অলৌকিক নয়, লৌকিক (দ্বিতীয় খণ্ড)/অধ্যায় সাত


সাত


আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়-ফুঁক

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের আদিবাসী সমাজের জানগুরুরা (অঞ্চলভেদে তাকে যে নমেই ডাকা হোক না কেন) চোর ধরতে, চুরি যাওয়া জিনিসের হদিশ দিতে, অথবা চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রচলিত দেশীয় ওষুধ ঠিকমতো নির্ণয় করতে না পারলে অর্থলোভে, জীবিকার স্বার্থে অথবা নিজের অক্ষমতা ঢাকতে কোনও মানুষকেই ডাইন বা ডাইনি ঘোষণা করে এ সবের জন্য দায়ী করে। এ শুধু লোক ঠকানোর ব্যাপার নয়, শুধুই প্রবঞ্চনা ও প্রতারণার মাধ্যমে এরা অজ্ঞ গ্রামবাসীদের আর্থিকভাবে শোষণই করে না, এরা ঠাণ্ডা মাথায় খুনে। এরা শুধু যে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতেই কাউকে ডাইন ঘোষণা করে, তা নয়। অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে স্বার্থান্বেবীর হয়ে ঘাতকের ভূমিকা গ্রহণ করে, কাউকে ডাইনি ঘোষণা করে।

 মানুষের দুর্বলতা ও অজ্ঞতাই জানগুরুদের শোষণের হাতিয়ার। মন্ত্রশক্তিকে নয়, বিজ্ঞানের কৌশলকে কাজে লাগিয়েই ওরা মানুষ ঠকিয়ে চলেছে। কী সেই কৌশল? আসুন, সেগুলো নিয়েই এখন আমরা একটু নাড়াচাড়া করি।

চোর ধরে আটার গুলি

 বাড়িতে চুরি হলে ওঝার কাছ থেকে বাড়ির লোক হাজির হন। ওঝা পয়সা ও পাঁচপো আটা আনতে বলে। গৃহস্বামীর কাছ থেকে জেনে নেয় কাকে কাকে তিনি সন্দেহ করছেন। আটাতে মন্ত্র পড়া হয়। মন্ত্র পড়া আটা থেকে কিছুটা নিয়ে প্রয়োজনমাফিক জল ঢেলে শক্ত করে মাখা হয়। এবার আসে একটি জলভর্তি বাটি। গুঝা মাখা আটা থেকে একটু করে আটা ছিঁড়ে নিয়ে একটি করে গুলি পাকায়, একজন করে সন্দেহভাজন মানুষের নাম বলে বাটির জলে ফেলতে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মে আটার গুলি ডুবে যাওয়ার কথা। যেতেও থাকে তাই। কিন্তু দর্শকরা হঠাৎ দেখতে পান একটা গুলি জলে ডুবে গিয়ে আস্তে আস্তে আবার ভেসে উঠছে। এমন তো ঘটার কথা নয়? কার নামে আটা ফেলা হয়েছিল? যাঁর নামে আটা ফেলা হয়েছিল গ্রামবাসীরা তাঁকেই ধরেন। অনেক ক্ষেত্রে ধৃত ব্যক্তি চোরাই জিনিস বের করে দেন। অনেক ক্ষেত্রে জানান জিনিসটি বিক্রি করে দিয়েছেন অথবা জিনিসটা যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে এখন পাচ্ছেন না। কেউ বোধহয় চোরের উপর বাটপাড়ি করেছে।

 এখন দেখা যাক কীভাবে আটার গুলি জলে ভাসে। কীভাবেই বা সত্যিই চোর ধরা পরে?

 আটার গুলি বানাবার সময় আটার ভিতরে মুড়ি, খই, শোলার টুকরো বা থার্মোকলের টুকরো ঢুকিয়ে দিলে এবং মুড়ি খইয়ের উপর অতি সামান্য আটার আস্তরণ থাকলে, আটার তৈরি গুলিটা সম-আয়তনের জলের চেয়ে হালকা হলে, গুলি জ্বলে ফেলার পর ভেসে উঠবে। মুড়ি বা খইয়ের চেয়ে শোলা বা থার্মোকল অনেক বেশি হালকা তাই শোলা বা থার্মোকলের টুকরো আটার গুলিতে ঢোকালে সেই আটার গুলি আরও কম আয়েশে ভাসানো যাবে।

 চোর কি ধরা পড়ে? এটা আগেই মনে রাখা প্রয়োজন চুরি করার কথা স্বীকার করার অর্থ কিন্তু এই নয়, বাস্তবিকই সে চোর।

 সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। যতদূর মনে আছে ঘটনাটা এই ধরনের: একটি মহিলার বিকৃত মৃতদেহ পুলিশের হাতে আসে। পুলিশ দপ্তর থেকে ছবিটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ছবি দেখে এবং অন্যান্য পোশাক-আশাক ও চেহারার বিবরণ দেখে জানান এটি তাঁদের পরিবারের মেয়ে। মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি স্বামী-রত্নটি বউয়ের খোঁজে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন। বউ নাকি ঝগড়া করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ। শ্বশুরবাড়িতে এসেছে কি না, তারই খোঁজ করতেই স্বামী বাবাজির এখানে আসা।

 স্বামীটিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোর্টে কেস ওঠে। স্বামী শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেন, তিনিই স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন। কেসের বিবরণ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এবার ঘটে যায় আর এক নাটক। যাঁর হত্যা নিয়ে এই বিচার, তিনি স্বয়ং আদালতে হাজির হয়ে জানান, তিনি জীবিত, বাস্তবিকই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে ঘর ছেড়েছিলেন। এতদিন ছিলেন এক বান্ধবীর বাড়িতে। পত্রিকায় তাঁর হত্যার কথার স্বামী স্বীকার করেছেন খবরটি পড়ে হাজির হয়েছেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া একটা অদ্ভুত ঘটনায় মিটে গেল।

 স্বামীটি হত্যা না করেও কেন হত্যার অপরাধ স্বীকার করে কঠিন শাস্তিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন? সম্ভবত শারীরিক বা মানসিক অথবা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন এর চেয়ে যে কোনও শাস্তিই অনেক লঘু।

 ডাইনি প্রথার ক্ষেত্রে সে সব সন্দেহজনক ব্যক্তির নান গৃহস্বামী দেন, তাদের মধ্যে কেউ চুরি করতেই পারে। তার নামের গুলি ওরা জলে ভাসালে গণপ্রহারে চোর চুরি যাওয়া জিনিস বের করে দেয়। কিন্তু যদি ভালো মানুষের নামের গুলি ভাসে তখন গণপ্রহার থেকে বাঁচতে ভালো মানুষটিও অপরাধ স্বীকার করে জরিমানা দেওয়াকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।

হাতে ফুটে ওঠে চোরের নাম

 শুধু আদিবাসী সমাজেই নয়, বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে অদ্ভুত পদ্ধতিতে চোর ধরা হয়। ওঝা মন্ত্রশক্তিতে চোরের নাম বলে দিতে পারেন, এই বিশ্বাস নিয়ে যখন কেউ নিজের চুরি যাওয়া জিনিস উদ্ধার করতে ওঝার দ্বারস্থ হন, তখন ওঝা জেনে নেন সন্দেহজনকদের নাম। অনেক ক্ষেত্রেই নাম জানার পর ওঝার এজেণ্টরা এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে আরও কিছু তথ্য সরবরাহ করে ওঝাকে।

 দক্ষিণার বিনিময়ে ওঝা চোর ধরতে নানা ধরনের অং-বং-চং মন্ত্র আওড়ায়। তারপর একটা কাগজে লিখে ফেলে সম্ভাব্য চোরেদের নাম। সেই কাগজ পুড়িয়ে তৈরি করা হয় ছাই। সেই ছাই ওঝা নিজের হাতে বা সহকারী কারো হাতে ঘষে ছাই বেড়ে ফেলতেই উপস্থিত দর্শকরা দেখতে পান ছাঁই ঘসা হাতে কালো হরফে ফুটে উঠেছে একটা নাম। যার নাম উঠেছে সে সন্দেহভাজন একজন। তার ওপর চাপ পড়লে কখনো-সখনো চাপে পড়ে স্বীকার করে চুরির কথা। কখনও চুরির মাল ফেরত পাওয়া যায়। কখনও বা জরিমানা দিয়ে উদ্ধার পেতে হয়। ঘোষিত চোর কেন অপরাধ স্বীকার করে? সে প্রসঙ্গে গেলে, বার বার একই কথা শোনাতে হবে বলে নীরব রইলাম। বরং আসি, কী করে ওঝা ছাই ঘষে হাতে নাম ফুটিয়ে তোলে।

 ঘন সাবান জল অথবা বটের আঠা অথবা ঐ জাতীয় কিছুকে কালির মতো ব্যবহার করে কাঠিজাতীয় কিছু দিয়ে হাত চোর হিসেবে যার নাম ঘোষণা করা হবে, তার নামটি লিখে রাখা হয়। অর্থাৎ হাতে লেখা হল আঠা-জাতীয় জিনিস দিয়ে। ছাই ঘরতেই লেখার আঠা ছাইগুলোকে ধরে নেয়। মুখের ফুঁয়ে বা হাতের ঝাপটায় উড়ে যায় বাকি ছাই। তাই পরবর্তী পর্যায়ে দর্শকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে ছাইয়ে লেখা নামটি।

চোরের কলা কাটা পড়ে মন্ত্রে

 ওঝা সন্দেহভাজনদের হাতে ধরিয়ে দেয় একটা করে খোলা-সহ গোটা পাকা কলা, চলতে থাকে তন্ত্র-মন্ত্র। মন্ত্রের পাঠ চুকতে একজন করে সন্দেহভাজন মানুষ এগিয়ে আসেন। কলার খোসা ছাড়ায় সকালের সামনে। খোসা ছাড়াবার পর ওঝা পরীক্ষা করে দেখেন কলাটার ভিতরটা দু-টুকরো করে কাটা কি না। গোটা থাকলে কলা ধরেছিল যে, খায়ও সে। এরই মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে ঘটে যায় বিস্ময়কর কিছু। খোসা ছাড়াতেই দেখা যায় কলাটা পরিষ্কার দু-টুকরো করে কাটা। অবাক কাণ্ড। তখনও খোসা পরীক্ষা করলে দেখা যায়, খোসা গোটাই রয়েছে।

 প্রতিটি আপত-অলৌকিক ঘটনার মতোই চোরের কলা কাটা পড়ে মন্ত্রে নয়, কৌশলে। কৌশলটাও অতি সহজ সরল, একটা গোটা কলা নিন। একটা পরিষ্কার ছুঁচ। এবার ছুঁচটা কলার যে কোনো এক জায়গায় ঢুকিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে কলার শাঁসের চারপাশটা ঘোরান। পুরোটা ঘোরানো হলে ছুঁচটা বের করে নিন। কলার খোসার গায়ে ছুঁচের সূক্ষ ছিদ্র ছাড়া আর কিছু নজরে পড়বে না। অথচ ভিতরের কলাটা কাটা পড়েছে ছুঁচটা পুরোটা ঘুরে আসার ফলে। খোসা ছাড়াতেই কাটা কলা দৃশ্যমান হবে।

নখদর্পণ

 যাঁর বাড়িতে চুরি হয়, সাধারণ তাঁদের পরিবারের কোনও শিশু, কিশোর বা মহিলাকে দেখানো হয় নখ-দর্পণ বা নখের আয়না। সেই দর্পণে ফুটে ওঠে চোরের ছবি। এমনকী, অনেক সময় নাকি, কেমনভাবে চুরি হয়েছিল, কীভাবে চোর এলো, কী ভাবে চোর পালাল, সমস্ত ব্যাপারটাই চলচ্চিত্রের মতোই একের পর এক নখের উপর ফুটে ওঠে। পুরো ঘটনাটাই ঘটানো হয় অপ্রাকৃতিক উপায়ে, গুনিন বা ওঝার ‘অলৌকিক’ ক্ষমতায়।

 বহু ওঝার নখ-দর্পণ ক্ষমতার খবর পেয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই খবরদাতাদের বলেছি, আমি একটা জিনিস লুকিয়ে রাখব। নখদর্পণে ওঝা লুকানো জিনিস বের করে দিতে পারলেই দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা। খবরদাতারা প্রায়শই প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেছেন। সেই ওঝাকে পরীক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেবেন কথা দিয়েও কেউ রাখেনি। এখনও আমি সেই একই ভাবে নখ-দর্পণ করতে পারা ওঝার খোঁজে আছি। যে কেউ এমন ওঝা এনে নখ-দর্পণের বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারলে ওঝার হাতে তুলে দেব প্রণামীর পঞ্চাশ হাজার টাকা। এটা অতি স্পষ্ট এবং সত্য যে প্রতিটি অলৌকিক ঘটনার মতোই নখ-দর্পণের অস্তিত্বও রয়েছে শুধুই গাল-গল্পে ও মিথ্যাভাষণে। এদিকে এখন একটু তাকাই—নখ-দর্পণ ব্যাপারটা কী? সত্যিই কি তাহলে কিছুই দেখা যায় না? নখ-দর্পণ যেভাবে করা হয় তা হল এই: যাঁদের বাড়ি চুরি হয়েছে তাঁদের পরিবারের একটি শিশু, কিশোরী একান্ত অভাবে একজন আবেগপ্রবণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মহিলাকে বেছে নেওয়া হয় মিডিয়াম হিসেবে। মিডিয়ামকে পাশে বসিয়ে এঝা বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে সন্দেহভাজন মানুষদের নামগুলো জেনে নিতে থাকে। মিডিয়ামও নিজের অজ্ঞাতে সন্দেহভাজন মানুষগুলোর বিষয়ে জেনে নেয়। স্বাভাবিক কারণে সন্দেহভাজন এইসব মানুষগুলোও মিডিয়ামের পরিচিত ব্যক্তিই হয়। কীভাবে চুরি হতে পারে এই সব বিষয়েও ওঝা কিছু কথাবার্তা চালিয়ে যায়। তারপর মিডিয়ামের বুড়ো আঙুলে তেল (সাধারণ সরষের তেল) সিঁদুর বা তেল-কাজল লাগিয়ে দেওয়া হয়। চকচকে বুড়ো আঙুলটায় মন্ত্র পড়ে দেওয়া হয়। ওঝা বলতে থাকে, “বুড়ো আঙুলে এবার চোরের ছবি ভেসে উঠবে, চোরের ছবি ভেসে উঠবে। একমনে দেখতে থাক, দেখতে পাবে চোরের ছবি।” সম্মোহনের মতো করেই মিডিয়ামের মস্তিষ্ককোষে ধারণা সঞ্চার করা হতে থাকে যে চোরের ছবি ভেসে উঠবে। সম্মোহিত করে ধারণা সঞ্চারের মাধ্যমে যে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটানো যায় বা দেখানো যায় এ বিষয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’-এর প্রথম খণ্ডে। তাই আবার এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনায় গেলাম না।

 একসময় সম্মোহনী ধারণা সঞ্চারের ফলে মিডিয়াম বিশ্বাস করতে শুরু করে বাস্তবিকই চোরের ছবি ফুটে উঠবে তার নখে। আবেপ্রবণতা, বিশ্বাস ও সংস্কারের ফলে এক সময় মিডিয়াম সঞ্চারিত ধারণার ফলে দেখার আকুতিতে অলীক কিছু দেখতে থাকে। এটা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় Visual hallucination। মিডিয়াম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সন্দেহভাজন কোনো একজনের অস্পষ্ট একটা ছবি নিজের নখে দেখতে পাচ্ছে বলে বিশ্বাস করতে থাকে। কখনও বা অস্পষ্ট ছবি স্পষ্টতরও হয় মস্তিষ্ককোষে ধারণা সঞ্চারের গভীরতার জন্য। কখনও হাতের নখে মিডিয়াম দেখতে পায় চোরের আসা, চুরি করা এবং পালানো পর্যন্ত।

 কখনও কখনও নখ-দর্পণের ক্ষেত্রে Visual illusion-হ্যাঁ, ভ্রান্ত দর্শনের ঘটনাও ঘটে। তেল-সিঁদুর নখে মাখিয়ে দেওয়ায় নখটি চকচকে হয়ে ওঠে। অনেক সময় আশেপাশের মানুষজন, গাছপালা ইত্যাদির ছবি অস্পষ্টভাবে চকচকে নখে প্রতিফলিত হয়। অস্পষ্টতার দরুণ দড়িকে সাপ ভাবার মতোই প্রতিফলিত অস্পষ্ট ছবিকেই চোরের ছবি বা চুরির ঘটনার ছবি বলে মিডিয়াম বিশ্বাস করে নেয়।

 যেহেতু সন্দেহভাজন একজনের কথাই মিডিয়াম বলে, তাই তার ঘোষিত মানুষটি চোর হতেও পারে। চোর না হলেও চুরি করেছে, এমন স্বীকারোক্তিও প্রহার থেকে বাঁচতে যে দিতেই পারেন, সে বিষয়ে আগেই যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে।

বাটি চালান

 চুরি যাওয়া জিনিসের হদিশ পেতে যা চোর ধরতে বাটি চালানোর ব্যাপক প্রচলন এখনও আছে। নখ-দর্পণের সঙ্গে বাটি চালানোর কিছুটা মিল রয়েছে। বাটি চালানের মিডিয়াম ঠিক করা হয় সাধারণত যার বাড়ি চুরি হয়েছে, তাঁদেরই পরিবারের কোনও কিশোর-কিশোরীকে। এখানেও ওঝা বা গুনিন মিডিয়ামকে পাশে বসিয়ে চুরির খুঁটিনাটি ঘটনা শুনতে থাকে গৃহস্বামীর কাছ থেকে। শুনে নেয় কাদেরকে চোর বলে সন্দেহ করছেন গৃহস্বামী। গৃহস্বামীর সন্দেহ মিডিয়ামকে প্রভাবিত করে। তারপর একসময় বাটি চালানের বাটি আসে। মিডিয়ামকে বাটির উপর দু-হাতের ভর দিয়ে উবু করে বসানো হয়। গুনিন ঘন ঘন মন্ত্র আওড়ায়, মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকে, বাটিটা এবার মিডিয়ামের হাত দুটোকে টানবে। বাটিটা যে মিডিয়ামের হাত টানবেই, এই কথাটাই বার বার গভীরভাবে টেনে টেনে বলে যেতে থাকে ওঝা। আমাদের হাত নড়ে, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের নিয়ন্ত্রণে ঐচ্ছিক মাংসপেশীগুলোর সংকোচন-প্রসারণের ফলে। ওঝার কথা এক মনে শোনার ফলে আবেগপ্রবণ মস্তিষ্কে ধারণা সঞ্চারিত হতে থাকে, বাটিটা তার হাত টানছে, বাটিটা একটু একটু করে গতি পাচ্ছে। বটিটা চোরের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অনেক সময় সন্দেহভাজন মানুষদের বাটি চালানের সময় হাজির রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে মিডিয়াম ভাবতে তাকে, বাটি চোরের দিকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাটির ওপর হাতের ভর রেখে উবু হয়ে বসার ফলে ধারণা সঞ্চারের ফল দ্রুততর হয়।


বাটি চালানোর একটি দৃশ্য

এমনিতেই বাটির ওপর শরীরের ভর আড়াআড়ি ভাবে থাকায় বাটির সরে যাবার বা এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও ‘বাটি চোর ধরতে এগোষে’ এই বিশ্বাস যখন তীব্রতর হয় তখন অবচেতন মন থেকেই মিডিয়াম বাটিটিকে ঠেলতে শুরু করে। অর্থাৎ মিডিয়াম নিজের অজান্তেই বাটিকে চালনা করে। মিডিয়ামের মনের ভিতর চোর সম্বন্ধে একটা ধারণা সঞ্চারিত হয়ে বাটিটিকে ঠেলতে শুরু করে। মিডিয়াম নিজের অজান্তেই বাটিকে চালনা করে। মিভিরামের মনের ভিতর চোর সম্বন্ধে একটা ধারণা সঞ্চারিত হয়ে রয়েছে। মিডিয়ামের সেই সঞ্চিত ধারণার প্রভাবে অবচেতন মন বাটিটিকে কোনও একজন সন্দেহভাজন মানুষের দিকে অথবা সন্দেহভাজন ব্যক্তির বাড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

কঞ্চি চালান

 চোর ধরার ব্যাপারে ‘কঞ্চি-চালান’ ওঝা, জানগুরুদের একটি জনপ্রিয় তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন। ‘নখ-দর্পণ’ এবং ‘বাটি চালান’-এর মতই কঞ্চিও চালানো হয় মিডিয়ামের সাহায্যে। একই ভাবে মিডিয়াম হয় চুরি যাওয়া বাড়ির স্বল্পবয়স্ক কেউ অথবা আবেগপ্রবণ সংস্কারাচ্ছন্ন মহিলা। চোর সম্বন্ধে মিডিয়ামের চিন্তায় কিছু নাম ঘোরাঘুরি করে, যে নামগুলো বাড়ির মানুষদের কাছ থেকে সন্দেহজনক বলে ইতিপূর্বেই শুনেছে।

 সিডিয়াম কঞ্চি ধরে থাকে। কোনও ক্ষেত্রে কঞ্চির এক প্রান্ত ধরা থাকে মিডিয়ামের হাতে, অন্যপ্রান্ত মাটি স্পর্শ করে থাকে। এ ছাড়াও আরও ভিন্ন ভিন্ন ভাবেও কঞ্চি ধরার প্রথা আছে।

 ওঝার মন্ত্রে বাটির মতোই কঞ্চি গতি পায়। কঞ্চি অনেক সময়ই চোর বা চোরের বাড়ি চিনিয়ে দেয়। গণ-প্রহার, চুরি স্বীকার করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আবার আলোচনা করলে অনেকেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে ভেবে নিয়ে কলম সংযত করলাম।


কঞ্চি চালান হচ্ছে হারানো জিনিস পেতে

কুলো চালান

 শুধু আদিবাসী সমাজেই নয়, গ্রামে-গঞ্জে, আধা শহরে এমনকি খোদ কলকাতাতেও ‘কুলো-চালান’ দিব্বি ‘চলছে-চলবে’ করে ঠিকই টিকে রয়েছে কুলো-চালানে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আসলে একরার কুলো-চালানে নিজে অংশ নিলে অবিশ্বাস করা বেজায় কঠিন। কেন কঠিন, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে কুলো-চালানে কী হয়, তাই নিয়ে একটু আলোচনা করে নিলে বোধহয় মন্দ, হবে না।

 যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তে দেওয়া সম্ভব তার সবই নাকি স্কুলো-চালানে জেনে নেওয়া সম্ভব। যেমন ধরুন—‘আমি পরীক্ষায় পাশ করব কি না?’ ‘আমার প্রমোশনটা এবারে হবে কি না?’ ‘এ বছরের মধ্যে আমার চাকরি হবে কি না?’ ‘সুদেষ্ণার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে কি না?’ ‘এ বছর মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে কি না?’ ‘আমার ঘড়িটা গঙ্গাধর চুরি করেছে কি না?’ ‘চাঁদু হাঁসদা আমরা গরুটাকে বান মেরেছে কি না?’ এমনি হাজারো প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে। তবে প্রশ্ন পিছু নগদ দক্ষিণা চাই। দক্ষিণা নেবেন ওঝা, গুনিন বা তান্ত্রিক, যিনি মন্ত্র পড়ে কুলোকে চালাবেন। কুলো ঘুরবে, বিনা হাওয়াতেই ঘুরবে।

 কুলো চালানে’র কুলোর একটু বৈশিষ্ট্য আছে। না, একটু ভুল বললাম। কুলোতে বৈশিষ্ট্য নেই। তবে এই কুলোয় উঁচু কানায় গেঁথে দেওয়া হয় ধারালো ছুঁচলো লম্বা কাঁচি। যে কাঁচি দিয়ে নাপিতেরা চুল ছাঁটে, সেই ধরনের কাঁচিই কুলো-চালানে ব্যবহৃত হয়। কাঁচির হাতল বা আঙুল ঢোকাবার দিকটা থাকে কুলোর ওপরে। তলার ছবিটা দেখলে একটা আন্দাজ পাবেন। কুলো তো তৈরি হলো। ওঝা মন্ত্রও পড়ল। কিন্তু তারপর? তারপর নয়, মন্ত্র পড়ার সময়ই প্রশ্নকর্তা কাঁচির একদিকের হ্যাণ্ডেলের তলায় একটা আঙুল রাখেন। সাধারণত তর্জনী স্থাপন করতে বলা হয়। অন্য হ্যাণ্ডেলের তলায় তর্জনী রাখেন প্রশ্নকর্তার পরিচিত কেউ অথবা গুনিন স্বয়ং। আবার একটা ছবি দিলে কেমন হয়?

 গুণীন এবার প্রশ্নকর্তাকে বলেন, আপনি মনে মনে আপনার প্রশ্নটা ভাবতে থাকুন। গভীরভাবে ভাবতে থাকুন। আপনার প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, দেখবেন কুলোটা আপনা থেকে ঘুরে যাবে আর, উত্তর যদি ‘না’ হয়, কুলোটা ঘুরবে না। একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।

প্রশ্নকর্তা ভাবতে থাকেন। এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায় কুলোটি কখনো ঘুরে যাচ্ছে। কখনোও বা রয়েছে নিশ্চল।

 কুলোর এই ঘুরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রশ্নকর্তার অবচেতন মন। ওঝার কথার প্রশ্নকর্তা বিশ্বাস করলে একসময় ভাবতে শুরু করেন, বাস্তবিকই মন্ত্রপূত কুলোটা সমস্ত প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-জাতীয় উত্তর দিতে সক্ষম। উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হওয়ার প্রতি প্রশ্নকর্তার আগ্রহ বেশি থাকলে তার অবচেতন মন নিজের অজান্তেই আঙুল নেড়ে কাঁচি ঘুরিয়ে কুলোকে ঘুরিয়ে দেয়। প্রশ্নকর্তার অবচেতন মন 'না' উত্তরে আগ্রহী হলে কাঁচির তলাকার আঙুল স্থির থাকে। অতএব স্থির থাকে কুলো। অবচেতন মনের এই জাতীয় কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না থাকলে প্রশ্নকর্তা অবশ্যই বিশ্বাস করে নিতে বাধ্য হন, তাঁর প্রশ্নের উত্তরেই মন্ত্রপূত কুলো ঘুরছে অথবা স্থির থাকছে। জানগুরু কাঁচি ধরলেও সাধারণ সে তার আঙুল স্থির রেখে দেয়। কারণ সে এই মনস্তত্ত্বটুকু জানে, তার আঙুল নেড়ে কুলো চালাবার কোনও


কলকাতার বুকে কুলোচালন
প্রয়োজনই নেই। কুলো চালাবে প্রশ্নকর্তার অবচেতন মন।

 অবচেতন মন দিয়ে আংটি চালানোর বিষয়ে ভূতে ভর নিয়ে আলোচনায় যেহেতু যথেষ্ট সময় নিয়েছি, তাই আর আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম না। শুধু এটুকু বলি—আপনি নিজে কুলো-চালানের কুলো নিয়ে বসুন। সঙ্গী করুন কাউকে। তাকে বলুন, কোনও প্রশ্ন গভীরভাবে চিন্তা করতে। তবে প্রশ্নটা যেন এমন হয় যাতে তার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তেই পাওয়া যায়। একমনে চিন্তা করতে শুরু করলেই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে কুলো ঘুরবে, ‘না’ হলে কুলো স্থির থাকবে।

 একটু অপেক্ষা করলেই দেখতে পারেন মজা। দেখবেন, আপনার সঙ্গীর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে কুলো কখনও ঘুরছে, কখনও বা স্থির থাকছে।

 এমন পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই বুঝতে পারবেন জানগুরু বা তান্ত্রিকদের কুলো-পড়া মন্ত্রের বুজরুকি।

থালা পড়া

 থালা-পড়া দিয়ে সাপে কাটা, কুকুরে কামড়ানো রোগীকে ভালো করার মতো ওঝা ও গুনিন এখন এদেশে অনেক আছে—এ ধরনের বিশ্বাস অনেক মানুষের মধ্যেই বর্তমান। আবারও বলি, শুধুমাত্র আদিবাসীদের মধ্যেই এই বিশ্বাস সংক্রামিত হয়নি, ছড়িয়ে পড়েছে বহু শহরবাসী বা শহরে চাকুরিয়াদের মধ্যেও।

 রোগী রোদ্দুরে পিঠ খুলে বসে থাকে। গুনিন পিতল বা কাঁসার থালায় মন্ত্র পড়ে পিঠে থাবড়ে বসিয়ে দিতেই অবাক কাণ্ড! থালাটা রোগীর পিঠের উপর সেঁটে বসে যায়। যেন চুম্বকের টানে আটকে আছে লোহা। গুনিন যতক্ষণ মন্ত্র পড়ে অর্থাৎ যতক্ষণ সাপের বা কুকুরের বিষ শরীর থেকে না নামে, ততক্ষণ থালা আটকে থাকে পিঠে। বিষ নামলেই পিঠের থালাও সুড়সুড় করে নেমে আসে।

 বহু প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে জানিয়েছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই নাকি রোগী থালা-পড়াতে বিষ-মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু মূল প্রশ্নটা এই, কী করে প্রত্যক্ষদর্শী সিদ্ধান্তে এলেন রোগী বিষ-যুক্ত ছিলেন? কুকুর কামড়ালেই জলাতঙ্ক হয় না। জলাতঙ্ক হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ থেকে। যে কুকুরটি কামড়েছে সে যদি আগে থেকেই জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে শুধুমাত্র তবেই তার কামড়ে সৃষ্ট ক্ষত ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

 কুকুর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণ ছয় দিনের বেশি বাঁচে না।
কুকুরে কামড়ানোর পর্ পিঠে থালা বসান হয়েছে।
জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার চারদিন আগেই কুকুরের লালায় রোগের ভাইরাস থাকতে পারে। তাই চিকিৎসকরা সাধারণভাবে বলেন, যে কুকুর কামড়েছে সেটাকে দশ দিন পর্যন্ত লক্ষ করবেন। দশ দিনের পরও কুকুরটি বেঁচে থাকলে Anti Rabies Vaccine বা ARV নেওয়ার কোনও প্রয়োজন হয় না। কোনও কারণে কুকুরটিকে নজরে রাখা সম্ভব না হলে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে ARV ইনজেকশন নেওয়া উচিত। বর্তমানে অবশ্য কার্যকর আরো কিছু Vaccine বেরিয়েছে। যেমন inactivated Rabies Vaccine তার মধ্যে একটি।

 বিড়াল, শেয়ালের বা নেকড়ের কামড়েও জলাতঙ্ক হতে পারে, যদি যে কামড়েছে সে জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাপে কাটার ক্ষেত্রেও একই রকমভাবে বলতে হয়, সাপে কামড়ালেই বিষাক্ত সাপ কামড়েছে ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদের দেশে নির্বিষ সাপই সংখ্যাগুরু (শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ)। আবার সংখ্যালঘু বিষাক্ত সাপ কামড়ালেই যে সে কামড় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে, এটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। দেখতে হবে সেই কামড়ে একজনের মৃত্যু ঘটানোর মতো পরিমাণে বিষ ঢালতে পেরেছে কি না। অনেক সময় এমনটাও হয়ে তাকে, ছোবল মারছে দেখে দ্রুততার সঙ্গে শরীর সরিয়ে নেওয়ার জন্য বা অন্য কোনো কারণে বিষাক্ত সাপ অতি সামান্য বিষ ঢালতে সক্ষম হয়। এইসব ক্ষেত্রেও রোগীর বিষ থেকে মৃত্যু-সম্ভাবনা থাকে না।

অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুকুর বা সাপ কামড়ালেই ‘কুকুরের বিষ’ বা ‘সাপের বিষ' মুক্ত করার প্রয়োজন হয় না, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বিষমুক্তই থাকে। কিন্তু বাস্তবিকই যদি জলাতঙ্কে আক্রান্ত কুকুর, বিড়াল বা শিয়াল কামড়ায় তবে ARV ইনজেকশন নেওয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আরও কম বেদনাদায়ক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, ইনজেকশন বা ওষুধও হয়তো আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু কোনো ক্রমেই থালা পড়ায় জলাতঙ্কের বিষ টেনে নিয়ে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে না।

 একই কথা সাপের বিষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, বিষাক্ত সাপ উপযুক্ত পরিমাণে শরীরে বিষ ঢাললে অ্যাণ্টিভেনম সিরাম নিতে হবে অথবা অন্য কোনও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু এরকম ক্ষেত্রে মন্ত্রঃপূত থালা কোনওভাবেই বিষ মুক্ত করে রোগীকে বাঁচাতে পারবে না। তবে থালা আটকায় কীভাবে? সে প্রসঙ্গেই আসি। ওঝা যে থালা ব্যবহার করে, সেটা অবশ্যই যার পিঠে বসানো হবে তার পিঠের চেয়ে ছোট মাপের। পিতল বা কাঁসার থালাটির মাঝখানটা চারপাশের চেয়ে কিছুটা উঁচু। রোদে বসিয়ে রাখা তথাকথিত রোগীটির পিঠ স্বাভাবিকভাবেই ঘামে ভিজে ওঠে। থালাটির পিছন দিকটি এবার সজোরে রোগীটির পিঠের উপর এমন ভাবে বসানো হয় যাতে থালাটির চারপাশ ও পিঠের মধ্যে সামান্যতম ফাঁক না থাকে। পিঠের ঘাম ফাঁক হওয়ার সম্ভাবনা বন্ধ করে। জোরে প্রায় ছুড়ে থালাটি পিঠে বসানোয় এবং থালাটির মাঝখানটা সামান্য উঁচু হওয়ায় থালা ও পিঠের মাঝখানে বায়ু থাকে না বা কম থাকে। ফলে বাইরের বাতাসের চাপে থালা পিঠ আঁকড়ে থাকে।

 সময় যতই পার হতে থাকে একটু একটু করে বাতাসও ঘামের সূক্ষ্ম ফাঁক-ফোকর দিয়েও ঢুকতে থাকে। ফলে এক সময় থালা পিঠ থেকে খসে পড়ে।

 আপনারাও হাতে-কলমে পরীক্ষা করেই দেখুন না। কোনও সাপে কাটা বা পাগলা কুকুরে কামড়ানো রোগী লাগবে না। লাগবে না কোনও মন্ত্র-তন্ত্র। একই পদ্ধতিতে ঘামে ভেজা থালা চেপে ধরলেই কিছুক্ষণের জন্য আটকে থাকবে।

 থালা পড়ায় যে সব মানুষ সাপের বিষ বা জলাতঙ্ক থেকে মুক্ত হচ্ছেন, থালা, পড়া না দিলেও এবং কোনও ওষুধ গ্রহণ না করলেও তাঁরা সাপের বিষ ও জলাতঙ্ক থেকে মুক্ত হতেন। কারণ তাঁদের শরীরে সাপের বিষ বা জলাতঙ্কের ভাইরাসই ছিল না। কামড়ে ছিল নির্বিষ সাপ আর ভাইরাস-মুক্ত কুকুর।

‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাতচালায়’ বিষ নামানো

 বিষ-পাথরে সাপের বিষ তোলা যায়, এই ধরনের বিশ্বাস বহু মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। আদিবাসী ওঝা, গুনিনের পাশাপাশি অ-আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিষ-পাথরের প্রচলন রয়েছে।

 বিষ-পাথর ব্যবহার করা হয় এইভাবে। সাপে কাটা রোগীকে আনার পর তার ক্ষতস্থানে বিষ-পাথর ধরা হয়। পাথর নাকি ক্ষতস্থান থেকে দ্রুত বিষ শুষে নিতে থাকে। পাথরটাকে বিষ মুক্ত করতে এক বাটি দুধে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখা হয়। দুধের রঙ সাপের বিষে নীল হতে থাকে। পাথরটা তুলে আবার ক্ষতস্থানে বসানো হয়। কিছু পরে পাথরের বিষ নামাতে আবার চলে পাথরের দুধ-স্নান। এমনি চলতেই থাকে। এরই মাঝে রোগীকে গোলমরিচ খাওয়ানো হয়। রোগীকে জিজ্ঞেস করা হয়, ঝাল লাগছে কি না। রোগী জানান, ঝাল লাগছে না। আবারও চলতে থাকে বিষ পাথরের বিষ তোলা। এক সময় রোগী জানান, গোলমরিচ ঝাল লাগছে। আনা হয় আর এক বাটি দুধ। এবার ক্ষতস্থানে বিষ-পাথর বসিয়ে পাথর দুধে ফেলা হয়। দর্শকরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেন দুধ আর নীল হচ্ছে না। পাথরের অদ্ভুত ক্ষমতায় প্রতিটি প্রত্যক্ষদর্শী অবাক মানেন। রোগীও বড়ি ফেরেন সুস্থ শরীরে।

 বিষ পাথর বিষ তোলে না। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তবে দুধ কেন নীল হয়? উত্তর একটাই—ওঝা বা গুনিন দুধে ছোট্ট একটা নীলের টুকরো ফেলে দেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুধে নীল দ্রবীভূত হতে থাকে এবং দুধও গভীর থেকে গভীরতর নীল রং ধারণ করতে থাকে।

 রোগী কেন তবে গোলমরিচের ঝাল অনুভব করতে পারেন না? উত্তর এখানেও একটাই—গোলমরিচ বলে রোগীকে খাওয়ান হয় পাকা পেঁপের বিচি। ঝাল লাগবে কী করে?

 কিন্তু অসুস্থ সাপে কাটা রোগী সুস্থ হয় কী করে? উত্তর এখানেও একটাই—কামড়ে ছিল নির্বিষ সাপ। তাই, বিষে অসুস্থ হওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না।

 গোলমরিচ পরে কেন ঝাল লেগেছে বা দুধ পরে কেন নীল হয়নি, এর উত্তর নিশ্চয়ই আপনারা পেয়েই গেছেন, ঝাল লেগেছে তখনই যখন গোল মরিচই খেতে দেওয়া হয়েছে। দুধ সাদা থাকে তখনই, যখন দুধে নীল পড়েনি।

 এও তো ঠিক, নির্বিষ সাপের কামড় চিনতে না পারলে মৃত্যু-ভয়ে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারে। আবার বিষ-পাথরের পুরো কর্মকাণ্ড দেখার পর বিষ মুক্ত হয়েছেন বিশ্বাসেই মানসিক অসুস্থতা বিদায় নেয়।

 সেই প্রসঙ্গে জানাই, কৃষ্ণনগরে জনৈক পাদ্রি সাহেব দাবি করেন, তিনি বিষ পাথরে রোগীর দেহ থেকে সাপের বিষ টেনে নিতে সক্ষম। ওই দাবিদারকে আমাদের সমিতির তরফ থেকে বার বার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি। আমাদের সহযোগী সংস্থা কৃষ্ণনগরের 'বিবর্তন' পত্রিকা গোষ্ঠী আয়োজিত কৃষ্ণনগরেরই বিভিন্ন প্রকাশ্য সভায় আমরা এই চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছি। নদীয়া জেলার বেথুয়াডহরি বিজ্ঞান পরিষদ আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় ‘৮৮ ও ’৮৯ সালে পোস্টার নিয়ে বিশাল পদযাত্রাও হয়েছে। সেখান থেকেও ঘোষিত হয়েছে আমাদের সমিতির সরাসরি চ্যালেঞ্জ।

 উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরেও আর এক চিকিৎসক উত্তমকুমার বিশ্বাস একইভাবে বিষ-পাথরের সাহায্যে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইনিও নাকি কৃষ্ণনগরের পাদ্রি সাহেবের মতোই বেলজিয়ামের বিষ-পাথর দিয়ে সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসা করেন। দাবি করেন হাসপাতাল যে রোগীকে ভর্তি
বাঁ দিক থেকে ডাঃ সন্দীপ পাল, লেখক, বিষপাথর চিকিৎসক ডাঃ উত্তমকুমার বিশ্বাস ও যুক্তিবাদী সমিতির সহ-সভাপতি ডাঃ বিরল মল্লিক।
করতে সাহস করেনি, সেইসব রোগীদেরও তিনি ভালো করে দেন।

 এই দুই বেলজিয়াম বিষ-পাথর প্রয়োগকারী যে ভাবে বিষ-পাথর ব্যবহার করেন সেটা খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করছি। রোগীর সাপে কাটা জায়গাটার আশেপাশের কয়েকটা স্থান নতুন ব্লেড বা ধারাল অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেলেন। চেরা জায়গার উপর বিষ-পাথর বসিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেন। ব্যাণ্ডেজ খুলে আমাকে এবং ‘ইণ্ডিয়া টু-ডের’ প্রতিনিধিকে দেখিয়েছেন, বিষ-পাথর শরীরে লেগে রয়েছে। বিষ-পাথরগুলোকে দেখে আপাতভাবে পাথর বলে মনে হয়নি। একটা স্নেটকে বহু ছোট ছোট টুকরো করলে যে ধরনের দেখাবে, বিষ-পাথরগুলো অনেকটা সে ধরনের। পার্থক্য এই বিষ-পাথর কিছুটা আঠা আঠা তেলতেলে ও চকচকে। শরীরে একটু চেপে দিয়ে দেখেছি, কিছুক্ষণের জন্য বসে যায়। পাথরের তিনটে টুকরো সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। ভূতত্ত্ববিদ সংকর্ষণ রায়কে একটি পাথর দিয়েছিলাম। তাঁর অভিমত-ন্যাচারাল পাথর নয়। কৃত্রিমভাবে তৈরি। আঠাজাতীয় কিছু রয়েছে।

 ৩ জুন ’৯০। বিকেলে ডাক্তার বিশ্বাসের চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। সেদিন তাঁর চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ন’জন। তাদেরই একজন সাধনা মণ্ডল। থাকে, ঠাকুরনগর চিকনপাড়ায়—কিশোরী। ডাক্তারবাবু জানালেন, “সাধনাকে পদ্ম-গোখরো কামড়ে ছিল। খুব যন্ত্রণা ফিল করেছিল।” সাধনাও জানাল, “যখন কামড়েছিল তারপর থেকে যন্ত্রণা প্রচণ্ড বেড়েই যাচ্ছিল।”

 অথচ মজা হল, এই পদ্ম-গোখরো কামড়ালে যন্ত্রণা বাড়ত না। কারণ এই সাপের বিষ স্নায়ুগুলোকে অসাড় করে। ডাঃ বিশ্বাস এই জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই কেমন পসার জমিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে চলেছেন। কারণ ’৯০ সালের জুনেই তাঁর কাছে চিকিৎসিত হতে এসে কয়েকজন রোগী মারা যান। মৃতেরা বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়েছিলেন এবং ডাক্তার বিশ্বাসের পক্ষে বা বিষ-পাথরের পক্ষে রোগীকে বিষ-মুক্ত করা সম্ভব নয় বলেই রোগীদের মৃত্যু হয়েছিল।

 ডাঃ বিশ্বাস ও কৃষ্ণনগরের পাদ্রি নিঃসন্দেহে ঘাতকের ভূমিকাই পালন করে চলেছেন। রোগী ও তার আত্মীয়দের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে শোষণ ও হত্যা চালিয়েই যাচ্ছেন।

 আমাদের সমিতির তরফ থেকে এই দুই ডাক্তারসহ সব বিষ-পাথরের দবিদারদের জানাচ্ছি খোলা চ্যালেঞ্জ। তাঁরা প্রমাণ করুন তাঁদের বিষ-পাথরের বিষ শোষণ করার ক্ষমতা আছে। শর্ত এই—আমরাই বিষাক্ত সাপ সরবরাহ করব। এবং বিষাক্ত সাপের কামড় খাবে যে পশুটি, সেটাও আমরাই সরবরাহ করব। একই সঙ্গে সরকারি প্রশাসনের কাছে দাবি—মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। এমন শর্তের পিছনে কারণটি হল—বিষ থলে অপারেশন করে বাদ দেওয়া সম্ভব। দক্ষিণ ২৪ পরগনার নাজির আলির কাছে অনেক সাপের ওঝা ও তথাকথিত সর্পবিশারদ এসে বিষের থলিহীন বিষদাঁতওয়ালা সাপ কিনে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে সাপটি বিষাক্ত এবং বিষদাঁতওয়ালা হলেও বাস্তবে আজ কিন্তু নির্বিষ। তাই সাপটি সরবরাহের দায়িত্ব রাখতে চাই নিজেদের হাতে। পশুটিকেও আমরাই হাজির করতে চাই এ জন্যে, যাতে বিষ প্রতিষেধক ব্যবস্থা একটু একটু করে পশুর শরীরে গড়ে তুলে সেই পশুটিকে হাজির করে বিষ-পাথরের কারবারিরা আমাদের মাত না করতে পারেন।


 অনেকের বিশ্বাস ওঝা, গুনিনদের অনেকে হাত চেলে সাপের বিষ নামাতে সক্ষম। ধারণা অমূলক। মন্ত্র পড়ে হাত চালিয়ে ওঝারা তাঁদেরই সুস্থ করতে সক্ষম যাদের বিষাক্ত সাপ দংশন করেনি।

 বিষাক্ত সাপ কামড়েছে অনুমান করে মানসিকভাবে যাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁরা যখন দেখেন হাত চেলে দুধে হাত ধুয়ে ফেলতেই দুধ নীল হয়ে যাচ্ছে, গোল মরিচ কামড়েও ঝাল না পাওয়া অসাড় জিব একটু একটু করে সাড় ফিরে পাচ্ছে, অনুভব করতে পারছে গোল মরিচের ঝাল স্বাদ, তখন স্বভাবতই হাত চালার অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে ফেলেন।

পেট থেকে শিকড় তোলা

 অনেক ওঝা বা গুনিন রোগী দেখে জানায়, কেউ রোগীকে তুক করে শিকড় খাইয়ে দিয়েছে, তাতেই এই ভোগান্তি। রোগীকে বা রোগীর বাড়ির লোকের হাতেই ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি পিতল বা কাঁসার ঘটি। বলে পাশের কুকুর, কুয়ো, টিউবকল বা জলের হাঁড়ি থেকে জল ভরে আনতে।

 জলে ভরা ঘটি শুনিনের হাতে দিতে সে রোগীর পেটে জল ভরা ঘটি বসিয়ে মন্ত্র পড়তে থাকে। এক সময় ঘটি নামিয়ে গুনিন রোগী বা রোগীর বাড়ির লোককে ঘটির জল পরীক্ষা করতে বলে। বিস্ফারিত চোখে রোগী ও তাদের বাড়ির লোক দেখতে পায় শিকড় বা ওই জাতীয় কিছু। খালি ঘটিতে শিকড় এলো কোথা থেকে? জল তো গুনিন বা তার কোনও লোক আনেনি? তবে?

 দুভাবে এমন ঘটনা ঘটানো হয়ে তাকে। কখনও পিতল ফাঁসার ঘটির ভিতরের গলার দিকে (সে দিকটা সাধারণভাবে দৃষ্টির আড়ালে থাকে) আটার আঠা ও ওই ধরনের কিছু দিয়ে শিকড়টা জলে আনতে দেওয়ার আগেই আটকে রাখে গুনিন। মন্ত্র পড়ার মাঝে সুযোগ বুঝে আটকে রাখা শিকড়কে মুক্ত করে। বিষয়টা ছবিতে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।


পেট থেকে শিকড় তুলছেন জনৈক পুরোহিত

 কখনও বা মন্ত্র-পড়ার ফাঁকে গুনিন সবার চোখের আড়ালে একটা শিকড় জলে ফেলে দেয়।

 এ সত্ত্বেও অনেক সময় রোগী কিছুটা সুস্থবোধও করেন। বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে বহু অসুখই সারানো সম্ভব। মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ চিকিৎসক, এমনকী চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও তার প্রচুর উদাহরণও আছে। ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। কোন কোন অসুখের ক্ষেত্রে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে অসুখ সারানো সম্ভব এবং কেন তা সারে—এই প্রসঙ্গ নিয়ে তাই আবার পুরনো আলোচনায় ফিরলাম না।

চাল-পড়া

 বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে হার, দুল, আংটি টাকা-পয়সা বা ঘড়ি—এমন ক্ষেত্রে এই একবিংশ শতাব্দীতে পা বাড়াবার মুহূর্তেও অনেকেই থানা-পুলিশ করার চেয়ে গুনিনের দ্বারস্থ হওয়াটাই বেশি পছন্দ করেন।

 শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ ও আদিবাসী সমাজের মানুষরাই গুনিনের চোর ধরার ক্ষমতায় বেশি রকম আস্থাবান। গুনিনদের অনেকেই চোর ধরতে সন্দেহজনকদের ‘চাল-পড়া’ খাওয়ায়।

 চোর ধরতে চাল পড়ার প্রচলন বহু প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। ‘চাল পড়া’ জিনিসটা কী? আসুন ছোট্ট করে বলি। ধরুন আপনার বাড়িতে চুরি হয়েছে। বুঝতে আপনার অসুবিধে হয়নি, এ সিঁধেল চোরের কাণ্ড নয়। আপনারই চেনা-জানা, বাড়ির কাজের লোক অথবা পাড়ারই কোনও হাত-টান দু-চারজনকে সন্দেহও করছেন। হাতে-নাতে প্রমাণ নেই, তাই বসে বসে হাত কামড়ানো ছাড়া কোনও উপায় নেই বলে যখন ভাবছেন, ঠিক তখনই খবর পেলেন তিন মাইল দূরের সাঁওতাল পল্লির কার্তিক মুর্মু খুব বড় গুনিন। অব্যর্থ ওর চাল পড়া। আপনি হারানো জিনিস ফেরত পেতে পুলিশের ওপর নির্ভর করাটা ডাহা বোকামো ধরে নিয়ে কার্তিক মুর্মুর দ্বারস্থ হলেন। কার্তিক জানালেন কবে কখন যাবেন। আপনাকে নির্দেশ দিলেন সেই সময় পরিবারের সকলকে এবং সন্দেহজনকদের হাজির রাখতে। সময় মতো কার্তিক এলেন। সঙ্গে এক ফুলধারিয়া। শুরু হল কার্তিকের বকবকানি। তার মন্ত্রঃপূত চাল পড়া খেয়ে কোন গ্রামের কে কবে মারা গেছে তার এক দীর্ঘ ফিরিস্ত্রি পেশ করে উপস্থিত অনেকেরই পিলে চমকে দিলেন। যারা হাজির রয়েছে তারা চাল পড়া খাইয়ে চোর ধরার অনেক কাহিনিই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। তাই কার্তিক যখন বলল, সে চালে মন্ত্র পড়ে দেওয়ার পর প্রত্যেককে খাওয়াবে, যে চুরি করেছে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হবে, বুক ধড়ফড় করতে থাকবে, চুরির কথা স্বীকার না করলে মুখ থেকে রক্ত উঠে মারা যাবে—তখন কার্তিকের কথায় অবিশ্বাস করার কোনও কারণ উপস্থিত কেউ খুঁজে পেল না।

 আপনার গৃহিণীর কাছ থেকে সামান্য চাল নিয়ে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন কার্তিক। সে কী মাথা ঝাঁকানি। কাঁপানো বাবরি চুলগুলো উথাল-পাথাল করতে লাগল। কার্তিকের শরীর দুলতে লাগল, মাঝে মাঝে হুঙ্কার। এক সময় রক্ত লাল চোখ মেলে কার্তিক এক একজনকে ধরে ধরে খাওয়াতে লাগল মন্ত্রঃপূত চাল বা চাল পড়া। এরপর তিন রকমের যে কোনও একটি ঘটনা ঘটতে পারে। একজন চাল পড়া হাতে পেয়ে মুখে পোরার পরিবর্তে আশেপাশে পাচার করার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলে একবার গুনিনের কাছে আছড়ে পড়ে, একবার আপনার পা ধরে অপরাধ স্বীকার করে বার বার ক্ষমা চাইতে পারে।

 দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটতে পারে এই ধরনের চাল পড়া খাওয়া মানুষদের মধ্যে একজন কেমন যেন অসুস্থ বোধ করতে থাকে। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, বুক ধড়ফড় করতে থাকে, বুক জ্বলে যায়, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় আতঙ্কে। নিজেকে বাঁচাতে অপরাধ স্বীকার করে। গুনিনের পায়ে মাথা কুটে বার বার করুণ আবেদন জানাতে থাকে—“মরে গেলাম, আর সহা করতে পারছি না, মন্ত্র কাটান দাও।”

 আবার এমন ঘটতে পারে, সবাইকে চাল পড়া খাওয়াবার পরেও কারো শরীরেই সামান্যতম অস্বস্তি দেখা গেল না, অপরাধী ধরা পড়ল না। গুনিন ঘোষণা করল, “যারা এখানে উপস্থিত তাদের মধ্যে চোর নেই।” গুনিনের এই ঘোষণাকে অনেক মানুষই সত্য বলে মেনে নেয়।

 ঘটনা তিনটিকে আমরা একটু যুক্তি দিয়ে বিচার করি আসুন। চাল পড়ার ক্ষেত্রে এই তিন ধরনের যে কোনও একটি ঘটনাই ঘটে তাকে—তবে হয়তো সামান্য রকমফের করে। এর কোনোটিই চাল পড়ার অভ্রান্ততা বা অকাট্যতার প্রমাণ নয়। চাল পড়া না খেয়েই চোর কেন অপরাধ স্বীকার করে এটা নিশ্চয়ই আপনারা প্রত্যেক পাঠক-পাঠিকাই বুঝতে পেরেছেন। গুনিনের কথায় চোর বিশ্বাস করেছে। তাই চাল খেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে অপরাধ স্বীকার করাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছে। চাল পড়া খেয়ে কেন চোরের শারীরিক নানা অসুবিধে হতে থাকে, সে বিষয়ে নতুন করে বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখি না। কারণ ‘অলৌকিক নয়,__PAGESEPARATOR__লৌকিক’-এর প্রথম খণ্ডে এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা বহু উদাহরণ-সহ হাজির করা হয়েছে। যাঁরা এখনও প্রথম খণ্ড পড়ে উঠতে পারেননি, তাদের জন্য খুব সংক্ষেপে দুচার কথায় ব্যাখ্যা হাজির করছি।

 যে সব সন্দেহভাজনদের চাল পড়া খাওয়ানো হয়, তাদের মধ্যে চোর থাকতেই পারে। চোরের মনে চাল পড়ার প্রতি ভীতি থাকতেই পারে। যে সব আত্মীয় প্রতিবেশী, বন্ধু ইত্যাদির মধ্যে সে বড় হয়েছে তাদের অনেকের কাছেই হয় তো নানা অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছে, শুনছে তুকতাক, ঝাড়ফুঁকের নানা বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা। পড়তে জানলে ছোটবেলা থেকেই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি পড়ে অলৌকিক নানা ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে অলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাস। অনেক সময় চেতন মন অনেক অলৌকিক কহিনিকে অগ্রাহ্য করতে চাইলেও মনের গভীরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা অলৌকিক বিশ্বাস কিন্তু দুর্বল মুহূর্তে আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

 চোর হয়তো ইতিপূর্বে মা-ঠাকুমা, পাড়া-পড়শি অনেকের কাছেই চাল পড়া খাইয়ে চোর ধরার অনেক গা শির শির করা ঘটনা শুনেছে। শুনেছে চাল পড়া খেয়ে চোরের বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা ইত্যাদি নানা গল্প। বিশ্বাসও করেছে। হয়তো শুনিনের দেওয়া চাল পড়া খাওয়ার আগে গুনিনের ক্ষমতা বিষয়ে সন্দেহ ছিল। এমনও হতে পারে, মন্ত্র-শক্তির প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল না। আর তাইতেই খেয়ে ফেলেছে। খাওয়ার পর দ্বিধাগ্রস্ত দুর্বল মনে চিন্তা দেখা দিল-চাল পড়ার সত্যিই যদি ক্ষমতা থাকে তবে তো আমি মারা যাব। মৃত্যুর আগে আমার শ্বাসকষ্ট হতে থাকবে, বুক ধড়ফড় করবে, বুক জ্বালা করবে। আমার কি তেমন করছে? কোনও অস্বস্তি কি শরীরে অনুভব করছি? হ্যাঁ। আমার যেন কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে! দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুকেও যেন কেমন একটা জ্বালা জ্বালা করছে? আমি মিথ্যে ভয় পাব না। কিন্তু এ তো মিথ্যে ভয় নয়। সত্যিই তো বুকে জ্বালা করছে। বুক জ্বলে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

 বাস্তবিকই চোরটি তখন এইসব শারীরিক কষ্ট অনুভব করতে থাকে। চাল পড়ার ক্ষমতার প্রতি চোরটির বিশ্বাস বা আতঙ্কই তার এই শারীরিক অবস্থার জন্য পুরোপুরি দায়ী। এই শারীরিক কষ্টগুলো সৃষ্টি হয়েছে মানসিক কারণে, চাল পড়ার অলৌকিক ক্ষমতায় নয়।

 একটি মাত্র উদাহরণ হাজির করে আপনাদের ধৈর্যের ওপর অত্যাচার থেকে বিরত হব। ’৮৮ সালের ঘটনা। ডাইনি সম্রাজ্ঞী ঈন্সিতার তখন রমরমা বাজার। পত্র-পত্রিকা খুলেই ঢাউস ঢাউস ঈঙ্গিতা। ঈপ্সিতার নাম, অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পত্র-পত্রিকাগুলোর প্রচারের ঠেলায় আমাদের সমিতির সভ্যদের তখন পিঠ বাঁচানোই দায়। ঠিক করলাম, ঈপ্সিতার মুখোমুখি হব। শুনে আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির জনৈক সদস্য আমাদের বললেন, “আরে ধু-র-, ঈপ্সিতার কোনও ক্ষমতাই নেই। ওর বুজরুকি ফাঁস করতে আবার সময় লাগে? গিয়ে একবার চ্যালেঞ্জ করুন না, ভুডু ৰাণ মেরে আপনাকে মেরে ফেলতে; দেখি কেমন ভাবে মারে?”

 বললাম, “ঠিক আছে, তাই হবে, কাল দেখা করে সেই চ্যালেঙাই জানাবো। বলবো বাণ মেরে আপনাকে মারতে।”

 শুনেই উনি হঠাৎ দপ করে রেগে উঠলেন। বললেন, “আমাকে। কেন মারতে বলবেন? চ্যালেঞ্জ জানান আপনি। আপনি নিজেকে মারতে বলুন।’

 পরের দিন রাত ন-টা নাগাদ আমার বাড়িতে হাজির হলেন ওই সদস্য। সরাসরি জানতে চাইলেন ঈন্সিতাকে বাণ মারার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি কি না। বললাম, “জানিয়েছি। এবং আমাদের সমিতির তরফ থেকে আপনিই বাণের মুখোমুখি হতে চান, এ কথাও জানিয়েছি। আমার কাছ থেকে আপনার কিছু পারটিকুলার্স নিয়েছেন। জানিয়েছেন, তিন দিন তিন রাতের মধ্যেই আপনার ওপর বাগের অ্যাকশন শুরু হবে।”

 ব্যাঙ্ক আন্দোলনের নেতা ওই তরুণ তুর্কি আমার কথা শুনে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। তারপর বার কয়েক মিন মিন করে বললেন, “আমি তো ওঁকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইনি। আমাকে এর মধ্যে জড়ানো নীতিগতভাবে আপনার উচিত ছিল না।”

 পরের সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই খবর পেলাম, তরুণ তুর্কির স্ট্রোক হয়েছে। দৌড়লাম দেখা করতে। প্রথমেই ওঁর স্ত্রীর মুখোমুখি হলাম। আমাকে জবাবদিহি করালেন, “আপনার কি উচিত ছিল, ঈন্সিতার বিরুদ্ধে আমার হাজব্যাণ্ডকে লড়িয়ে দেওয়া?” বুঝলাম কোথাকার জল কোথায় গড়িয়েছে। আসামি আমি রোগী ও তার

 স্ত্রী দুজনের কাছেই এবার সত্য প্রকাশ করলাম, “ঈপ্সিতার সঙ্গে ভুডু মন্ত্রে কাউকে মারবার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাই হয়নি। মজা করতে আর কিছুটা পরীক্ষা করতেই মিথ্যে গল্পটা ফেঁদেছিলাম।”

 এক্ষেত্রে তরুণ বন্ধুটি ঈপিতার ক্ষমতায় বিশ্বাস করে আতঙ্কের শিকার হয়েছিলেন। হয় তো মরেও যেতেন। মারা গেলে যেতেন ঈন্সিতার অলৌকিক ক্ষমতায় নয়, ঈপিতার অলৌকিক ক্ষমতার আতঙ্কে।

বাণ-মারা

 সাধারণভাবে বহু মানুষের মধ্যেই একটা ধারণা রয়েছে, সত্যিই কারো কারো ‘বাণ মারা’র ক্ষমতা আছে। আদিবাসীরা যেমন বাণ মারায় গভীর বিশ্বাসী, তেমনি অ-আদিবাসীদের মধ্যেও বাগ মারার বিশ্বাসীর সংখ্যা কম নয়।

 বাণ মারায় যারা বিশ্বাসী, তাদের চোখে বিষয়টা কী? একটু দেখা যাক। বাণ মারা এক ধরনের মন্ত্রশক্তি, যার সাহায্যে অন্যের ক্ষতি করা যায়—তা সে যত দূরেই থাকুক না কেন। ক্ষতি করা যায় নানা ধরনের, যেমন ঘুসঘুসে জ্বর, কাশি, মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা, শরীরে যা হওয়া, ঘা না শুকানো, ঘন ঘন অজ্ঞান হওয়া, প্রস্রাবে রক্ত পড়া, গরুর বাঁট দিয়ে রক্ত পড়া, শরীর দুর্বল করে দেওয়া, শরীর শুকিয়ে দেওয়ায় মৃত্যু, অপঘাত মৃত্যু, অন্যের রোগ চালান করা। এছাড়াও দেখা যায়, কেউ হয়তো শত্রুতা করে কারো গরুর ওপর বাণ মারল। এবেলা ওবেলা মিলিয়ে তিন সের দুধ দিত। কোথাও কিছু নেই, গরুর বাঁট থেকে বেরোতে লাগল দুধের বদলে রক্ত। বগানে থনথন করে উঠেছিল কুমড়ো গাছ। মাচান বেঁধে গাছটাকে ওপরে তুললেন। কড়া পড়ল রাশি রাশি। কী বিপুল সংখ্যায় কুমড়ো হবে ভেবে যখন প্রতিদিন পরম যত্নে জলসিঞ্চন করে চলেছেন, তখন হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলেন গাছটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। গোড়ার মাটি আলগা করে সার চাপালেন। কিন্তু কোনও কাজ হলো না। গাছটা শুকিয়ে মরে গেল। অতএব ধরে নিলেন, আসলে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। গাছের অত ফলন দেখে কেউ হিংসেয় বাণ মেরে দিয়েছে। অতএব...

 এমনি বাণ মারার ফলেই নাকি অনেকের কোলের বাচ্চা হঠাৎ কেমন ঝিম মেরে যায়। শরীরের পেটটা শুধু বাড়ে আর সমস্ত শরীরটাই কমতে থাকে। কোমরের তামার পয়সা, জালের সীসে লোহা—কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। হবে কী করে, ওকে যে বাণ মেরেছে। পোয়াতি জলজ্যান্ত বউটা বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা গেল। কেন? কেউ নিশ্চয়ই বাণ মেরেছে। এমনই শতেক অসুখ আর ঘটনার পিছনে অনেক মানুষই সর্বনাশা মন্ত্রের অদৃশ্য বাণ বা তিরের অস্তিত্ব খুঁজে পায়।

বাণ মারা শুধুমাত্র সাঁওতাল আদিবাসীদের বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে নেই। অসম, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপুরা, সিকিম, উত্তরবঙ্গ এবং ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেই বাণ মারার প্রতি গভীর বিশ্বাস রয়েছে। আরব কি আফ্রিকা, কানাডা কি অস্ট্রেলিয়া সর্বত্রই বাণ মারায় বিশ্বাসী মানুষ রয়েছেন। আফ্রিকাবাসীদের অনেকেই মনে করেন, ভুডু মন্ত্রে বাণ মেরে যে কোনও শত্রুরই শারীরিক ক্ষতি করা সম্ভব। আফ্রিকার ভুডু মন্ত্রের চর্চা ইউরোপীয় দেশগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করেছে।

 শরীর বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার সুযোগ পাওয়া মানুষ জানতে পেরেছে, বুঝতে শিখেছে আমাদের রোগের কারণ কোনও তুকতাক, বাণ মারা ইত্যাদি অশুভ শক্তির ফল নয়, নয় পাপের ভোগ। প্রতিটি রোগকে বিশ্লেষণ করলেই অলৌকিক কারণের হদিশ পাওয়া যাবে। যদিও এটা বাস্তব সত্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও সব রোগ মুক্তির উপায় উদ্ভাবন করতে পারেনি। পারেনি মৃত্যুকে ঠেকাতে। কিন্তু না পারার অর্থ এই নয়—রোগের পিছনে বাণ মারা, তুক-তাকের মতো অলৌকিক কিছু শক্তি কাজ করে। ক্যানসার, যক্ষ্মা, ধনুষ্টঙ্কার, গ্যাংগ্রিন, ম্যালেরিয়া, অনাহারজনিত অপুষ্টি ইত্যাদি রোগের লক্ষণকেই অনেক বাণ মারা বা ভূক-তাকের অব্যর্থ ফল বলে ধরে নেয়।

 আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির, শাখা সংগঠন ও সহযোগী সংস্থাগুলো আজ পর্যন্ত দুশোর ওপর বাণ মারার দাবিদারদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রেই বাণ মারায় সমিতির কোনও সদস্যের মৃত্যু হয়নি—যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাণ মেরে মেরে ফেলার দাবিই ওঝা, গুনিন, তান্ত্রিকরা করেছিল। বাণ মারার শারীরিক প্রতিক্রিয়া দুর্বল চিত্তের অলৌকিকে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই শুধু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর সে সব ক্ষেত্রে গুনিন, তান্ত্রিকদের ক্ষমতার কাহিনি পল্লবিত হয়, ওদের ক্ষমতায় বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ে, রমরমা বাড়ে।

 বাণ মেরে কারও যেমন মৃত্যু ঘটানো সম্ভব নয়, তেমনই সম্ভব নয়, মন্ত্রে অন্যের শরীরে রোগ চালান করা বা রোগমুক্ত করা। অনেক সময় রোগী চিকিৎসক ও গুনিনের সাহায্য একই সঙ্গে গ্রহণ করে। চিকিৎসার গুণে রোগ সারানোও রোগী অনেক সময় বাণ মারার ক্ষমতায় বিশ্বাসী হওয়ার দরুন গুনিনের কৃপায় রোগমুক্তি ঘটেছে বলে মনে করে। আবার অনেক সময়শু ধুমাত্র গুনিনের বাণ মারায় রোগমুক্তি ঘটেছে এমন কথা দিব্যি গেলে বলার মতো অনেক লোকও পেয়েছি। তাদের কেউ কেউ হয়তো মিথ্যাশ্রয়ী। কিন্তু সকলেই নন, কারণ এমনটা ঘটা সম্ভব।

 রোগ সৃষ্টি ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বহু রোগের উৎপত্তি হয় ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি থেকে। মানসিক কারণে বহু অসুখই হতে পারে, যেমন—মাথাধরা, মাথার ব্যথা, শরীরের কোনও অংশে বা হাড়ে ব্যথা, স্পন্ডালাইটিস, স্পন্ডালোসিস, আরথ্রাইটিস, বুক ধড়ফড়, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, পেটের গোলমাল, পেটের আলসার, কামশীতলতা, পুরুষত্বহীনতা, শরীরের কোনও অঙ্গের অসাড়তা, কৃশতা এমনি আরো বহু রোগ মানসিক কারণে সৃষ্ট। এইসব রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অনেক সময়ই ঔষধি-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, ইনজেকশন ইত্যাদি প্রয়োগ করেন, সঠিক এবং আধুনিকতম চিকিৎসার সাহায্যে রোগ মুক্ত করা হচ্ছে, এই ধারণা রোগীর মনে সৃষ্টি করে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে আরোগ্যের পথে নিয়ে যান। এই রোগীর বিশ্বাস নির্ভর এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে ‘প্ল্যাসিবো’ (Placebo) চিকিৎসা পদ্ধতি। প্ল্যাসিবো চিকিৎসা-পদ্ধতি বিষয়ে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির প্রথম খণ্ডে বহু উদাহরণ-সহ বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে বলে এখানে আর বিস্তৃত আলোচনায় গেলাম না। শুধু এটুকু বলেই শেষ করতে চাই, যারা চিকিৎসকের সাহায্য ছাড়া বাণ মারা বা তুকতাকের ক্ষমতায় মুক্ত হয়েছে বলে মনে করে, তারা প্রতি ক্ষেত্রেই মানসিক কারণে নিজের দেহে রোগ সৃষ্টি করেছিল। এবং তাদের আরোগ্যের পেছনে বাণ মারা, তুকতাক বা তন্ত্রমন্ত্রের কোনও গুণ বা বৈশিষ্ট্য সামান্যতম কাজ করেনি, কাজ করেছে বাণ মারা, তুকতাক ও মন্ত্র-তন্ত্রের প্রতি রোগীদের অন্ধ বিশ্বাস।

গরুকে বাণ মারা

 গ্রামের মানুষ মাঝে-মধ্যে ওঝা বা গুনিনের কাছে হাজির হয় দুধেল গাইয়ের সমস্যা নিয়ে। কেউ বাণ মেরেছে, অথবা কোনও ডাইনির নজর পড়েছে। গরুর বাঁট থেকে দুধের বদলে বের হচ্ছে রক্ত।

 ওঝা ঝাড়-ফুঁক করে টোটকা ওষুধ দেয়। তাতে গরুর রক্ত দুধ সাদা না হলে শালপাতায় তেল পড়ে ঘোষণা করে কোনও ডাইনির নজর লেগেছে। কখনও বা ডাইনি কে তাও ঘোষণা করে গুনিন। পরিণতিতে নিরীহ কোন রমণীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

 গরু শুধু নয়, মোষ, ছাগল, ভেড়া, শুয়োর সবার ক্ষেত্রেই দুধের পরিবর্তে রক্ত ও পুঁজ বের হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। ভাইরাস থেকেই এই রোগ হয়। পশু-চিকিৎসকদের ভাষায় এই রোগকে বলা হয় ম্যাসটাইটিস' বা 'ঠুনকো'। আধুনিক চিকিৎসার সাহায্যের এই রোগ সারানো যায়।

ভোলায় ধরা

 নিধা গাঁয়ের মানুষ প্রতিদিন বিশাল ধু-ধু মাঠটা পারাপার করছে এবেলা ওবেলা। হঠাৎই এক ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুরে মাঠ পার হয়ে বাড়ি আসতে গিয়ে কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল। কোথায় বাড়ি? কোথায়ই বা গাঁ? সেই সকালে চাট্টি আমানি পেটে ঢুকেছিল, যাতে ভাতের চেয়ে জলই ছিল বেশি। তিন ক্রোশ পথ হেঁটে টাঙির কোপে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করে মাথায় বোঝাটা চাপাবার আগে গলায় ঢেলে নিয়েছিল এক বোতল তরল আগুন। এই আগুন শরীরে না ঢেলে দিলে তিন ক্রোশ পথের আকাশের আগুনকে শরীরকে সামাল দেবে কেমন করে? বেচাল আগুনে হাওয়া ঠেলে চলেছে—সে অনেকক্ষণ। এতক্ষণ ছ-ক্রোশ পথ বোধহয় হাঁটা হয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় রাংচিতা আর ঢোলকলমির বেড়ায় ঘেরা গাঁয়ের বাড়িগুলো? ভয় ধরে মনে। পথ ভুল হচ্ছে। এত দিনের চেনা পথ, তবে তো ভোলায় ধরেছে। ভোলায় ভুলিয়ে মারতে চায়। গরম গা ভায়ের ঠেলায় ঠাণ্ডা মেরে যায়। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। জ্বালানির খোঁজে আসা কয়েকটি কিশোরী ও বৃদ্ধা ওকে অমনপানা পড়ে থাকতে দেখে দৌড় লাগায় গাঁয়ে। ধাঁ ধাঁ করে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। নিধাকে গাঁয়ের লোকেরা নিয়ে আসে বাড়ি। কিন্তু এ কোন নিধা? ডাকাবুকো মানুষটা কেমন হায়ে গেছে। হাবার মতো চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। কোন কিছুই ঠাওর করতে পারছে না। নিধার বউ গোপা অমন অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। নিধার ছেলে-মেয়েগুলো বড়দের ভিড় ঠেলে বাপের কাছে এগুতে সাহস পেল না। অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে সকলের কাণ্ড-কারখানা দেখছিল। নিধার বাপ হরি বাউড়ি মেলা শোরগোল তুলে চেঁচাল, “ওরে নিধাকে ভোলায় ধরেছে, জল নিয়ে আয়।” পুরুলিয়া জেলার এমন শুখো জায়গায় জলের অভাবে মাটিতে ফাটল ধরে। শীর্ণ গরুগুলো জল-ঘাসের অভাবে ধুঁকছে। তবু জল হাজির হয়। নিধাকে দাওয়ায় কিছুক্ষণ বসিয়ে গায়ের ঘামটা মেরে দাঁড় করিয়ে দেয় পাড়াপড়শিরা। মাথায় জল ঢালা হতে থাকে। তারই মাঝে শ্বশুরের আদেশে নিধার কাপড়ের কসিতে টান মারে গোপা। একেবারে পুরুষ মা কালী। ঠা-ঠা করে হাসতে থাকে দু-চারজন মেয়ে মর্দ। নিধা চমকে উঠে গোগার হাত থেকে কাপড় টেনে নিয়ে আৰু বাঁচাতে তৎপর হয়। গোপার আতঙ্ক দূর হয়। মুখে হাসি ফোটে। ‘ভোলা’ ছেড়ে দিয়েছে।

 এতক্ষণ যে ঘটনাটি বললাম, তাতে স্মৃতির সঙ্গে সামান্য কল্পনার মিশেল দিয়েছি পাঠক-পাঠিকাদের ভোলায় পাওয়া মানুষটি মানসিকতা বোঝাতে। ঘটনাস্থল পুরুলিয়া জেলার আদ্রা শহরের উপকণ্ঠের বাউড়ি পল্লি। ওই মাঠ পার হতে গিয়ে অনেককেই নাকি ভোলায় পেত, শৈশবে এমন গল্প অনেক শুনেছি। আমার জ্যাঠতুতো মেজদাও যখন ষণ্ডা চেহারার এক প্রখর জেদি যুবক, তখন এক সন্ধ্যায় ওই মাঠ পার হতে গিয়ে তিনিও নাকি একবার ভোলার পাল্লায় পড়েছিলেন। যে মাঠ অগুনতি বার পার হয়েছেন, সে মাঠের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুন হরিতকির গাছের কাছে পথ ভুলেছিলেন। এদিক-ওদিক উল্টোপাল্টা ছোটাছুটি করে যখন শীতের সন্ধ্যাতেও ঘেমে নেয়ে একশা তখন সাউথ ইনস্টিটিউটের বনাদা আবিষ্কার করলেন মেজদাকে। বিহ্বল মেজদার গায়ে শীতের রাতেও বালতি বালতি কুয়োর জল ঢালতে দেখেছি।

 ভোলায় ধরা যুবতীকে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে তার মাথায় অনবরত জল ঢালতে দেখেছি। আর একগাদা নানা বয়সি নারী-পুরুষের সামনে বয়স্কা মহিলাকে দেখেছি যুবতীটির অনাবৃত স্তন টিপতে। তাদের ধারণা, এইভাবে বিভিন্ন বয়সি বিভিন্ন সম্পর্কের নারী-পুরুষদের সামনে ভোলায় ধরা মানুষটিকে লজ্জা পাইয়ে দিতে পারলে ভোলায় ধরা ছেড়ে যায়।

 পথিকের আত্মবিস্মৃত হওয়া বা ভুলে যাওয়া থেকেই ভোলায় ধরা কথাটি এসেছে। বিশাল ফাঁকা মাঠ অতিক্রম করতে গিয়ে কিছু কিছু সময় কারো কারো দিক বিভ্রম ঘটতেই পারে। ঠা-ঠা রোদ্দুর ও অন্ধকার রাতে এমন ধরনের দিক-বিভ্রম ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। তার ওপর আবার মাঠটির যদি ‘ভোলায় ধরার মাঠ’ হিসেবে কুখ্যাতি থাকে, তবে তো সোনায় সোহাগা। ভোলায় ধরার আতঙ্ক থেকেই তাকে ভোলায় ধরে—ভূতে ধরার মতোই। ভোলায় ধরার ভয় আদৌ না থাকলে দিকবিভ্রম ঘটলেও ভোলায় ধরে না কখনওই।

 রাত দুপুরে অতি পরিচিত পথ চলতে গিয়ে দিক ভুল করার অভিজ্ঞতা কম বেশি অনেকেরই আছে। ধরুন শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেছেন আরো পাঁচটা দিনের মতো। রাতের আলো ঝলমল শিয়ালদহ। আপনার সঙ্গী যে দিকে এগুলো তা দেখে অবাক হলেন। “ওদিকে যাচ্ছিস কেন?” জিজ্ঞেস করতেই জবাব পেলেন, “গেট দিয়ে বেরুবো না।” আবার আপনার অবাক হওয়ার পালা। গেট আবার ওদিকে কোথায়? ও তো গেটের ঠিক উল্টো দিকে হাঁটছে। আপনি কিছুটা হতভম্ব, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে সঙ্গীকে অনুসরণ করতে গিয়ে আবারও অবাক হলেন। অতি স্থির ভাবে মনে হচ্ছে উল্টো দিকে হাঁটছেন কিন্তু ওই দূরে গেটটাও দেখতে পাচ্ছেন। এমন ভুল শ্যামবাজার মোড়ে গড়িয়াহাটের মোড় বা পৃথিবীর যে কোনও স্থানেই হতে পারে। এই সাময়িক দিক নির্ণয়ে ভুল করাকেই কিছু কিছু মানুষ ভাবেন—কোনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তি তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল মৃত্যুর গভীরে। ভোলায় মারার আগে অন্যের নজরে পড়ায় জীবনটা বেঁচেছে, কিন্তু ভোলায় ধরার পরিণতিতেই এমন স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে।

 ভোলা নামক অলীক কিছুর জন্য দিক খুঁজে পাচ্ছে না ভেবে দিক-হারা মানুষটি কেবলমাত্র ভয়েই মারা যেতে পারে। ভয়ে মস্তিষ্ক কোষের ভারসাম্য সাময়িকভাবে নষ্ট হতেও পারে। ‘ভোলায় ধরলে সব ভুলে যায়’ এমন একটা ধারণা শোনা কিছু কাহিনি বা দেখা কিছু ঘটনা থেকে পথিক প্রভাবিত হতেই পারে। প্রভাবিত পথিক যদি তীব্র আতঙ্কে ভাবতে শুরু করেন, আমাকে ভোলায় ভুলিয়ে নিয়ে ঘোরাচ্ছে, আমাকে হয় মেরে ফেলবে নতুবা সব কিছু ভুলিয়ে দেবে—তবে পথিকের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া যেমন বন্ধ হতে পারে, তেমনই ঘটতে পারে সাময়িক স্মৃতিভ্রংশের ঘটনা।

 আবারও বলি, দিক বিভ্রমের মতো ঘটনাকে ভোলায় ধরার মতো অতিপ্রাকৃত ঘটনা বলে ভয় না খেলে মৃত্যু বা স্মৃতিভ্রংশতা দেখা দেয় না কখনওই।

জন্ডিসের মালা

 জণ্ডিস বা ন্যাবা রোগে মন্ত্রঃপূত মালা পরার প্রচলন শুধু যে আদিবাসী সমাজ বা গঞ্জেই ব্যাপকতা পেয়েছে, তা নয়। বিভিন্ন শহরে এমনকী, কলকাতাতেও মন্ত্রপূত জণ্ডিসের মালার প্রতি জণ্ডিস রোগীদের আগ্রহ ও বিশ্বাস লক্ষ্য করার মতো।

 কলকাতার দর্জিপাড়ার মিত্তিরবাড়ি থেকে জণ্ডিসের মালা দেওয়া হয় প্রতি শনিবার। তিন-চার পুরুষ ধরেই তাঁরা এই মালা দিয়ে চলেছেন। সংগ্রহকারীদের ভিড়ও দেখার মতো।

 জণ্ডিসের মালায় কী হয়। জণ্ডিস রোগী এই মালা পরে সাধারণত প্রাপ্ত নির্দেশ মতো দুদিন স্নান করেন না। তেল, ঘি, মাখন খাওয়া বারণ। নিতে হয় পূর্ণ বিশ্রাম। মন্ত্রঃপূত মালা জণ্ডিসের রোগ যতই শুষে নিতে তাকে ততই মালা বাড়তে থাকে। বুক ছাড়িয়ে পেটের দিকে নামতে থাকে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক মামলার মতো এ মালা একই আয়তন নিয়ে থাকে না। মালার অদ্ভুত ব্যবহারে ব্যবহারকারীরা বিশ্বাস বাড়ে। এবং সাধারণত দেখা যায় রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন।

 সমগ্র বিষয়টার মধ্যে একটা অলৌকিকের ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে। কোনও মালা কি এমনি করে বাড়ে? বাড়ে বইকি, মালাটা যদি বিশেষভাবে তৈরি হয় ফুলের বদলে বামনহাটি, ভৃঙ্গরাজ অথবা আপাং গাছের ডাল দিয়ে। এইসব গায়ের ডাল ফাঁপা এবং দ্রুত শুকিয়ে কৃশ থেকে কৃশতর হতে থাকে।

 এই জাতীয় গাছের ডাল ছোট ছোট করে কেটে তৈরি করা হয় মালা। ডালের টুকরোগুলোকে গেঁথে মালা তৈরি করলে সে মালা কিন্তু বাড়বে না। মালা বাড়াতে গেলে সুতো বাড়াতে হবে। ছুঁচে গাঁথা মালায় বাড়তি সুতো পাওয়া সম্ভব নয় বলেই সে মালা বাড়ে না। জণ্ডিসের মালা তৈরি হয় বিনা ছুঁচে। বলা চলে জণ্ডিসের মালা বোনা হয়। এই বোনার কৌশলেই বাড়তি সুতো মালা বাড়ায়। এবার আসা যাক মালা বানাবার পদ্ধতিতে। বামনহাটি, ভৃঙ্গরাজ বা আপাং অথবা ফাঁপা অথচ দ্রুত শুকোয় এমন কোনও গাছের ডাল কেটে বানানো হয় ছোট ছোট কাঠি, এক একটা কাঠি আড়াআড়িভাবে ধরে আঙুলের সাহায্যে ফাঁস দিয়ে গা ঘেঁষে ঘেঁষে বাঁধা হতে থাকে কাঠিগুলো। এই বিশেষ পদ্ধতির ফাঁস বা গিঁটের নাম শিফার্স নট (shiffer's knot) বা সেলার্স নট (sailor's knot)।

 গা ঘেঁষে ঘেঁষে জড়ানো কাঠিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যতই শুকোতে থাকে ততই সুতোর ফাঁক ঢিলে হয়, দু-কাঠির মধ্যে ফাঁক বাড়ে। মালা বাড়তে থাকে।

 এই মালা বাড়ার পিছনে যেমন মন্ত্রশক্তি কাজ করে না, তেমনই জণ্ডিস রোগ শুষে নেওয়াও এই বাড়ার কারণ নয়। এই একই পদ্ধতিতে মন্ত্র ছাড়া আপনি নিজে হাতে মালা বানিয়ে একটা পেরেকে ঝুলিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন। মন্ত্র নেই, জণ্ডিস নেই তবু মালা বাড়ছে।

 জণ্ডিস হয় বিলিরুবিন নামে হলুদ রঙের একটি রঞ্জক পদার্থের জন্য স্বাভাবিকভাবে মানুষ ও অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীর পিত্তে বিলিরুবিনের অবস্থান। রক্তে এর স্বাভাবিক উপস্থিতি প্রতি ১০০ সি.সি.-তে ০.১ থেকে ১ মিলিগ্রাম। উপস্থিতির পরিমাণ বাড়লে প্রথমে প্রস্রাব হলুদ হয়। তারপর চোখের সাদা অংশ ও শরীর হলুদ হতে থাকে। রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বিভিন্ন কারণে বাড়তে পারে। প্রধানত হয় ভাইরাসজনিত কারণে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে, বিশ্রাম নিলে, চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ না করলে রোগী কিছুদিনের মধ্যেই আরোগ্যলাভ করেন।

 এছাড়াও অবশ্য জণ্ডিস হতে পারে। পিত্তনালীর পাথর, টিউমার, ক্যানসার হওয়ার জন্য অথবা অন্য কোন অংশে টিউমার হওয়ার জন্য পিত্তনালী বন্ধ হলে পিত্ত গন্তব্যস্থল ক্ষুদ্রান্ত্রে যেতে পারে না, ফলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং জণ্ডিস হয়।

 আবার কোনও কারণে রক্তে লোহিত কণিকা অতিরিক্ত মাত্রায় ভাঙতে থাকলে হিমোগ্লোবিনের তুলনায় বেশি পরিমাণে বিলিরুবিন তৈরি হবে এবং জণ্ডিস হবে।

 ভাইরাসজনিত কারণে জণ্ডিস না হয়ে অন্য কোনও কারণে জণ্ডিস হলে চিকিৎসার সাহায্যে মূল কারণটিকে ঠিক না করতে পারলে জণ্ডিস-মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

 আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য না নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিশ্রাম ও খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন মেনে জণ্ডিস থেকে মুক্ত হওয়া যায় বটে (তা সে জণ্ডিসের মালা পরুন, অথবা নাই পরুন), কিন্তু জণ্ডিসের মালার ভরসায় থাকলে ভাইরাসজনিত কারণে হওয়া জণ্ডিস থেকে মৃত্যুও হতে পারে। যকৃৎ স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে চিরকালের জন্য যেমন ভুগতে হতে পারে। তেমনই বিলিরুবিনের মস্তিষ্কে উপস্থিতি স্থায়ী স্নায়ুরোগ এমনকী, মৃত্যু হানতে পারে।

 জণ্ডিস হলে চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে জানা প্রয়োজন জণ্ডিসের কারণ। পরবর্তী ধাপ হবে প্রতিকারের চেষ্টা।

জন্ডিস ধোয়ানো

 জণ্ডিস হলে রোগীরা যেমন মালা পড়তে দৌড়ান, তেমনি অনেকে দৌড়োন জণ্ডিস ধোয়াতে।

 ওঝা বা গুনিন জণ্ডিস রোগীর শরীরে মন্ত্র পড়ে হাত বুলিয়ে জলে হাত ধুতেই মন্ত্রশক্তির প্রভাবে জল হলুদ রঙ ধারণ করতে থাকে। আপনি যদি ভেবে থাকেন ‘রামবাবু’ বা ‘শ্যামবাবু’ যে কেউ রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে জলে হাত ধুলেই জল জণ্ডিসের বিষ ধারণ করে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে তবে ভুল করবেন। এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখার পর অনেক বিজ্ঞান পড়া মানুষ যদি মন্ত্র-তন্ত্র বা আদিবাসীদের তুক-তাক, ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলেন, তবে অবাক হব না। আমাদের যুক্তিতে কোনও কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে না পেলে অহংবোধে ধরে নিই, এর কোনও ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব নয়, অর্থাৎ ব্যাখ্যার অতীত, অলৌকিক। আমরা অনেক সময়ই বিস্মৃত হই, আমার জ্ঞানের বাইরের কোনও কারণ দ্বারাই এমন কাজটা ঘটা সম্ভব।

 প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বাস্তবে অনেক সময় দেখা যায় রোগী একটু একটু ভালও হচ্ছেন। জণ্ডিস-ধোয়া গুনিনের নাম ও পসার বাড়ে। কেন সায়ে, এই প্রসঙ্গের আবার অবতারণা করা অপ্রয়োজনীয়, কারণ জণ্ডিসের মালা নিয়ে আলোচনাতে এই প্রসঙ্গে আমি এসেছিলাম। বরং এই প্রসঙ্গে আসি, কী করে জণ্ডিস রোগীর গায়ে বোলানো হাত ধুলে জল হলুদ হয়।

 একটু কষ্ট করে আম ছাল বেটে রস তৈরি করুন। একটা পাত্রে জল নিয়ে তাতে চুল ফেলে রাখুন। ঘণ্টা কয়েক পরে যে পরিষ্কার চুন জল পাবেন সেটা একটা বাটিতে ছেঁকে স্রেফ জল বলে যার সামনেই হাজির করুন—সকলেই সাধারণ জল বলেই বিশ্বাস করবেন। হাতে ঘষুন আমগাছের রস। এবার একজন সুস্থ মানুষের গায়ে হাত বুলিয়ে হাতটা বাটির চুল জলে ধুতে থাকুন, দেখবেন সেই অবাক কাণ্ডটাই ঘটে যাচ্ছে—জল হলুদ হয়ে যাচ্ছে।

যেসব প্রচলিত তুকতাক,
ঝাড়-ফুঁক বিষয়ে আমরা আলোচনা
করলাম, এর বাইরেও কিছু কিছু থেকে গেছে,
যেগুলো অপ্রধান বলে আলোচনায় আনিনি, অথবা
এমন কিছু কিছু তুক-তাক নিয়ে আলোচনা করলে ভাল
হতো, যেগুলোর বিষয়ে আমি এখনও কিছু শুনিনি
বলে আলোচনা করতে পারলাম না। সে সব তুক-তাক,
ঝাড়-ফুঁকের বিষয়ে বিস্তৃতভাবে জানিয়ে কেউ যদি
এর লৌকিক ব্যাখ্যা চান, নিশ্চয়ই দেব। এই
বিষয়ে আপনাদের কোনও অনুসন্ধানে
প্রয়োজনে আমার এবং আমাদের
সমিতির সমস্ত রকম সহযোগিতার
প্রতিশ্রুতি রইল। শুধু
অনুরোধ, চিঠি জবাবি
খাম-সহ পাঠাবেন।