড়ে বললাম, “এ গ্রামের যে কজন গত ছ-মাসে মারা গেছেন, তাঁদের একজনকে যদি ‘ডাইনি’তে খেয়ে থাকে তবে মন্ত্রশক্তিতে এই মাটির পাত্রে আগুন জ্বলে উঠবে।”
বাটির জল নিয়ে আখের শুকনো ছিবড়ের উপর ফেললাম, আগুন জ্বলল না। গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে সামান্যতম উত্তেজনা লক্ষ করলাম না। বুঝলাম, আগুন না জ্বলাটাই স্বাভাবিক ঘটনা বলে ওরা ধরে নিয়েছে।
এবার বললাম, “গত ছ-মাসে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের কাউকেই যদি ডাইনি না খেয়ে থাকে, ঠিকমতো ওষুধ না খাওয়ায় মারা গিয়ে থাকে, তবে জল ঢাললেও আগুন জ্বলবে।”
আতা পাতায় জল তুলে ছিবড়েতে ঢালতেই আগুন জ্বলে উঠল। এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখে বাচ্চা-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা সকলেই উত্তেজনায় শোরগোল তুললেন।
শেষপর্যন্ত কিন্তু ওই পল্লির সাঁওতালরা বিশ্বাস করেছিলেন, জানগুরুর ক্ষমতা নেই। জানগুরুর জড়িবুটিতে তাই রোগ সারেনি। ব্যর্থতা ঢাকতে একটা নিরীহ মানুষকে ডাইনি বলেছিল।
জানি, যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে সে দিন একজন ঘোষিত ডাইনিকে বাঁচিয়েছিলাম, সেরকমভাবে একজনকে শুধু বাঁচানো যেতে পারে মাত্র, এর দ্বারা আদিবাসী সমাজ থেকে ‘ডাইনি’ ও ‘জানগুরু’দের অলৌকিক অশুভ ও শুভ ক্ষমতা বিষয়ে গড়ে ওটা অন্ধ বিশ্বাস দূর হবে না।
আদিবাসীদের মধ্য থেকে কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার, এ বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি। তবু একটি হত্যা রোধ করতে তাৎক্ষণিক আর কোনও উপায় আমার জানা ছিল না।
যেভাবে আগুন জ্বালিয়েছিলাম, তার মধ্যে যে কোনও অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার ছিল না, এটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিজ্ঞান পরিষদের ছেলেদের সাহায্যে দুটি জিনিস সংগ্রহ করেছিলাম—পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও গ্লিসারিন। সবার দৃষ্টির আড়ালে আখের ছোবড়ায় ফেলে দিয়েছিলাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। গ্রাম ঘোরার সময় বাটির পুরো জলটাই ছিটিয়ে বা ফেলে শেষ করে দিয়েছিলাম। হাতের কৌশলে, সবার নজর এড়িয়ে বাটিয়ে ঢেলে দিয়েছিলাম গ্লিসারিন।
প্রথম দফায় গ্লিসারিন ঢেলেছিলাম ছিবড়ের সেই জায়গাগুলোতে, যেখানে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট নেই। দ্বিতীয় দফায় গ্লিসারিন ঢেলেছিলাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের গুঁড়োর উপর। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট গ্লিসারিনের সংস্পর্শে এসে তাকে অক্সিডাইজ করেছে। অক্সিজেনের ফিজিক্যাল পরিবর্তনের ফলে ওই রাসায়নিক উত্তাপ বেড়ে গিয়ে এক সময় আগুন জ্বলে উঠেছে।
যেখানে গ্রামবাসীরা ঘোষিত ডাইনিকে গ্রাম ছাড়া করেছে অথবা ‘এখুনি’ হত্যা করবেন না মনে হচ্ছে, সেখানে গ্রামবাসীদের অন্যভাবে সত্যকে বোঝানো যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে একটা ঘটনা তুলে দিচ্ছি। এবারের ঘটনাস্থল মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি ব্লকের চাঁদপাড়ার সাঁওতাল পল্লি। সালটা ১৯৫৮। ঈশ্বর সোরেন বছর কুড়ির এক তরুণ, কিছু দিন ধরে কাশতে কাশতে রক্ত বের করে ফেলছিল মুখ থেকে। শরীরও শীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। এমনটা কেন হচ্ছে? ঈশ্বরের বাবা ছোট সোরেন জানগুরুর জড়িবুটি খাওয়াচ্ছিল কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। জানগুরু শেষে জানাল ঈশ্বরকে ডান খাচ্ছে। ডান কে তাও জানাল। ঈশ্বরের বিমাতা চুরকীই ঈশ্বরকে খাচ্ছে।
চুরকীকে ডইনি ঘোষণা করায় প্রাণ বাঁচাতে চুরকী বাপের বাড়ি পালিয়ে যায়। বাপের বাড়ি কাছেই পশুই গ্রামে। মণিগ্রাম বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে ঈশ্বর লেখাপড়া শিখতে আসতেন। শিক্ষক কমলারঞ্জন প্রামাণিকের সন্দেহ হল ঈশ্বরের টি বি রোগ হয়েছে। কমলারঞ্জন গ্রামের মানুষদের বোঝালেন ঈশ্বরের এক ধরনের অসুখ হয়েছে। এই অসুখে এমনিভাবেই মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। চুরকী যে ঈশ্বরকে খাচ্ছে, এ কথা কেউ প্রমাণ করতে পারবে? গ্রামের অনেকেই যদিও প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করে জানিয়েছিলেন তাঁরা দেখেছেন চুরকী ডাইনি। কিন্তু কী দেখেছেন, যাতে ডাইনি বলে জানতে পেরেছেন-কমলারঞ্জনের এই প্রশ্নে অনেকে অস্বস্তিতে পড়েছেন। শেষপর্যন্ত কমলারঞ্জন ঈশ্বর ও ছোট সোরেনের সমর্থন পেয়ে অন্যদের রাজি করাতে সমর্থ হয়েছিলেন। বহরমপুর সদর হাসপাতালে বুকের ছবি তুলে চিকিৎসক জানালেন টি বি। চিকিৎসক কমলারঞ্জনের কাছে পূর্ব-সমস্যার কথা শুনে ঈশ্বরকে বোঝালেন, কেন এই রোগ হয়েছে, কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে। চিকিৎসা শুরু হলো। পরবর্তীকালে কমলারঞ্জন ঈশ্বরকে হাজির করলেন গ্রামের মানুষদের সামনে। ঈশ্বর জানালেন চিকিৎসকের মতামত। মানুষগুলো কিন্তু যুক্তি মেনে নিলেন। মেনে নিলেন চুরকী ডাইনি নয়। ছোট সোরেন চুরকীর গ্রামবাসীদের ৬০ টাকা জরিমানা দিয়ে চুরকীকে ফিরিয়ে আনেন। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চুরকীর এখন ভরা সংসার।
গুনিন কালীচরণ মুর্মু
কালীচরণ মুর্মু জগমাঝি। এই নামেই পরিচিত গুনিন কালীচরণ। ‘জগমাঝি’ কালীচরণের উপাধি নয়। ‘জগমাঝি’ সাঁওতাল সমাজের নৈতিকতার রক্ষক ও সমাজের অন্যতম প্রধান। গুনিনের অভ্রান্ত গণনার কথা শুনে প্রতিদিন অনেকেই আসেন। কেউ আসেন হরানো গরু, চুরি যাওয়া জিনিস-পত্তরের খোঁজে, কেউ বা আসেন নিখোঁজ আপনজনের হদিশ জানতে। গুনিলের টানে আসা মানুষজন সাধারণত নদীয়া ও তার আশেপাশের জেলার মানুষ। ট্রেনে এলে নামতে হয় মদনপুর-এ। ছোট স্টেশন। টেশনের বাইরে মিলবে রিকশা ভ্যান। ভ্যানে পনেরো মিনিটের পথ জঙ্গল গ্রামের মোড়। সেখানে নেমে জিজ্ঞেস করলেই লোকে দেখিয়ে দেবে কালীচরণের বাড়ি। মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি। কালীচরণের বয়স ষাটের ধারে কাছে। বয়সের ঠাওর মেলবে না শরীরে। কাজ করতেন কল্যাণীর স্পিনিং মিলে। অবসর নেওয়ার পর পুরো সময়ের গুনিন। ওর তুক-তাক, ঝাড়ফুঁক, গোনার ক্ষমতায় বিশটা গাঁয়ের লোকের তরাস লাগে।
তরাসের হাওয়া লাগেনি সম্ভবত মদনপুরের কিছু এঁচোড় পাকা দামাল ছেলে-মেয়ের। এদের জাতপাতের বালাই নেই, ঈশ্বর-আল্লা না মেনেও এরা বুক ঠুকে বলে, আমরা সাচ্চা-ধার্মিক। এমনি দুটি ছেলে ভানু হোর রায় আর রেজাউল হক গিয়েছিল গুনিনকে কিঞ্চিং বাজিয়ে দেখতে। এখন ১৯৯০ সালের অক্টোবরের শেষ। আশপাশের গাঁ-শহরের রাজনীতির বাবু মশাইরা কদিন আগেও বড়ই ব্যস্ত ছিলেন দুর্গোপুজো, কালীপুজো নিয়ে। কালীঠাকুরকে জলে ডুবিয়েই বাবুদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে ধর্ম-উন্মাদনার হাত থেকে দেশ উদ্ধারে। জঙ্গলগ্রাম অবশ্য এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। ‘রাম-বাবরি’ র বিষের হলকা নানা বাঁক ঘুরে এখানে পৌঁছবার আগেই ঝিমিয়ে পড়েছে।
গুনিন কালীচরণ গুনে গেঁথে রেজাউল আর ভানুর আসার উদ্দেশ্য বের করে ফেলেছিলেন। বললেন, “তোমরা এসেছ কেন, জানি। তোমাদের গ্রামে একটা গণ্ডগোল বেধেছে ভাই...”
“উঁহু, সে জন্যে তো আসিনি। আর আমাদের গ্রামে গণ্ডগোলও কিছু বাধেনি।”
গুনিন ওদের এমন বেখাপ্পা কথায় চটলেন,
বললেন, “আমার ক্ষমতার সন্দো? তোমাদের ভালো হবে না। আমি যদি তোমার চারপাশে গণ্ডি কেটে দিই, সে গণ্ডি আমি না কাটান দিলে পেরোতে পারবে? পিঁড়িতে বসিয়ে মন্ত্র পড়ে দিলে পিঁড়ি পাছায় এমন সেঁটে যাবে, তখন বুঝবে সন্দো করার মজাটা।”
চির, রেজাউল, কালীচরণ, মুর্মু ও ভানু ভানুও ঝপাং করে তেতে গেল। বলল, “বেশ তো, গণ্ডি কেটে আমাকে বন্দি করুন তো! আজই করে দেখাতে পারলে পাঁচশ টাকা দেব। আর যদি কয়েকটা দিন পরে দেখান—পঞ্চাশ হাজার দেব।”
“তোমাদের দেখছি বড় চ্যাটাং-ট্যাটাং কথা, বড় টাকার গরম। পুঁইচচ্চড়ি চিবোন চেহারা আর মুখে পঞ্চাশ হাজারের গপ্পো। বোঙ্গা খেপলে ও সব বুকনি ঠাণ্ডা মেরে যাবে।”
রেজাউল সামাল দিল, ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র নাম শুনেছেন, আমরা সেই সমিতিরই ছেলে। যারা আপনার মতো ক্ষমতার দাবি করে, তাদের দাবি সত্যি কি মিথ্যে, পরীক্ষা করি আমরা। কী সব যুগ পড়েছে, ‘ঠগ বাছতে গাঁ-উজাড়’। পরীক্ষা না করে কারো দাবি মানা কি উচিত? আপনিই বলুন না?’
কালীচরণ জুলজুল করে রেজাউলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সুর নামিয়ে বললেন, “আসল কথা কী জানো, গণ্ডি দিতে অনেক হ্যাপা। অনেক জিনিস-পত্তর জোগাড় করতে হয়। এই বয়সে তোমাদের জন্যে এতো হ্যাপা তুলতে পারব না।”
ভানু, রেজাউল অত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। ভানুর নাছোড়বান্দা আবদার, “তাহলে মন্ত্রে পিঁড়ি সাঁটাটা অন্তত দেখান। এত নাম-ডাক আপনার, শুনেছি বোঙ্গার কৃপায় আপনি তুকতাক, রোগ চালান, ঝাড়-ফুঁকে অনেক অসম্ভব সম্ভব করেন। আমাদের ওই পিঁড়ির ব্যাপারটা দেখাতেই হবে।”
কালীচরণ নরম হলেন। বললেন, “ঠিক আছে, কাল সকালে এসো।”
সকালে দুজনের বদলে সমিতির আটজন হাজির হল কালীচরণের আস্তানায়—তবে নানা দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা ভাবে। তারপর কী ঘটেছিল, শোনা যাক মদনপুর শাখার সম্পাদক চিত্তরঞ্জন পালের কাছ থেকেই।
‘আমার সঙ্গী ছিল অসীম। সাহসী, বেপরোয়া অসীম আমারই মতো তরুণ এবং সমিতির পুরো সময়ের কর্মী। মুখে যতদূর সম্ভব চিন্তার ভাব ফুটিয়ে কালীচরণকে বললাম, বড় একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি, আপনাকে সমাধান করে দিতেই হবে।’
জগমাঝি কালীচরণ আমাদের অপেক্ষা করতে বলে উঠে গিয়ে নিয়ে এল দশ-বারোটা সবুজ কাঁঠাল পাতা। হাঁক পাড়তেই একটি ছোট্ট মেয়ে একটা তেলের শিশি দিয়ে গেল, সঙ্গে কিছু কাঠি। জগমাঝি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছিল আর একটা করে কাঁঠাল পাতা তুলে নিয়ে তাতে দু-ফোঁটা তেল ছিটিয়ে পাতাটা ভাঁজ করে একটা করে কাঠি গুঁজে দিচ্ছিল এ-ফোঁড়, ও-ফোঁড় করে।
আমাকে নিয়ে এই মুহূর্তে আমাদের সমিতির আট জন সদস্য এখানে আছি। ভানু রেজাউলও এসেছে। সম্ভবত তথাকথিত কোনও অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়ে ভানু, রেজাউলকে অবাক করে দিয়ে সিঁড়ি আটকানোর চ্যালেঞ্জটা এড়াতে চায় বলেই ভানুরা আমার আগে আসা সত্ত্বেও আমার সমস্যা নিয়ে গুনতে শুরু করল কালীচরণ।
ছটা পাতায় তেল দিয়ে ভাঁজ করে কাঠি গুঁজে রেখে শুরু করল নানা অঙ্গভঙ্গি করে বেজায় রকম মন্ত্র পড়া। এক সময় একটা পাতা তুলে নিয়ে কাঠি খুলে ফেলে পাতাটার ভাঁজ খুলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সেদিকে। একটু পরে বলল, “তুমি যার জন্যে এসেছ সে মেয়ে।”
বললাম, “না, সে তো মেয়ে নয়।”
জগমাঝি এবার আর একটা পাতা তুলে নিল। পাতা খুলে তেল পড়া দেখে বলল, “যার জন্য এসেছো সে একটা বাচ্চা ছেলে।”
বললাম, “না, সে তো বাচ্চা ছেলে নয়।”
জগমাঝি এবার তৃতীয় পাতা তুলে নিল, “তার পেটে ব্যথা হয়।”
বললাম, “ব্যথাটা পেটে তো নয়, বুকে।”
জগমাঝি ওই তৃতীয় পাতাটার দিকেই আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “বুকের ব্যথাটা এই পেটের জন্যেই। ডাক্তার দেখাচ্ছ। ওষুধ খাওয়াচ্ছে, তাও ভালো হচ্ছে না। ওষুধে ভালো হবে না। খারাপ হাওয়া লেগেছে। ঝাড়তে হবে। রোগীকে নিয়ে এসো, ঝেড়ে দেব।”
বললাম, “রোগীর এত বয়স হয়েছে, রোগে ভুগেও কাহিল, নিয়ে আসাটাই সমস্যা।”
আবার পাতার দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে একটু পরেই আমাকে বলল, “হ্যাঁ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বুড়ো, খুব বুড়ো। ও তোমার কে হয়?”
বললাম, “ঠাকুরদা”।
“হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। এখন খুব কষ্ট পাচ্ছে। বুক চেপে ধরে রয়েছে। বাড়ি ফিরে ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস কোরো, ঠিক এই সময় বুকে ব্যথা উঠেছিল কি না, তাইতেই আমার ক্ষমতা বুঝতে পারবে।” ভানু ও রেজাউলের দিকে চেয়ে বলল, “তোমরাও যাও না কেনে ওর সঙ্গে। গেলেই বুঝতে পারবে আমি জগমাঝি ঠগ কি শুনি।”
জগমাঝি কি ঠগ? সে উত্তর আমাদের পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরদা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে তুললাম না, জগমাঝি মিথ্যাচারিতা ধরতে আমি যে অভিনয়ের আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেটা উপস্থিত-বিশ্বাসী ভক্তরা কীভাবে নেবে-এই ভেবে। ওর মিথ্যাচারিতার মুখোশ অন্য ভাবে খোলাটাই এক্ষেত্রে শ্রেয়। আর সেই শ্রেয় পথটিই অবলম্বন করলো ভানু। ভানু বলল, “আজ কিন্তু আমাদের দুজনকে আসতে বলেছিলেন। আপনি আমাদের দুজনের যে কোনও এক জনকে পিঁড়িতে বসিয়ে মন্ত্র পড়ে সিঁড়ি পেছনে আটকে দেবেন বলেছিলেন। এখন দিন। আপনি পারলে গুনে শুনে পাঁচশো টাকা দিয়ে যাব।”
হাসল জগমাঝি, “কেউ টাকার লোভ দেখালেই কি ক্ষমতা দেখাতে হবে। আমি বা আমার বোলা কি তোমাদের জন-খাটার মানুষ যে, তোমরা বললেই দেখাব?”
অক্ষমতা এড়াবার কু-যুক্তিটা ভালোই রপ্ত করেছে জগমাঝি ওরফে ঠগমাঝি।
প্রসন্ন হসিতে মুখ ভরিয়ে জগমাঝি উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে বলল, “পরীক্ষা নেওয়ারও নিয়ম-কানুন থাকে। এই যে ছেলেটির ঠাকুরদার বুকে ব্যথার কথা শুনে বলে দিলাম, সত্যিই কি মিথ্যে খোঁজ নিয়ে এসে না ক্যানে হারানো জিনিসের খোঁজ চাইতে, গুনে বলে দিতাম।”
কথাটা শেষ করতেই ভানু বললো, “আমার একটা কলম হারিয়েছে, দামী কলম, মনে হয় চুরি করেছে আমারই কোনও বন্ধু। গুনে বের করে দিলে প্রণামী দেব”।
আবার কাঁঠাল পাতা এল, তেল ছিটিয়ে আগের মতোই মন্ত্র পড়ে পাতা খুলে তেল পড়া দেখে জামাঝি বললো, “হুঁ চিনের কলম।”
ভানু বলল, “না, জাপানের।”
“ওই হলো। আচ্ছা, তুমি কি পেনটা নিয়ে বাজারে বা দোকানে গিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, তা গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়ছে দোকানে কলমটা দিয়ে লিখেছি, পকেটে পুরেছি কি না, মনে পড়ছে না।”
জগমাঝি আর একটা পাতার তেলপড়া দেখে বলল, “ওই দোকানের মালিকের কাছেই আছে।”
“পেনটা ফেরত যাতে পাই, তার ব্যবস্থা করে দিন।”
“কলমটা কার আছে, বলে দিয়েছি। দোকানদারকে চাপ দিলে ফেরত পেতে পারো। কিন্তু সে যদি ফেরত না দেয়, অস্বীকার করে, তা আমি কী করবো? প্রণামী তিনটে টাকা আর তেল পড়ার জন্য যা খুশি দিয়ে যাও।” এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমিও প্রণামী তিনটে টাকা আর তেল পড়ার জন্য যা খুশি নামিয়ে রাখো।”
বললাম, “ঠিক উত্তর দিলে নিশ্চয়ই প্রণামী দিতাম। কিন্তু প্রথম থেকেই তো দেখছি, আপনি সব উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছেন। না আমারটা বলতে পেরেছেন, না বলতে পেরেছেন ওঁর কলমের ব্যাপারে কিছু।”
জগমাঝি কালীচরণ বোধহয় নিজের বর্তমান অবস্থা ও আমাদের উপস্থিতির মধ্যে কোনও পরিকল্পনার সম্ভাবনা অনুমান করে হঠাৎ কেমন চুপ মেরে গেলেন। তার চোখ দুটোতে একবারের জন্যেও জ্বলে উঠল না চুয়াড় বিদ্রোহের আগুন, বরং চোখ দুটোর আমানির ছলছল নেশা।
আমার ঠাকুরদার বুকে ব্যথার মতোই কলম হারানোর ব্যাপারটাও ছিল পুরোপুরি কাল্পনিক।
