অলৌকিক নয়, লৌকিক (দ্বিতীয় খণ্ড)/অধ্যায় দুই
দুই
পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনি ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
বেশিদিনের কথা নয়। পঞ্চাশ বছর আগেও কলকাতা আর তার আশেপাশে সন্ধ্যার পর শ্যাওড়া কি তেঁতুল গাছের তলা দিয়ে যেতে গা ছমছম করত। মাঝেমধ্যে নাকি সে-সব জায়গায় অদ্ভুত সব ভূতদের দেখা পাওয়া যেত। এক সময় কলকাতায় ভূতুড়ে বাড়িও কম ছিল না। এককালে খাস কলকাতাতেই নাকি দেখা যেত সাহেব ভূত ভূতুড়ে ঘোড়ায় চেপে জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে টগবগিয়ে চলে যাচ্ছে। কলকাতার বহু বনেদি বাড়ির জলসাঘরে বেলোয়ারি কাচের টুং-টাং আওয়াজের সঙ্গে ঘুঙুরের বোল তুলত কোন বিদেহী বাইজি। বহু পাষাণ-প্রাসাদেই ঘুরে বেড়াত ক্ষুধিত আত্মা।
আজ সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। আগের সেই রহস্যময় কলকাতা আজ বড় বেশি শুল্কং কাষ্ঠং হয়ে পড়েছে। কলকাতা আজ এত বেশি মুখর হয়ে উঠেছে যে আজকাল সেই সব ভূতদের আর দেখাই পাওয়া যায় না। জানি না কলকাতা থেকে উদ্বাস্তু হওয়া ভূতদের কোথায় পুনর্বাসন হয়েছে আজ? শহর কলকাতা যখন ভূতদের বিরহে নেহাতই কাঠ-কাঠ, এমনই সময়ে ১৯৮২-র ২১ এপ্রিল আনন্দবাজার দারুণ এক স্কুপ নিউজ ছাড়ল। সকালে আনন্দবাজার হাতে পেতেই বাড়িতে, চায়ের আড্ডায়, পাড়ার মোড়ে, স্কুল-কলেজে, অফিস-পাড়ায়, হইহই পড়ে গেল—আলিপুরে পুলিশ ভূত পাওয়া গেছে। প্রথম পাতায় চার কলম জুড়ে দারুণ গুরুত্বের সঙ্গে খবরটা প্রকাশ করেছে আনন্দবাজার—
গভীর রাতে ট্যাকসির এক নিরুপদ্রব সওয়ার
চোর ভূত, ডাকাত ভূত, প্রেমিক ভূত, প্রেমিকা ভূত, নর্তকী ভূত, সাহেব ভূত, কুকুর ভূত, বন্ধু ভূত এ সবের অনেক গপ্প পড়েছি ও শুনেছি। কিন্তু পুলিশ ভূত নিয়ে খবর কাগজের ঢাউস খবর মানেই সত্যির গ্যারান্টি।
অনেকেই বললেন, “আত্মা যে অমর, ভূতের অস্তিত্ব যে বাস্তবিকই আছে আনন্দবাজার তা হাতে-নাতে প্রমাণ করে দিল।”
রাস্তায়-ঘাটে অফিস কাছারিতে আমাকেও কম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল না—“এবারও কি বলবেন, ভূত বলে কিছু নেই? আনন্দবাজারের কথা মিথ্যে প্রমাণ করতে পারবেন?”
বাড়িতে স্ত্রীর হাত থেকেও রেহাই নেই। বাইরে সেও নাকি আমার জন্য অপদস্থ হচ্ছে, আর আমি নাকি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছি। এক প্রবীণ ও বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী নাকি সীমাকে খোঁচা দিয়ে বলেছেন, “কী হে, তোমার কর্তা এখন কী বলেন? ভূত আছে তো? নাকি খবরটাকেই মুখের জোরে অস্বীকার করতে চান?"
সেখানে উপস্থিত সীমার কিছু বান্ধবীও ওই সঙ্গীতশিল্পীকে সমর্থন করে এই বিষয়ে আমাকে মুখ খুলতে বলেছেন।
আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবরটিকে বিশ্বাস করলে বিজ্ঞানকেই অবিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু প্রকাশিত খবরটি যে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে-এই সত্যটুকু অস্বীকার করার উপায় নেই।
এক্ষেত্রে অনুসন্ধান, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে না এসে শুধুমাত্র লেখার অক্ষরকে বিশ্বাস করলে অনেক আদ্যন্ত মিথ্যেকে নির্ভেজাল সত্য বলে বিশ্বাস করতে হয়।
সত্যি ভূতের ও সত্যি অলৌকিক ঘটনার কল্প কাহিনি প্রতিনিয়ত ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েই চলেছে এবং যতদিন পাঠক-পাঠিকারা এই ধরনের অলৌকিক কিছুর খবর তীব্র আগ্রহ নিয়ে পড়বেন, ততদিন পত্র-পত্রিকাগুলোও পাঠক-পাঠিকারা ‘যে খবর খান' সে ধরনের খবরই ছেপে যাবেন আর্থিক লাভের আশায়। অথচ আজ পর্যন্ত একটি অলৌকিক ঘটনা বা আত্মার অস্তিত্ব কোনও ধর্মগুরু, প্যারাসাইকোলজিস্ট বা কোনও পত্র-পত্রিকা বিজ্ঞানের দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধরা পড়েছে ফাঁক আর ফাঁকি।
ভূতের বিষয়ে সঠিক খবর পাওয়ার আশায় প্রথমেই যোগাযোগ করলাম সে সময়কার কলকাতার পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার শ্রী শিবনাথ রায়ের সঙ্গে। সহযোগিতাপূর্ণ ব্যবহার পেলাম তাঁর কাছে।
প্রকাশিত পুলিশ ভূতের খবরটার সম্বন্ধে তিনি কিছু খবর রাখেন কি না জিজ্ঞেস করতেই বললেন,—“হ্যাঁ, পত্রিকায় খবরটা পড়েছি বটে, তবে ওই পর্যন্তই—”
“সে কী!” আমি আতঁকে ওঠার ভান্ করি, “এই ব্যাপারে পুলিশমহল তোলপাড়। পরপর কয়েকজন ট্যাক্সিচালক নাকি সংশ্লিষ্ট থানায় এসে ভূত সম্বন্ধে অভিযোগও করে গেছে—”
“না মশাই, আলিপুর থানা কেন, কোনো থানাতেই এই ধরনের রিপোর্ট বা ডায়েরির খবর আমাদের কাছে নেই।”
“এই বিষয়ে আপনার নিজস্ব কোনও মতামত...”
“এই বিষয়ে কী আর বলব? বলতে পারি, খবরটা শুধু পত্রিকায় দেখেছি। আমাদের কাছে ভূতের কোনো খবর নেই। এই বিষয়ে আরও খবর পেতে আপনি বরং সরাসরি, আলিপুর পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করুন।”
যোগাযোগ করলাম আলিপুর পুলিশ স্টেশনের সঙ্গে।
উনত্রিশে জুনের দুপুর। অফিসার ইনচার্জ শ্রী তারক গাঙ্গুলি সে সময়ে উপস্থিত ছিলেন না থানায়। কোনো কাজে বেরিয়ে ছিলেন। ডিউটি অফিসার এ. এস. আই. শ্রী পি. কে. নাগের সঙ্গে কথা হল। যথেষ্ট সহযোগিতা করলেন তিনি।
শ্রী নাগ জানালেন, “না মশাই, এ যাবৎ এই থানায় কোনো ট্যাক্সি-ড্রাইভার এই ধরনের কোনো ডায়েরি তো দূরের কথা, কোনো রিপোর্টও করেনি। পত্রিকা বিশেষ করে যে জায়গাটার কথা বলেছে সেখানে আমাদের পুলিশ কনস্টেবল সারারাত পাহারা দেয়। তারাও ভূত নিয়ে কোনো দিন কোনো রিপোর্ট করেনি।”
হায়! ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক ঠেলে। শেষ পর্যন্ত এমন একটা রোমাঞ্চকর ভূতুড়ে ব্যাপার নেহাৎই মাঠে মারা যাবে?
শেষ চেষ্টা হিসেবে জ্বলে ডোবার আগে খড়কুটো ধরার মতো ধরলাম কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের ডেপুটি কমিশনার নম্বর ওয়ান শ্রী সুবিমল দাশগুপ্তকে। স্মার্ট চেহারার অসাধারণ ঝকঝকে চোখের অধিকারী সুবিমলবাবুকে পুলিশ ভূতের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাদের গোয়েন্দারা নাকি হাজার মাথা ঘামিয়েও এই ভৌতিক রহস্যের কিনারা করতে পারেননি? এখন একটা শাস্তি-স্বস্ত্যয়নের কথা ভাবছেন?”
সপ্রতিভ কণ্ঠে শ্রী দাশগুপ্ত উত্তর দিলেন, “ওই ভূতের ব্যাপারটা পুরোপুরি মিথ্যে। এমন কোনো ঘটনাই আদপে ঘটেনি, সুতরাং আমাদের দপ্তরের মাথা ঘামাবারও কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
এরপর যোগাযোগ করি, ট্যাক্সি-ড্রাইভারস ইউনিয়নের সঙ্গে। সাধারণ সম্পাদক শিশির রায় জানান, তাঁরা অনেকেই ঘটনাটা শুনেছেন, কিন্তু কেউই প্রত্যক্ষদর্শী নন। অনেকে অবশ্য ঐ পথ বর্জন করে চলেছেন।
আমার কাছে যেটা বিস্ময়কর মনে হয়েছে সেটা হল, এমন একটা বিদঘুটে মিথ্যে খবর আনন্দবাজারের মতো নামী-দামি পত্রিকা এত গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাতেই ছাপাল কী করে? অদ্ভুতুড়ে খবরটি দেখে বার্তা-সম্পাদক বা সম্পাদকের কারও কি একবারের জন্যেও মনে হয়নি, খবরটি সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে?
এক সত্যি ভূতের কাহিনি ও এক বিজ্ঞানী
ভূত নেই নেই করে যাঁরা চেঁচাচ্ছেন, যাঁরা বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে বলছেন, “মৃত্যুর পরেই মানুষের সব শেষ”, “আত্মা মোটেই অমর নয়,” তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েই একটি ভূতের “সত্যি কাহিনি” প্রকাশিত হল “পুলিশ ফাইল” নামের একটি মাসিক পত্রিকায়। পুলিশ ফাইল পত্রিকার সম্পাদক মোটেই এলে-বেলে লোক নন, দস্তুরমতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অধ্যাপক অনীশ দেব। ভৌতিক ঘটনাটির নায়ক দেবেন, নায়িকা অনুরাধার ছবিও সম্পাদক প্রকাশ করেছিলেন, সেই সঙ্গে দিয়েছিলেন দেবেনের পুরো ঠিকানা।
ঘটনাটা ছোট্ট করে জানাচ্ছি।
দেবেন থাকেন কলকাতার কাশীপুরের ২৬ নং শ্যামল মুখার্জি লেনে। দেবেনের বাবা রামদেববাবু পুরসভার কেরানি। দেবেন বয়সে তরুণ। বিয়ে করেন ১২ জুন ১৯৮৫। স্ত্রীর অনুরাধা ভুবনেশ্বরের কাজী লেনের বাসিন্দা ছিলেন। বাবার নাম জগদেব নারায়ণ।
বিয়ের পর দিন ১৩ জুন প্রথম ভৌতিক ঘটনাটা ঘটল। ফুলশয্যার রাতে দেবেন অনুরাধাকে একা পেয়ে অনুরাধার গলা এবং শরীরের নানা অংশে প্রচণ্ড জোরে কামড়ে রক্তাক্ত করে তুলল। সেই সঙ্গে ভয় দেখিয়ে বলল, “তুমি যতই চেষ্টা করো না কেন বাঁচতে পারবে না। আমি তোমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাব।” আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, দেবেন যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন তা দেবেনের গলার স্বর ছিল না, মেয়ের কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসছিল।
অনুরাধা ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। চিৎকারে অনুরাধার শাশুড়ি ও ননদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
শাশুড়ির কাছে এসে ঘটনাটুকু সংক্ষেপে বলে অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অনুরাধাকে শুইয়ে দিয়ে দেবেনের মা বাবা ও দুই বোন ফুলশয্যার ঘরে ঢুকে দেখেন দেবেন ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে তুলে দেবেনকে কামড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করায় দেবেন বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, এমন কিছু সেই করেইনি। সকলে এবার এলেন অনুরাধার কাছে। ঘুমন্ত অনুরাধার ক্ষত থেকে আবরণ সরাতেই আর এক বিস্ময়! কোথায়ই বা ক্ষত? কোথায়ই বা রক্ত?
দ্বিতীয় রাতে অনুরাধাকে একা পেয়ে দেবেন আবার আক্রমণ চালাল। কামড়ে নাক আর দুটো কান কেটে নিল।
অনুরাধার চিৎকারে এ রাতে দেবেনের বাড়ির লোক ছাড়া প্রতিবেশীরাও ছুটে এলেন। অনুরাধাকে নীলরতন হাসপাতালে ভর্তি করা হল। কাশীপুর থানায় খবর গেল। পরদিন সকালে পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর পঙ্কজকুমার লাহা তদন্ত করতে হাসপাতালে গেলেন। সেই সময় অনুরাধার নাক কান আর বুকে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ডাক্তার ভট্টাচার্য জানালেন বেশি রক্তপাতের জন্য অনুরাধার বাঁচার আশা নেই।
শ্রীলাহা এবার এলেন কাশীপুরে দেবেনের বাড়িতে। দেবেন জানালেন, তিনি এইসব ঘটনার কিছুই জানেন না। শ্রীলাহা দেবেনকে নিয়ে গেলেন মৃত্যুর প্রহর গোনা অনুরাধার কাছে। কিন্তু কী আশ্চর্য? হাসপাতালে অনুরাধাকে পাওয়া গেল সম্পূর্ণ সুস্থ এবং অক্ষত অবস্থায়। নাক কানের অংশ যে কয়েক ঘণ্টা আগে কামড়ে কেটে নেওয়া হয়েছিল, তার সামান্যতম প্রমাণও পাওয়া গেল না অনুরাধার শরীরে।
খবর পেয়ে অনুরাধার বাবা এসেছিলেন ভুবনেশ্বর থেকে। সন্দেহ প্রকাশ করলেন দেবেনের উপর ভূতে ভর করেছে। পরের দিন সকালে তিনি উত্তরপাড়া থেকে তান্ত্রিক অঘোর সান্যালকে নিয়ে এলেন। দেবেনের বাড়িতে ঢোকার মুখে বিশাল ভিড়। পুলিশ এসেছেন। এসেছেন ডাক্তারও। জানতে পারলেন গতরাতে অনুরাধা শুয়েছিলেন শাশুড়ির ঘরে। শাশুড়ি নাকি গলা টিপে মেরে ফেলেছেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছেন অনুরাধা মৃত অঘোর তান্ত্রিক জানালেন এসবই এক ভূতের কারসাজি। পুলিশ ‘লাশ’ না নিয়ে গিয়ে যদি তাঁকে পুজো করার জন্য কিছুটা সময় দেন, তবে তিনি অনুরাধাকে বাঁচিয়ে দিতে পারবেন; সেই সঙ্গে এই পরিবারের সকলকে চিরকালের জন্য ঐ ভূতের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন।
পুলিশের অনুমতি মিলল। দ্রুত পুজোর আয়োজন করা হল। অঘোর তান্ত্রিক যজ্ঞ শুরু করতেই দেবেন মেয়ের গলায় চিৎকার করতে লাগল, “আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে মেরো না।” শেষ পর্যন্ত জানা গেল শাকিলা নামের একটি মেয়ে ’৮৫-র ৮ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেছিল। তারই আত্মা এইসব কাণ্ড ঘটিয়েছিল। একসময় মৃত অনুরাধা সবাইকে আশ্চর্য করে উঠে বসল।
অনুরাধাকে মৃত ঘোষণা করা ডাক্তার অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, অলৌকিক আজও ঘটে। মন্ত্রশক্তিতে মৃতকেও বাঁচানো যায়।
কাহিনির শেষে লেখা রয়েছে : ‘এ এক অবিশ্বাস্য কাহিনি হলেও সত্য।’ কাহিনির শুরুতেই লেখা ছিল ‘পুলিশ ফাইল থেকে’, অর্থাৎ, পুলিশ ফাইল থেকেই এইসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।
লেখাটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, বেশ কিছু চিঠি এই প্রসঙ্গে আমি পেয়েছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পত্র লেখক-লেখিকারা জানতে চেয়েছিলেন আমি এই ‘সত্য ঘটনা’কে স্বীকার করি কি না এবং সেই সঙ্গে স্বীকার করি কি না ভূতের অস্তিত্বকে। যুক্তিবাদী বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেও লেখাটি পড়ে, বিভ্রান্ত হয়ে এই বিষয়ে আমার মতামত ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। যুক্তিবাদীদের মনেও বিভ্রান্তি দেখা দেওয়ার কারণ : ১। পত্রিকাটির সম্পাদক পরিচিত বিজ্ঞান পেশার মানুষ। ২। ঘটনাটি পুলিশ ফাইল থেকেই নেওয়া বলে ঘোষণায় জানানো হয়েছে। ৩। কাহিনির শেষাংশে বলা হয়েছে—‘ঘটনাটি অবিশ্বাস্য কাহিনি হলেও সত্যি।’ ৪। ঘটনার প্রধান চরিত্র দেবেন এবং অনুরাধার ফটোও ছাপা হয়েছে।
ভূতে পাওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয় মানসিক রোগ, নয় তো অভিনয়। মস্তিষ্ক-কোষ থেকেই আমাদের চিন্তার উৎপত্তি। একনাগাড়ে ভূতের কথা ভাবতে ভাবতে অথবা কোনও বিশেষ মুহূর্তে ভূতে ভর করেছে ভেবে কোনও কোনও আবেগপ্রবণ মানুষের মস্তিষ্ক-কোষে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যাকে চলতি কথায় বলতে পারি মাথার গোলমাল। এই সময় মানসিক রোগী ‘তার উপর ভূতে ভর করেছে’ এই একান্ত বিশ্বাসে অদ্ভুত সব ব্যবহার করে। ভূতে পাওয়া যদি মানসিক রোগ না হয় তবে অবশ্যই ধরে নেওয়া যায় রোগী বা রোগিণী ভূতে পাওয়ার অভিনয় করছে। এখানে অনীশ দেবের পত্রিকায় লেখক অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের ‘সত্যি কাহিনি’টিতে এমন অনেক কিছু ঘটেছে, বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা মেলে না। কাটা নাক কান জুড়ে যাচ্ছে, ক্ষতচিহ্ন মিলিয়ে যাচ্ছে, মৃত জীবিত হচ্ছে ইত্যাদি।
আমার মনে হয়েছিল-এর একটাই ব্যাখ্যা হয়, সম্পাদক ও লেখক আমাদের প্রত্যেককে প্রতারিত করেছেন। সত্যি কাহিনির নামে আগাগোড়া মিথ্যে কাহিনি বলে গেছেন। কিছু বিজ্ঞানকর্মীর তাও সন্দেহ ছিল এমন একজন পরিচিত বিজ্ঞান পেশার মানুষ ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক কি পাত্র-পাত্রীর নাম ঠিকানা ছবি ছাপিয়ে থানার সাব-ইন্সপেক্টরের নাম, হাসপাতালের নাম, ঘটনার তারিখ উল্লেখ করে পুরোপুরি মিথ্যে লিখবেন? রহস্য থাকলে তা হয় তো অন্য কোনও জায়পায়।
স্ট্রিট ডাইরেক্টরিতে শ্যামল মুখার্জি লেনের নাম খুঁজতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেলাম। এমন নাম কোথাও নেই। ঠিক করলাম ঠিকানা যখন পেলাম না, এবার কাশীপুর খানা থেকে খোঁজ করা শুরু করি। দেখি তাঁরা এই ঘটনা সম্পর্কে কতটা অলোকপাত করতে পারেন। ঠিকানাটার হদিশও ওঁদের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের ভার তুলে দিলাম আমাদের সমিতির এক তরুণ বিজ্ঞান কর্মীর হাতে। তার হাত দিয়েই ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র রাইটিং প্যাডে কাশীপুর পুলিশ স্টেশনের অফিসার ইনচার্জকে উদ্দেশ করে লেখা একটি চিঠি পাঠাই। সঙ্গে পুলিশ ফাইলেও তথাকথিত সত্যি ভূতের কাহিনিটির ফটো কপিও। চিঠিতে জানাই ‘পুলিশ ফাইল’ পত্রিকার জুন ১৯৮৮ সংখ্যায় একটি ভূতুড়ে ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২৬ নং শ্যামল মুখার্জি লেন কাশীপুর পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে বলা হয়েছে। পত্রিকাটির ফটো কপি আপনার পড়ার জন্য পাঠালাম। আমাদের সমিতি নানা অলৌকিক ঘটনার সত্যানুসন্ধান করে থাকে। আপনার এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে আমরা অনুসন্ধানে উৎসাহী । বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য আমাদের সমিতির সদস্যকে পাঠানো হল। তাঁকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা ও সহায়তা করলে বাধিত হব। চিঠির তারিখ ছিল ৫।৬।৮৮।
পরের দিনই বিজ্ঞানকর্মীটি কাশীপুর থানায় যোগাযোগ করে, চিঠিটি দেয় এবং প্রধানত তিনটি বিষয়ে জানতে চায় : ১। শ্যামল মুখার্জি লেন নামের কোনও ঠিকানা আদৌ এই থানা এলাকায় আছে কি না? ২। ঘটনাকাল ১৯৮৫ সালে পঙ্কজকুমার লাহা নামের কোনও সাব-ইন্সপেক্টর আদৌ কাশীপুর পুলিশ স্টেশনে কাজ করতেন কি না? ৩। জুন ১৯৮৫-তে এই ধরনের কোনও ঘটনা থানার ডায়েরিতে বা অন্য কোনও নথিতে আছে কি না?
৯ জুন আমাকে লেখা এক চিঠিতে থানার অফিসার ইন-চার্জ স্পষ্ট ভাষায় যা জানালেন, তার সংক্ষেপ-সার-১। কাশীপুর পুলিশ স্টেশনের অধীনে এমন কোনও ঠিকানা নেই। ২। ১৯৮৫ সালে পঙ্কজকুমার লাহা নামের কোনও সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন না। ৩। এই ঘটনার কোনও তথ্য আমাদের পুলিশ স্টেশনের নথিতে নেই।
আমি বিস্মিত হলাম। কী চূড়ান্ত মিথ্যেকে সত্যি বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন সম্পাদক ও লেখক। এর পরও কি আমার দেখা উচিত, সম্পাদকের ও লেখকের তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে কিছু বলার আছে কি না? একাধিক দিন আমি এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির একাধিক সদস্য সম্পাদক অনীশ দেবের বাড়ি গিয়েছি। ওই বাড়িই পুলিশ ফাইল পত্রিকার অফিস। কোনও দিনই অনীশ দেবের দেখা পাইনি। আমাদের আসার উদ্দেশ্য প্রতিবারই অফিসের জনৈক কর্মীকে জানা হয়েছে। জানিয়েছিলাম, দেবেন-অনুরাধার ‘সত্যি কাহিনি’র ওপর আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান এবং কাশীপুর থানার লিখিত উত্তর বলছে লেখাটির সঙ্গে বাস্তব সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই। এটা স্রেফ গল্পকথা। এই বিষয়ে অনীশবাবুর কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনও প্রমাণ থাকলে তিনি প্রমাণসহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাধিত হব।
অনীশ দেব আমার সঙ্গে দেখা করেননি। পরিবর্তে ১৮ জুন তারিখে লেখা তাঁর একটি পোস্ট কার্ড পাই। তাতে শুরুতে লেখা, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি বলে দুঃখিত।’ মাঝখানে এক জায়গায় লেখা, ‘আমার লেখাটি গল্পকথা হিসেবেই প্রকাশ করেছি।’ শেষ অংশে লেখা, ‘পুলিশ ফাইল’ আপাতত আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ফলে আগামী সংখ্যাতে যে কোনও ত্রুটি স্বীকার করব সে সুযোগও নেই। সুতরাং এজন্য দুঃখপ্রকাশ করছি। আপনার পরিচালনায় যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাফল্য কামনা করে শেষ করছি।’
চিঠিটা অনীশ দেবের ডিগবাজির সাক্ষ্য হিসেবে সযত্বে রেখে দিয়েছি। এর পরেও অনীশবাবুর কাছে কয়েকটি জিজ্ঞাসা আমার থেকেই গেল। অনীশবাবু, সত্যিই কি ‘গল্পকথা’ হিসেবেই লেখাটি প্রকাশ করেছিলেন? তবে আবার ‘সত্যি কাহিনি’ প্রমাণের জন্য ভূরি ভূরি বাক্যি খরচ করলেন কেন? কেনই বা কাল্পনিক দুটি চরিত্রের ফটোগ্রাফ প্রকাশ করলেন? ফটোগ্রাফ দুটি তবে কার? অনীশবাবু, আপনার কথা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ কাহিনিটা ‘গল্পকথা’ই হয়, তবে ত্রুটি স্বীকারের প্রশ্ন আসছে কেন? আপনার কথাই আপনার মিথ্যাচারিতাকে ধরিয়ে দিচ্ছে না কি?
অনীশবাবু, আপনাকে শেষ প্রশ্ন, সত্যিই কি আপনি যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন? যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাফল্য মানেই আপনার মতো অপ-বিজ্ঞানের ধারক-বাহক ও মিথ্যাচারীদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা।
বেলঘরিয়ার গ্রিন পার্কে ভূতুড়ে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
’৮৭-র আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে বেলঘরিয়ার গ্রিন পার্কের একটি বাড়ি ঘিরে রহস্যজনক অনেক কাণ্ড-কারখানা নাকি ঘটতে থাকে। খাবার-দাবার উল্টে যাচ্ছে, হাতা, খুন্তি, থালা, বাসন, এমনকী বাড়ির দেওয়াল ঘড়িটি পর্যন্ত নাকি উড়ে বেড়াচ্ছে। ভূতুড়ে কাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মেলা। প্রতিদিন ভূতের নাচন দেখতে শয়ে শয়ে মানুষ ভিড় জমাতে লাগলেন।
আমাদের সমিতির সেই সময়কার সহ-সম্পাদক বিজয় সেনগুপ্ত ১৭ আগস্ট গেলেন একটি নিরীহ প্রস্তাব নিয়ে। পাড়ার ছেলেরা তখন বাড়ি ঘিরে ব্যারিকেড তৈরি করেছেন। তার বাইরে বিশাল জনতা ভূতুড়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে। আমাদের সমিতির নাম করে ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলেন বিজয়। বাড়ির মালিক দিলীপ ঘোষ বাড়িতেই ছিলেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। বাড়ির প্ল্যান তৈরি করেন। দুই বিয়ে। সম্পত্তি নিয়ে অশান্তি চলছে। বিজয় ভূতের কাণ্ড-কারখানার কথা দিলীপবাবুর কাছ থেকে যা শুনলেন, তা আগে শোনা ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। ইতিমধ্যে তান্ত্রিকের পিছনে অনেক টাকাও নাকি বেকার খরচা করেছেন দিলীপবাবু।
বিজয় আমাদের সমিতির তরফ থেকে প্রস্তাব দিলেন, সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ এখানে একনাগাড়ে তিন দিন তিন রাত থাকবেন, এর মধ্যে কোনও ভৌতিক ঘটনা ঘটলে আমাদের সমিতির তরফ থেকে প্রবীর ঘোষ দেবেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। ভূতের উপদ্রব না হলে বাড়ি ভুত মুক্ত করার জন্য আপনি আমাদের সমিতিকে দেবেন মাত্র পাঁচ হাজার। যুক্তিবাদী সমিতির তিনজন সদস্য প্রবীরবাবুর সঙ্গী হবেন।
প্রস্তাবে দিলীপবাবু চমকালেন, বললেন, ‘না, না, আজ থেকে ভূতের উপদ্রব বন্ধ হয়ে গেছে তো।’ অগত্যা বিজয়কে বিদায় নিতে হল, নিচে নামতে উৎসুক দর্শকরা জানতে চাইলেন, যুক্তিবাদী সমিতির এ বাড়ির ভূত তাড়াতে নামছে না কি? বিজয় জানালেন, যুক্তিবাদী সমিতির নামেই ভূতের উপদ্রব বন্ধ হওয়ার কাহিনি। দিলীপবাবুর উদ্দেশে ক্রুদ্ধ জনতার গালাগাল ও ধিক্কার শুনতে শুনতে বিজয় বিদায় নিয়েছিলেন।
নিউ জলপাইগুড়িতে ভূতের হানা
মাসকয়েক আগের ঘটনা, নিউ জলপাইগুড়ি সেন্ট্রাল কলোনির যুবতী রূপাকে ভূতে ধরেছে, অতিপ্রাকৃতিক যত ঘটনা ঘটে চলেছে রূপাদের বাড়িতে। মুহূর্তে খবর এতই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে ঘটনাটার রহস্য অনুসন্ধানে নিউ জলপাইগুড়ি ফাঁড়িকে নামতে হয়। শোনা যায় বাল্ব, কৌটো, শিশি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র আপনা থেকেই ছিটকে ছিটকে যেখানে সেখানে এসে পড়ছিল।
আমাদের সমিতির সহযোগী সংস্থা শিলিগুড়ির নবোদয় বিজ্ঞান পরিষদের পক্ষে প্রলয় চৌধুরী, পঙ্কজ বসু, বিশ্বদীপ রায় মুহুরী সত্যানুসন্ধানে নেমে পড়েন। ঘটনার বিবরণ জানতে রূপার বাবা এ কে ব্যানার্জি, মা রেখা, রূপা, রূপার বন্ধু কমলেশ রায়, পাশের কোয়ার্টারের পরিমল চন্দ্র পাল এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলেন ও.সি. রাজকুমার ঘোষের সঙ্গেও।
ঘটনার সকলের বিবরণগুলো পরপর সাজানোতে যে চিত্রটা ভেসে উঠল সেটা হল এই—রূপাদের বাড়িতে কমলেশ ও তার বন্ধু-বান্ধবীদের হই-হুল্লোড়ে বিরক্ত পরিমলবাবু প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন। সে চুরাশি সালের ঘটনা। প্রতিবাদ জানানোর পর থেকে পরিমলবাবুর কোয়ার্টারের উঠোনে বোতল, টিন ইত্যাদি পড়তে থাকে। পরিমলবাবু কাউকে হাতে-নাতে ধরতে না পারলেও এগুলোকে মানুষেরই কীর্তি অনুমান করে ৬ এপ্রিল ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ করেন। আশে-পাশের কিছু মানুষজন রূপা-কমলেশদের সন্দেহ করতে থাকেন। ব্যানার্জি পরিবার অবশ্য দৃঢ়তার সঙ্গে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ব্যাপারটা হয় তো কোনও মানুষেরই কাজ নয়।
ভূতের উপদ্রব বন্ধ হয়। ’৮৮-র সেপ্টেম্বরের শুরুতেই পরিমলবাবুর সঙ্গে ব্যানার্জি পরিবারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ভূতের উপদ্রবও শুরু হয়। ৪ সেপ্টেম্বর পরিমলবাবু পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। ভূত তার পরে পরেই উপদ্রব বন্ধ রাখে। আবার শুরু ’৮৯-এর সেপ্টেম্বর। ২৫ সেপ্টেম্বর পরিমলবাবু আবার ফাঁড়িতে দৌড়লেন। আশে-পাশের জনমতও পরিমলবাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পিছনে ভূতের বদলে মানুষেরই হাত আছে বলে সন্দিগ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। অবস্থা ঘোরাল হচ্ছে দেখে পুলিশ অনুসন্ধানে নামে। আর এই সময়ই শুরু হয় ব্যানার্জি বাবুদের বাড়িতেও ভূতের নানা উপদ্রব। সঙ্গে বাড়তি বোঝা—রূপার উপর ভূতের ভর। ভূত তাড়াতে ওঝা আসে, ঝাড়ফুঁকও চলে। ভূত বিদায় নেয়।
স্থানীয় মানুষ ও নবোদয় বিজ্ঞান পরিষদ কিন্তু অনুমান করে জনরোষ ও পুলিশের হাত থেকে বাঁচতেই ব্যানার্জিবাবুর বাড়িতে এবং রূপার উপর ভূতের অত্যাচার অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
দমদমের কাচ ভাঙা হল্লাবাজ-ভূত
তামাম পাঠকদের অবাক করে দিয়ে ২৭ নভেম্বর ’৯০ ‘গণশক্তি’র প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলম জুড়ে বিশাল ছবি সহ এক অদ্ভুত প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। এই বিশাল জায়গা খরচ করার পরও সপ্তম পৃষ্ঠার পাঁচ কলম জুড়ে প্রকাশিত হল শেষাংশ। পাঠকদের অবগতির জন্য খবরটি তুলে দিলাম।
প্রতিবেশীরা অবাক, গৃহস্বামী চিন্তিত
দমদমের একটি বাড়িতে আপনা থেকেই ভাঙছে কাচের সামগ্রী
কলকাতা, ২৬শে নভেম্বর—দমদম এলাকায় এক বাড়িতে বাম্ব, টিউব, আয়না সহ যাবতীয় কাচের সামগ্রী আপনা থেকেই ভাঙতে শুরু করেছে। ওই তিনতলা বাড়িটির দোতলার একটি ছোট্ট ঘরে এই ঘটনা ঘটে চলেছে প্রায় দেড়মাস ধরে। এই আশ্চর্য ঘটনার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অথচ ইতিমধ্যেই সত্তরটি বাল্ব, ষোলটি টিউবলাইট, তিনটি চিমনি ও অন্যান্য কাচের জিনিসপত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। বাড়ির গৃহকর্তা নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক। তাই কেবল ঘটনাটিরই বিবরণ দেওয়া হচ্ছে।
এই অদ্ভুত ঘটনাটির সূত্রপাত গত ১৮ই অক্টোবর রাতে। সেদিন প্রথম ওই ঘরটির বাসিন্দা স্বামী-স্ত্রী ও পুত্র খেয়েদেয়ে শুয়েছেন। হঠাৎ দুম করে আওয়াজ। ঘর অন্ধকার। আর টুকরো কাচের মাটিতে পড়ার শব্দ। দেশলাই ঘষে আলো জ্বালিয়ে ভদ্রলোক অবাক। নাইট ল্যাম্পটি ভেঙে টুকরো হয়ে পড়ে গেছে। শুধু হোল্ডারে বাল্বের ক্যাপ ও ফিলামেন্টটি আটকে আছে। যাই হোক এটি নানা কারণে ঘটে থাকে তাই কেউই বিশেষ আমল দেননি। পরদিন নতুন একটি বাল্ব কিনে লাগানো হয়। সেদিন রাতেও কিছুক্ষণ জ্বলার পর হঠাৎই একই রকমভাবে বিস্ফোরিত হয়ে বাল্বটি ভেঙে গেল। পরপর দুদিন একই ঘটনা ঘটতে দেখে পরদিন ভদ্রলোক একজন স্থানীয় ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে ডাকলেন। ঘরে ডি সি বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। মিস্ত্রীর পরামর্শে সুইচ বক্স পালটানো হল কারণ বক্সটি নাকি আলগা হয়ে গেছে এবং সেকারণেই যত বিপত্তি। বক্স পালটানোর পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতেই লাগল। অর্থাৎ দুটো-তিনটি করে ছোট বাল্ব প্রতিদিন ফেটে যায়। এভাবে দিন দশেকের মধ্যে প্রায় কুড়িটি বাল্ব ভেঙে যাওয়ার পর তিনি বাল্ব লাগানোই বন্ধ করে দিলেন। এবারে আক্রমণ শুরু হল টিউব লাইটের ওপর। পর পর তিনটি টিউবলাইট ভেঙে যাওয়ার পর ডি সি লাইনের একজন দক্ষ মিস্ত্রিকে ডেকে আনা হয়। তাঁর পরামর্শে টিউবের চোক বদলানো হয়। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। এর মধ্যে পাড়ার কিছু লোকজন ভুতুড়ে বাড়ি বলে বাড়িটিকে চিহ্নিত করে ফেলতে শুরু করলেন এবং তাঁদের ও বাড়িওয়ালার চাপে ভদ্রলোক জনৈক ওঝাকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে বাধ্য হন। ওঝা প্রচুর মন্ত্র পড়ে কিছু লেবু ও লঙ্কা ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে দিয়ে যান। কিন্তু ঘটনা থেমে থাকল না। বরং পরবর্তী ঘটনাগুলি বিচার করলে বলা যায় যে ওঝারে মন্ত্র পড়ার পর তাণ্ডব আরও বৃদ্ধি পেল। এরপর একদিন লোডশেডিং চলাকালীন বাড়িতে ডিমলাইট বা কেরোসিনের বাতি জ্বলছিল। হঠাৎ চিমনীর কাঁচটি শব্দ করে ফেটে গেল। দেওয়ালের একটি ছোট বুক-শেলফ্ শক্ত করে লাগানো ছিল। শেলফ্টিতে দুটি কাচের ঢাকনা ছিল। হঠাৎ একদিন দুপুরবেলায় দুটি কাচের ঢাকনাই কিছু সময়ের ব্যবধানে ভেঙে গেল। ঘরের মেঝেতে একটি কাচের কাপ-ডিস বোঝাই ছোট আলমারি ছিল। একদিন রাত্রিবেলা গোটা আলমারিটা আছাড় খেয়ে পড়ে গেল এবং তার ভেতরের সমস্ত কাচের জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কাচের উপর এই অদৃশ্য শক্তির আক্রমণ ইদানীং চরম আকার ধারণ করেছে। সেই ঘরে তিনটি বড় আলমারি আছে। দুটি কাচবিহীন। একটিতে কাচের আয়না ছিল। গোটা আলমারিই জিনিসপত্রে ঠাসা। এই ভারি আলমারিতে হঠাৎ একদিন দুপুরবেলায় দেখা গেল আলমারির কাচে, ভেতরদিক থেকে গোল হয়ে একটি গর্ত হয়ে গেল এবং কাচ গুঁড়ো হয়ে পড়তে শুরু করল। এর কিছুক্ষণ পরে গোটা আলমারি মাটি থেকে উঠে উলটে পড়ে গেল। কাচের আয়নাটির উপরদিকটি ভেঙে গেল। যাই হোক আলমারিটিকে যথাস্থানে আবার বসানো হল। এরপর দুদিন আলমারিটি পড়ে গেছে এবং শেষবারে সমস্ত কাচের অংশটিই গুঁড়িয়ে গেছে। যদিও আলমারিটি প্রায় দশ বছর ধরে ওই জায়গাতেই রয়েছে এবং কোনভাবেই সেটিকে ভারসাম্যবিহীন অবস্থা বলা যায় না। এখন ঘরটির মধ্যে আর কোন কাচের সামগ্রী অক্ষত অবস্থায় নেই। অবশ্য চশমার কাচ এখনও ভাঙেনি। প্রায় দেড়মাসব্যাপী এই অদ্ভুত ঘটনায় সত্তরটি বাঘ, ষোলটি টিউব, তিনটি চিমনি ও অন্যান্য কাচের জিনিসপত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। এবং প্রথম দিকের ঘটনার থেকে এখনকার ঘটনার সংখ্যা এবং জোর অনেক বেশি। যেমন প্রথম দিকে বাল্বগুলি ফুটো হয়ে যাচ্ছিল এখন ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে হঠাৎ ঘরের পাখাটি অস্বাভাবিক ভাবে দুলতে শুরু করে। যদিও সেসময় কোন হাওয়া বইছিল না এবং পাখাটিও চলছিল না। দুর্ঘটনা এড়াতে এরপর পাখাটি খুলে রাখা হয়। এর মধ্যে অনেক দক্ষ ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার ঘরটি দেখে গেছেন। গোটা ঘরে ওয়্যারিং বা সরবরাহ লাইনের পরিবর্তন করে নতুন তার লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন যন্ত্রের পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে বৈদ্যুতিক সংযোগে কোন আপাত-গন্ডগোল নেই। ঘরে রেডিও বা টেপরেকর্ডারে কোন সমস্যা নেই। বাসিন্দা তিনজনের শরীরেও কোনও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নেই। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল একসাথে কোন জিনিস ভাঙছে না। একটি একটি করে কাচের জিনিস ফেটে যাচ্ছে। বাল্ব ভাঙার ক্ষেত্রে আলোর জোরটা প্রথমে বেড়ে যাচ্ছে এবং তারপরে বাল্ব ফেটে যাচ্ছে। প্রথম দিকে কাচগুলি খণ্ডে খণ্ডে ভাঙছিল। এখন মিহি গুঁড়ো হয়ে ভাঙছে।
ঘরটি দোতলায় অবস্থিত। এর নিচে ও উপরে দুটি একই আয়তনের ঘর রয়েছে। ঘরটির দুপাশেও ঘর রয়েছে। এই সমস্ত ঘরগুলিতে এই ধরনের কোন অসুবিধা নেই। ঘরটির সুইচ বোর্ড থেকে লাইন টেনে বারান্দায় আলো জ্বালানো হচ্ছে, সে আলো একবারও ভেঙে যায়নি। এমনকি ঘরের দরজায় পরীক্ষামূলক ভাবে একটি বাল্ব জ্বলানো হয়েছিল সেটিও এখন পর্যন্ত অক্ষত। প্রকৃতপক্ষে এই আলোটিই বাসিন্দাদের রাত্রিবেলার একমাত্র সহায়। এযাবৎ এই ধরনের কোন ঘটনাই শুধু সে বাড়ি কেন গোটা অঞ্চলের কোন বাড়িতেই দেখা যায়নি। ঘটনাটি প্রত্যক্ষভাবে দেখার জন্য একটি বাধ এবং একখণ্ড কাচ সে ঘরে রাখা হয় এবং দেড়ঘণ্টার মধ্যে সেগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই অদ্ভুত রহস্যের খবর ইতিমধ্যে বিজ্ঞানী মহলেই কিছু পরিমাণে পৌঁছেছে এবং সকলেই এই রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে বিভিন্ন পরীক্ষাও শুরু করেছেন। কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের তৎপরতায় এই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু এই দেড়মাস ধরে ঘরটির তিন বাসিন্দা এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও মানসিক অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে কিছু ব্যক্তি ঘটনাটিকে ভুতুড়ে বলে চিহ্নিত করে তাদের উপর নানা রকম চাপ সৃষ্টি করছেন। কিন্তু তাঁরা একমুহূর্তের জন্যও মানসিক দুর্বলতা প্রকাশ করেননি এবং তাঁরা স্থিরনিশ্চিত যে, ঘটনাটির সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই বের হবে।’
‘গণশক্তি’র সংবাদ সূত্র ধরে পরের দিনই দমদমের ভূতুড়ে বাড়ির বড়সড় এক খবর ছাপল ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা। এতে দু-চারটি নতুন তথ্য পরিবেশিত হল। অমিয়শংকর রায় একজন সক্রিয় সি পি আই (এম) সদস্য। থাকেন দক্ষিণ দমদমের একটি ত্রিতল বাড়ির এক ঘরের ফ্লাটে। গত ১৮ অক্টোবর ঘটনার শুরু। অমিয়বাবু গিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে সংবর্ধনা জানাতে। সে রাতে বাল্ব ফাটা দিয়ে কাচ ভাঙার শুরু।
ইতিমধ্যে ২৮, ২৯ এবং ৩০ তারিখেও গণশক্তি পত্রিকায় এই ঘটনা ছবিসহ যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হল। ড. এস.পি. গণচৌধুরী, ড. দিলীপ বসু, ড. মধুসূদন ভট্টাচার্য, ড. তারাশঙ্কর ব্যানার্জির মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানার রহস্য ভেদ করতে কাচ-হস্তা ঘরটিতে পরীক্ষা চালিয়েছেন বলে প্রকাশিত হয়। সেই সঙ্গে কখনও প্রকাশিত হল—তাঁরা কারণ খুঁজে বের করতে পারেননি, কখনও প্রকাশিত হল—ঘরে পরীক্ষা চালাতে গিয়ে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছেন।
ইতিমধ্যে স্থানীয় কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতা রহস্য উন্মোচনে আমার সাহায্য চাইলেন। ২৭ নভেম্বর আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে ঘরটি দেখতে যাব জানাই। সেদিন সন্ধ্যায় ঘরটি ও তার আশপাশের পরিবেশের উপর পরীক্ষা চালাই।
কাচ ভাঙে কিসে? অবধারিতভাবে এটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কাচ ভাঙতে পারে অনেক কারণে। কারণগুলো একটু দেখা যাক : (১) উচ্চ শব্দতরঙ্গের আঘাতে। (২) বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ কাচে লাগিয়ে রাখলে। (৩) কাচের তাপমাত্রার হঠাৎ প্রচণ্ড রকম পরিবর্তন ঘটলে। (৪) আঘাত করলে। (৫) কোয়ার্জ (কাচ কাটা পাথর) দিয়ে আঁচড় কাটলে।
কাচের বাল্ব ভাঙতে পারে কী কী কারণে, একটু দেখা যাক : (১) কোন কারণে যদি বৈদ্যুতিক লাইনে বেশি ভোল্টেজ প্রবাহিত হতে থাকে তবে অনেক সময় বাল্ব ফেটে যায়। (২) জ্বলন্ত গরম বাল্বে ঠান্ডা জলের ছিটে দিলে বাল্ব ফাটবে। (৩) আঘাত করে বাল্ব ফাটানো সম্ভব। তবে ওভার-ভোল্টেজে বা অনেকক্ষণ ধরে জ্বলে থাকা নিয়নে ঠান্ডা জল ছিটোলে নিয়ন ফাটবে না।
কাচগুলো কেমনভাবে ভাঙছে, এটা বোঝার জন্য ভাঙা কাচের টুকরোগুলো পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কাচ ভেঙে যাওয়ার আগে-পরে কাচগুলো যাঁরা দেখেছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলাও একইভাবে প্রয়োজনীয়।
অমিয়শংকরবাবু দমদম স্টেশনের লাগোয়া কালীকৃষ্ণ শেঠ লেনের ৯১/৬ নম্বর বাড়ির দোতলার একটি ঘর নিয়ে থাকেন। ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম দরজার ওপরে তথাকথিত ‘লাকি নাম্বার’ ৭৮৬ লেখা। আনুমানিক ১০ ফুট বাই ৮ ফুট ঘরের মধ্যেই অমিয়বাবুর পুরো সংসার।
অমিয়বাবু সকালেই খবর পেয়েছিলেন সন্ধ্যায় যাব। পরিচয় দিতেই আপ্যায়িত করলেন। অমিয়বাবু দক্ষিণ দমদম পুরসভার হিসেবরক্ষকের চাকরি করেন। স্ত্রী তৃপ্তি রায় দমদমের প্রাচ্য বাণীমন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান। ছেলে সৌম্য দমদমের কে.কে. হিন্দু অ্যাকাডেমির ছাত্র, এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। অমিয়বাবু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। সিপিআই(এম)-এর স্থানীয় কমিটির সদস্য। তৃপ্তি দেবীর হাতে গ্রহরত্নের আংটি। দেখলেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহার করছেন। ছেলে সৌম্য বাড়ি ছিল না। শুনলাম, পড়াশুনোর অসুবিধে হচ্ছিল বলে তাকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাখা হয়েছে কাল বিকেল থেকে।
অমিয়বাবুর বাড়ির অবস্থান দেখে নিশ্চিত ছিলাম— কাচ ভাঙার ক্ষেত্রে শব্দতরঙ্গের কোনও ভূমিকা নেই। অনেক সময় বিমানবন্দরের খুব কাছের বাড়ির কাচের শার্সি বা জিনিস-পত্তর ভাঙে বিমানের তীব্র শব্দ-তরঙ্গের আঘাতে। অমিয়শংকরবাবুর এই ঘরটি বিমানবন্দরের কাছে নয়। বিমানের শব্দ এখানে বাসের শব্দের চেয়েও মৃদু। কাছেই রেললাইন। কিন্তু ট্রেনের শব্দে ঘর কাঁপে না, কাঁপে না সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া পাতলা কাচের শিশি—পরীক্ষা করে দেখেছি। বাড়ির ধারে-কাছে কোনও কারখানা নেই, যেখান থেকে তীব্র শব্দতরঙ্গ তৈরি হতে পারে। অতএব শব্দতরঙ্গকে ভাঙার কারণ হিসেবে বাদ দিতেই হয়।
রাসায়নিক পদার্থ যেমন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড কাচে দিলে কিছু সময় পরে কাচ ফাটতে পারে। এ-ক্ষেত্রে অ্যাসিড প্রয়োগের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি মানুষের উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন।
অমিয়শংকরবাবুর ঘরের বাল্বের কাচ ওভার-ভোল্টেজের দরুন ভাঙতে পারে। কিন্তু ৭১ বার ওভার ভোল্টেজে ভাঙা সম্ভব নয়। কারণ ইতিমধ্যে বহুবার মাপা হয়েছে। বহু বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, সংস্থা ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ভোল্টেজের বিষয়ে পরীক্ষা করেছেন। লাইন-লিকেজ কি না, সে বিষয়েও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। ভোল্টেজে কোনও অস্বাভাবিকতা বা লাইনে কোনও লিকেজ পাওয়া যায়নি। গোটা ঘরের ওয়্যারিং করা হয়েছে নতুন করে। ভোল্টেজ পরীক্ষা করে দেখেছি, ১৭৫। অতএব অমিয়বাবুর ঘরের ওয়্যারিং নতুন করার পরও কাচের বাল্ব ফাটার জন্য বাড়তি ভোল্টেজকে আদৌ দায়ী করা চলে না। কিন্তু অমিয়বাবুর দাবি মতো নতুন ওয়্যারিং-এর পরও বাল্ব ফেটেছে। আরও একটা তথ্য অমিয়বাবু জানালেন, এই ঘরের লাইন থেকে তার টেনে বাইরের বারান্দায় বাল্ব জ্বালালে তা ভাঙছে না। বৈদ্যুতিক লাইনের ত্রুটিতে বাল্ব ফাটলে সেই ত্রুটিপূর্ণ লাইন থেকে টানা বাইরের বাল্বও ফাটবে। একই লাইন থেকে টানা সত্ত্বেও ঘরের বাল্ব কাটছে, বাইরের বাল্ব নয়, এমনটা হতে পারে বাল্ব ফাটানোর পিছনে মানুষের হাত থাকলে। ঘর স্যাঁতসেঁতে বা দূষিত গ্যাসে পূর্ণ নয়। যথেষ্ট খোলামেলা।
বিদ্যুতের গোলমালে বাল্ব ফাটতে পারে, কিন্তু বুক-কেস, আলমারির কাচ বিদ্যুতের গোলমালে ফাটার কোনও সম্ভাবনা নেই। চিমনি, আয়না এবং অন্যান্য কাচের জিনিস ফাটার ক্ষেত্রেও বিদ্যুতের ত্রুটিকে কোনওভাবেই দায়ী করা যায় না। কাঠের আলমারি নাকি আপনা থেকেই চারবার পড়ে গেছে। সিলিং ফ্যান আপনা থেকে দুলছে। ঘরে তখন কোনও জোরালো হাওয়া ছিল না। ফ্যানও ঘুরছিল না। বিদ্যুতের গোলমালে এমন কিছু ঘটা সম্ভব ছিল না। কাঠের আলমারিতে ভারসাম্যের কোনও অভাব ছিল না। পরীক্ষা করে দেখেছি। আরও লক্ষণীয়, ঘরে একটি বড় স্টিলের আলমারি ছিল। স্টিলের আলমারি কিন্তু একবারও পড়েনি। কারণ একজনের পক্ষে স্টিলের আলমারি ঠেলে ফেলে দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। ছোট কাঠের আলমারি ফেলা যথেষ্ট সহজসাধ্য। ফ্যান দোলাতে, আলমারি ফেলতে একান্তভাবে প্রয়োজন মানুষের যে ফ্যান দোলাবে, আলমারি ফেলে দেবে।
আলমারির কাচ ভেঙেছে অদ্ভুতভাবে। একদিকের পাল্লা কাঠের। অন্য দিকের পাল্লায় ওপরে-নিচে দুটি কাচ। হঠাৎ একদিন বাড়ির লোকদের চোখে পড়ল, ওপরের কাচে একটা বৃত্তাকার দাগ। দাগের আশেপাশে কয়েকটা আঁচড়। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা গেল ওপরের কাচটা ভেঙে পড়েছে। দু-একদিন পরেই ভাঙল নিচের কাচটা। এ-কথাগুলো অমিয়বাবু ও তৃপ্তি দেবীর কাছ থেকেই শোনা।
আলমারির কাচের কয়েকটা টুকরো হাতে নিয়ে সামানা নজর দিতেই বুঝলাম আলমারির কাচ সরাসরি আঘাত করে ভাঙা নয়। প্রথমে কোয়ার্জ (কাচ-কাটা পাথর) দিয়ে গোল দাগ ফেলা হয়েছে এবং আঁচড় কাটা হয়েছে। তারপর একসময় সুযোগে বুঝে সামান্য আঘাত করা হয়েছে। ফলে কাচ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। টুকরোগুলোর ভাঙা অংশের কিছুটায় কোয়ার্জে কাটার চিহ্ন স্পষ্ট। বাকি অংশ আঘাত করে ভাঙার ফলে চল্টা উঠে গেছে।
ওপরে দেওয়ালে টাঙানো ছোট্ট বুক-কেসটার পাশাপাশি দুটো কাচ লাগানো ছিল। কাচগুলো দুদিকে সরানো যায়। ওগুলোর ভাঙা টুকরো দেখিনি। শুনেছি প্রথমে একপাশের কাচ ভেঙে পড়েছিল। তারপর অন্য পাশের। দেখিনি, তাই বোঝা সম্ভব ছিল না ওই কাচ ভাঙার ক্ষেত্রেও ‘কাচ-কাটা পাথর’ ব্যবহার করা হয়েছিল অথবা সরাসরি আঘাত করা হয়েছিল অথবা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছিল।
অমিয়বাবু ও তৃপ্তি দেবীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি ১৮ অক্টোবর রাতে প্রথম বাল্বটা ফাটার ক্ষেত্রেই শুধু তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী। ঘরে ঢোকার মুহূর্তে বাল্বটা বিরাট শব্দ করে ফেটে গিয়েছিল। আর কোনও একট দুর্ঘটনারও তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী নন। সিলিং ফ্যান দুলেছে— অমিয়বাবু ও তৃপ্তি দেবী দেখেছেন। কিন্তু ছেলের চিৎকারে ঘরে ঢুকে দেখেছেন। আলমারি পড়তে তাঁরা দুজনের কেউই দেখেননি। দেখেছেন পড়ার পর। ঘরে তখন ছিল ছেলে সৌম্য৷ দুজনে ঘটনাগুলো নিজের চোখে ঘটতে দেখেছেন বললেও অবশ্য তাঁদের কথাকে অভ্রান্ত সত্যি ধরে নিয়ে বিচার করতে বসতাম না। কারণ মানুষের বাড়িয়ে বলার প্রবণতা, প্রত্যক্ষদর্শী বলে জাহির করার প্রবণতা থেকে মিথ্যে বলার বিষয়ে যথেষ্ট অবগত। আমি জেরা করার মতো করে প্রশ্নের ঝড় তুলিনি। নানা কথার ফাঁকে ফাঁকে আমার প্রয়োজনীয় উত্তরগুলো বের করে নিচ্ছিলাম। সম্ভবত অমিয়বাবু ও তৃপ্তি দেবী সচেতন ছিলেন না, আমি ঠিক কী জানতে চাইছি।
ঘরে বর্তমানে কোনও কাচের জিনিস নেই বাল্ব ছাড়া। পরীক্ষা করতে কোনও কাচের জিনিস নিয়ে যাইনি। শুনলাম, কাচের জিনিস রাখলে নাকি আধ ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে যায়। একটি বাল্ব অবশ্য গতকাল বিকেল থেকে অক্ষত অবস্থায় ঘরে বিরাজ করছে। বাল্বটি নাকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয়েছে। এও শুনলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বেই নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিজ্ঞানী কাচ ভাঙার রহস্য অনুসন্ধানে নেমেছেন। কিন্তু এ কথার মধ্য দিয়েও একটা প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ পেল--কাল সন্ধে থেকে সৌম্য বাড়িতে নেই, কাল সন্ধে থেকে আজ রাত পর্যন্ত বাল্বটি ভাঙেনি।
অমিয়বাবু ও তৃপ্তি দেবীকে ভরসা দিলাম, কোনও চিন্তা নেই। ভাঙার কারণ ধরতে পেরেছি বলে আশা করছি। আপনারা যদি সহযোগিতা করেন, তাহলে আগামী রবিবার থেকেই কাচ ভাঙা বন্ধ করতে পারব।
পরিপূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস পেলাম। বললাম, রবিবার সকাল দশটায় আসব। আলমারি ও বুক-শেলফের সমস্ত কাচ সেদিন আবার লাগানোর ব্যবস্থা করুন। ঘণ্টা ছয়েক থাকব। নিশ্চিন্তে থাকুন, সে-সময়ের মধ্যে কিছুই ভাঙবে না।
কেন ভাঙছে? দুজনের প্রশ্নের উত্তরেই জানালাম, সে-দিনই ছ-ঘণ্টা পার করে দিয়ে তারপর জানাব।
অমিয়বাবু জানালেন, শনিবারই সব কাচ লাগিয়ে রাখবেন। বললাম, তেমনটি করবেন না। শনিবার কাচ ভাঙতেই পারে। এমনকী, সব কাচই। কাচের মিস্ত্রিকে এনে মাপ দিয়ে কাচ কাটিয়ে রাখুন। রবিবার আমার সামনে লাগানো হবে। মিস্ত্রিকে বলবেন দশটায় আসতে।
ঘর থেকে বেরোতেই উপস্থিত সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলেন। জানতে চাইলেন, ভাঙার কারণ ধরতে পেরেছি কি না। জানালাম, আগামী রবিবার সকাল দশটায় আমাদের সমিতির তরফ থেকে কয়েকজন আসছি। আমাদের সামনে আবার নতুন করে ভেঙে যাওয়া সব কাচ লাগানো হবে। ছ’ঘণ্টা থাকব। এতদিন পর্যন্ত ঘরের কাচ আধ ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ভাঙছিল। কিন্তু আশা করছি সে-দিন ওই দীর্ঘ ছ’ঘণ্টার মধ্যেও কোনও কাচই ভাঙবে না। বিকেল চারটের সময় জানাব কেন ভাঙছিল। এর আগে আর কিছু জানাচ্ছি না। সাংবাদিকরা এ প্রশ্নও করছেন, রবিবার কেন? কেন এই চারদিন সময় চেয়ে নিচ্ছেন? কেন কালই বন্ধ করতে আসবেন না? বললাম, আগামীকাল রবিবার হলে আগামীকালই আসতাম। ছুটির দিন ছাড়া আমার এবং আমাদের সমিতির অনেকের পক্ষেই দীর্ঘ ছ-আট ঘণ্টা সময় বের করা খুবই অসুবিধেজনক।
পরের দিন গণশক্তির প্রথম পৃষ্ঠাতেই আমাদের সমিতির পক্ষে আমার ‘কাচ ভাঙা রহস্যময় বাড়িতে যাওয়ার কথা’ এবং ‘কয়েক দিনের মধ্যেই রহস্য উন্মোচিত হবে’ বলে আশা প্রকাশ করার কথা প্রকাশিত হল।
ইতিমধ্যে আমাদের সমিতির কিছু সদস্য অমিয়বাবুর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলল। কথা বলল সৌম্যের স্কুলের কিছু ছাত্রের সঙ্গে। গণশক্তির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল—প্রতিবেশীদের চাপেই অমিয়বাবু ওঝা ডেকেছিলেন। প্রতিবেশীদের বক্তব্য, এমন চাপ তাদের দিক থেকে কখনওই দেওয়া হয়নি। সৌম্যের বিষয়েও প্রতিবেশী বা ছাত্রদের ধারণা মোটেই ভালো নয়।
শনিবার সন্ধ্যায় অমিয়বাবুর বাড়ি হাজির হলাম, কাচ লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে কি না জানতে। বাড়িতে ছিলেন শুধু তৃপ্তি দেবী। জানালেন মিস্ত্রি মাপ নিয়ে গেছে। কাল দশটার মধ্যে ওরা চলে আসবে। আপনার সামনেই কাচ লাগানো হবে। আপনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন এবং রবিবার আসবেন শুনে সৌম্য আপনাকে দেখবে বলে দারুণ বায়না ধরেছে। আসলে আপনার কথা তো অনেক পড়েছে, তাই আপনাকে দেখতে চায়। আপনি কিভাবে কাচ ভাঙা বন্ধ করেন, সেটা নিজের চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। বললাম, বেশ তো, ওকে নিয়েই আসুন।
তৃপ্তি দেবী জানালেন, দূরদর্শন থেকে একজন এসেছিলেন। রবিবার কিছু ছবি তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁকে জানিয়েছি, সে-দিন প্রবীরবাবু সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ-বাড়িতে একটা পরীক্ষা চালাবেন। অতএব প্রবীরবাবুর সঙ্গে কথা না বলে, তাঁর অসুবিধে হবে কি না না জেনে ওইদিন আপনাদের ছবি তোলার অনুমতি দিতে পারছি না।
১ ডিসেম্বর শনিবার বসুমতী পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠাতেই খবর পরিবেশিত হয় ২ ডিসেম্বর কাচভাঙা ঘরে কাচের জিনিসপত্র রাখা হবে এবং সেই সঙ্গে আলমারির ভেঙে যাওয়া কাচও নতুনভাবে লাগানো হবে। সমিতির প্রতিনিধিরা ওইদিন ঘরে ৬ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করবেন, ইত্যাদি।
২ ডিসেম্বর রবিবার সকালে The Telegraph পত্রিকার প্রায় আধ পৃষ্ঠা ধরে প্রকাশিত হল একটি সচিত্র প্রতিবেদন ‘POLTERGEIST’। প্রতিবেদক প্রণয় শর্মা প্রতিবেদনটিতে জানালেন, 'ইতিমধ্যে সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংস্থার তরফ থেকে বিজ্ঞানীরা ঘরটি দেখতে গিয়েছিলেন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কিন্তু এ-পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।
‘কিন্তু গত কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সায়েন্স অ্যান্ড র্যাশনালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রবীর ঘোষের দৃশ্যপটে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে। এই যুক্তিবাদী ওই পরিবারের সদস্যদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি ২ ডিসেম্বরের মধ্যে রহস্যভেদ করবেন। তিনি শ্রীরায়কে বাল্ব টিউবলাইসহ সমস্ত কাজের সামগ্রী তাঁর উপস্থিতির দিন লাগাতে বলেছেন।’
২ ডিসেম্বর রবিবার সকাল দশটায় অমিয়বাবুর ফ্ল্যাটে হাজির হলাম আমি ও আমাদের সমিতির কিছু সদস্য। আজই প্রথম দিনের আলোয় ঘরটি দেখলাম৷ অমিয়বাবুর ঘরে দরজার পাশেই কালো কালি দিয়ে কাঁচা হাতের কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা। বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে আলমারি ও বুক-কেসের সব কাচ লাগানো হল। তবে কাচ লাগানোর আগে প্রতিটি কাচ ভালোমতো স্পিরিট দিয়ে মুছে নিয়েছিলাম। ঘরের বাল্ব ও টিউবলাইট জ্বেলে দেওয়া হল। ঘরের বাশ্বের হোল্ডার থেকে দড়ি দিয়ে একটা আয়না ঝুলিয়ে রাখা হয়। যে আলমারি উল্টে পড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেই আলমারির মাথায় রাখা হয় কেরোসিন ল্যাম্পের একটি চিমনি। তার পর চলে অপেক্ষা। ঘরে সাংবাদিকরা, অমিয়বাবু ও সৌম্য ছাড়া মাঝে-মধ্যে ছিলেন তৃপ্তি দেবী ও অমিয়বাবুর পরিচিত কেউ কেউ। ভিডিও-তে ছবি তোলা হয়েছে ‘আজকাল’ পত্রিকার তরফ থেকে। সৌম্যের ডান বাহুতে একগাদা তাগা তাবিজ ঝোলানো। শেকড় ঝোলানো ছিল বারবার উল্টে পরা কাঠের আলমারিতে। অমিয়বাবু আন্তরিক আতিথেয়তা দেখিয়ে আমাদের দফায় দফার চা, সিগারেট ও রসগোল্লা খাইয়েছেন। ঘরে আমাদের সমিতির পক্ষে ছিলেন জ্যোতি মুখার্জি, কমল বিশ্বাস, আশিস মুখার্জি, দেবু হালদার ও জাদুকর শুভেন্দু পালিত। ওঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল প্রতিটি কাচের জিনিসের ওপর লক্ষ্য রাখা। সমিতির সভ্য ছাড়া যাঁরাই ঘরে উপস্থিত থাকবেন তাঁদের কারও ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ধাক্কায় বা আঘাতে যেন কোনও কাচের জিনিস ভেঙে না যায় অথবা কোনও আসবাব উল্টে না পড়ে, এ-দিকে নজর রাখার দায়িত্বও ছিল ওঁদের ওপর। সারা ঘরে ছড়িয়ে রাখা কাচের সামগ্রীর কোনও একটিকে ঠাসা ভিড়ের সুযোগে স্রেফ আঘাত হেনে ভেঙে ফেলা বা কোনও জিনিস উল্টে ফেলে দেওয়া এমন কোন কঠিন কাজ নয়। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন নজর রাখা। এই ঘটনার পিছনে মানুষের হাত থাকলে, সেই হাতের মালিক কে হতে পারেন, এ বিষয়ে যুক্তিগুলো সাজালেই অনুমান করা যায়, এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য অনুমানের হদিশ পেয়ে ঘটনার নায়ককে বাঁচাতে আমাদের ধোঁকা দিতে আজ অন্য কেউ কাচ ভঙ্গকারীর ভূমিকা নিতে পারে। আর এটা মাথায় রেখেই দুদিন আগে নজরদারির দায়িত্ব যাঁদের দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের নিয়ে ক্লাস করেছি। ব্ল্যাক বোর্ডে রহস্যময় ঘরটির কোথায় কী আছে এবং কোথায় কোথায় কাচ লাগানো হবে, কাচের সামগ্রী রাখা হবে তার ছবি এঁকে কে কেমনভাবে নজর রাখবেন, তা বুঝিয়েছি। নজরদারদের কেউ কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেলে পরিবর্ত হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কয়েকজনকে ‘রিজার্ভ’ রেখেছি। বাইরে দর্শকদের মধ্যে মিশে থাকা সমিতির সদস্যদের পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শশাংক মণ্ডলকে। নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে সমিতির পক্ষ থেকে কাছ ভাঙার রহস্যের আবরণ সরালাম। বললাম কাচ ভাঙে কী কী কারণে। জানালাম, এ ঘরের কাচ শব্দ-তরঙ্গে ভাঙছিল না। এমন সিদ্ধান্তে আসার পক্ষে যুক্তিগুলো হাজির করলাম। ওভার-ভোল্টেজে ঘরের যে কোনও কাচের জিনিস ভাঙা, আলমারি বারবার উলেট দেওয়া, চালু না হওয়া সিলিং ফ্যান দোল খাওয়ানো অসম্ভব। ওভার-ভোল্টেজের দরুন কাচের বাল্ব প্রথম দু-একবার ভাঙলেও ভাঙতে পারে। কিন্তু প্রতিটি বাল্ব ও টিউবলাইট যে ওভার-ভোল্টেজে ভাঙছিল না, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভোল্টেজ পরীক্ষা করা হয়েছে, লাইন পাল্টানো হয়েছে। অথচ লাইন পাল্টানোর পরও বাল্ব ও নিয়ন ফেটেছে। অথচ লক্ষ্য করুন, এই একই লাইন থেকে তার টেনে বাল্ব বাইরে সবার চোখের সামনে রাখলে ও জ্বালালে ফাটছে না। বিদ্যুৎ লাইনে গোলমাল থাকলে, এক্ষেত্রে বাইরের বাল্ব ও ফাটত।
তীব্র শব্দের প্রভাবে কাচ ভাঙার সম্ভাবনা এখানে শূন্য। আশে-পাশে কল-কারখানা রেল ও বিমানের এমন কোনও তীব্র শব্দ সৃষ্টি হয় না, যার দরুন কাচ ভাঙতে পারে। রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে কাচ ভাঙা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু আপনারা ভাঙা কাচের টুকরোগুলো একটু লক্ষ্য করুন।
‘বর্তমান’ পত্রিকার বার্তা-সম্পাদক রূপকুমার বসুর হাত থেকে তাঁর সংগৃহীত দুটুকরো কাচ নিয়ে সাংবাদিকদের দেখালাম। কাচগুলো দেখলেই বোঝা যায় এই কাচগুলো ভাঙার আগে কিছু দিয়ে অনেকটা কেটে রাখা হয়েছিল। বাকিটা ভেঙেছে আঘাতে, চলটা ওঠা দেখলেই বোঝা যায়। এই যে টুকরোগুলো দেখলাম, এগুলো কাঠের আলমারির ভাঙা কাচের টুকরো। আলমারির কাচ ভেঙেছে একটু অদ্ভুতভাবে। আলমারির এক দিকের পাল্লায় ওপরে-নিচে কাচ লাগানো দেখতে পাচ্ছেন। হঠাৎ একদিন দেখা গেল ওপরের কাচে একটা স্পষ্ট গোল দাগ কাটা, তার আশে-পাশে কয়েকটা আঁচড়। তারপর একদিন তলার কাচেও একই ধরনের দাগ দেখা গেল। একদিন দেখা গেল ওপরের গোল দাগের অংশটা ভেঙে পড়েছে। তলার কাচটাও একদিন ওভাবেই ভাঙল—কাচের মাঝখানে একটা বড় গোল ফুটো। কাচের ওপর কি দিয়ে দাগ কাটা যায়? কোয়ার্জ (কাচকাটা পাথর) পাঁথর দিয়ে কাটা যায়। এই শহরে অনেক জায়গাতেই কাচকাটা পাথর বিক্রি করেন কিছু ভিন্ প্রদেশী মহিলারা। এক টাকা থেকে দু-টাকা দাম। এমনকী, দমদম স্টেশন চত্বরেই ওই পাথর বিক্রি হয়। ফটোর দোকানে কাচ কাটার জন ছোট একটুকরো কাঠের আগায় হীরে লাগানো থাকে। অমন একটা কাচ-কাটার যন্ত্র জোগাড় করা এমন কিছুই কঠিন নয়। কোয়ার্জ জাতীয় কোনও কিছু দিয়ে কাচে গোল করে দাগ কেটে রাখলে কাচের অনেকটাই কেটে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে বৃত্তের মাঝে একটি আঘাত করলেই কাচ ভেঙে যাবে বৃত্তের আকারে। আলমারির কাচ ভাঙার ক্ষেত্রে কোয়ার্জ জাতীয় পাথরই ব্যবহৃত হয়েছিল।
কথার মাঝখানে প্রতিবাদ করলেন উত্তেজিত অমিয়বাবু, আপনি এভাবে কাচ কেটে দেখাতে পারবেন?
বললাম, নিশ্চয়ই পারব। আপনি অনুমতি দিলে করে দেখাতে পারি।
না, অনুমতি দেননি অমিয়বাবু। বরং বললেন, বুক কেসের কাচ তো গোল হয়ে ভাঙছিল না। ওটার কী ব্যাখ্যা দেবেন?
বলেছিলাম, ভাঙা কাচগুলোর একটা অংশ গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গেছে। জোরালো আঘাত করলে আঘাতস্থলের কাচ গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে।
অমিয়বাবুর আত্মীয় বলে পরিচিত এক ভদ্রলোক জোরালোভাবে আমার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। বললেন, কাচগুলো কেউ আঘাত দিয়ে ভাঙার সময় তার পক্ষে আদৌ কি এমন ক্যালকুলেশন করে আঘাত করা সম্ভব যার দরুন গুঁড়ো হয়ে যাবে? আপনার এই থিয়োরি আদৌ মানতে পারছি না। অমিয়বাবু মুখ খুললেন, আপনি এই রকম গুঁড়ো করে ভেঙে দেখাতে পারবেন?
বললাম, আমি আপনাদের দুজনের কথারই উত্তর দেব। অমিয়বাবুর আত্মীয়কে বললাম, আঘাতে কাচটা সাত টুকরো হয়ে ভাঙলে আপনি প্রশ্ন করতেন, কাচটা ঠিক সাতটুকরো হয়ে ভাঙল কেন? কেন দু'টুকরো বা পাঁচ টুকরো নয়? এ-ভাবে ক্যালকুলেশন করে কি ভাঙা সম্ভব? ভাঙার সময় কেউ ক্যালকুলেশন করে ভাঙে না, এক্ষেত্রেও ক্যালকুলেশন করে ভাঙেনি। মেরেছে এবং ভেঙেছে। আর অমিয়বাবুর উত্তরে জানাচ্ছি, উনি অনুমতি দিলে এইভাবে গুঁড়ো-গুঁড়ো করেই ভেঙে দেখিয়ে দিতে পারি।
অমিয়বাবু আর এগোলেন না। তবে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, আর আলমারিটা পড়ল কী করে?
ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তাই পড়েছে।
একজনের পক্ষে ঠেলে ফেলে দেওয়া আদৌ সম্ভব? আপনি ফেলতে পারবেন?
বললাম, আমি তো পারবই, এখানে উপস্থিত আমাদের সমিতির যাকে সবচেয়ে দুর্বল বলে আপনার মনে হয়, তাকেই ডেকে নিন, দেখবেন সেও ফেলে দেবে।
আর বাল্বগুলো ফাটছিল কী করে? অমিয়বাবু প্রশ্ন করলেন।
এখানেও মানুষের হাত ছিল। ফাটানো হচ্ছিল বলেই ফাটছিল।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অমিয়বাবু জানালেন তাঁর ধারণা বাল্ব থেকেই কোনও একটা অজ্ঞাত রশ্মি বেরিয়ে এসে আলমারি উল্টে দিয়েছে, কাচগুলো ভেঙেছে। সৌম্যেরও বক্তব্য ছিল ওই ধরনের। সৌম্যের কথামতো ও দেখেছে বাল্ব থেকে একটা হলদে রশ্মি বেরিয়ে এসে আলমারিতে আঘাত করেছে।
ফ্যান দোলার ব্যাখ্যাও চেয়েছিল অমিয়বাবুর ঘনিষ্ঠ একজন। জানিয়েছি ফ্যান দোলালেই দোলে। কেউ দুলিয়ে দিয়েছিল।
কে এমনটা করেছে? আমাদের এ ঘরে থাকি মাত্র তিনজন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমরাই। সুতরাং আপনার কথা মেনে নিলে এটাই দাঁড়ায় আমার স্ত্রী বা ছেলে কেউ এ-সব করেছে। আমার স্ত্রী কি পাগল যে ধুম্-ধুম্ করে জিনিস-পত্তর ভাঙবে। আমার ছেলেও যদি ভেঙে থাকে, তবে একবারও কি আমরা দেখতাম না। অমিয়বাবু বললেন।
বললাম, গত বুধবার প্রথম সাক্ষাৎকারে আপনি কিন্তু আমাকে বলেছিলেন ম্যান্ডেলাকে সংবর্ধনা দেবার দিন সন্ধ্যায় ঘরে ঢোকার সময় বাল্বটা দুম্ করে ফেটে যেতে দেখেছিলেন, তার পর আর একটি ঘটনাও আপনি নিজের সামনে ঘটতে দেখেননি। দেখেছেন ঘটে যাওয়ার পর। আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও আলাদা করে কথা বলেছি। উনিও কোনও ঘটনা নিজের চোখে ঘটতে দেখেননি, দেখেছেন ঘটে যাওয়ার পর। ঘটনাগুলো ঘটার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী কিন্তু আপনার ছেলে। আজও সাংবাদিকদের সামনে বহুবার বলেছেন, কাচের জিনিস ঘরে রাখলে আধ ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে যাচ্ছে। গতকাল সন্ধেয় এসে বউদির (তৃপ্তি দেবী) কাছ থেকে জানতে পারি, কোনও এক জ্যোতিষী না বাবাজি কী একটা জিনিস দিয়ে বলেছেন, সৌম্যের ওপর কার একটা কোপদৃষ্টি পড়েছে। তাইতেই এইসব অঘটন। কিছুটা ওঁর কথা মতোই এ-বাড়ি থেকে সৌম্যকে দূরে রাখতে গত মঙ্গলবার বিকেলে সাতগাছিতে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। তৃপ্তি দেবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সৌম্যকে পাঠানোর পর আর কোনও কাচের জিনিস কি ভেঙেছিল? তিনি জানিয়েছিলেন, ঘরে বর্তমানে ভাঙার মতো কোনও কাচের জিনিস নেই, তাই ভাঙারই প্রশ্ন নেই। কাচের জিনিস রাখলে ভাঙবে, এতদিন ধরে যা ঘটছে, তাতে এটা ধরে নেওয়াই যায়। আবার সত্যি এমনও হতে পারে, এই জ্যোতিষী যা বলেছেন, তাই সত্যি। সৌমা এ-ঘরে উপস্থিত হলে ওর শরীর থেকে কোনও রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে আবার অঘটন ঘটতে থাকবে। তৃপ্তি দেবীরও ইচ্ছে ছিল, আমাদের এই ছ’ঘণ্টা পরীক্ষা চালাবার সময় সৌম্য উপস্থিত থাকুক। সৌম্যকে আনতে বলেছিলেন। ও এই ছ’ঘণ্টা ছিল, কিন্তু তবু কাচ ভাঙেনি। আসলে কাচগুলো মানুষই ভাঙছিল। আজ সে ভাঙার সুযোগ পায়নি। ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে যুক্তি এ-কথাই বলে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন অমিয়বাবু পরিবারেরই কেউ। প্রশ্ন উঠেছে, কেন ভাঙবে? আপনাদের দুটি তথাকথিত ভূতুড়ে ঘটনা বলছি। শুনলে ভাঙার কারণের কিছুটা হদিশ পেতে পারেন।
‘জল-ভূত’ ও ‘পোশাককাটা-ভূত’-এর ঘটনা দুটির উল্লেখ করে বললাম, জলভূতের সৃষ্টি করে বালকটি তার মায়ের কড়া শাসনের প্রতিশোধ তুলতে চেয়েছিল, শাস্তি দিতে চেয়েছিল। আর পোশাককাটা ভূতের সৃষ্টি হয়েছিল বাড়ির কাজের কিশোরী মেয়েটির হতাশা থেকে। কিশোরীটির কথামতো বাড়ির ছোট ছেলেকে সে ভালোবাসে। ছোটছেলে তাকে আদর-টাদর করে বটে, কিন্তু ভালোবাসে অন্য একটি মেয়েকে। কিশোরীটির ইচ্ছে হয়, ছোটছেলের মুখোশ খুলে দেয় তার প্রেমিকার কাছে। কিশোরীটি বিশ্বাস করে, মুখোশ খুলতে গেলে লাভ হবে না কিছুই। বড়জোর ছোটছেলের সঙ্গে তার প্রেমিকার বিচ্ছেদ হবে। কিন্তু তাতে ছোটছেলে তাকে আদৌ বিয়ে করবে না। বরং ঘটনাটা জানাজানি হলে যে কোনও একটা অপবাদ দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিশোরীটি মেয়েদের পোশাক আর ছোটছেলের পাজামার ওপর আক্রোশ মিটিয়েছে তার অবদমিত যৌন আবেগ, ক্রোধ, ঈর্ষা ও হতাশা থেকে। অনেক সময়ই কিশোর-কিশোরীদের ক্ষোভ, হতাশা, অবদমিত আবেগই রূপ পেতে পারে এই ধরনের নানা কাণ্ড-কারখানা ঘটিয়ে বড়দের উত্ত্যক্ত করার মধ্যে।
এখানে কে নিশ্চিতভাবে ঘটনা ঘটাচ্ছে, তা বলার মতো কোনও অকাট্য প্রমাণ আমাদের হাতে নেই বটে, কিন্তু যুক্তিগুলো পরপর সাজালে মনে হয় ঘটনাগুলো ঘটানোর সম্ভাবনা কিশোরটিরই সবচেয়ে বেশি। কিশোর বয়সে বা যৌবন সন্ধিক্ষণে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বিচ্ছিন্নতার সমস্যা, একাকিত্বের সমস্যাও এর মধ্যে অন্যতম। কিশোরটি সেই সমস্যাতে পীড়িত হতেই পারে। তারই হয়তো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বড়দের পীড়িত করার চেষ্টায়। এ-ক্ষেত্রে তেমন সম্ভাবনাও রয়েছে। অমিয়বাবু রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মা তাঁর স্কুল নিয়ে। বাবা মা'র স্নেহ থেকে, তাঁদের কাছে পাওয়া থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। যখন বাবা ঘরে থাকেন, তখনও তাঁকে ঘিরে থাকে অন্য মানুষেরাই। ব্যস্ত রাজনীতিবিদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক জীবন, এ-কথা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি এক ঘরের ছোট্ট ফ্ল্যাটে মা-বাবার অনুপস্থিতির একাকিত্ব যেমন সৌম্যকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে, তেমনই বহুজনের ভিড়ে বড় বেশি একা করেই বার বার নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে সৌম্য। ঘরে পড়াশুনোর মতো পরিবেশের অভাব তাকে একটু একটু করে লেখাপড়ার জগৎ থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে। অনুবঙ্গ হিসেবে পাল্টাতে পারে বন্ধুজগতের পরিবেশ। ওর ক্ষোভ, হতাশা থেকে বড়দের উত্ত্যক্ত করার জন্য ও এমনটা করতেই পারে।
অমিয়বাবু সরাসরি প্রায় চ্যালেঞ্জ জানালেন, স্বীকার করছি কাচ আধ ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ভাঙত। আজ ছ’ঘণ্টা পর্যন্ত ভাঙেনি। কিন্তু আপনারা চলে যাবার পর আবারও ভাঙতে পারে। আমার ছেলেকে ঘরে রাখব না। অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেব। কিন্তু তারপরও যে ভাঙবে না, সে গ্যারান্টি আপনি দিতে পারবেন।
বললাম, আপনার চ্যালেঞ্জ আমাদের সমিতি গ্রহণ করছে। কিন্তু ঘরে কেউই থাকবে না। ঘর ‘সিল্’ করে দেব। ছ’দিন, ছ’সপ্তাহ, ছ’মাস—এতদিন সিল্ থাকবে কিছু ভাঙবে না, উল্টোবে না। আপনি কি এই শর্তে রাজি হবেন? না, রাজি উনি হননি।
পরের দিন ‘The Telegraph’, ‘আজকাল’, ‘বর্তমান’, ‘বসুমতী’ পত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে আমাদের সমিতি কর্তৃক কাচ ভাঙা রহস্যভেদের খবর প্রকাশিত হয়।
খবরটা কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। ৫ ডিসেম্বরের গণশক্তিতে আবার
আলমারির কাচ পরীক্ষা করছেন লেখক
চেয়ারে বসে অমিয়শংকর রায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। তাতে জানানো হয় অমিয়শংকর রায় জানিয়েছেন ‘রবিবার প্রায় জোর করেই প্রবীর ঘোষ নামে এক ব্যক্তি এ সম্পর্কে পরীক্ষা করতে ঘরে ঢোকেন। সঙ্গে কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদেরও ডেকে নিয়ে আসেন। পরের দিন সংবাদপত্রে তাঁর ভাষ্য পড়ে বিস্মিত।’
অর্থাৎ আমি কিছু সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রায় জোর করে তাঁর ঘরে ঢুকে দীর্ঘ ছ-সাত ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা চালিয়েছিলাম। এবং সাংবাদিকদের কী বলেছি, তিনি জানতেন না। পরের দিন সংবাদপত্র পাঠে প্রথম জানলেন এবং বিস্মিত হলেন। এত মিথ্যা ভাষণের আগে অমিয়বাবুর খেয়াল করা উচিত ছিল, ওইদিন ‘আজকাল’ পত্রিকা ভিডিও তে যতটা সময় ধরে রেখেছে, তা অমিয়বাবুর মিথ্যাচারিতার মুখোশ খোলার পক্ষে যথেষ্টর চেয়ে বেশি। এটা অবশ্য অমিয়বাবুর বোধহয় জানা ছিল না, তাঁদের সঙ্গে একাধিক দিন আমার যে সব কথাবার্তা হয়েছে, তার অনেকটাই ক্যাসেটবন্দি করে রেখেছি। জানা থাকলে এমন আদ্যন্ত মিথ্যাভাষণ থেকে নিশ্চয়ই সংযত হতেন—মুখোশ খুলে পড়ার ভয়ে।
জানি না, অমিয়বাবুর এই ধরনের মিথ্যাচারিতার সঙ্গে সৌম্য পরিচিত কি না? দীর্ঘ বছর কাছাকাছি থেকে বাবাকে দেখার দরুন বাবার এই দুর্বলতার কথা সৌম্যের অজানা না থাকতেই পারে। দেখা দিতে পারে বাবার প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা, ক্ষুব্ধতা ইত্যাদি। পাশাপাশি বাবার এই ধরনের মিথ্যাচারিতা ছেলেকে অন্যভাবেও প্রভাবিত করতে পারে।
হতাশা, ঈর্ষা, অবদমিত আবেগ, ক্রোধ, শ্রদ্ধাহীনতা ইত্যাদি
থেকে এই ধরনের হল্লাবাজ ভূত সৃষ্টির বহু ঘটনা মনোরোগ
চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে। এমন অবস্থায়
মা-বাবার উচিত ভালোবাসা ও সহানুভূতি নিয়ে
সন্তানের পাশে দাঁড়ানো। ঠুন্কো সম্মানবোধের
দ্বারা পরিচালিত হয়ে কেউ সন্তানের ভ্রান্তিকে,
অন্যায়কে আড়াল করতে চাইলে সে
তৈরি হয়ে উঠতে পারে আর
এক ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’।
এটা বললে অপ্রাসঙ্গিক হবে না, ৯ ডিসেম্বর ’৯০ ‘আজকাল’ পত্রিকায় ‘রবিবাসর’-এর দুটি রঙিন পৃষ্ঠা ছিল ‘মানুষ ভূত' নিয়ে। অমিয়বাবুর মিথ্যাচারিতার মুখোশ খোলার পক্ষে পৃষ্ঠা দুটির ভূমিকা ছিল যথেষ্টর চেয়েও বেশি।
আগরপাড়ায় ‘ভুতুড়ে’ আগুন
খবরটা বিশালভাবেই ছড়িয়েছিল—আগরপাড়ার একটা বাড়িতে রহস্যজনকভাবে যেখানে-সেখানে আগুন জ্বলে উঠছে যখন-তখন। আগুন প্রথম জ্বলেছিল গত ২৪ এপ্রিল ১৯৯৩। শনিবার সকাল ৯টায়। তারপর থেকে আগুন তাড়া করে ফিরেছে বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন সময়ে। আগুন ধরেছে বিছানার গদিতে, চাদরে, শাড়ির কোনায় খাতায়, বই-পত্তরে এমনকী কাঠের ইঁদুর-কলে। রহস্যময় এমন আগুনের যখন-তখন আক্রমণে বাড়ির সকলের নাওয়া-খাওয়া-শোয়া শিকের উঠেছে। বাড়ির প্রবীণতম সদস্য সদানন্দ দাস। সংসারে আছেন তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে, বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, তিন পুত্রবধুর বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে ও পাঁচ নাতি-নাতনি। সবচেয়ে বড় নাতি বাবাই পড়ে ক্লাস সেভেন-এ।
ও বাড়িতে আর থাকতেন চার ঘর ভাড়াটে, যাঁদের এক ঘর বাড়ি ছেড়ে উঠে গেছেন ভুতুড়ে আগুনের আক্রমণে গত মঙ্গলবার।
আগুন-হানার রহস্য উন্মোচনে যাঁরা সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন সপ্তর্ষি ক্লাবের টগবগে তরুণ। তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন স্থানীয় দমকল বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ। পাশের পুরনো কুয়ো থেকে কোনও গ্যাস বেরিয়ে এমন অঘটন ঘটিয়েছে কি না—পরীক্ষা করতে দমকল বাহিনী দড়ি বেঁধে হ্যারিকেন নামিয়েছে। হ্যারিকেন নিভে যেতে কুয়োকে গ্যাস মুক্ত করতে জল এনে কুয়ো ভর্তি করে কুয়োকে গ্যাসমুক্ত করেছেন, কিন্তু তাতেও বাড়িকে আগুন-মুক্ত করতে পারেননি। অগত্যা বাড়ির বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও আগুন-রহস্য পিছু ছাড়েনি। বাড়ির ছেলেরা ওঝা নানুবুড়োকে এনেছেন গত বৃহস্পতিবার সকালে। প্রণামী দৃশো একান্ন টাকা। নানুবুড়ো জলপড়া ছেটাবার সময়ই আগুন জ্বলেছে একটা খবরের কাগজে। খড়দার এক ভর-এ পড়া মানুষের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাড়ির লোকেরা। তিনি ভরগ্রস্ত অবস্থায় জানিয়েছিলেন, 'ব্রহ্মভূত এমনটা ঘটাচ্ছে। জলপড়া দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরের চারপাশে জলপড়া ছেটানো হয়েছে। কিন্তু আগুন ঠেকানো যায়নি তাতেও।
পরের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য দেবাশিস চ্যাটার্জি গিয়েছিলেন সমিতির তরফ থেকে সরেজমিনে তদন্ত করতে। ঘরের প্রত্যেক সদস্যকে একঘরে কথায় কথায় আটকে রেখেছিলেন রাত সাড়ে ন’টা থেকে শুক্রবার সকাল পাঁচটা পর্যন্ত। এই প্রথম এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনও আগুন জ্বলল না। দেবাশিস জানিয়ে এলেন, শুক্রবার প্রবীর ঘোষ আসবেন। শুক্রবার দুপুর দুটো তিরিশে নিজে গিয়ে হাজির হলাম ওই বাড়িতে। শুনলাম এখনও পর্যন্ত আর একবারের জন্যেও আগুন ধরেনি। আমি যাব খবর পেয়ে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার সাংবাদিক ও চিত্র-সাংবাদিকরা হাজির হয়েছিলেন আমারও আগে।
ঘরে বসেছিলেন এক মাজারের পির। পিরকে এনেছেন বাড়ির বড় ছেলে সমীর দাসের শ্যালক সনৎকুমার। পিরসাহেব ঘণ্টা দেড়েক ‘ভর হওয়া' মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে জানিয়েছেন—জিনের কাণ্ড। পির চার দেওয়ালে চারটে গজাল পুঁতে দিয়ে বাড়ি বেঁধে দিয়েছেন জিনের কারসাজি বন্ধ করতে।
সমস্যা হল ভিড়। যে ঘরে ঢুকি আমার সঙ্গে ঢুকে পড়েন এক ঝাঁক উৎসাহী জনতা, সপ্তর্ষির সদস্যরা ও সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিকরা। আমি গিয়েছি ‘আজকাল’ পত্রিকার তরফ থেকে। চিত্র-সাংবাদিক হিসেবে সঙ্গে এসেছেন অভিজিৎ মুখার্জি। ভূতুড়ে পোড়ার কিছু স্যাম্পেল দেখা দরকার। বাড়ির সম্প্রতি পোড়া কিছু জামা-কাপড় বা কাগজ এনে দিতে বলতে মেজছেলে প্রবীর ও সনৎবাবু একটা শো-কেসের ওপরে পাতা আধ-পোড়া খবরের কাগজ থেকে কিছুটা ছিঁড়ে দিলেন, গন্ধ শুকলাম। কোনও তীব্র বিশেষ গন্ধ পেলাম না, যেটা মেটালিক সোডিয়ামের সাহায্যে জ্বালালে হত। সবার সামনে কাগজে কিছুটা জল ঢেলে দিতেই খবরের কাগজের রঙ মুহূর্তে হয়ে গেল হালকা বেগুনি। যেমনটা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটে জল পড়লে হওয়া উচিত। ঘরে তখন অনেক দর্শক আগুনের ক্ষেত্রে যে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের একটা প্রবল ভূমিকা ছিল এটা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, এর সঙ্গে গ্লিসারিন মিশলেই বিক্রিয়ায় আগুন জ্বলে, আর এ ভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে আগুন জ্বালানো হয়েছে। পটাশিয়াম মেশানো জল জিভে চেটে দেখলেন আজকাল-এর চিত্র-সাংবাদিক অভিজিৎ মুখার্জি, চাখলেন সনৎবাবু। দুজনেই একমত হাঁ, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটই।
পরিবারের সকলের সঙ্গেই আলাদাভাবে কথা বললাম। বাইরের কারও পক্ষে এই ঘরে বিভিন্ন সময়ে ঢুকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও গ্লিসারিন আগুন জ্বলে ওঠার মতো করে গুছিয়ে রেখে যাওয়া অসম্ভব। সুতরাং এটা ভাড়াটে বা কোনও প্রোমোটারের পরিকল্পনার অঙ্গ হতে পারে না। তবে যে আগুন জ্বালিয়ছে সে এই দুটির ব্যবহার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। আমাদের সমিতির ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি পড়ে এই রসায়ন দুটির প্রয়োগ শিখেছে, এমনও হতে পারে। খুবই ক্যাজুয়্যাল ভঙ্গিতে অথচ আসলে সতর্কতার সঙ্গে বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম। জানালাম এই পরিবারেই একজন ঘটনাটা ঘটাচ্ছে। এই পরিবারেরই একজন এমনটা ঘটাচ্ছে বলায় বাড়ির কেউই তেমন সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এমন কী, ওই দুটি রসায়নে আগুন জ্বলে—এটা মানতেই চাইলেন না। আবার 'সপ্তর্ষির কেউ কেউ যদিও বা মানলেন, তবু তাঁদের জিজ্ঞাসা – আগুন জ্বলার সময় ধারে-কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? হাতে-কলমে আমাকে পরীক্ষা করে দেখানোর জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানালেন দু-একজন অতি উৎসাহী দর্শক। সপ্তর্ষির এক তরুণ দৌড়ে কিনে আনলেন গ্লিসারিন ও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। বাড়ির বড় বউ দিলেন এক টুকরো কাপড়। কাপড়ের ভাঁজে পটাশিয়াম ছড়িয়ে দিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম কাপড়টা। কাপড়ে গ্লিসারিন ঢেলে দিলাম। এক সময় গ্লিসারিন গা বেয়ে নেমে এল, পটাশিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া শুরু করল, ধোঁয়া-পোড়া গন্ধই হচ্ছিল। পোড়া কাপড়ে এক গ্লাস জল ঢেলে দিতেই কাপড়টা হালকা বেগুনি হয়ে গেল—খবরের কাগজটার মতোই।
সমীরবাবু বললেন, ‘আপনি তো বললেন আমাদের পরিবারেরই কেউ এমনটা ঘটাচ্ছিল। আপনার কথা যদিও মেনে নিই, তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, যে ঘরে যখন আগুন জ্বলছে তখন দেখা গেছে ঘর ফাঁকা, কেউ নেই।’
‘তেমনটাই তো হওয়ার কথা। যে আগুন জ্বালাচ্ছিল, সে যথেষ্ট চালাক। গ্লিসারিন ঢালছে কাপড়ে বা চাদরে। যেখানে ঢালছে তার কিছুটা নীচে রাখছে পটাশিয়াম। গ্লিসারিন ধীরে ধীরে নামছে। ততক্ষণে ভিলেন অনেক দূরে। তাই প্রতিবারই ঘটনাস্থলে ঘটনার সময় ভিলেনের দেখা মেলেনি।’
সপ্তর্ষির অনেকেই জানতে চাইলেন ভিলেনের নাম। সম্ভবত তাতেই উদ্দীপ্ত হয়ে বাড়িরই এক বউ প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘নামটা যদি জানেনই তো জানান না।’
বললাম, ‘দেখুন যে এমনটা করেছে, সে আমাকে কথা দিয়েছে আর করবে না। তার কথা ক্যাসেটবন্দি করা আছে। তাকে আমিও কথা দিয়েছি, আর এমনটা না করলে তার নাম কাউকে জানাব না। আপনাদের প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ তাকে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিন। এর পরও সে যদি আবার এমন ঘটনা ঘটায় আমি নিজে এসে তার স্বীকারোক্তি আপনাদের শুনিয়ে দিয়ে যাব।
আমার এই কথা শোনার পর কেউ আর নাম জানতে পীড়াপীড়ি করেননি।
এ ভাবেই আগুন ভূতের টগবগে রহস্যে জল ঢেলে দিয়ে আগরপাড়ায় বিজ্ঞানমনস্কতার জয়কেই আবারও ঘোষণা করে এলাম।
১মে ’৯৩-এ বহু পত্রিকাতেই ছবিসহ এই রহস্যভেদের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
নাগেরবাজার উড়ালপুলের ভূত
সালটা ২০১২। বিরাট গুজব এ’বছর নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। হোক বা না হোক সাংঘাতিক ঝড় উঠল এ বছর। সেটা হল দমদম নাগেরবাজার উড়ালপুলে ভূতের দেখা মিলছে প্রতি রাতেই। ভূতের গুজবটা প্রতিটা মিডিয়াই প্রচারে প্রচারে ছয়লাপ করে দিল। সন্ধে হতেই উড়ালপুল শুনশান। এমন সময় নিউজ টাইম থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। রাত ৮টা থেকে ১২টা লাইভ প্রচার হবে উড়ালপুলে ভূত নিয়ে। হাজির হলাম। এবার শুনুন সেদিন টিভিতে কী প্রচারিত হয়েছে।
টিভির পর্দায় ভেসে উঠল—অদৃশ্য উপস্থিতি! আজ সন্ধে ৬টা থেকে দমদমের নাগেরবাজার উড়ালপুলে সন্ধে নামলেই অশরীরী আতঙ্ক। অশরীরীর সন্ধানে প্রবীর ঘোষ, সঙ্গী নিউজ টাইম। দম বন্ধ করা লাইভ কভারেজ। উড়ালপুলের ভূত! আজ সন্ধে ৬টা থেকে।
সতর্কীকরণ : হৃদয় দুর্বল হলে এই অনুষ্ঠান দেখবেন না।
সঞ্চালিকা জুমেলা : ভূত কি আদৌ আছে। এই প্রশ্ন কিন্তু বহুযুগের। অবশ্য গা ছমছমে ভূতের গল্প শুনলে সকলেরই ভয় ভয় লাগে। আর সেই ভয়কে বেশ উপভোগ করা যায়। কিন্তু বাস্তবে ভূতের গল্প শুনলে ভয় যত না করে আতঙ্ক তার থেকে বেশিই ছড়ায়। দাবানলের মতো ছড়ায় নানান গল্প। আর বাড়ে আতঙ্ক।
খোদ কলকাতা এমন অনেক ভূতের গল্প শুনেছে, ভয় পেয়েছে আবার মনেও রেখেছে। আবার তা ভুলেও গেছে। এমনই এক ভূত ভয়ের আমদানি হয়েছে কদিন আগে। নাগেরবাজারের উড়ালপুলে নাকি রাত দুপুরে নেমে আসছে অশরীরী। না। কারোর ঘাড় মটকায়নি। কারোর ব্যাগের টাটকা ইলিশ নিয়ে যায়নি কোনও মেছো বা মামদো ভূত।
শোনা যাচ্ছে, এই ভূতের একমাত্র নজর একলা গাড়ি চালক। দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি না থাকলে এই ভূত নেমে আসছে উড়ালপুলে। আর সত্য যাচাই করতে আমরা গত দু'দিন ধরে খোঁজ চালাচ্ছি। কী শুনেছি? কী দেখেছি? জানাব আপনাদের।
এই সত্য উদ্ঘাটন তো আমরা করবই। কিন্তু এই মুহূর্তে স্টুডিয়োতে আমার সঙ্গে যারা রয়েছে তাঁদের সাথে আলাপ করে নিই। আমার একেবারে বাঁদিকে রয়েছে প্রবীর ঘোষ। যুক্তিবাদী সমিতির সভাপতি। তার ঠিক পাশেই রয়েছে লোপামুদ্রা গোস্বামী। মনোবিদ। প্রবীরবাবু আপনি কিছু বলুন।
প্রবীর : আমি জনাকুড়ি মানুষের কাছ থেকে খবর পেয়েছি এবং কুড়িজন আবার প্রত্যক্ষদর্শী। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা আবার সাংঘাতিক সাংঘাতিক। ভয়ঙ্কর। আজকে সরাসরিভাবে একজনকে ইনভাইট করেছি আসতে। ভূত দেখান, যদি পারেন তবে ২৫ লাখ টাকা দেব। আর যদি না পারেন তাহলে একটা থাবড়া মারব একেবারে দাঁতগুলো যাতে সব ঝরে যায়। এটা বলেছি। আজকে একজন আসবে এবং সে থাকবে আমাদের সঙ্গে। আমি প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছি এবং চ্যালেঞ্জিং মুডে তাদেরকে বলেছি আমাদের সাথে যেতে। একজনকেও পাইনি। একজনকেও না। সুতরাং এটা আমার কাছে স্রেফ গুজব।
সঞ্চালিকা : প্রবীরদা এই ঘটনাটাকে বলছেন স্রেফ গুজব। এবং আমাদেরও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু যেসকল ট্যাক্সি ড্রাইভার রয়েছেন, যেসব বাইক চালক রয়েছেন, তাদের byte রয়েছে। তাঁরা বলছেন, কেউ একজন আসছে। হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাচ্ছে। তারপরেই এই অনুষ্ঠানগুলো ঘটছে।
লোপামুদ্রা : সাইকোলজিতে একটা শব্দ আছে যেটাকে বলে মাস-হ্যালিউসিনেশন। অনেক লোক একসঙ্গে যখন কোনও প্যারানর্মাল বস্তুকে আলাদা আলাদাভাবে এক্সপিরিয়েন্স করেন আর কী। আর এই ঘটনাগুলো কোনও নতুন নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে বারেবারে মাস-হ্যালিউসিনেশন ঘটে চলেছে।
ঊনবিংশ শতকের এরকম একটা ঘটনা। ইংল্যান্ডের স্প্রিং হিলস জ্যাক। রাস্তায় এরকম একজনকে দেখা যাচ্ছে যার ব্যাটমানের মতো অনেকটা চেহারা। হাতে বড় বড় নখ। চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। তাকে সারা ইংল্যান্ড জুড়ে দেখা যাচ্ছে। সেইজন্যই মাস-ইলিউসিনেশনের ব্যাপারটা যুগে যুগে রয়েছে আর কী।
অনেকে একসাথে এরকম করতে থাকে। এটা কনফারমেটিভ প্রেশারে করে। মানে আমার একটা কিছু পারসেপশন হচ্ছে, আমি আমার পাশের লোকেরও সেই একই পারসেপশন হতে থাকল আর কী। সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার আর কী। কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব আছে যারা এই ধরনের জিনিসগুলোকে সহজে অ্যাকসেপ্ট করে নেয়।
সঞ্চালিকা : সেই জন্যই কি এই ধরনের কথাগুলো লোকের মুখে বারবার করে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
লোপামুদ্রা : হ্যাঁ। হ্যাঁ।
প্রবীর : সেরকম নয়। বোধহয় ১৯৫৩ সাল। তখন আমি আদ্রায় থাকি। পি সি সরকার গেছেন ম্যাজিক দেখাতে। ম্যাজিক দেখেছি। খুবই ভালো ম্যাজিক দেখিয়েছেন। কিন্তু তারপর গুজবটা যেটা রটল যে, যখন ম্যাজিক দেখানোর কথা, তার থেকে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু ম্যাজিক শুরু হচ্ছে না। লোকজন নাকি খুব খেপে গেছে। হইহই করছে। দারুণ অবস্থা যখন, তখন জাদুকর সরকার এলেন স্টেজে। তাঁকে দেরি করলেন কেন জিজ্ঞাসা করাতে বললেন যে, আমার ঘড়িতে তো ঠিক টাইম-ই আছে। সবাই নাকি ঘড়িতে দেখলেন পারফেক্ট টাইমে উনি ঢুকেছেন। এটাকে বলে গুলগল্প। কারণ, এই ধরনের ম্যাজিক দেখানো সম্ভব নয়।
এই প্রত্যেকে আমার বাবা হলেও গুলগল্প করেছেন, আমার ঠাকুরদা হলেও করেছেন। প্রত্যেকে গুলগল্প করেছেন। যাঁরা গুল মারেন, যাঁরা মিথ্যে কথা বলেন, তাঁরা কারোর না কারও বাবা, মা, দাদা, দিদি যে কেউ। এর কোনও বিকল্প নেই। গুল ছাড়া কিচ্ছু নেই।
সঞ্চালিকা : একেবারেই। সেই সত্য উদ্ঘাটন তো আমরা করবই। তবে নাগেরবাজার উড়ালপুলে ভূতের গল্প মোটামুটি একই। আক্রান্ত কখনও দু-চাকা, কখনও চার-চাকা। গল্প শুনেছি অনেকের। কিন্তু ভূতের দেখা আমরা পাইনি। তাই ভূত সাজাতে হয়েছে। আর সাজাতে হয়েছে ঘটনাও। আতঙ্কিত ঘটনার বর্ণনার পুনঃনির্মাণ করেছি আমরা। চলুন দেখি।
নীল-সাদা ডোরাকাটা শান্ত নাগেরবাজার উড়ালপুল। এপারে দমদম ভগবতীপুর আর ওপারে সরোজিনী নাইডু কলেজ। নতুন ব্রিজ দিয়ে সকাল থেকে রাত গাড়ির মিছিল। তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে এপার থেকে ওপার ওখানেই নাকি ওত পেতে থাকে ভয়। উড়ালপুলের মাঝেই নাকি আছে এক বা একাধিক অশরীরী। কোথায়? কোনখানে?
না দিনের আলোয় কোনও চিহ্ন নেই। শান্ত-সুন্দর এই পুলে ভয় কোথায়? কোথায় অশরীরী ছায়া?
না কিচ্ছু নেই। না আছে ছায়া, না আছে শব্দ। ভূতের গন্ধ মাত্র নেই এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত।
কিন্তু আঁধার নামলেই ঘনিয়ে আসে ভয়। মুখে মুখে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে ভয়। উড়ালপুলের বাঁকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘনিয়ে আসে আতঙ্ক। কোনও অশরীরী নেমে আসে উড়ালপুলের বাঁকে।
দোকলা গেলে দোষ নেই। একলা গেলেই ভয়। সেই ভয় ছড়িয়ে পড়ছে গল্পে-গল্পে। এক চালকের মুখ থেকে আর এক চালকের মুখে। দু-চাকা বা চার-চাকা। উড়ালপুলের বাঁকে কে যেন হাত দেখায়। উঠতে চায় গাড়িতে। কুহেলের ডাকের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে গাড়ি। চালকের হাত-পা যেন নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে থামিয়ে দেয় গাড়ি। কে সে? কেন দাঁড় করায় গাড়ি? কী চায় সে?
আতঙ্ক বাড়ছে। ভয় বাড়ছে। প্রতিদিন সকাল নিয়ে আসছে আঁধার রাতের নতুন নতুন আতঙ্কের কাহিনি। আগের রাতে অশরীরী হানা চালিয়েছেন কারও ওপরে? শোনা যায় নানা কাহিনি।
চালক গাড়ি দাঁড় করাতেই খুলে যায় দরজা। সামনের সিটে বসে মাঝবয়সি কেউ। চলতে থাকে গাড়ি। কিন্তু আচমকাই প্রচণ্ড আঘাতে সম্বিৎ ফেরে চালকের। কিন্তু ততক্ষণে পাশের সিটে কেউ নেই। কোনও চিহ্ন নেই। কেউ কোথাও নেই। নিঃশব্দে নেমে গেছে সেই মাঝবয়সি পুরুষ। শুনশান রাস্তায় গাড়িচালকের শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশির করে নেমে আসে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রাতের আঁধারে ঘুমিয়ে পড়ে উড়ালপুল। পরদিন সকালে মুখে মুখে শোনা যায় নতুন গল্প, নতুন আতঙ্কের কাহিনি। রহস্যের আড়ালে থেকে যায় নাগেরবাজার উড়ালপুল। ভূতের ভয় গ্রাস করে নেয় গাড়ি-চালকের অবচেতন।
সত্যিই কি কোনও ছায়া মানুষ হামলা চালায় গাড়ির চালকদের ওপর নাকি মানুষের বেশে কোনও অমানুষ দুষ্কৃতী। কী চায় সে? কেন আসে রাতের অন্ধকারে? সত্যিই কি সে আছে নাকি শুধু ভয়, ভয় আর ভয়।
সঞ্চালিকা : আপনাদের খুব ছোট করে একটা নাট্যরূপান্তর দেখালাম। লোকের মুখে যেভাবে নাগেরবাজার উড়ালপুল সম্বন্ধে নানারকমের গল্প শোনা যাচ্ছে তার কিছু দেখালাম আপনাদের! প্রবীরবাবু আপনার কাছে প্রথমে আসছি। আপনি দেখলেন এই নাট্যরূপান্তর যেটা বারেবারে করে প্রত্যেকের মুখে ঘুরে ফিরে আসছে।
প্রবীর : আমি নাগেরবাজারে বাজার করি। ধরা গেল সকালবেলায় বাজার করতে যাচ্ছি, এই ওই দোকানদার সবাই চেনে আমায়। কাকু, জেঠু এইরকম ভূত দেখা যাচ্ছে কিছু একটা করুন। যখন আমি বলি তুমি দেখেছ, বলে হ্যাঁ আমি নিজে দেখেছি।
ঠিক আছে চলো। যেদিন যাবে বলো। ব্যস, তারা গায়েব। এই যে প্রত্যক্ষদর্শীরা, তারা প্রত্যেকে হল না-দেখা মানুষ। যেমন ঘড়ির ম্যাজিকটা পি সি সরকার কোনও দিন দেখাননি। কিন্তু গাদা-গাদা লোক নাকি দেখেছে। এরকম ভূত কেউ দেখেনি যাদের প্রত্যেককে অফার করেছি, আবার বলছি ২৫ লাখ দিয়ে দেব। ব্যাঙ্ক থেকে চেক বাউন্স করবে না আমার।
সুতরাং এইগুলো খালি মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। কারণ একজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেই না মানুষের মধ্যে মিথ্যে কথা বলার প্রবণতা থাকে। ও প্রত্যক্ষদর্শী হল, আমিও প্রত্যক্ষদর্শী। প্রত্যক্ষদর্শী হলে একটা ঘ্যাম থেকে যায় না। সেই ঘ্যাম থেকে গাদা-গাদা প্রত্যক্ষদর্শী বাড়ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আর সব কী স্টোরি! আমার কাছে এসে স্টোরি বলে, আমি শুনি।
সঞ্চালিকা : লোপামুদ্রাদি এই মানুষবেশী একটা ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না লোকমুখে ছড়াচ্ছে বারেবারে, যে রাত্তির ১০টার পর হলেই চার চাকার গাড়ি হলেই এবং অবশ্যই একজন গাড়ি চালক হলেই মানুষবেশী একটা ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কী সেটা?
লোপামুদ্রা : অ্যাকচুয়ালি, এই হ্যালিউসিনেশন যখন হয় আর কী, একটা ছায়া ধরুন একটা আলো-আঁধারি হয়তো। তখন রাত্রি হয়ে গেছে। ব্রিজটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তো ন্যাচারালি কোথাও হয়তো সেখানে আলো পড়ছে, একটু অন্ধকার হয়ে আছে। তার মধ্যে একটা কিছুকে সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন ভেবে নিয়েছিল আর কী। আর এই গল্প লোকমুখে ছড়াতে শুরু করল।
প্রবীরবাবু বলছিলেন যে, একজন দেখার সাথে সাথে দশজন প্রত্যক্ষদর্শী। এরকমভাবেই এই গল্পগুলো ছড়াতে শুরু করে।
টিভির পর্দায় ভেসে উঠল নাগেরবাজার উড়ালপুলের চিত্র। একজন সাংবাদিক বলতে লাগলেন—শোনা যায় মে মাসের মাঝামাঝিতে এই দমদম উড়ালপুলের ওপরে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সুমন নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। এবং তার এই মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই এই উড়ালপুলে ভূতের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
শুধু এই এলাকাতেই বা কেনও, উত্তর কলকাতার শহরতলির যেসব মানুষ ব্যবহার করে এই নাগেরবাজার ব্রিজ মানে রামকৃষ্ণ ব্রিজ, তাদের মুখে মুখে এখন আতঙ্কের গল্প। যাঁরা কস্মিনকালেও ওই সেতুর ধারেকাছে যাননি তাঁরাও বলছেন ওই একই কথা। সেই যুবক কী অশরীরী হয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে না কি অন্য কিছু। আমরা গিয়েছিলাম সত্য খুঁজতে। কে দেখেছেন ভূত? সত্যিই আমরা পেয়েছি ভূত দেখা মানুষকে। কী বলছেন তিনি? কেমন দেখলেন ভূতের চেহারা।
তপন বিশ্বাস। পেশায় গাড়ি চালক। অবিন্যস্ত চুল। গায়ের রং শ্যামলা। ক্যামেরার সামনে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বললেন, রাত্তিরবেলা এখানে একটা ছেলে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে গাড়িকে হাত দেখায়। হাত দেখাল। গাড়িতে উঠল। উঠে তারপরে ড্রাইভারকে একটা চড় মারল। ছবি দেখা যায় না। প্রথমে দেখা যায় দাঁড়ানো থাকলে। তারপর হারিয়ে যায়। গাড়িতে আর থাকে না।
রাত্তির একটা নাগাদ। হঃ হঃ হঃ একদিন দাঁড় করাইছিল। তারপরে লোক নাইকো। হাত দেখাল। তারপর আর লোক নাই।
সাংবাদিক পিনাক : সত্যিই ভূত দেখেছেন। তারপর অবাক বিস্ময় নিয়ে আমরা আরও খোঁজ চালালাম। কথা হল স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে। না। তিনি দেখেননি। তবে ভূত দেখেছেন এমন মানুষের চিৎকার শুনেছেন তিনি।
সেই বাসিন্দা বললেন রাত্তির মোটামুটি একটার পরেই দেখা যাচ্ছে যে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছে এবং ছবি দেখা যাচ্ছে না। মারছে ড্রাইভারকে।
সত্যিই কি ভূত না কি গল্প। কেউ কেউ বলছেন সেই ছায়া মানুষের ডাকে সাড়া না দিয়ে চলে যাওয়াও নাকি যাচ্ছে না। আপনি আপনি আটকে যাচ্ছে গাড়ি। দুর্ঘটনার মুখে পড়ছেন চালক। এমনই এক বাইক চালক নাকি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে দেখতে গিয়ে নিজের কানে ভুত কাহিনি শুনেছেন, পাওয়া গেল এমনই একজনকে উড়ালপুলের ওপরে।
প্রশান্ত মণ্ডল নামক ওই স্থানীয় ব্যবসায়ী বললেন, কয়েকদিন ধরেই শুনতে পাচ্ছি আমি যে, তিনজন-চারজন করে মারা গেছে। কালকে একজন এরকম ব্রিজের ওপর অ্যাকসিডেন্ট হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমি ওঁকে দেখতে গেছি। দেখতে গিয়ে আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? উনি বললেন, ব্রিজের ওপর টার্নিংপয়েন্ট-এ গাড়ির হ্যান্ডেল ঘোরাতে চাইছি কিন্তু ঘুরছে না, স্কিপ করছে। তো রেলিং-এ ধাক্কা না মেরে গাড়িটা ফেলে দিয়েছি। আর কনুই ছুলে গেছে, চোট লেগেছে।
ভূতের এই কাহিনি শুনলেও ওই ব্যবসায়ী রাতে নিজে অবশ্য অশরীরী ছায়াও দেখেননি। তবে কি পুরোটাই গল্প? সকলেই কি ভুল দেখেছে? সবাই দেখলেও ওই ব্যবসায়ীকে কেন দেখা দিল না ছায়ামানুষ? আমাদের মনে যে সন্দেহের প্রশ্ন, পুলিশের চোখেও তাই।
দমদম থানায় জিজ্ঞেস করলে দমদম থানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টা গুজব বলেছেন। আমরা নাগেরবাজারে পরপর দু-রাত কাটিয়েছি উড়ালপুলে। না ভুত দেখতে পাইনি। কিন্তু শুনেছি মুখে মুখে ছড়ানো ভয়ের কথা। তাই হাল ছাড়বে না নিউজ টাইম। আজ রাতেও মুখোমুখি হতে চাই আমরা।
তৃতীয় দিন মধ্যরাতেও থাকবে নিউজটাইম সঙ্গে থাকবে ক্যামেরা, প্রবীর ঘোষ আর আপনারা। আমরা গল্পভূতের পর্দা ফাঁস করবই। আমরা যাচাই করব উড়ালপুলে ভূত, নাকি গোটাটাই অদ্ভুত এক গুজব।
সঞ্চালিকা : দুদিন ধরে আমাদের প্রতিনিধিরা নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন, সত্যের খোঁজ করার চেষ্টা করেছেন। প্রবীরবাবু আপনার কি একবারও মনে হয়নি যে উড়ালপুলে গিয়ে আমিও একবার দেখি।
প্রবীর : আমি গেছি তিনদিন। আমার ড্রাইভারকে আলাদাভাবে পাঠিয়েছি দু-দিন। এই ১১টা থেকে ১টার মধ্যে আমরা কিছু দেখিনি। সুতরাং বুঝেছিলাম মিথ্যে। তা সত্ত্বেও একটু দেখলাম। কিন্তু কিছু দেখিনি।
যিনি দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শী তাঁদের সাথে একটু কথা বলতে চাই। আমার প্রশান্তবাবুকে কিছু প্রশ্ন করার আছে। প্রশান্তবাবু বলেছিলেন যে তারপর মারা গেছে চারজন। ওই প্রত্যক্ষদর্শীকে এনে দিন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সঞ্চালিকা এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন।
সঞ্চালিকা : লোপামুদ্রাদি আপনি কী বলেন?
লোপামুদ্রা : একধরনের ব্যক্তিত্ব আছে যারা এই বুজরুকিতে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। এইমাত্র প্রবীরবাবু বললেন যে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত।
সঞ্চালিকা : প্রবীরবাবু, এই যে প্রশান্ত ব্যক্তিটির কথা শুনলাম একটু আগে....
প্রবীর : আসলে তাকে দেখে, তার চেহারা দেখে আমি নিশ্চিত যে তিনি মানসিক রোগী নন। চারজনের মৃত্যুর খবর ঠিক না। তাঁর মনে হয়েছে এইভাবে বলাই ভালো। বলেছেন।
গুজব কীভাবে হয়? ধরা গেল আমি শেয়ালদা স্টেশনে একটি গুজব ছড়ালাম। সেই গুজবটা শেয়ালদা স্টেশন চত্বর থেকে দমদম যাওয়ার আগে, মানে উড়তে উড়তে যাওয়ার আগে গুজবটা যা করে হয়তো রানাঘাটে পৌঁছে গেছে। একটা লোক পৌঁছবার আগে গুজবটা পৌঁছে গেছে।
সঞ্চালিকা : কিন্তু যার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, তাকে কিন্তু দেখতে গেছে এই প্রত্যক্ষদর্শী।
প্রবীর : হ্যাঁ। অ্যাকসিডেন্ট তো হয়ই। যে কোনও জায়গাতেই অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। অ্যাকসিডেন্ট হলেই ভৌতিক ভাবব, এ তো মহা মুশকিল ৷ তাহলে তো প্রতিদিন গাদা গাদা ভূত অ্যাকসিডেন্ট ঘটাচ্ছে।
একজন কেউ প্রমাণ দিক এটা ভূতের কাণ্ড। অ্যাকসিডেন্ট হলেই ভুতের কাণ্ড এটা কীভাবে বিশ্বাস করব নর্মাল মানুষ হিসেবে। আর একটু অ্যাবনর্মাল হলেই এরকম হ্যালিউসিনেশন বা অন্য কিছু হতে পারে, এছাড়া আর কিছু না। শিক্ষা-দীক্ষা কম থাকলে তাদের মধ্যে মাস-হিস্টিরিয়া হয়। মাস-হিস্টিরিয়ার এত কেস দেখেছি। এই কেস-হিস্ট্রি নিয়েও আমার একটা বই আছে। সম্মোহনের A to Z।
সঞ্চালিকা : লোপামুদ্রাদি এই কেস-হিস্ট্রি আপনি এতবছর ধরে রিসার্চ করছেন তো এই ধরনের কেস কীরকম age-এর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়? ৮ থেকে ৮০ সবার মধ্যেই কি দেখতে পাওয়া যায়?
লোপামুদ্রা : আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য। মাস-হিস্টিরিয়া যখন হয় বা এই ধরনের তখন শিক্ষাগত যোগ্যতা মানে শিক্ষিত মানে sorry to say শিক্ষিত মানে তারা শিক্ষিত কিন্তু শিক্ষিত না কোট-আনকোট, কিন্তু সেই অর্থে শিক্ষিতদের আমি বলতে শুনেছি এমনকিছু কথা যেগুলো নর্মালি হওয়ার কোনও কারণ নেই। তাঁরা সেগুলো বলতে শুরু করেন হঠাৎ করে। যেমন ধরুন, এই যে ১৯৯৫ সালে গণেশের দুধ খাওয়া হয়েছিল। তারপরে যখন তার ব্যাখ্যা দিয়ে দেওয়া হয়েছে ওটা একটা ক্যাপিটারি অ্যাকশন বা এটসেটরা, যেকোনও কোরাসি। কিন্তু আমি দেখেছি যারা বিশ্বাস করার নয় আর কি তারা ওটা (ব্যাখ্যা) বিশ্বাস করবে না। তারা সবসময় অন্যটা পার্টিকুলারলি ওই দিনেই গণেশ দুধ খেয়েছিল, সারা পৃথিবী জুড়ে ওইদিনেই যিশুখ্রিস্ট দুধ খেয়েছিল......মানে এরকম একটা গল্পের মধ্যে থাকতেও তাঁরা ভালোবাসে। এটা একটা ব্যক্তিত্বের ব্যাপার টাইপের। এর সঙ্গে আমি অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় সবসময় শিক্ষাগত যোগ্যতা ইয়ে পাইনি। আমি অনেককে পেয়েছি যারা সেই অর্থে শিক্ষিত।
প্রবীর : আমি অবশ্যই শিক্ষিতদের কাউকে পাইনি। 0%। ধরা গেল এই যে যারা গণেশকে দুধ খাওয়াতে গেছে তারা যদি এরকমও হয় তা সত্ত্বেও তারা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন শিক্ষাহীন মানুষ।
এছাড়া ওই গণেশের দুধ খাওয়াটা প্রথম সরাসরিভাবে টেলিগ্রাফ পত্রিকার হয়ে কভার করতে যাই এবং ধরি এবং সেটা national level-এই দূরদর্শন থেকে প্রচার করা হয়েছিল কীভাবে হয়েছে।
কারণ সত্যানুসন্ধান করাটা আমার বেঁচে থাকার শ্বাস-প্রশ্বাস।
আমি দেখেছি মাস-হিস্টিরিয়ার প্রচুর কেস। যেমন, ধর্মগুরুরা যেকোনও সময় মাস-হিস্টিরিয়া বাধিয়ে দিতে পারে। একদিনে অনেক গোলমাল হয়ে যেতে পারে। ধরা গেল প্রধানমন্ত্রী মারা গেলেন, মাস-হিস্টিরিয়াতে হাজার তিনেক শিখ মারা গেল। এটাও তো মাস-হিস্টিরিয়া।
যারা সত্যিকারের সাইকোলজিটা ভালো বোঝে, তারা যে কোনও জায়গায় মাস-হিস্টিরিয়া করাতে পারে।
আমার মনে আছে, হাই কোর্টের শতবর্ষ উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান ছিল। আলোচনা সভা ছিল। তাতে আমি একজন আমন্ত্রিত বক্তা ছিলাম। দু'জন বলা কী বলেছিলেন তাঁদের বিরোধিতা করে আমি বলেছিলাম যে, সাইন্টিফিকালি মাস-হিস্টিরিয়া করতে পারি।
একজন পুলিশের আই পি এস ছিলেন। আমি বলেছিলাম, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলায় যাব ৬ থেকে ৮টা ছেলেকে নিয়ে। পুরো খেলা অ্যাবানডন করে দিয়ে চলে যাব। কারণ হিস্টিরিয়া কীভাবে তৈরি করতে হয় তারও একটা সায়েন্স আছে। সেটাও জানি। সুতরাং পারব না কেন।
কিন্তু এটার উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল আর প্রত্যক্ষদর্শী দুটোই চাই। উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল আমি বলে দেব। কীভাবে হয়েছে আমি তো জানি।
সঞ্চালিকা : এই মুহূর্তে একজন দর্শকবন্ধু আমাদের ফোন করেছেন। সোমেন কোটাল। তিনি প্যারানর্মাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটিভ অফ ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেন। সোমেন কোটাল এই মুহূর্তে আমাদের টেলিফোন লাইনে রয়েছে। সোমেনবাবু আপনার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে, আপনি আমাদের জানান।
সোমেন কোটাল : অ্যাকচুয়ালি, এই ভূত-প্রেত এই সময় নিয়ে সারা বিশ্বে তো এরকম নানা ব্যাপার চলছে। নাগেরবাজার উড়ালপুল নিয়ে আমার খুব কিউরিওসিটি ছিল আসলে কী হয়েছে জিনিসটা দেখার জন্য। গতকাল রাত্রিতে সাড়ে বারোটা নাগাদ আমি ওখানে পৌঁছাই এবং সারারাত আমি ছিলাম। এবং ভোর ৪টের সময় আমি ওখান থেকে ফিরে আসি। সারারাত আমি জেগে থেকে investigate করেছি ওখানে। লোকেরা এরকম বলেছে যে বাইক নিয়ে যাওয়ার সময় একা গেলে কেউ দাঁড় করায়, লিফট চায়। তো আমি নিজে একা গিয়ে দেখেছি কেউ লিফট চায়নি। আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেছি কোনও কিছু appear হয়নি সেখানে। তারপরে কেউ কেউ বলেছে বাইকের হ্যান্ডেল টেনে ধরছে। আমি একটা হাত ছেড়ে দেখেছি যে কেউ যদি হ্যান্ডেল টেনে ধরে তাহলে বুঝতে পারব। আবার তারপর এরকমও করেছি যে অ্যাকসিলারেটরটা ছেড়ে দিয়েছি। অ্যাকসিলারেটরটা নিজে নিজে বেড়ে যাওয়ার কথা লোকের মুখে শোনা হিসেবে।
তো এরকমভাবে বিভিন্নরকম experiment করেছি ওই জায়গাটায়। একা একা বসে থাকার চেষ্টা করেছি। কমিউনিকেট করার চেষ্টা করেছি। আমি বলেছি যে যদি কোনও সত্যি আত্মা থাকে তাহলে আমাদের সাথে কমিউনিকেট করুন। তো আমার মনে হয়েছে নিছকই এটা গুজব ছড়ানো হয়েছে। ওখানে কোনওরকম ভৌতিক সত্তা আমার চোখে পড়েনি। লোকের কথামতো যেখানে ভূতের activity, সারারাত যদি আমি থাকি, একবার না একবার আমার চোখে পড়া উচিত ছিল।
কিন্তু ভূতের কোনওরকম উপদ্রব নেই। ভূত উড়ালপুলের ওপর চাপেনি। হয়তো মানুষের মাথাতে ভূত চেপেছে—এটা হতে পারে।
প্রবীর : সোমেনবাবু খুব ভালো বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সঞ্চালিকা : প্রবীরবাবু কোনও প্রশ্ন আছে আপনার সোমেনবাবুকে?
প্রবীর : না। উনি তো দেখেননি। দেখলে, প্রত্যক্ষদর্শী হলে নিশ্চয় প্রশ্ন করতাম।
সঞ্চালিকা : সোমেনবাবু আপনার কাছে একটা প্রশ্ন রাখব কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিক্রিয়া আমরা নিয়েছি। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিক্রিয়া আমরা শুনিয়েছিলাম, তিনি বাইকে করে যাচ্ছিলেন এবং যখন টার্ন নিচ্ছিলেন সেই সময় বাইকের হ্যান্ডেল কিছুটা সময়ের জন্য হলেও স্টিফ হয়ে গেছিল। সে বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
সোমেনবাবু : দেখুন এটা হয়তো কোনও টেকনিকাল প্রবলেম-এর জন্য হতে পারে। ওনার বাইকের হ্যান্ডেল কী করে স্কিপ হচ্ছে সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আমার যেটা নিজের অভিজ্ঞতা, দু-তিনবার ওই সিচুয়েশন করার চেষ্টা করেছি, আমার বাইকের হ্যান্ডেল ধরে কেউ টেনে ধরেনি। লোকের মুখে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ভূতের কোনও অস্তিত্ব বা কারণ ওখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সঞ্চালিকা : অনেক ধন্যবাদ সোমেনবাবু। সোমেন কোটালের কথা থেকে জানা গেল, নাগেরবাজার উড়ালপুলে তিনি অনেক ছানবিন করেও ভূত দেখেননি।
প্রবীরবাবু এবার আপনার কাছে ফিরে আসছি। অনেকক্ষণ ধরে আপনি বলছেন ভূত যদি কেউ দেখতে পায় তাহলে তাকে আপনি একটা surprise gift দেবেন।
প্রবীর : না না। সে দেখতে পেলে আমি কেন দেব? সে তো এখনই ১০০ জন এসে বলবে আমি দেখেছি-দেখেছি করতে করতে।
আসলে দেখাতে হবে আমাদের এবং আগেই নিউজ টাইমকে অভিনন্দন জানাচ্ছি দারুণ করেছেন। কারণ গুজবটাও করা হয়েছিল একাধিক মিডিয়া থেকে। একেবারেই গুজবটা তৈরি করা হয়েছিল একাধিক মিডিয়া থেকে। আপনারা সেই গুজবকে উৎপাটন করছেন সেজন্য ধন্যবাদ। আপনাদের সঙ্গে আছি, থাকব।
যদি কেউ ভূত দেখাতে পারেন তাহলে ২৫ লক্ষ টাকা দেব যেটা আমার বইতে লেখা থাকে। গোটা চল্লিশেক বইতে তো লেখা আছেই আমার চ্যালেঞ্জের কথা। নিন চ্যালেঞ্জ। যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী আছেন তাঁরা দেখিয়ে দিন।
সঞ্চালিকা : তাহলে যে সমস্ত দর্শকবন্ধুরা এই মুহূর্তে নিউজ টাইমের পর্দায় চোখ রেখেছেন, তাঁরা প্রবীরবাবুর চ্যালেঞ্জ আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন যে ভূত দেখার প্রমাণ মিললে কিন্তু ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।
এই মুহূর্তে আমরা চলে যাব নাগেরবাজার উড়ালপুলে। সেখানে আমাদের প্রতিনিধি পিনাকপাণি ঘোষ রয়েছেন। পিনাক ৮টা ২০ নাগাদ তোমার সাথে কথা হয়েছিল। এই মুহূর্তে প্রায় পৌনে নটা বাজে। রাত ঘনিয়ে আসছে। এবং মোক্ষম টাইম চলে আসছে। কী দেখছ এই মুহূর্তে? কী সিচুয়েশন দেখতে পাচ্ছ সেখানে তা আমাদের জানাও।
সাংবাদিক : একটু উৎসাহী মানুষের ভিড় হয়ে গেছে। প্রবীরবাবু রয়েছেন আমাদের স্টুডিয়োয়। অন্যান্য অতিথিরাও রয়েছেন। ফোন করেছিলেন সোমেন কোটাল। কথা হয়েছে। কিন্তু সকলেই বলছেন যে, না, ভূত বলে কিছু নেই।
এবং আমরাও সেটাই প্রমাণ করতে চাইছি। মানুষের মন থেকে আতঙ্ক দূর করার জন্যই আমাদের আজকের অনুষ্ঠান। ভূত নেই কিন্তু আতঙ্ক সত্যি। এখানে আতঙ্ক একটা তৈরি হয়ে রয়েছে। উড়ালপুলের ঠিক পাশেই যাদের বাড়ি রয়েছে তারা দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছে। গল্পের বইতে যখন আমরা পড়ি তখন গা ছমছম করে অনেকসময় এবং এটা যদি নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় একটা ভুতের গল্প তৈরি হয় তাতেও তো আতঙ্ক তৈরি হয়।
আমরা পাশেই বাড়ির একটা বাসিন্দাকে পেয়েছি যাঁর কাছ থেকে জানতে চাইব আপনারা কেমন আছেন?
স্থানীয় বাসিন্দা : যেদিন অ্যাকসিডেন্টটা হয়, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডিটেলস ব্যাপারটা দেখেছিলাম যে কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, কীভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, পাড়ার একজনকে দাদা বলি, সে কীভাবে ভুলেছে, সব দেখেছি।
এবার তারপর থেকেই একটা গা ছমছমানি ভাব থাকে। জানালাটা রাত্তিরে খুললে কীরকম একটা লাগে।
ভূত-কুত সেরকম কিন্তু দেখিনি। কোনও লোক দেখিনি। ভূত বলে যে কিছু আছে মানিও না, দেখিওনি। কিন্তু ওই যে দৃশ্যটা দেখেছিলাম সেটা দেখার পর কীরকম যেন একটা চোখে ভাসে। কীরকম একটা আতঙ্ক মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
সঞ্চালিকা : পিনাক তুমি বলো উড়ালপুলে টহলদারি কেমন হয় টহলদাররা কিছু কি দেখেছে?
পিনাক : আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। স্বরূপ তরফদার স্থানীয় সাংবাদিক আমাদের। তিনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা নিছকই গুজব।
এই ব্রিজে যে টার্নগুলো রয়েছে, গাড়িগুলো ওখান থেকে একটা গতি নিয়ে আসে। এই টার্নে যদি একই গতি নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তাছাড়া শুধুমাত্র এই টানটানিতে অন্ধকার হয়ে রয়েছে।
সঞ্চালিকা : লোপামুদ্রাদি বাইশ বছর ধরে আপনি রিসার্চ করছেন। এই বাইশ বছরে খোদ কলকাতার এরকম ধরনের ঘটনার অভিজ্ঞতা কি আপনার হয়েছে না কি পুরোটাই মফসস্লের?
লোপামুদ্রা : আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি সেটা শহর কলকাতার নয়, একটু মফস্সলের। তো সেখানে একসাথে ৬ জন লোকের ভর হয়। সকাল থেকে সন্ধে অবধি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকের কেউ কালী হয়, কেউ শিব হয় তো কেউ দুর্গা হয়। নানানরকম ভর হতে থাকে।
এটা একটা হিস্টিরিয়ার রিজন তা আমি বুঝতে পারছি। এবং তাদেরকে যা জিজ্ঞেস করা হয় তারা সব সত্য বলে দেয়। এরকম একটা ব্যাপার।
এই হিস্টিরিয়াগুলো হয় আর কি। এগুলো হওয়ানোও যায়। এগুলো হওয়ানো কোনও কঠিন নয়। চাইলে ঘটানো যায়।
সঞ্চালিকা : উড়ালপুলে রয়েছে আমাদের প্রতিনিধি। আমরা জেনে নেব তাদের কাছ থেকে এখন ওখানে কী হচ্ছে?
সাংবাদিক : আর একটা বিষয় যখন আমরা সরাসরি এই খবরটা সম্প্রচার করার জন্য এসেছি এবং দমদম থানার আই সি-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি জানিয়েছেন, এই বিষয়টা নিয়ে টেলিফোনে বিভিন্ন সময় ওনার কাছে খবর গেছে। তাকে যখন বলা হয়েছে থানা থেকে যে, আপনি সামনে আসুন, আপনার সঙ্গে কী ঘটনা ঘটেছে, এসে বলুন। সে কিন্তু তখন প্রকাশ্যে আসছে না, টেলিফোনে ফোন করছে।
বিষয়টা এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এর পিছনে কোনও চক্র কাজ করছে কি না সে বিষয়গুলো আস্তে আস্তে উঠে আসবে। জুমেলা আমি আমাদের অতিথি প্রবীরবাবুর কাছে একটা বিষয় জানতে চাইব, ‘আমি ভূত দেখেছি' এই গল্পটা বলার মধ্যে কী একটা গল্প আছে যে সবাই আমাকে একটু গুরুত্ব দেবে, তারা শুনতে চাইবে কেমন করে দেখলাম।
এইভাবেই কি অনেক সময় গল্প রটে যায় যে দেখিনি কিছু, যা শুনেছি সেটাই আমার জীবনে বাস্তব ঘটেছে? এরকম কি মানুষের মধ্যে মনোভাব দেখা যায়?
প্রবীর : হ্যাঁ। এবং অবশ্যই দেখা যায়, ভীষণভাবে দেখা যায়। কারণ, আমি আমার জীবনে দেখেছি এরকম ধরনের প্রচুর উদাহরণ যে, গুজব এরকমভাবেই প্রত্যক্ষদর্শীতে ভর্তি হয়ে যায়।
‘অলৌকিক নয়, লৌকিক দ্বিতীয় খণ্ডে’ এরকম ভূতের কাহিনিতে ভর্তি যে, এক-একজন ডাক্তার থেকে শুরু করে অনেকেই মিথ্যে কথা বলে গেছেন। সেগুলো প্রকাশ্যে প্রমাণ করে দিয়েছি যে এগুলো মিথ্যে কথা বলেছে।
তাঁরা মিথ্যে কথা বলেন। আমি এবার সরাসরিভাবে জানাচ্ছি যে, নিউজটাইম গুজবটা শেষ করে দিল। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে। কারণ দেখবেন প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কিন্তু ফোন করছেন না। এই ৫০ লাখ টাকার চ্যালেঞ্জ জানার পরেও ফোন করছেন না। আতঙ্ক উড়িয়ে দেওয়ার পরেও...
সঞ্চালিকা জুমেলা পাশ থেকে জানিয়ে দিল যে চ্যালেঞ্জ মূল্য ২৫ লাখ টাকা।
আমি তখন বললাম, ও ২৫ লাখ। আচ্ছা ৫০ লাখ বলে ফেলেছি ঠিক আছে। ৫০ লাখই দিয়ে দেব। তাতেও চেক বাউন্স করবে না। যান ৫০ লাখই করে দিলাম।
সাংবাদিক : প্রবীরবাবু আপনাকে প্রশ্ন করব এই আতঙ্ক দূর করার জন্য কী করা যেতে পারে?
প্রবীর : এই যে আজকে নিউজ টাইম প্রোপাগান্ডাটা যে করছে, ঠিকঠাকমতো একটা প্রোগ্রামকে প্রেজেন্ট করছে সেটাই আতঙ্ক দূর করার পক্ষে যথেষ্ট, যথেষ্ট এবং শেষ কথা। দক্ষিণ দমদম পৌরসভাতে প্রচুর মানুষ, প্রত্যক্ষদর্শী জমায়েত হয়েছেন। এবং সেখানকার চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল সমীর চ্যাটার্জি বারবার ফোন করে আমাকে বলেছেন যে এই হচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শী।
আমি বলেছি প্রত্যক্ষদর্শীকে ফোন দাও। তাঁদের বলেছি টাকা নিয়ে যেতে। কোথায় কী!
বললেন, কী রে তুই যে বললি, এবার বল প্রবীর ঘোষের সামনে। একটা কথাও বলে না প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সাংবাদিক : আমাদের সঙ্গে যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকে কিছু বলতে চান।
তিনি মাইক ধরলেন একজন লোকের দিকে।
দর্শক : ২৫ লাখ টাকা দিয়ে আমাদের আতঙ্ক তো আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন স্যার। এই ব্রিজটা হওয়াতে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। সেই ব্রিজটাকে একটা ভূত বলে আতঙ্ক তৈরি করছেন।
গ্রামে-গঞ্জে যাচ্ছেন তো, মিদনাপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া যাচ্ছেন সেখানে জঙ্গলমহলে আপনারা ভূত দেখছেন না আর এই টাউনশিপে ভূত আসছে কোথা থেকে?
সাংবাদিক : এ ব্যাপারে স্থানীয় মানুষও আমাদের সঙ্গে একমত যে আদৌ ভূত নেই।
উড়ালপুলে প্রচণ্ড চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে গেল।
প্রবীর : যে কোনও সময়ে দেখেছি, জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছি তারা প্রত্যেকে পরাজিত হয়ে গেছে। জ্যোতিষ শাস্ত্রকে পেশাগতভাবে বে-আইনি পেশা করে ছেড়েছি। ভূত বা অবতারদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছি, অলৌকিকতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছি তখন আমরা জিতে প্রমাণ করে দিয়েছি এগুলো নেই।
ভূত যে কিছু নেই এটা প্রমাণ করার জন্য এই চ্যালেঞ্জটা দেওয়া হয়েছে। যিনি মনে করছেন এতে ভূতের প্রোপাগান্ডাটা আরও বাড়বে তিনি একটা ভুল ধারণার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন এটুকু নিশ্চিন্তে বলতে পারি।
লোপামুদ্রা : আপনাদের এই প্রয়াসটা আমার খুব ভালো লেগেছে। গুজবটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এই তিনদিন ধরে যে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে এটা খুব ভালো প্রচেষ্টা। এবার বোধহয় এটা বন্ধ হয়ে যাবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
সঞ্চালিকা : ২৫ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জটা বেড়ে গিয়ে ৫০ লক্ষ টাকা হয়ে গেছে অর্থাৎ যে ভূত দেখতে পাবে সে টাকাটা পাবে।
প্রবীর : না না। ভূত দেখতে পাবে না। আমাদের ভূত দেখাবে। যদি ফ্রড করে ভূত দেখায় তাহলে আমি সেই ভূতটা আর একটা তৈরি করে দেব। এরকম প্রচুর ভূতুড়ে কাণ্ড আমিও করাতে জানি।
চলুন। আমরা সরাসরিভাবে ওখানে যাব। এবং সরাসরিভাবে ওখানে থাকব। আপনারা চলুন। আমরা গিয়ে দেখতে চাই ভূত কী করে?
সঞ্চালিকা : অবশ্যই প্রবীরবাবু আমরা তো যাবই। আর আপনার ২৫ লক্ষ টাকার amountটা বেড়ে গিয়ে ৫০ লক্ষ টাকা হয়ে গেছে।
প্রবীর : হ্যাঁ হোক। তাতেও চেক বাউন্স করবে না।
সঞ্চালিকা : অর্থাৎ আপনি যাচ্ছেন এবং আজ আমরা ১১.৩৫-এ ভূতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করব প্রবীরবাবুকে নিয়ে।

ঘটনাস্থলে প্রবীর ঘোষ সরাসরি। আজ রাত ১১.৩৫ থেকে।
সরোজিনী নাইডু কলেজের কাছ থেকে উড়ালপুলে উঠতে গিয়ে দেখি পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ব্যারাকপুর, বারাসত, দমদম পুলিশের প্রচুর ভ্যান ও জিপ হাজির। ব্যারিকেড দিয়ে ব্রিজের ওপর রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চার-পাঁচ হাজার মানুষের ভিড়।
আমার সঙ্গে দমদম থানার ওসি কথা বলে গাড়িটা ছেড়ে দিলেন। আমরা ব্রিজে উঠলাম। একটা ওবি ভ্যান থেকে প্রচার চলছে। আমি যেতেই ক্যামেরাম্যান আর তিনজন সাংবাদিক আমার কাছে এগিয়ে এলেন। উটকো লোক হটিয়ে শুধু ওই তিনজনের মোবাইল নাম্বার আমার মোবাইলে সেভ করলাম।
বললাম, যা কিছু বলবেন মোবাইলে বলবেন। আমারও যা কিছু বলার মোবাইল-এ বলব। এখন ব্রিজের দু'পাশে চোখ-কান খোলা রাখুন।
ব্রিজের বাঁদিকের রেলিং-এ দেখলাম একটা ক্যালেন্ডার থেকে কাটা কালীর ছবি রেলিং-এর দেওয়ালে সাঁটা। ওখানে কাছে গিয়ে নজর করতে দেখলাম রেলিং-এর সঙ্গে একটা শক্ত নাইলন সুতো বাঁধা যা দিয়ে হাঙরও ধরা যাবে। খেয়াল করলাম সুতোটা রাস্তার ওপর পড়ে আছে এবং আর একটা প্রান্ত এসেছে এপারে। এবং এখানেও সুতোর অন্য প্রান্ত রেলিং-এ বাঁধা।
কাছে একটি বয়স কুড়ি-বাইশ-এর ছেলে একটা সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে ক্যামেরাম্যানকে বললাম কালীর ছবির কাছে বাঁধা সুতোটা ফলো করে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যেন স্পষ্ট করে তুলে রাখে।
এবার ওদের জানালাম যে চলো আমরা সবাই এবার স্টুডিয়োর দিকে গেলেই হবে। আমার ভূত ধরা হয়ে গেছে।
তলা থেকে নামৰ কী, হাজারে হাজারে লোকে আমাদের গাড়ি ঘিরে নানারকম প্রশ্নবাণ ছুড়ছে। কী হল দাদা? ভূত ধরতে পেরেছেন? ভূত দেখেছেন? ৫০ লাখ টাকা জীবনে দেখেছেন?
আমরা আবার স্টুডিয়োয় ঢুকলাম। পরে ক্যামেরায় স্পষ্ট জানালাম নাইলনের সুতোর স্পষ্ট গল্প। কোনও মোটরবাইক আসছে, ওই সুতোটা টান টান করে ধরলে যেকোনও সময় পড়ে যাবে মোটরবাইক।
এবং ক্যামেরায় সাইকেল আরোহী ছেলেটিকে দেখিয়ে বললাম যে, এই ছেলেটি এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে। একটু লক্ষ করলেই দেখবেন যে ওর ক্যারিয়ারে সুতো বাঁধা রয়েছে।
পরেরদিন ভোরবেলার ওসি ফোন করে জানালেন, ওই ছেলেটিকে থানায় নিয়ে এসেছি। আর তার সাথীদেরও নিয়ে এসেছি। একটু ধোলাই চলছে। আপনি কী স্টেপ নেবেন ওদের ব্যাপারে?
বললাম, একটু কড়কে ছেড়ে দিন তাহলেই হবে।
খবরটা বিশালভাবেই ছড়িয়েছিল—আগরপাড়ার একটা বাড়িতে রহস্যজনকভাবে যেখানে-সেখানে আগুন জ্বলে উঠছে যখন-তখন। আগুন প্রথম জ্বলেছিল গত ২৪ এপ্রিল ১৯৯৩। শনিবার সকাল ৯টায়। তারপর থেকে আগুন তাড়া করে ফিরেছে বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন সময়ে। আগুন ধরেছে বিছানার গদিতে, চাদরে, শাড়ির কোনায়, খাতায়, বই-পত্তরে এমনকী কাঠের ইঁদুর-কলে। রহস্যময় এমন আগুনের যখন-তখন আক্রমণে বাড়ির সকলের নাওয়া-খাওয়া-শোওয়া শিকেয় উঠেছে। বাড়ির প্রবীণতম সদস্য সদানন্দ দাস। সংসারে আছেন তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে, বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, তিন পুত্রবধূর বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে ও পাঁচ নাতি-নাতনি। সবচেয়ে বড় নাতি বাবাই পড়ে ক্লাস সেভেন-এ।
ও বাড়িতে আর থাকতেন চার ঘর ভাড়াটে, যাঁদের এক ঘর বাড়ি ছেড়ে উঠে গেছেন ভূতুড়ে আগুনের আক্রমণে গত মঙ্গলবার।
আগুন-হানার রহস্য উন্মোচনে যাঁরা সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন সপ্তর্ষি ক্লাবের টগবগে তরুণা। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন স্থানীয় দমকল বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ। পাশের পুরনো কুয়ো থেকে কোনও গ্যাস বেরিয়ে এমন অঘটন ঘটিয়েছে কি না—পরীক্ষা করত দমকল বাহিনী দড়ি বেঁধে হ্যারিকেন নামিয়েছে। হ্যারিকেন নিভে যেতে কুয়োকে গ্যাস মুক্ত করতে জল এনে কুয়ো ভর্তি করে কুয়োকে গ্যাসমুক্ত করেছেন, কিন্তু তাতেও বাড়িকে আগুন-মুক্ত করতে পারেননি। অগত্যা বাড়ির বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও আগুন-রহস্য পিছু ছাড়েনি। বাড়ির ছেলেরা ওঝা নানুবুড়োকে এনেছেন গত বৃহস্পতিবার সকালে। প্রণামী দুশো একান্ন টাকা। নানুবুড়ো জলপড়া ছেটাবার সময়ই আগুন জ্বলেছে একটা খবরের কাগজে। খড়দার এক ভর-এ পড়া মানুষের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাড়ির লোকেরা। তিনি ভরগ্রস্ত অবস্থায় জানিয়েছিলেন, ‘ব্রহ্মভূত এমনটা ঘটাচ্ছে।’ জলপড়া দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরের চারপাশে জলপড়া ছেটানো হয়েছে। কিন্তু আগুন ঠেকানো যায়নি তাতেও।
পরের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য দেবাশিস চ্যাটার্জি গিয়েছিলেন সমিতির তরফ থেকে সরেজমিনে তদন্ত করতে। ঘরের প্রত্যেক সদস্যকে একঘরে কথায় কথায় আটকে রেখেছিলেন রাত সাড়ে ন’টা থেকে শুক্রবার সকাল পাঁচটা পর্যন্ত। এই প্রথম ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনও আগুন জ্বলল না। দেবাশিস জানিয়ে এলেন শুক্রবার প্রবীর ঘোষ আসবেন। শুক্রবার দুপুর দুটো তিরিশে নিজে গিয়ে হাজির হলাম ওই বাড়িতে।
শুনলাম এখনও পর্যন্ত আর একবারের জন্যেও আগুন ধরেনি। আমি যাব খবর পেয়ে 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও 'সংবাদ প্রতিদিন' পত্রিকার সাংবাদিক ও চিত্র-সাংবাদিকরা হাজির হয়েছিলেন আমারও আগে।
ঘরে বসেছিলেন এক মাজারের পির। পিরকে এনেছেন বাড়ির বড় ছেলে সমীর দাসের শ্যালক সনৎকুমার। পিরসাহেব ঘণ্টা দেড়েক ‘ভর হওয়া' মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে জানিয়েছেন—জিনের কাগু। পির চার দেওয়ালে চারটে গজাল পুঁতে দিয়ে বাড়ি বেঁধে দিয়েছেন জিনের কারসাজি বন্ধ করতে।
সমস্যা হল ভিড়। যে ঘরে ঢুকি আমার সঙ্গে ঢুকে পড়েন এক ঝাঁক উৎসাহী জনতা, সপ্তর্ষির সদস্যরা ও সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিকরা। আমি গিয়েছি ‘আজকাল’ পত্রিকার তরফ থেকে। চিত্র-সাংবাদিক হিসেবে সঙ্গে এসেছেন অভিজিৎ মুখার্জি। ভুতুড়ে পোড়ার কিছু স্যাম্পেল দেখা দরকার। বাড়ির সম্প্রতি পোড়া কিছু জামা-কাপড় বা কাগজ এনে দিতে বলতে মেজছেলে প্রবীর ও সনৎবাবু একটা শো-কেসের ওপরে পাতা আধ-পোড়া খবরের কাগজ থেকে কিছুটা ছিঁড়ে দিলেন, গন্ধ শুকলাম। কোনও তীব্র বিশেষ গন্ধ পেলাম না, যেটা মেটালিক সোডিয়ামের সাহায্যে জ্বালালে হত। সবার সামনে কাগজে কিছুটা জল ঢেলে দিতেই খবরের কাগজের রঙ মুহূর্তে হয়ে গেল হালকা বেগুনি। যেমনটা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটে জল পড়লে হওয়া উচিত। ঘরে তখন অনেক দর্শক। আগুনের ক্ষেত্রে যে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের একটা প্রবল ভূমিকা ছিল এটা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, এর সঙ্গে গ্লিসারিন মিশলেই বিক্রিয়ায় আগুন জ্বলে, আর এ ভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে আগুন জ্বালানো হয়েছে। পটাশিয়াম মেশানো জল জিভে চেটে দেখলেন আজকাল-এর চিত্র-সাংবাদিক অভিজিৎ মুখার্জি, চাখলেন সনৎবাবু। দুজনেই একমত—হ্যাঁ, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটই।
পরিবারের সকলের সঙ্গেই আলাদাভাবে কথা বললাম। বাইরের কারও পক্ষে এই ঘরে বিভিন্ন সময়ে ঢুকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও গ্লিসারিন আগুন জ্বলে ওঠার মতো করে গুছিয়ে রেখে যাওয়া অসম্ভব। সুতরাং এটা ভাড়াটে বা কোনও প্রমোটারের পরিকল্পনার অঙ্গ হতে পারে না। তবে যে জ্বালাচ্ছে, সে এই দুটির ব্যবহার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। আমাদের সমিতির ‘অলৌকিক, নয়, লৌকিক’ বইটি
আগরপাড়ায় সদানন্দ দাসের বাড়িতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা। শুক্রবার
ছবি : অভিজিৎ মুখার্জি, ১ মে, ১৯৯৩ আজকাল পড়ে এই রসায়ন দুটির প্রয়োগ শিখেছে, এমনও হতে পারে। খুবই ক্যাজুয়েল ভঙ্গিতে অথচ আসলে সতর্কতার সঙ্গে বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম। জানালাম এই পরিবারেরই একজন ঘটনাটা ঘটাচ্ছে। এই পরিবারেরই একজন এমনটা ঘটাচ্ছে বলায় বাড়ির কেউই তেমন সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এমন কি ওই দুটি রসায়নে আগুন জ্বলে—এটা মানতেই চাইলেন না। আবার ‘সপ্তর্ষি’র কেউ কেউ যদিও বা মানলেন, তবু তাঁদের জিজ্ঞাসা- আগুন জ্বলার সময় ধারে-কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? হাতে-কলমে আমাকে পরীক্ষা করে দেখাবার জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানালেন দু-একজন অতি উৎসাহী দর্শক। সপ্তর্ষির এক তরুণ দৌড়ে কিনে আনলেন গ্লিসারিন ও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। বাড়ির বড় বউ দিলেন এক টুকরো কাপড়। কাপড়ের ভাঁজে পটাশিয়াম ছড়িয়ে দিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম কাপড়টা। কাপড়ে গ্লিসারিন ঢেলে দিলাম। এক সময় গ্লিসারিন গা বেয়ে নেমে এল, পটাশিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া শুরু করল, ধোঁয়া-পোড়া গন্ধই হচ্ছিল। পোড়া কাপড়ে এক গ্লাস জল ঢেলে দিতেই কাপড়টা হালকা বেগুনি হয়ে গেল— খবরের কাগজটার মতোই।
সমীরবাবু বললেন, ‘আপনি তো বললেন আমাদের পরিবারেরই কেউ এমনটা ঘটাচ্ছিল। আপনার কথা যদিও মেনে নিই, তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, যে ঘরে যখন আগুন জ্বলছে তখন দেখা গেছে ঘর ফাঁকা, কেউ নেই।’ ‘তেমনটাই তো হওয়ার কথা। যে আগুন জ্বালাচ্ছিল, সে যথেষ্ট চালাক। গ্লিসারিন ঢালছে কাপড়ে বা চাদরে। যেখানে ঢালছে তার কিছুটা নীচে রাখছে পটাশিয়াম। গ্লিসারিন ধীরে ধীরে নামছে। ততক্ষণে ভিলেন অনেক দূরে। তাই প্রতিবারই ঘটনাস্থলে ঘটনার সময় ভিলেনের দেখা মেলেনি।’
সপ্তর্ষির অনেকেই জানতে চাইলেন ভিলেনের নাম। সম্ভবত তাতেই উদ্দীপ্ত হয়ে বাড়িরই এক বউ প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘নামটা যদি জানেনই তো জানান না।’
বললাম, ‘দেখুন যে এমনটা করেছে, সে আমাকে কথা দিয়েছে আর করবে না। তার কথা ক্যাসেটবন্দি করা আছে। তাকে আমিও কথা দিয়েছি, আর এমনটা না করলে তার নাম কাউকে জানাব না। আপনাদের প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ তাকে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিন। এরপরও সে যদি আবার এমন ঘটনা ঘটায় আমি নিজে এসে তার স্বীকারোক্তি আপনাদের শুনিয়ে দিয়ে যাব।’
আমার এই কথা শোনার পর কেউ আর নাম জানাতে পীড়াপীড়ি করেননি।
এ-ভাবেই আগুন ভূতের টগবগে রহস্যে জল ঢেলে দিয়ে আগরপাড়ায় বিজ্ঞানমনস্কতার জয়কেই আবারও ঘোষণা করে এলাম।
১মে ’৯৩-এ বহু পত্রিকাতেই ছবিসহ এই রহস্যভেদের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯ জুলাই, বুধবার ২০০০

কলকাতার হাসপাতালে ভূত
সালটা ২০০৭, তারিখ ৮ মার্চ। কলকাতা টি.ভি.-র সঙ্গে সন্ধে নাগাদ গেলাম পাইকপাড়ার ‘ইন্দিরা মাতৃসদন ও শিশু কল্যাণ হাসপাতাল’-এ। টিভির ‘ওবি’ ভ্যান সঙ্গী। ‘লাইভ’ টেলিকাস্ট হবে।
আমরা পৌঁছনোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিশাল ভিড়। বাস, গাড়ি চলাচল বন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল পুলিশবাহিনী হাজির। হাসপাতালের ইনচার্য ডাঃ ডি বাসুকে ফোনে ডেকে আনা হল। তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, সকাল থেকে রোগী ও শিশুদের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু বিকেল হতেই ভিড় ফাঁকা। প্রয়োজনেও কোনও রোগী ভর্তি হয় না। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন এই হাসপাতালে ভূত থাকে। না আমি কোনও দিনই রাতে থাকেনি।
—কেন থাকেননি?
আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, রাতে একটিও রোগী থাকে না। থেকে কী করব?
—রাতে যে কর্মীদের ডিউটি থাকে এবং তার জন্য মাইনেও পান, তাঁরাও থাকেন না?
আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, না কেউ থাকেন না। জানালাম, এই এলাম। সন্ধে ৭টা ৩০ বাজে। ঢোকার সময় দেখলাম, কয়েকজন লোক মদ খেতে খেতে তাসের জুয়া খেলছে। এই হাসপাতাল কি অসামাজিক কাজের জায়গা? এমনটা ঘটলে তো এইসব সমাজবিরোধী লোকেদের ভয়েই রোগিনীদের সম্মান নিয়ে টানাটানি হতেই পারে। তাই নয় কি?
উত্তর নেই।
ফোন করলাম স্বাস্থ্য অধিকারী স্ত্রী বক্সিকে। তিনি জানালেন, এত জানতাম না। মিডিয়ার কাছ থেকে এই প্রথম শুনলাম। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা নেব?
বললাম, সব বেড ফাঁকা পড়ে আছে। কোনও কোনও রুমে ও কম্পাউন্ডের ভেতর মদ-জুয়ার আসর চলছে। এইগুলো বন্ধ করুন। যারা কম্পাউন্ডে অসামাজিক কাজ করছিল, স্থানীয় ছেলেরা আমাদের ঘিরে রেখেছে। পুলিশকে বলুন, ওদের অ্যারেস্ট করতে। আমি এখানে হাজির একজন সার্জেন্টের মোবাইল নম্বর দিচ্ছি। তাঁকে ফোন করুন। নিন নম্বরটা লিখুন....
বাইরে এসে জনতার উদ্দেশে বললাম, এই হাসপাতালে কোনও ভূত নেই। আদশে ভূত বলেই কিছু নেই। কেউ যদি আমাকে ভূত দেখাতে পারেন, তাঁকে দেবো ২৫ লক্ষ টাকা। এই কয়েকজন সমাজবিরোধী, ভূতের ভয় দেখাচ্ছিল, মহিলাদের শ্লীলতাহানী করছিল। আপনারা পাড়ার লোকেরা যদি রুখে দাঁড়ান, তবে হাসপাতাল ভূতমুক্ত হবে। আপনাদের সেবায় লাগবে।
আমাদের এবার ফেরার পালা। আমার গাড়ি ও ওবি ভ্যান এগলো জনতার বিরাট উল্লাসের মধ্য দিয়ে।
