অলৌকিক নয়, লৌকিক (দ্বিতীয় খণ্ড)/অধ্যায় তিন
তিন
যে ভূতুড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
ভূত আনলেন বিজয়া ঘোষ
এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় আর কোনও দিন পড়িনি। দর্শকদের একাংশ আমাদের সমিতির আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাকেই এমন তীব্র আক্রমণ চালাবে, এটা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। আমাদের বারাসত শাখার ছেলেদের যথেষ্ট লড়াকু বলেই জানি। কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের যথেষ্ট বিভ্রান্ত বলে মনে হল। বারাসত শাখার সম্পাদক শুভাশিস ইন্দু কয়েকজন সঙ্গীসহ দ্রুত পায়ে মঞ্চে উঠে এলেন। পরিস্থিতিকে সামাল দিতে মাইকের মাউথপিস নিজের হাতে তুলে নিলেন। মেঘের মতো ভারী গলায় বলে চললেন, “আপনারা এত উত্তেজিত হবেন না। যাঁরা যুক্তিবাদী সমিতির অনুষ্ঠানে এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমরা নিশ্চয়ই ন্যূনতম যুক্তিবাদী মানসিকতা প্রত্যাশা করতে পারি। আপনারা দেখলেন, আপনারা শুনলেন একটু আগে বিজয়া দেবী প্রবীরবাবুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, তিনি প্ল্যানচেট করে আত্মা এনে সবার সামনে প্রমাণ করবেন প্ল্যানচেট, দেহাতীত আত্মা ও ভূতের বাস্তব অস্তিত্ব আছে। বিজয়া দেবীর এই চ্যালেঞ্জের উত্তরে প্রবীরবাবু এখুনি আপনাদের সামনে স্পষ্টতই ঘোষণা করেছেন, তাঁর একটা চ্যালেঞ্জ আছে, পৃথিবীর যে কেউ অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারলে প্রবীরবাবু তাঁকে দেবেন ৫০ হাজার টাকা এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্র সহ প্রতিটি শাখা ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু কেউ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাইলে তাঁকে কয়েকটি পূর্বশর্ত পালন করতে হবে। শর্ত এক : চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীকে ৫ হাজার টাকা ভারতীয় বিজ্ঞান যুক্তিবাদী সমিতির কাছে অথবা প্রবীর ঘোষের কাছে জামানত হিসেবে দিতে হবে। শর্ত দুই : চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীকে অবশ্যই জানাতে হবে তিনি ঠিক কী ঘটনা অলৌকিক উপায়ে ঘটাতে চাইছেন। অতএব এখন চ্যালেঞ্জের বিষয়টা পুরোপুরি নির্ভর করছে বিজয়া দেবীর ওপর। তিনি জামানত হিসেবে ৫ হাজার টাকা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির বারাসাত শাখাতেও জমা দিতে পারেন। টাকা জমা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে আমরা এই বিধান সিনেমা হলেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার ব্যবস্থা করব।”
শুভাশিসের কথা অসাধারণ গোলমাল ভেদ করে সাধারণের মধ্যে কতখানি পৌঁছেছিল সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছিল। আর কথাগুলো কানে ঢুকলেও সেগুলো মেনে নিতে যে গোলমালের নায়করা রাজি নন, তা তাদের ঘুসি পাকিয়ে হাত ছোড়া, স্টেজের দিকে ধেয়ে আসা এবং আমাকে ও আমার পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে কিঞ্চিৎ গালি-বর্ষণের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ওঁদের দাবি আমাকে এখুনি এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে।
এই ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জের তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করতে যাওয়া নিঃসন্দেহে ঝুঁকির। অলৌকিক যে সব ঘটনা বিভিন্ন তথাকথিত অবতাররা ঘটিয়ে দেখান, সে গুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায় : ১। কৌশলের সাহায্যে। ২। শরীর বৃত্তির সাহায্যে।
বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি। একজন অবতার বা ধর্মগুরু যখন নাড়ির গতি স্তব্ধ করেও বেঁচে থাকেন, জীবন্ত সমাধিতে থেকে প্রমাণ করতে চান যোগবলে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে শূন্যে ভেসে থাকেন, মন্ত্রশক্তিতে যজ্ঞের আগুন জ্বালানো, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি করেন, মনের কথা পড়ে ফেলেন, তখন সেগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি করেন স্রেফ কৌশলের সাহায্যে। আবার একজন রোগী যখন কোনও ধর্মগুরুর পা ধোয়া জল খেয়ে বা তাবিজ-কবজ নিয়ে অথবা জল-পড়া তেল-পড়া খেয়ে রোগ মুক্ত হল, তখন কিন্তু সেগুলোর মধ্যে থাকে না কৌশলের সামান্যতম ছোঁয়া। এইসব ধর্মগুরু, অবতার বা ওঝারা রোগমুক্তির ক্ষেত্রে কোনও ম্যাজিক কৌশলের সাহায্য নেন না। শুধুমাত্র বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই যে কত রকম রোগ সারানো যায় সে বিষয়ে ভালোমতো জানা না থাকলে, মনে হতেই পারে অলৌকিক ক্ষমতাই রোগমুক্তির কারণ। রোগ সৃষ্টি বা নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বহু রোগের উৎপত্তি ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেকে। মানসিক কারণে যে সব অসুখ হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, মাথার ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, স্পন্ডালাইটিস, স্পন্ডালেসিস, অরথ্রাইটিস, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, পেটের আলসার, কাশি, ব্রোঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, ব্লাডপ্রেসার, অবসাদ, ক্লান্তি ইত্যাদি। যখন এইসব রোগ মানসিক কারণে হয়, তখন রোগীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে মূল্যহীন ঔষধ, ক্যাপসুল ইনজেক্শন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করেই বহুক্ষেত্রে রোগীদের রোগ মুক্ত করা সম্ভব হয়। এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে প্ল্যাসিবো (Placebo) চিকিৎসা পদ্ধতি। উপরে বর্ণিত রোগে পীড়িত কেউ যদি পরম বিশ্বাসে কোনও ধর্মগুরু বা তান্ত্রিকজাতীয় কারও কাছে আরোগ্যের প্রার্থনা জানিয়ে পরম আশ্বাস লাভ করেন, “যা, তুই ভালো হয়ে যাবি” জাতীয় কথার মাধ্যমে, তবে অনেক সময় দেখা যায় রোগী রোগমুক্তও হয়ে যাচ্ছেন—এই একই কারণে জল-পড়া তেল-পড়া, তাবিজ কবজেও অনেক সময় দেখা যায় রোগ সারছে। এই জাতীয় রোগমুক্তির পিছনে কখনওই কোনো অলৌকিক ক্ষমতা কাজ করে না, কাজ করে ধর্মগুরু, তান্ত্রিক বা ওঝাদের প্রতি রোগীদের অন্ধ বিশ্বাস। প্রথম খণ্ডে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি।
আবার মস্তিষ্ক কোষের বিশেষ গঠন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বা হিস্টিরিয়া রোগীর বিভিন্ন ধরনের অন্ধ-বিশ্বাস, কুসংস্কার ও সংবেদনশীলতার জন্য এমন অনেক কিছু ঘটিয়ে দেন, যেগুলোকে সাধারণ মানুষ শারীরবৃত্তি বিষয়ে অজ্ঞতার দরুন ভূতে ভর বা ঈশ্বরে ভর বলে ধরে নেন, ফলে বহু ক্ষেত্রেই হিস্টিরিয়া রোগীরা পূজিত হয় বা নিন্দিত হয় ঈশ্বরের বা ভূতের প্রতিভূ হিসেবে। সাধারণভাবে অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বা প্রগতির আলো থেকে বঞ্চিত সমাজের মানুষদের মধ্যেই এই ধরনের হিস্টিরিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। সাধারণভাবে এই শ্রেণির মানুষদের মস্তিষ্ককোষের স্থিতিস্থাপকতা বা সহনশীলতা কম। যুক্তি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করার ক্ষমতা অতি সীমিত। বহুজনের বিশ্বাসকে মেনে নিতে অভ্যস্ত। মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতা যাদের কম তারা এক নাগাড়ে একই ধরনের কথা শুনলে বা ভাবলে অনেক সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলা ঘটে। একান্ত ঈশ্বর বিশ্বাস বা ভূতে বিশ্বাসের ফলে রোগী ভাবতে থাকে তার শরীরে ঈশ্বরের বা ভূতের আবির্ভাব হয়েছে, ফলে রোগী ঈশ্বরের বা ভূতের প্রতিভূ হিসেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকে।
এই জাতীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মস্তিষ্ক কোষের অধিকারীদের কেউ কেউ নিজের অজান্তে স্ব-নির্দেশ (auto-suggestion) পাঠিয়ে অন্যের ব্যথার চিহ্ন নিজের শরীরে গ্রহণ করেন। মস্তিষ্ক কোষের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে শরীর বৃত্তির এই অস্বাভাবিকতাকেই অনেকে অলৌকিক ঘটনা বলে ধরে নেন। এ বিষয়েও আগে দীর্ঘ আলোচনা করেছি।
তাই অনেক সময় তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা দেখার সঙ্গে সঙ্গে কৌশল ধরে ফেলা এবং একই ঘটনা ঘটিয়ে দেখানো সম্ভব নাও হতে পারে। দু-পাঁচদিন দেরি হতেই পারে। শুধুমাত্র এই কারণে, কেউ কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেখাতে চাইলে তাঁকে জানাতে বলি তিনি কী ঘটিয়ে দেখাবেন। তিনি যদি বলেন, জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাবেন বা শূন্যে ভেসে দেখাবেন, সে ক্ষেত্রে বাস্তবিকই তিনি এ সব অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যেই যদি দেখান তবে আমার পক্ষে তাঁর লৌকিক কৌশল ধরে ফেলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কী ঘটিয়ে দেখাবেন জানা থাকলে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার সময়ের ব্যবধানের মধ্যে সম্ভাব্য কৌশলগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ আমি পেতে পারি এবং সেই ভাবনা-চিন্তার ফসল হিসেবেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীদের পরাজিত করা আমার পক্ষে সম্ভব।
এই মুহূর্তে দর্শকদের একাংশ যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপস্থিত দর্শকদের প্ররোচিত করছেন এবং সভায় একটা গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছেন সেটা আমাদের সমিতির সভ্যদের নিয়ে জোর করে বন্ধ করতে চাইলে একটা অসুবিধে হতেই পারে। দর্শকদের মধ্যে অনেক মহিলা আছেন। গোলমালের সূচনা হলে তাঁদের অবস্থাটা কী হতে পারে সেটাও যেমন ভাবার বিষয়, তেমনই ভাবার বিষয় হল বন্ধ প্রেক্ষাগৃহে গন্ডগোল শুরু হলে আমরা দ্রুত গন্ডগোল বন্ধ করতে না পারলে তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে? একটা দুর্ঘটনা আমাদের সমিতির সম্মানকে অনেকটাই নষ্ট করে দিতে পারে। আর বেশি ভাববার মতো সময় ছিল না। ঘোষণা করলাম, “আপনাদের দাবির প্রতি সম্মান জানাতে আমি এই মুহূর্তেই বিজয়া দেবীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি।”
গোটা প্রেক্ষাগৃহ উল্লাসে যেন ফেটে পড়ল। এবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা বিজয়া ঘোষের দিকে ফিরলাম, “আপনি কী ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেখাতে চাইছেন?”
মাউথপিস মুখে বন্দি করে বিজয়া দেবী শুরু করলেন, “এতক্ষণ আপনি আপনার বক্তব্যে বললেন, ধর্মশাস্ত্রগুলোতে আত্মার বিষয়ে বলা হয়েছে, আত্মা মানে চিন্তা, চৈতন্য বা মন। বিজ্ঞান বলতে মন বা চিন্তা হল মস্তিষ্ক কোষেরই অ্যাকশন, মস্তিষ্ক কোষের অ্যাকশন তত দিনই থাকবে যতদিন মানুষ বেঁচে থাকবে। মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক কোষেরও অ্যাকশন শেষ হয়, অর্থাৎ আত্মাও মারা যায়। আপনি এতক্ষণ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন আত্মা মরণশীল। আমি উপস্থিত দর্শকদের সামনে আপনাকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দেব আত্মা অমর। প্রমাণ করে দেব বিজ্ঞানের সেখানে শেষ সেখান থেকেই অধ্যাত্মবাদের শুরু।”
বিজয়াদেবীর কথা শুনতে শুনতে আমি তাঁকেও লক্ষ্য করছিলাম। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো। ওজন সম্ভবত পঁচাত্তর কেজির কম নয়। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, রঙ ফর্মা। গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ স্পষ্ট। সম্ভবত বারাসাতের কাছাকাছিই থাকেন, তাই প্রেক্ষাগৃহে প্রচুর জঙ্গি ভক্ত সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।
বিজয়া ঘোষ বারাসাত শাখার বিলি করা প্রচারপত্রের ও পোস্টারের দৌলতে জানতেন আমার কাছে পরাজিত অবতার ও জ্যোতিষীদের নাম। আজ ২৬ মার্চ ’৮৯। গত মাসখানেক ধরে অবতার গৌতম ভারতীর সঙ্গে আমার গোলমালের খবরটা পেশাদার অলৌকিক মাতাজি বিজয়া দেবীর অজানা থাকার কথা নয়, বিশেষত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যখন এই নিয়ে যথেষ্ট হইচই চলছে। এত কিছু জানার পরেও তিনি আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর এই এগিয়ে আসার মধ্যে যথেষ্ট পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে। তিনি ভালোমতোই জানেন, ভাববার মতো যথেষ্ট সময় সুযোগ না দিলে পৃথিবীর সেরা জাদুকরকেও পরাজিত করা যায় জাদু-কৌশল দিয়েই। এটা জানেন বলেই তাঁর লোকজন দিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, যাতে বাধ্য হই এই মুহূর্তে তাঁর মুখোমুখি হতে। স্বাভাবিক কারণেই আমি নিশ্চয়ই এমন একটা অসম্ভব ঝুঁকি নিতে রাজি হব না, এটাও বিজয়া দেবীর জানা। রাজি না হলে গন্ডগোল পাকিয়ে আমাদের আলোচনাচক্র ও অলৌকিক বিরোধী বিজ্ঞান শিক্ষণ শিবিরের কাজ ভণ্ডুল করে দিতে পারলে এটাই বিশাল করে প্রচার করা যাবে—বিজয়া ঘোষের চ্যালেঞ্জের মুখে প্রবীর ঘোষের পলায়ন, ফলে ক্ষুব্ধ দর্শকদের হামলায় যুক্তিবাদী সভা পণ্ড।
বিজয়া দেবীর কথা শেষ হতেই প্রচুর হাততালি পড়ল। প্রশ্ন করলাম, “আপনি কোথায় থাকেন?”
“বারাসাতের বালুরিয়ায়।”
“আপনি এর আগে কখনও আত্মা এনেছেন?” প্রশ্ন করলাম।
বিজয়া দেবী তাঁর ডান হাতের মাউথপিসটা মুখের কাছে এনে শ্রোতা ও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমি প্ল্যানচেট করে আত্মা আনি। অনেকেই আমার কাছে আসেন তাঁদের প্রিয়জনের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছেয়। মৃত্যুর আগে যে কথা জেনে নেওয়া হয়নি তেমন অনেক কথাই জেনে নিতে চান অনেকে। অনেকে জানতে চান, তাঁদের প্রিয়জনের আত্মা এখন কেমন আছে। অনেকে শুধুমাত্র প্রিয়জনের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগটুকু পেতেই আকুল হয়ে ছুটে আসেন।”
জিজ্ঞেস করলাম, “এর জন্য আপনি কি কোন পারিশ্রমিক নেন?”
“না, না, আমি কিছুই দাবি করি না। ভালোবেসে যে যা দেন, তাই নিই।” বিজয়া দেবী জানালেন।
সম্প্রতি আনন্দবাজারের প্রকাশিত আচার্য গৌতম ভারতীর সাক্ষাৎকারটির কথা মনে পড়ল। গৌতম ভারতীও বিজয়া দেবীর মতোই বলেছিলেন ভক্তরা ভালোবেসে যে যা দেন, তাই গ্রহণ করেন। কেউ দুহাজার টাকা দিলেও নেন, কেউ পঁচিশ হাজার দিলেও।
বললাম, “আপনি কি বাস্তবিকই এই হল ভর্তি দশর্কদের সামনে আত্মা এনে দেখাবেন?”
“নিশ্চয়ই।”
“শুনেছি ভূতেরা ভিড়-টিড় পছন্দ করে না। যাঁরা প্ল্যানচেটে আত্মা আনেন বলে দাবি করেন, তাঁরাই আমাকে এ ধরনের কথা বলেছেন। যাই হোক, প্ল্যানচেটে আত্মা না হয় আনলেন, কিন্তু আত্মা যে বাস্তবিকই এসেছে, তা আমরা বুঝব কী করে?
“আপনার যে কোনও প্রশ্নের উত্তর আত্মা দেবে। আত্মা সূক্ষ্মদেহী, সর্বত্রগামী, তাই যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম।”
“এই মঞ্চেই তো দেখাবেন, কী কী ব্যবস্থা করতে হবে বলুন, আমাদের সমিতির ছেলেরা...”
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েস বিজয়া দেবী বললেন, “যা যা প্রয়োজন সবই নিয়ে এসেছি।”
একটুক্ষণের মধ্যে মঞ্চে একটা ছোট এবং চওড়া বেঞ্চ উঠে এল। বেঞ্চটাকে সামনে রেখে চেয়ারে বসলেন বিজয়া দেবী। বেঞ্চের উপর পাতলেন বিশাল একটা সাদা কাগজ ও তার উপর তিন-কোনা প্ল্যানচেট টেবিল। ত্রিভুজ আকৃতির প্ল্যানচেট টেবিলের তিনটি দিকের দৈর্ঘ্যই আনুমানিক ৬ ইঞ্চি করে। তলায় পায়ার বদলে তিনটি লোহার বল লাগানো। প্ল্যানচেট টেবিলের এক কোণে একটা ফুটো। ফুটোয় একটা ডট পেন গুঁজে দিলেন বিজয়া দেবী। পেনের মুখ রইল কাগজ ছুঁয়ে।
মাথাটাকে বার কয়েক জোরে জোরে নেড়ে বিজয়া দেবী প্ল্যানচেট টেবিল দু’হাতে ছুঁয়ে স্থির হয়ে রইলেন। মিনিট তিন চার। প্ল্যানচেট টেবিল থরথর করে বার কয়েক কেঁপে উঠেই গতি পেল, কাগজের উপর দ্রুত ওঠানামা করল।
কাগজটা তাঁরই এক ভক্তের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “আত্মার লেখাটা সমস্ত দর্শকদের দেখান।”
ভক্ত দু'হাতে কাগজটা মেলে ধরলেন দর্শকদের দিকে। বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে, অরবিন্দ বিশ্বাস। চিৎকার ও হাততালিতে প্রেক্ষাগৃহ ভরে গেল। এক উৎসাহী দর্শক মঞ্চে উঠে এলেন। বিজয়া দেবীকে প্রশ্ন করলেন, “বলুন তো আমার পেশা কী?”
বিজয়া দেবী তৎপর হলেন। নতুন একটা কাগজে অরবিন্দের আত্মা লিখল ‘সাংবাদিক’। বিজয়া দেবী এবার প্রশ্নকর্তাকে প্রশ্ন করলেন, “উত্তর ঠিক হয়েছে?”
প্রশ্নকর্তা উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ।”
আর এক প্রস্থ প্রচণ্ড হাততালিসহ চিৎকার।
এবার আরও কয়েকজন মঞ্চে উঠে এলেন। উদ্দেশ্য প্রশ্ন করা। আমার সমিতির সদস্যদের দু-একজনও বিজয়া দেবীর দিকে এগিয়ে এসেছে। তাঁদেরও উদ্দেশ্য সম্ভবত বিজয়া দেবীকে কঠিন কিছু প্রশ্ন করে আমাকে সাহায্য করা। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আমার মুঠোবন্দি মাউথপিসকে কাজে লাগালাম, “আপনাদের প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ, আপনারা কেউ মঞ্চে ওঠার চেষ্টা করবেন না, বা বিজয়া দেবীকে কোনও প্রশ্ন করার চেষ্টা করবেন না। আপনাদের কারও প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেই প্রমাণিত হবে না যে, আমি পরাজিত হয়েছি। আমাদের দুজনের মোকাবিলা আমাদেরই করতে দিন। সেই সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছি, এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার পর লিখে আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে দেব। লিখে সঠিক উত্তর দিলেই প্রমাণ হয় না যে আত্মা আছে বা অলৌকিক ক্ষমতা আছে। স্রেফ কৌশলের সাহায্যেই এমন উত্তর দেওয়া সম্ভব। অতএব প্রত্যেকের কাছে আবারও অনুরোধ করছি, আপনারা আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিন। আমি একটি প্রশ্ন করব, সঠিক উত্তর দিতে পারলে, আমার হাতঘড়িটা অবশ্যই দিয়ে যাব, এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ভেঙে দেব।”
মঞ্চে উঠে আসা উৎসাহীরা বিদায় নিতে বিজয়া দেবীকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার আনা আত্মাটি তো সূক্ষ্মদেহী। একটা নোটের (টাকার) নম্বর জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই বলতে পারবে?”
“অবশ্যই পারবে।” প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললেন বিজয়া দেবী।
পকেটের মানিব্যাগ থেকে একটা দু'টাকার নোট বের করে ডান হাতের মুঠোয় রেখে বললাম, “আমার ডান হাতে রয়েছে দু'টাকার এই নোটটা। প্ল্যানচেটের সাহায্যে নোটের নম্বরটা বলে দিলেই পরাজয় স্বীকার করে নেব।”
এখন গোটা প্রেক্ষাগৃহে গ্রামের শ্মশানের স্তব্ধতা। বিজয়া দেবী প্ল্যানচেট টেবিলে মগ্ন। ইতিমধ্যে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দুজন দর্শক এগিয়ে এলেন আমার মুঠোয় সত্যিই টাকা আছে কি না দেখতে। মুঠো খুলে তাঁদের সন্দেহমুক্ত করলাম।
একসময় বিজয়া দেবী মাউথপিসের শব্দ প্রেক্ষাগৃহে ছড়িয়ে পড়ল, “কী, বলছেন? কী বলছেন? আপনি উত্তর দেবেন না বলছেন?”
বিজয়া দেবী এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, “আত্মা উত্তর দেবে না বলছে?”
বললাম, “অন্য কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে কি আপনার আত্মা রাজি আছে?”
বিজয়া ঘোষ আবার মাথা ঝাঁকিয়ে মনোসংযোগ করে, প্ল্যানচেট টেবিলে দুহাতের আঙুল ছুঁইয়ে বসলেন। তারপর একসময় বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “আপনি আর কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে রাজি নন? আপনি চলে যাচ্ছেন?”
প্ল্যানচেট টেবিল থেকে হাত তুলে বিজয়া দেবী ঘোষণা করলেন, “আত্মা বিদায় নিয়েছে। সুতরাং এখন আর কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।”
চিৎকার, হাততালি, চেয়ার বাজিয়ে প্রায় গোটা হল বিজয়া দেবীকে ধিক্কার ও আমাদের সমিতির জয়কে অভিনন্দিত করল।
আমি ওই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনের উত্তরে সমিতির তরফ থেকে শ্রোতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ঘোষণা করলাম, “এই বিশ্বাসটুকু আপনারা নিশ্চিন্তে রাখতে পারেন যে, কোনও অবতার বা জ্যোতিষী আমাদের চ্যালেঞ্জ করার বা আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ধৃষ্টতা জানালে তাঁর মাথা এই পায়ে তথা যুক্তিবাদী আন্দোলনের কাছে নত করতে হবেই।”
পরাজিত বিজয়া দেবী শেষ পর্যন্ত লিখিত ভাবেই পরাজয় স্বীকার করে শকুন্তলা দেবী, ঈপ্সিতা, সাঁইবাবা, পারমিতা, গোবিন্দদের দলেই নাম লেখালেন।
পরাজিত বিজয়া দেবী শেষ পর্যন্ত জনতার দাবিতে লিখেছিলেন—
বিজয়া ঘোষ, স্বামী সমীর ঘোষ, উত্তর বালুরিয়া, বারাসাত, উত্তর ২৪ পরগনা।
আমি আজ ২৬।৩।৮৯ বেলা বারোটা কুড়ি, বিধান হল, বারাসাত, মৈত্রী সংঘ বনমালীপুর আয়োজিত ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠানে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষকে আত্মা এনে সব প্রশ্নের উত্তর দেব বলে যে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম তাতে হেরে গেছি।
উত্তর বালুরিয়া
সাক্ষী—
১. সঞ্জয় ব্রহ্ম— দৈনিক বসুমতী পত্রিকা |
২. অনিলকুমার দাশ সংস্কার মুক্তি, |
৩. প্রেমেন্দ্র মজুমদার সদস্য, সম্পাদকমণ্ডলী |
৪. অসীম গণ সদস্য, বারাসাত বিজ্ঞান সংঘ |
৫. স্বপন স্বর্ণকার ইভনিং ব্রিফ |
ভূত বাসা বাঁধে আমাদের
মনের অন্ধকারে। যেখানে জ্ঞানের আলো
আনলেই ভূতেরা পালায়, ভূতেরা মারা যায়। অজ্ঞানতা
আনে ভয়, দেয় ভূতেদের জন্ম। জ্ঞান আনে সাহস,
ঘটায় ভূতেদের মৃত্যু। ভূত কোনোদিনই
ছিল না, নেই, থাকবেও না।