অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/নতুন কিছু কথা


নতুন কিছু কথা



 ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ১ম খণ্ডের প্রথম প্রকাশ ২১ বছরে পা দিল। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে টানা ২১ বছর আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘বেস্ট সেলার’ তালিকায় স্থান পেয়েই আসছে। মনেই হতে পারে ‘অসম্ভব ব্যাপার’, কিন্তু ‘সত্যি’।

 আরও একটা ব্যাপার—‘যুক্তিবাদী সমিতি’-ও (ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি) ২১ বছরে পা দিল। ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ আর ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ এই দুটি ‘ব্র্যাণ্ড নেম’ আজ সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে।


 বুজরুকি ফাঁস নিয়ে লেখার শুরু ১৯৮২ সালে। ‘পরিবর্তন’ সেই সময় জনপ্রিয়তম বাংলা সাপ্তাহিক। সম্পাদক ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ‘লৌকিক অলৌকিক’ শিরোনামে লিখতাম বিভিন্ন তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার নেপথ্যের লৌকিক কারণ। পাঠকরা যে ভাবে লেখাগুলো গ্রহণ করলেন, তাতে সত্যিই আপ্লুত হলাম।

 আমার এই ধরনের লেখায় হাত দেওয়ার পিছনে কয়েকটা কারণ ছিল। সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, এ-দেশের অসাম্যের জগদ্দল ব্যবস্থাকে বাস্তবিকই পাল্টাতে হলে সমাজের কিছু মানুষের আন্তরিক সমর্থনের প্রয়োজন। আইন করে আজও জ্যোতিষচর্চা, ধর্মের নামে পশু বলি, দেহব্যবসা, পণপ্রথা ইত্যাদি বন্ধ করা যায়নি জন-সচেতনতার অভাবে। আবার আগে সমস্ত মানুষের বিবেকের পরিবর্তন ঘটাব, তারপর সমাজ বিপ্লব ঘটাবার কাজে হাত দেব—এটাও অত্যন্ত ভুল ধারণা। হাতের সামনেই উদাহরণ রয়েছে। গত শতকের শেষভাগে রাশিয়ায় যখন প্রতিবিপ্লব ঘটল, মার্কসের মূর্তিকে উপড়ে ফেলল, তখন গোটা ‘অপারেশন’-এ কত মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল? অতি মুষ্টিমেয়। কোনও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, গৃহযুদ্ধ ছাড়াই তারা হঠাৎ করে কমিউনিস্ট জমানা পাল্টে দিল। রাশিয়ার সামান্য কিছু মানুষ পুরো ‘অ্যাকশন’-এ নেতৃত্ব দিয়েছিল। নেতারা বুঝে নিয়েছিল, তাদের এই পাল্টে দেবার রাজনীতিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা কেউ-ই প্রায় করবে না। কমিউনিস্টদের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ধারণা, মন্দির-মসজিদ গির্জায় জোর করে প্রার্থনা বন্ধ করে দেওয়া, উঁচু মহলে দুর্নীতি—এসবই সাধারণ মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। জনগণের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ছিল। বার-ড্যান্স, ক্যাবারে, ব্লু-ফিলম, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি নানা ভোগসর্বস্বতা রুশ সমাজে ঢুকে গিয়েছিল। অলৌকিতার পক্ষে নানা গাল-গপ্পোকে ‘সত্যি’ বলে চালাতে চাইছিল রুশ সরকারি পত্র-পত্রিকা। কমিউনিস্টদের এই ‘ঘোমটার তলায় খেমটা নাচ’ দেশবাসীরা কী চোখে দেখছে, তা বোঝার সামান্যও চেষ্টা করেনি রাশিয়ার গদীতে বসা কমিউনিস্টরা। বুঝেছিল কমিউনিস্টদের ছুঁড়ে ফেলতে এগিয়ে আসা কিছু নেতা।

 যেখানে শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই, সেখানে মুষ্টিমেয় নেতাও সরকার উল্টে দিতে পারে, সমাজ পাল্টে দিতে পারে—রাশিয়ার ইতিহাস তেমন-ই শিক্ষা দিয়েছে।

 সমাজকে পাল্টে দেওয়ার পথ একটা নয়। বহু। প্রয়োজনে মানুষকে সচেতন করতে হয়। সমাবেশিত করে চালিত করতে হয়। কখনও বা গণ-হিস্টিরিয়া তৈরি করে কার্যোদ্ধার করা হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে হিস্টিরিক করে তুলে ‘ধর্মগুরু’ বা ‘ধর্মযোদ্ধা’রা আত্মঘাতী বাহিনী তৈরি করে ফেলে। যেমনটা দেখেছি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেণ্টার ধ্বংসের সময়। আবার আদর্শের জন্য উচ্চমেধার মানুষদের আত্মবলি দিতে দেখেছি গত শতকের ছয়-সাতের দশকে নকশাল আন্দোলনে।

 সমাজকে পাল্টাবার স্বপ্ন দেখা মানুষরা তাদের সংগৃহীত জ্ঞান থেকে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার ও প্রয়োগ করতে পারে। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল কি বর্তমান সময়ে আদৌ সম্ভব? সংঘর্ষ বিনা কি সাম্যের সমাজ গড়া সম্ভব? সাম্যের শত্রুরা কি বিনা বাধায় কাজ করতে দেবে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর ‘না’। সাম্যের সমাজ গড়তে গেলে আক্রমণের মোকাবিলায় প্রতি আক্রমণ করতেই হবে। সংঘর্ষে যেতেই হবে। অসাম্য ভাঙতে সংঘর্ষ ও সাম্য আনতে নির্মাণ জরুরি।

 বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী বা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে নিয়ে এক একটি পৃথক উন্নততর সাম্যের সমাজ গড়ার পরিকল্পনা নিলে তা হবে বাস্তবসম্মত। যেমন ওড়িয়াভাষী অঞ্চল বাংলাভাষী অঞ্চল (যার মধ্যে থাকবে পশ্চিমবাংলা, বিহারের বাংলাভাষী অঞ্চল,অসম ও ত্রিপুরার বাংলাভাষী অঞ্চল এবং বাংলাদেশ), ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সংস্কৃতি প্রভাবিত অঞ্চল, বিহার, অন্ধ্র, ছত্তিশগড়, পূর্ব ভারতের সাতটি প্রদেশ—প্রত্যেকেই পৃথক দেশ হলে অসুবিধা কোথায়? কোথাও নেই। ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলো যদি স্বাধীন দেশ হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, তবে বাংলা, বিহার, ওড়িশা, অসম, ত্রিপুরা কেন পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। তাত্ত্বিক ভাবে পারবে। বাস্তবেও পারবে।

 যাঁরা সাম্যের সমাজ গড়ায় নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। শোষিত জনগণের মধ্যে যদি কাজ করতে চান, তবে তাদের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়াতে হবে। পরিবারের একজন হতে হবে। তাদের ভালোবাসা, তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। হতে হবে তাদের ভরসাস্থল। তবে না মানুষগুলো নেতার কথায় জীবন দিতে পারবে অবহেলে। এই নেতারা তো শূন্য থেকে হঠাৎ করে জন্মায় না। এরা একটু একটু করে হয়ে ওঠে। বরং বলা ভালো—একজন ভালো খেলোয়াড়কে গড়ে তোলার মতোই নেতা গড়ে তুলতে হয়। তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাত-লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নেতা পরিশীলিত ও মার্জিত হয়।

 যুক্তিবাদী সমিতির অনেক রকম কুসংস্কার বিরোধী কাজের পাশাপাশি সাম্যের সমাজ গড়ার চিন্তাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার বিষয়ে সমস্ত রকমের সহযোগিতা করাও কাজ।


 এই আলোচনার মধ্য দিয়ে এটাই উঠে এল যে, যুক্তিবাদী সমিতি শুরুতে দুটি লক্ষ স্থির করেছিল। (এক), জনগণের একটা অংশকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা। এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান করা, সেই অনুষ্ঠানে তথাকথিত নানা অলৌকিক ঘটনার পিছনের লৌকিক কৌশলকে বেআব্রু করা, কুসংস্কার বিরোধী ‘ওয়ার্কশপ’ (যারা কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান করতে ইচ্ছুক, তাদের তৈরি করা), তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের এবং জ্যোতিষীদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাদের ভণ্ডামি ফাঁস করা, কুসংস্কার-বিরোধী নাটক, পথসভা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা—ঐশ্বরিক শক্তি, ঈশ্বর, কর্মফল, ভাগ্য ইত্যাদির কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই।

 (দুই), শোষিত মানুষদের মধ্য থেকে এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া। সেই মানুষ যুক্তিবাদী সমিতির সভ্য হতে পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। কিন্তু তাঁকে হতেই হবে সৎ, নির্লোভ, সাহসী, সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কিছু মানুষই শোষিত মানুষদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করে বঞ্চনার ক্ষোভ জাগিয়ে তুলতে ও তাদের সমাবেশিত করতে পারেন। সেইসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে সব্বাইকে সব কিছু বুঝিয়ে তারপর বিপ্লবের কাজে হাত দিতে গেলে আর বিপ্লব হবে না। কারণ সকলে কোনও দিন-ই একমত হবে না।

 (তিন), সাম্যের সমাজ গড়তে গেলে এতদিনকার চিন্তা-ভাবনা-মূল্যবোধের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ দেখা দেবে। সেই সংঘর্ষে লাঠি-বন্দুক না থাকলেও থাকবে পুরোনো চিন্তার সঙ্গে নতুনের ঠোকাঠুকি। আপনার উন্নততর ধ্যান-ধারণা নিয়ে যখনই প্রচারে নামবেন, দলিতদের অধিকার সচেতন করতে নামবেন, তখনই হুজুরের দল ও তাদের সহযোগীরা আপনার বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নামবে। তার মধ্যে থাকবে রাজনৈতিক দল, তাদের ‘বাহুবলী’রা, পুলিশ-প্রশাসন, প্রচার মাধ্যম ইত্যাদিদের কেউ কেউ। অথবা সবাই একজোট হয়ে আপনার ও আপনার দলের বিরুদ্ধে নামতে পারে। কতটা লড়াইতে যাবেন, কতটা লড়াই এড়াবেন, কাদের সহযোগী হিসেবে পাবেন—সেটা ভিন্নতর প্রশ্ন। দলিতদের ঘুম ভাঙাতে গেলে সংঘর্ষ অনিবার্য। সবাই যদি খাদ্য-বস্ত্র বাসস্থান-পানীয়-স্বাস্থ্য-শিক্ষা’র মতো সাংবিধানিক অধিকারগুলো দাবি করে বসে, তবে তো রাজনীতিকদের লুটে-পুটে খাওয়ার ঐতিহ্যকেই লাটে তুলতে হয়।

 (চার), সংঘর্ষের পর দ্বিতীয় ধাপে নির্মাণকালে শিক্ষা-সংস্কৃতি-আর্থিক উন্নতির মধ্য দিয়ে নতুন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সংখ্যাগুরু জনগণকে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।

 (পাঁচ), এই পর্যায়ের কাজ ঠিক মতো চালাতে পারলে পরের পর্যায়ে উন্নততর সাম্য গড়ার কাজে হাত দিতে হবে। এই নির্মাণ পর্যায়ে গড়ে তোলা হবে স্বনির্ভর গ্রাম, কমিউন, সমবায় ইত্যাদি। নিজেকে জিজ্ঞেস করে নিজের কাছে পরিষ্কার হতে হবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র এই পদ্ধতির প্রয়োগের সাহায্যে উন্নততর সাম্য আনা সম্ভব কি না? রাষ্ট্রশক্তি দখল করা সম্ভব কি না?

 (ছয়), যারা দলিতদের সাম্য আনার কাজে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে বলে মনে হয়, যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে তাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বারবার বসা দরকার। তাদের বোঝাতে হবে, আমাদের সমিতির প্রয়োগ কৌশল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল শুরু থেকে আরম্ভ করার। কাঁচা মাটি নিয়ে গড়ার।


 সব খেলারই নিজস্ব কিছু নিয়ম বা কৌশল থাকে। কেউ-ই শুরুতেই আস্তিনের সেরা তাসগুলো ফেলে না। সেরা দল বা খেলুড়ে সে-ই, যে প্রয়োজন বুঝে তাস বের করে।

 শুরুতেই সব তাস ফেলিনি। শুরু করেছিলাম কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। পরিবর্তন সাপ্তাহিকে আমার লেখা বছর তিনেক এমন একটা জনপ্রিয়তা পেল যে শহর, মফঃস্বল, গ্রাম থেকে আমন্ত্রণ আসতে লাগল। ‘থ্রি মেনস আর্মি’ নিয়ে শুরু হলো কুসংকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা। আমি, আমার বউ সীমা ও শিশুপুত্র পিনাকী। প্রথমে সীমা গান ধরতেন। তারপর আমি আর পিনাকী নানা বাবাজি-মাতাজিদের ‘অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য ফাঁস করতাম। সেটা ১৯৮৫-৮৬ সাল। তারপর সংগ্রামের সাথী হলেন অরুণ মান্না, গুপি ও সঞ্জয়।


 কিছু কিছু সমমনোভাবাপন্ন মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় শুরু করেছিলাম ১৯৮২-৮৩ সাল থেকেই। আড্ডা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক সব-ই হতো। একটা যুক্তিবাদী সংগঠন গড়ার প্রয়োজনীতার কথা বারবার আলোচনায় উঠে আসত।

 ১৯৮৫-র ১ মার্চ। বিকেলে আমার দেবীনিবাসের ছোট্ট ফ্ল্যাটে সমমনোভাবাপন্ন কিছু মানুষ এলেন। উদ্দেশ্য যুক্তিবাদী একটা সংগঠন গড়ার কাজকে রূপ দেওয়া। অসিত চক্রবর্তী, ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল, ডাঃ সুখময় ভট্টাচার্য, তরুণ মান্না, গৌতম, অমরেন্দ্র আদিত্য, জ্যোতি মুখার্জি এবং আরও কয়েকজন।

 সেদিনই গড়ে উঠলাে সংগঠন। নাম দেওয়া হলাে ‘ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতি।’ আমাদের সমিতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ লিখে ফেলা হলাে। তাতে লেখা হলাে; “আমরা সমাজ-সচেতনতার মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি ভারতের শােষিত জনগণের মুক্তির জন্য এতাবৎকাল যে সকল সংগ্রাম হয়েছে তার ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ—সংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের প্রতি গুরুত্ব আরােপ না করা। এ দেশের রাষ্ট্রশক্তি অর্থাৎ শােষক ও তাদের সহায়ক শ্রেণিরা শােষিত মানুষকে সংগঠিত হবার সুযােগ দিতে নারাজ। তাই পরিকল্পিতভাবে ধর্ম, জাত-পাত, প্রাদেশিকতাকে ভেদাভেদের ভিত্তি হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। বঞ্চিত মানুষদের মাথায় ঢােকাতে চাইছে—তাদের প্রতিটি বঞ্চনার কারণ অদৃষ্ট, পূর্বজন্মের কর্মফল, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়া।”

 ...“আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি, আমাদের দেশে বাস্তবিকই আজ পর্যন্ত জনজীবনে কোনও ব্যাপকতর গুণগত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে একইভাবে শােষিতদের চিন্তার ভ্রান্তির জালে আবদ্ধ রেখে শােষকরা শােষণ চালিয়েই যাচ্ছে। এতাবৎকাল আমাদের দেশে কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের নামে অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নামে যা যা ঘটেছে তার কোনওটাই বাস্তবিক অর্থে আদৌ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। ভারতে সংগঠিত তথাকথিত রেনেসাঁস যুগের আন্দোলন ছিল সমাজের উপরতলার কিছু ইংরেজি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ কিছু সংস্কার প্রয়াস মাত্র। তৎপরবর্তী তথাকথিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলি ছিল শুধুমাত্র কলাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ।”

 “আমাদের যুদ্ধ শােষণের শক্তিশালীতম হাতিয়ার প্রতিটি কুসংস্কার ও ভ্রান্ত-বিশ্বাসগুলাের বিরুদ্ধে।”

 “ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির একটা লােগাে বা প্রতীক তৈরির ভার পড়লাে আমার উপর। ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’আজও সেই প্রতীক-ই ব্যবহার করছে।

 ১৯৮৬-র জানুয়ারিতে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হলাে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’। প্রথম প্রকাশক: এ মুখার্জি অ্যাণ্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা-৭০০ ০৭৩। এতাে বিপুল সাড়া পাব, কল্পনাতেও ছিল না। বইমেলাতে বই যােগাতে হিমশিম খেয়েছে প্রকাশক সংস্থা। আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগলাে। অনেক মানুষের অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক কৌতুহল। ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র সঙ্গে যুক্ত হতে চান অনেকেই। বেনো জল ঢোকার সম্ভাবনা প্রবল। হুজুগে অনেকেই আসবেন। কিন্তু লক্ষ্য ও তার জন্য ঝুঁকি নেবার প্রশ্ন এলে অনেকেই খসে পড়বে—জানি। ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ মানে একটা প্রগতিশীল ব্যাপার। এ জন্যেও অনেকে ভিড়তে চাইতে-ই পারেন। আবার জনপ্রিয় একটা দলে ভিড়ে সুবিধে আদায় করতে আগ্রহী লোকের অভাব নেই এদেশে।

 কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছি পশ্চিমবাংলার গ্রামে-শহরে-আধা শহরে। তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুই তরুণ—গুপী ও সঞ্জয়। তারপর একে একে তন্ময়, কণিষ্ক, কাজল, কমল, রঘু, আশিস। এবার পুরোদস্তুর স্টাডি ক্লাসের প্রয়োজন অনুভব করলাম। ‘স্টাডি ক্লাস’ না হলে যুক্তিবাদী সমিতি আর পাঁচটা ক্লাবের মতো একটা ক্লাব হয়ে যাবে। এগিয়ে এলেন ‘কিশোর ভারতী’ স্কুলের হেডমাস্টার মিহির সেনগুপ্ত। তিনি প্রতি রবিবার ক্লাস করার জন্য ছেড়ে দিলেন স্কুল। তর্কে-বিতর্কে-আলোচনায় জমে গেল। পুরোনোদের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজন মানিক মৈত্র, ডাঃ সমিত ঘোষ, মিহির সেনগুপ্ত, ড. অপরাজিত বসু, ডাঃ বিষ্ণু মুখার্জি, অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়।

 জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তিবাদী সমিতি ঝড় তুলে এগিয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও আকাশবাণী আমাদের কাজ কর্মকে, বাবাজি-মাতাজিদের বুজরুকি ধরাকে বার-বার তুলে ধরেছে। বহু সাংবাদিক আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ আমাদের সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন। লক্ষ্মীন্দ্রকুমার সরকার, পথিক গুহ, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, অনন্যা চ্যাটার্জির নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করছি। ‘আজকাল’ পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত সেসময় ছিলেন আমাদের আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ।

 ১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বরে কলকাতা ময়দানে আমাদের হাতে বয় স্কাউট টেণ্টের চাবি তুলে দেন ডাঃ অরুণ শীল। সেদিন এক বিশাল সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। ডাইনি সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তী এবং আরও কয়েকজনের অলৌকিক ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে। সেই দিনই প্রকাশিত হল ‘কিশোর যুক্তিবাদী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। নাম অলংকরণ করেছিলেন আমাদের সমিতির সেই সময়কার সহ-সম্পাদক চন্দন ভট্টাচার্য। অসাধারণ অলংকরণ। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক পিনাকী ঘোষ।

 ১৯৮৯ সালে একটি রাজনৈতিক দল ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ দখলের এক ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের বদ-অভ্যেস থেকে আমাদের সংগঠনেও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলো।

 ১৯৮৯-এর ৮ ডিসেম্বর ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতি, ‘সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’ অনুসারে নাম রেজিস্ট্রেশন করালো। নতুন নাম হলো ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। ইংরেজিতে বলতে পারি ‘Rationalists’ Association of India’। সংক্ষেপে ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ ও SRAI নামে পরিচিত।

 ১৯৯০-তে সমিতির স্টাডি ক্লাস উঠে এলো মধ্য-কলকাতার বউবাজারে। ঠিকানা:৩৪-এ শশীভূষণ দে স্ট্রিট। কলকাতা-৭০০ ০১২। এটা ডাঃ বিরল মল্লিকের চেম্বার। স্টাডি ক্লাস হতো সোম-বুধ-শুক্র বিকেল ৫টা থেকে ৮টা। জমজমাট স্টাডি ক্লাস। ১৯৯১-তে এলেন সুমিত্রা পদ্মনাভন।


 কেন্দ্রে আঘাত হানলে, শাখাগুলো যাতে স্বনির্ভরতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে পারে সেই পরিকল্পনা মাথায় রেখে শাখাগুলিকে স্বয়ম্ভর করতে শাখা থেকে মুখপত্র প্রকাশে উৎসাহিত করলাম। আজ বহু শাখা, জেলা কমিটি ও জোনাল কমিটি মুখপত্র প্রকাশ করে। কেন্দ্রীয় ভাবে ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ১৯৯২ সালে। সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তে ছিল আমার উপর। ১৯৯৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সুমিত্রা পদ্মনাভন। প্রতি মাসে প্রকাশিত হচ্ছে ‘বুলেটিন’ যুক্তিবাদী সমিতি ও ‘হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন’-এর মাসিক মুখপত্র ‘আমরা যুক্তিবাদী’। বিষয়ভিত্তিক প্রতিটি সংখ্যা। তথ্যবহুল ও তাত্ত্বিক জ্ঞান সমৃদ্ধ লেখা প্রতিটি সংখ্যাতেই থাকে।


 ‘হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর কথা উঠে এলো হঠাৎ করে। কেন যুক্তিবাদী সমিতি ওদের সঙ্গে মিলে মাসিক মুখপত্র বের করে? প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর পিছনে রয়েছে একটা ছোট্ট ইতিহাস।

 ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ ঝড় তুলে-ই এগোচ্ছিল। বেশ চলছিল। গোল বাধলো ১৯৯৩-এর জানুয়ারিতে কলকাতা বইলেমায় ‘সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ বইটি প্রকাশিত হতেই। বইটিকে বলতে পারেন যুক্তিবাদী সমিতি’র ‘ম্যানিফেস্টো’ অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের ‘ঘোষণাপত্র’। ‘বিজ্ঞান আন্দোলন’-এর এতদিনকার ধ্যান ধারণাকে দুমড়ে-মুচড়ে নতুন ধারণা প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা করল। বইটিতে উঠে এলো ভারতের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস ও বিশ্লেষণ, ‘সংস্কৃতি’ শব্দের সংজ্ঞা, উঠে এল ‘প্রেম’, ‘দেশপ্রেম’, ‘গণতন্ত্র’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বহু প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং তাদের নতুন করে দেখা ও চেনা।

 আমরা ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠানে (এই নামেই আমরা কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান করে থাকি) ‘দেশপ্রেম’ থেকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ সব প্রসঙ্গই টেনে ________________

অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) আনতে লাগলাম। এই প্রথম আমরা প্রকাশ্যে দলিত মানুষদের অধিকার সচেতন করার কাজে হাত দিলাম। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে নতুন সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ার কাজে নামলাম। পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাস থেকে বার বার একটা শিক্ষা আমরা পেয়েছি—মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। কারণ তারা ভিতু, স্বার্থপর। আবার এই মধ্যবিত্তদের মধ্যে থেকেই বার বার উঠে এসেছে বিপ্লবের নেতারা। আদর্শবাদী, জীবনপণ করা সাহসী মধ্যবিত্তদের সংখ্যা অবশ্য এতই কম যে, তাদের খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতই অতি কষ্টসাধ্য। সাংস্কৃতিক চেতনার আলাে নিয়ে আমরা সূচ খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। ফলে কিছু গদিলােভী রাজনীতিক আমাদের সম্বন্ধে বলতে লাগল—আমরা রাজনীতি করছি। একনম্বর দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে জ্ঞান দেওয়া হলাে—আমাদের কী উচিত, তাই নিয়ে। এমনই একটা সংকটময় সময়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, জনগণকে পাশে পেতে জনগণের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। বিনা খরচে বস্তি ও গ্রামের ব্রাত্য শিশুদের এবং বয়স্কদের শিক্ষা, আইনি সাহায্য, কর্মশিক্ষা, চিকিৎসকদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প, পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিং, মরণােত্তর দেহদান ও চক্ষুদান, রক্তদান শিবির, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার মানুষের পাশে দাঁড়ানাে, বেশ্যাবৃত্তির মতাে নিষ্ঠুর ব্যবস্থা বন্ধ করে তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে চাপ | দেওয়া, মানবতা বিকাশের স্বার্থে মানুষকে ধর্ম, জাত-পাত প্রাদেশিক ও লিঙ্গবৈষম্যের মত কুসংস্কার ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করা। এইসব কাজের প্রয়ােজন মেটাতে গড়ে তােলা হলাে হিউম্যানিস্ট অ্যাসােসিয়েশন। দিনটা ছিল ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সাল। প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি : সুমিত্রা পদ্মনাভন। অ্যাসােসিয়েশনের প্রতীক তৈরি করেছিলাম আমি। বহু অসম্ভব জয় ছিনিয়ে এনেছে হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসােসিয়েশন। এই সময় আমরা ‘হিউম্যানিজম বা মানবতা’ কে উপসনা ধর্মের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। যুক্তিবাদ যেহেতু উপসনাধর্মের মূলে আঘাত করার কথা ভাবছিল, তাই যুক্তিবাদী’ মানেই নাস্তিক’–এরকম একটা নেতিবাচক ধারণা ছড়াচ্ছিল। কিন্তু যুক্তিবাদী’রা কখন-ই শুধুমাত্র নাস্তিক’ নয়। শুধু নাস্তিকতা সমাজোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে না। আমাদের লাগাতার প্রচারে বহু মানুষ এগিয়ে আসে নিজেদের হিন্দু, মুসলিম’ ইত্যাদি ধর্ম পরিচয় ছেড়ে ‘হিউম্যানিস্ট’ বা ‘মানবতাবাদী’ হিসেবে তুলে ধরতে। ধর্মান্ধতা, সম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ রুখতে এই নতুন ‘হিমম্যানিস্ট আন্দোলন সেই সময়ে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল। আবেদনপত্রে ধর্ম’ কলামে মানবতা লেখার আইনি su ________________

নতুন কিছু কথা অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ‘হিউম্যানিস্ট অ্যাসােসিয়েশন’। দিনটা ছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সাল, ভারতের বহু ভাষাভাষি পত্রিকায় খবরটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা Indian Express NEW DELHI FRIDAY, NOVEMBER 5, 1993 Nation When humanism will be the only religion by Abhijit Dasgupta not compulsory.” In fact, Mullick CALCUTTA - While the coun- added, most of the European nations try is going up in flames over reli- had already done away with the need gion, the City of Joy has taken the to fill up the religion slot regarding lead in trying to provide a healing jobs and other admissions. touch with the setting up of a new Incidentally, the Calcutta Univerorganisation, the Humanist Associa- sity has already done away with the tion of India (HAI) which, among religion criteria since the last acaother things, will campaign to re- demic session, a pioneering effort move the compulsory registration of the lead for which was taken by the religion as one of the criteria in job Senate member and famous physiand other admission forms. cian, Abirlal Mukherjee. Speaking to The Association, set up on Sep- Indian Express, Mukherjee said, “A tember 11 when the controversial question remains about caste in Parliament of Religions was inaugu- which we have to have reservations rated by the Pesident here, has al- for the listed tribes. In the univerready got the green signal from the sity, we have found a way out by givUN that the registration of the reli- ing a five-mark per cent advantage gion cannot be binding on any indi- for such candidates. But the religion vidual during the filling up of job slot has been totally abolished and other admission forms. Mullick said that his organisaBirol Mullick, a top official in tions would now build up public and the UN public health department international pressure on the Govhere and a physician by vocation, hasernment to abolish this "inhuman taken the lead in forming the asso- and degrading system of registraciation. Mullick told the Indian Ex- tion.” The HAI has already written press that he had written to the UN to five Novel laureates and Carl Information Centre director on Au- Sagan fer their views. It has also apgust 13 asking whether the registra- plied for membership to the umbrella tion was mandatory. The UN sent a organisation based in New York, Alreply on September 7 alongwith liance of Secular Humanist Society some booklets which "clearly dem- “We expect the membership soon onstrated that the registration was and this will make our fight even ________________

অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) more forceful." Mullick added. Af- religion and we are allowed to menter a strong public movement and tion that in our forms. Yes, this could opinion are organised, the Govern- be a first effort in helping the new ment will be approached officially. generation realise the follies of reli The Association would mainly gion based society. Ayodhya is a work in the field of humanrights prime example." concentrated in specific area of cus- Padmanabhan said that the todial deaths, police atrocities and response to the Association had been injustice against women. S. overwhelming and that they were Padmanabhan, general secretary of expecting a huge turnout at a public the Association, said, "We will not meeting slated later in December. rest till humanism is recognised as a হয়েছিল। সে সময় অ্যাসােসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছিে মিশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সমিত্র পদ্মনাভন। এবং সভাপতি ছিলাম আমি। সাম্যকামী কিছু রাজনৈতিক দল স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে একজোট হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলাে। যুক্তিবাদী সমিতির উপর দায়িত্ব পড়লাে কমন’ কর্মসূচির ভিত্তিতে ওদের কাছাকাছি আনার। রাজনৈতিক দলগুলাের কর্মসূচি বিশ্লেষণ করার। তারপর একটা দলিল' বা পথনির্দেশ হাজির করে দেখতে হবে—কোন বিশেষ কর্মসূচি এই সময়ের এবং এই দেশের উপযােগী। এটা ১৯৯০-৯১ এর কথা। আমরা জানালাম, প্রত্যেকটা সাম্যে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক শাখা থাকা অত্যন্ত জরুরি। তারাই হবে পার্টির সঙ্গে জনসাধারণের যােগসূত্র। সুখ-দুঃখের সাথী বিভিন্ন সমমনােভাবাপন্ন পার্টিগুলাের মধ্যেও যােগসূত্র তৈরি করতে পারে কালচারাল ফ্রন্টের বা সাংস্কৃতিক শাখার কমন’ কর্মসুচি। তারপরের পর্যায়ে আসবে কমন’ কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক পার্টিগুলাের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোেলা; কোনও কোনও ক্ষেত্রে কয়েকটা পার্টি মিলে একটাই পার্টি হয়ে যাওয়া। এসবই আমরা জানালাম আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষাকারী পার্টিগুলােকে। ১৯৯৩ সালে বিবিসির প্রােডিউসর ইনচার্জ রবার্ট ঈগল স্বয়ং তার টিভি টিম নিয়ে এলেন এবং প্রায় এক ঘণ্টার ডকুমেন্টারি তুললেন ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে। তাতে ভারতের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ আমেরিকাবাসী সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্ত জানালেন, “ভারতের বাম রাজনীতিতে একটা সরাসরি বিভাজন আছে—প্রবীর ঘােষের পক্ষে ও বিপক্ষে।” এই তথ্যচিত্রের নাম ছিল ‘গুরু বাস্টারস'। প্রায় ৫০টির মতাে দেশে তথ্যচিত্রটি দেখানাে হয়, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল মারফত। রবার্ট ঈগল আমাকে একটা চিঠি দিয়ে জানান—গত দশ বছরে তাদের তৈরি কোনও তথ্যচিত্র এতাে জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৯৪-এ নন্দন’-এ আমন্ত্রিতদের জন্য দুটি প্রদর্শনী হয়েছিল।  এই ইতিহাস হয়ে ওঠা তথ্যচিত্র সাম্য-বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়া শক্তির টনক নড়িয়ে দিল। যুক্তিবাদী সমিতির উত্থানে যারা নিজেদের সর্বনাশ দেখতে পেয়েছিল, তারা প্রত্যাঘাত হানার জন্য তৈরি হতে লাগলো।

সেই সত্যি হলো

 কুড়ি বছর আগে এই গ্রন্থটির ‘কিছু কথায়’ লিখেছিলাম, “যে দিন বাস্তবিকই কুসংস্কার বিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন দুর্বার গতি পাবে, সে-দিন দুটি জিনিস ঘটবে। এক: এই আন্দোলন যে শ্রেণিস্বার্থকে আঘাত হানবে সেই শ্রেণিস্বার্থ তাদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তীব্র প্রত্যাঘাত হানবে। সেই প্রত্যাঘাতের মুখে কেউ সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কেউ পিছু হটবে। দুই: যুক্তিবাদী চিন্তা জনসাধারণের চেতনার জগতে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাবে, তারই পরিণতিতে গড়ে উঠবে নতুন নেতৃত্ব, যে নেতৃত্বে থাকবে সমাজ পরিবর্তনের, সার্বিক বিপ্লবের অঙ্গীকার।

 সে-ই সত্যি হলো। যুক্তিবাদী আন্দোলন যখন দুর্বার গতি পেল, সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সমমনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে মূল স্রোত তৈরিতে হাত দিল, তখনই আমাদের সমিতির উপর নেমে এলো তীব্র প্রত্যাঘাত। সময় ১৯৯৬-এর আগস্ট। প্রত্যাঘাত হানার জন্য বছর তিনেক ধরে একদিকে ঘটানো হয়েছিল অনুপ্রবেশ। আর একদিকে লোভ দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল আমারই কাছের কয়েকজনকে। সুদীপ, সৈকত, দেবাশিস, রাজেশ, চির, রামকমল, সুতপা—এদের মধ্যে কে লোভের কারণে অনুপ্রবেশকারী, কে পরে বিক্রি হয়েছিল—আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। ব্যাপক আকারের এই ষড়যন্ত্রে শামিল ছিল রাষ্ট্রশক্তি ও বিদেশি শক্তি। তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিলেন কিছু রাজনীতিক, সাংবাদিক, এন জি ও কর্তা জ্যোতিষী ও বাবাজি-মাতাজি।

 ষড়যন্ত্রে আমাদের মৃত্যু ঘটলে ইতিমধ্যে একাধিকবার সমিতি উঠে যেত। কিন্তু তা হয়নি। হবেও না। কারণ এই অসম ও প্রায় অসম্ভব কঠিন লড়াইয়েও সঙ্গে পেয়েছি বহু চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, আইনজীবী এবং বিভিন্ন পেশার সৎ মানুষকেও।


 ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল। দশটা বছর আমাদের সমিতির পুনর্গঠন ও অগ্রগমনের বছর। মনে পড়িয়ে দেয় বিশ্বযুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মানি ও জাপানের পুনর্গঠন ও অগ্রগমনের ইতিহাসকে।

 ১৯৯৬-এ যেখানে নেমে গিয়েছিলাম, সেই প্রায় শূন্য থেকে আবার শুরু। তবে পদ্ধতি পাল্টে। ২০০০ সাল থেকে ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ কুসংস্কার বিরোধী কাজকর্ম এবং মানবতাবাদী কাজকর্মের সঙ্গে সাম্যের সমাজ গড়ার একটা ‘আইডিয়া’ বা ‘পরিকল্পিত চিন্তা’র প্রচার শুরু করলো। পরিকল্পনা সংক্ষেপে এই রকম—

________________

অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড) ১| বর্তমান অবস্থায় পৃথিবীর যােগাযােগ ব্যবস্থা এতই উন্নত যে, পৃথিবী যেন একটা গ্রাম। এই অবস্থায় সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল অসম্ভব। কারণ, যখন-ই সাম্যকামীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে যাবে, তখনই সাম্যবিরােধী সামরিক-শক্তিধর দেশগুলাে তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে। | ২। এই অবস্থায় আমাদের কাজ হবে, সশস্ত্র সংগ্রাম এড়িয়ে নিঃশব্দে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের একটা পথ খুঁজে বের করা। রাশিয়ার মতাে সাম্যকামী দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যদি সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বিনা রক্তপাতে দখল হয়ে যায়, তবে আমরা-ই বা কেন পারব না নিঃশব্দে দখল নিতে? ৩। সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, স্বয়ম্ভর গ্রাম ও সমবায় গড়ে তােলার মধ্য দিয়েই ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ সম্পূর্ণ হতে পারে। সামন্তপ্রভু বা রাষ্ট্রশক্তি সন্ত্রাস চালালে আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা সন্ত্রাস চালাতেই হবে। তাই অস্ত্র রাখতে হবে। নীতি হবে * আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র সংবরণ করা। ভুলেও ‘অস্ত্র সমর্পণ’ নয়। তাহলেই সাম্যের শত্রুরা নেকড়ের মতাে আঁপিয়ে পড়ে ছিড়ে খাবে। | ৪। হতদরিদ্র মানুষগুলাের আর্থিক উন্নতি, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার, চেতনার উন্নত ও উন্নততর সামাের জন্য কৃষিনভর অঞ্চলে গড়ে তুলতে হবে স্বয়ম্ভর গ্রাম বা কমিউন। | ৫ | স্বয়ম্ভর গ্রাম আসলে সমবায় গ্রাম। এমন সমবায় গড়ে তােলা সম্ভব সর্বত্র। কয়লা খাদান, তেলের খনি থেকে ব্যাঙ্কিং শিল্প; পরিবহন ব্যবসা থেকে গাড়ি উৎপাদন ব্যবসা ; হােটেল ব্যবসা থেকে মাছ চাষ ; চা বাগিচা থেকে খেলনা উৎপাদন; ক্ষুদ্র শিল্প থেকে বৃহৎ শিল্প—সমস্ত ক্ষেত্রেই সমবায় মালিকানা সম্ভব। | এদেশে সরকারি ছত্রছায়ায় সমবায় সংস্থাগুলােয় ধান্দাবাজ রাজনীতিকদের রমরমা। দুর্নীতির আখড়া। জনগণের সক্রিয় সহযােগিতায় যে সমবায় গড়ে তােলার কথা আমরা এতক্ষণ আলােচনা করলাম, সেগুলাে এক নতুন সমবায় চিন্তা—যেখানে জনগণতন্ত্রের প্রয়ােগ নিশ্চিত। ৬। স্বয়ম্ভর গ্রামগুলাের ও সমবায়গুলাের পরিচালন ক্ষমতা থাকবে গ্রামের প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটে নির্বাচিতদের হাতে। এমন গণতন্ত্র-ই হলাে বিপ্লবী জনগণতন্ত্র (Revolutionary People's Democracy)। শিল্পক্ষেত্রে কো-অপারেটিভগুলাের পরিচালনা ভার থাকবে সেইসব শিল্পের শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। চা-বাগিচা থেকে ট্রান্সপাের্ট ব্যবসা—সব সমবায়ের-ই শেয়ার হােল্ডার হবেন শুধুমাত্র শ্রমিকরাই। তবে-ই সমবায়গুলােতেও দেখা দেবে বিপ্লবী জনগণতন্ত্র। ৭। বিপ্লবী জনগণতন্ত্র’-তে প্রতিটি মানুষই তার অর্জিত গণতন্ত্র রক্ষা করতে আন্তরিক হবেন। কারণ, এমন জনগণতন্ত্রে প্রতিটি হতদরিদ্র মানুষই মানুষ হিসেবে সম্মান পায়। খেতের ফসল, অরণ্য, খনিজ সম্পদ, জলসম্পদ, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে গড়ে তােলা সমবায়ে, কর্মী শেয়ারহােল্ডারের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে শ্রমিক ছাড়া শেয়ার হােল্ডার নেই। শেয়ার বাজার নিয়ে ফাটকা নেই।  ৮। এমন সার্থক গণতন্ত্রে স্বয়ম্ভর গ্রামে ও সমবায়ে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ইত্যাদির টিঁকে থাকা অসম্ভব। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখা মানুষগুলোই দুনীতিপরায়ণদের চিহ্নিত করে নির্মূল করার দায়িত্ব নেবে।

 ৯। প্রতিটি সমবায় ও স্বয়ম্ভর গ্রামগুলোর উপর নজরদারি করবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকারীরা। সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে লোকসংগীতলোকনৃত্য-মেলা-যাত্রা-থিয়েটার-‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’-এ মাতিয়ে রাখবে সমবায় সংস্থা ও গ্রামগুলোকে। ওঁরা সিডি’তে দেখবেন দেশের বর্তমান অবস্থা, রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র, উন্নততর স্বয়ম্ভর গ্রাম ও সমবায়ের ছবি।

 ১০। স্বয়ম্ভর গ্রাম ও সমবায়ের ঘনবদ্ধ সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটলে সে-সব জায়গায় সমান্তরাল শাসন বা স্বশাসন অথবা স্বায়ত্তশাসন চালু করা হবে। এটা হবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের একটা বড় ধাপ।

 ১১। এই আন্দোলনকে পালন ও পুষ্ট করার পরবর্তী ধাপ হলো, জয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’-কে কবর দেওয়া। নির্বাচন সর্বস্ব ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’-কে ‘জনগণতন্ত্র’ বা ‘People's Democracy’-তে পাল্টে দেওয়া।

 ১২। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে স্বয়ম্ভর গ্রাম বা সমবায়গুলোতে শোষকদের দালাল রাজনৈতিক দল বা সরকার নাক গলাবার সুযোগ না পায়। আমরা প্রয়োজন মনে করলে সরকারের কাছে সাহায্য চাইব। এই ‘আমরা’ অবশ্যই স্বয়ম্ভর গ্রামবাসী বা সমবায়ের সদস্যরা।

 বিভিন্ন পথে বিশ্বাসী সাম্যকামী রাজনীতিকদের সঙ্গে বার বার আমরা আলোচনায় বসেছি। হাজারো খুঁটিনাটি প্রশ্ন উঠে এসেছে। আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত আমরা একটা জায়গায় পৌঁছেছি।


 ২০০৩ থেকেই নতুন অধ্যায়। শুরু হয়েছে সমন্বয় গড়ে তোলার কাজ, একাধিক দল মিলে এক হয়ে ‘মস্তিষ্ক যুদ্ধে’ নামার কাজ। ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে তুলে লক্ষ্য পূরণে নামা।

 এই স্বয়ম্ভর বা সমবায় চিন্তা আজকে ভারতের বাইরে নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ-মায়ানমার, দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

 নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকেই গৌতম বুদ্ধ, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ, যিশু, মার্ক্স লেনিন, মাও’দের মতো চিন্তাবিদদের স্বয়ম্ভর গ্রাম, কমিউন বা সমবায় চিন্তার একটা নতুন রূপ, নতুন প্রয়োগকৌশলের ‘আইডিয়া’ ছড়িয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছিলাম, তা ২০০২-২০০৩-এ ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেল।

 আজ ভারতের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলে, নেপালের শতকরা ৮০ ভাগ অঞ্চলে ভেনেজুয়েলায় পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করেছে ‘নতুন সাম্য চিন্তা’-কে। ভুটান, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, চিলি, পেরু, আর্জেণ্টিনার জনগণও নয়া সাম্যচিন্তাকে প্রয়োগ করতে সচেষ্ট।

 ২০০৫-এর ফেব্রুয়ারিতে বি বি সি রেডিও এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিল আমার ও যুক্তিবাদী সমিতির সভাপতি সুমিত্রা পদ্মনাভনের। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ইরেনা লুটো (Irena Luto)। সঙ্গী ছিলেন ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস’-এর প্রডিউসর নীল ট্রেভিক (Neil Treivik)। ইরেনা ও নীল দু’জনের-ই মনে হয়েছিল, গত শতকের নয়ের দশকে সমাজতন্ত্রের পতন সাম্যকামীদের হতাশ করেছিল। গত দু-এক বছরে একটা নতুন চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামকে বাইপাস (এড়িয়ে) করে ‘নব্য সমাজতন্ত্র’ (Neo-Socilism) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ থেকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলােতে পর্যন্ত। স্বয়ম্ভর গ্রাম, কমিউন, সমবায় এসবেরই ‘থিংকট্যাংক’ বা ‘চিন্তার উৎপত্তিস্থল’ যুক্তিবাদী সমিতির নেতা।

পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ওয়েবসাইট আমাদের

 Yahoo, Google, Rediffmail, AOL হলো পৃথিবীর জনপ্রিয় সমস্ত ‘সার্চ ইঞ্জিন’। এইসব ‘সার্চ ইঞ্জিন’ ‘সার্চ’ করে আপনি বিভিন্ন ওয়েবসাইট দেখতে পারেন। ‘rationalist’ অথবা ‘rationalism’ শব্দ দিয়ে সার্চ করলে তালিকার প্রথমেই উঠে আসবে আমাদের সমিতির ওয়েবসাইট। অর্থাৎ আমাদের ওয়েবসাইটের ‘র‍্যাঙ্কিং’ ১ম। এই র‍্যাঙ্কিং নির্ধারিত হয় ‘পেজর‍্যাঙ্ক’ পদ্ধতিতে, যা নির্ভর করে সাইটের জনপ্রিয়তার উপর। যত বেশি মানুষ সাইট দেখবেন, সাইট তত ভালাে ‘র‍্যাঙ্ক’ পাবে। অনুরােধ—সুযােগ থাকলে আমাদের সাইট www.srai.org দেখুন।

 কেন আমরা এক নম্বরে? জানতে গেলে দেখতেই হবে। এদেশের বহু মিডিয়া ‘ব্ল্যাক-আউট’ করার পরও আমরাই পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ওয়েবসাইট। আমরাই ভারতকে প্রথম এমন দুর্লভ সম্মান এনে দিয়েছি।

জয় নিশ্চিত করতে শক্তিশালী ‘নেপথ্যবাহিনী’ জরুরি

 মাদার টেরিজাকে ‘সেণ্টহুড’ দেবার বিশাল তােড়জোড় ব্যর্থ হয়েছিল। লক্ষ কোটি ডলার-পাউণ্ড-ইউরাে উড়লাে। প্রচার মাধ্যমগুলাে বিপুল পরিমাণে নিউজপ্রিণ্ট আর ক্যাসেট খরচ করলাে। এক বছর ধরে রােমে ‘মাদার’-এর স্মারক বিক্রি হল। শেষ পর্যন্ত এলাে মাদারকে সম্মান জানানাের দিন; ১৯ অক্টোবর, রবিবার, ২০০৩। কী আশ্চর্য! পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখলাে, মাদার-কে ‘সেণ্ট’ ঘােষণা না করে ‘ব্লেসেড’ বলে ঘােষণা করলেন পােপ দ্বিতীয় জল পল।

 এ এক অভাবনীয় ‘ইন্দ্র পতন’। পােপের আন্তরিক ইচ্ছে, সর্বাঙ্গীণ চেষ্টা এমন ভাবে ব্যর্থ হলাে।

 হলাে। তার কারণ—‘বিবিসি’ থেকে ‘টাইম’ হাজার হাজার মিডিয়া আমাদের সমিতির সত্যানুসন্ধান তুলে ধরে ভ্যাটিকান সিটির উপর দিনের পর দিন চাপ সৃষ্টি করে গেছে। শেষ পর্যন্ত পােপের পরামর্শদাতা ‘কার্ডিনাল’দের বেশির ভাগই পোপকে পরামর্শ দেন—র‍্যাশানালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডিয়ার (‘যুক্তিবাদী সমিতি’র নাম) সঙ্গে লড়াইতে না নামা-ই বুদ্ধিমানের কাজ। মৃত্যুর পর টেরিজার অলৌকিক ক্ষমতা মণিকার ক্যানসার রাতারাতি সারিয়ে তুলেছে, এমনটা দাবি করে টেরিজাকে ‘সেণ্ট’ বলে ঘোষণা করলে ভবিষ্যৎ আমাদের ক্ষমা করবে না। ভবিষ্যতে আমরা ‘মিথ্যাচারী’ ও ‘ভণ্ড’ বলে চিহ্নিত হব।

 এই যে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের অকুণ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি—এটা সম্ভব হয়েছে প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত কিছু বন্ধুদের সহযোগিতায়। ‘কার্ডিনাল’ অর্থাৎ পোপের পরামর্শদাতাদের (কার্ডিনালদের মধ্যে থেকে-ই পোপ নির্বাচিত হয়ে থাকেন। বেশির ভাগকে আমাদের পাশে দাঁড় করানোর পিছনে ছিল আরও অনেক অঙ্ক, অনেক বন্ধুদের সাহায্য। এই বন্ধুরা নেপথ্যে থেকেই সাহায্য করে গেছেন। এঁরাই আমাদের লড়াইয়ে ‘নেপথ্য বাহিনী’।

 স্বয়ম্ভর গ্রাম-কমিউন-সমবায় গড়ে তুলতে যে সব শিক্ষিত সমাজবিজ্ঞানী, কৃষিবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংগঠক ইত্যাদিদের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে তাঁরাই আমাদের শ্রদ্ধেয় নেপথ্য বাহিনী; যাঁদের ছাড়া আমাদের পরিকল্পনা অচল। যাঁরা আমাদের হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগ রাখছেন, তাঁরা নেপথ্য থেকেও আমাদের ‘প্রাণ ভোমরা’। তাঁরা কারা? পরিচয় হয় তো কোনও দিন-ই জানা যাবে না। জানানো হবে না। তাঁরা প্রকাশ্যে নেই বলেই আমরা আজ পর্যন্ত বহু অসম্ভব লড়াই জিতছি। তাঁরা-ই দিকে দিকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে গতিশীল করছেন; চূড়ান্ত জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন।

 আমাদের দুই সংগঠনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন খুশবন্ত সিং, ড. সরোজ ঘোষ, ড. সন্তোষ সরকার, ড. পবিত্র সরকার, ডাঃ সরোজ গুপ্ত, ডাঃ আবিরলাল মুখার্জি, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, দিলীপ গুপ্ত, গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সনাতন মুখোপাধ্যায়, মল্লিকা সেনগুপ্ত, কৃষ্ণা বসু সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

যাঁরা সমিতির শ্বাস-প্রশ্বাস

 যাঁরা যুক্তিবাদী সমিতির শ্বাস-প্রশ্বাস এক নিশ্বাসে সেই পাঁচজনের নাম বলে দেওয়া যায়। সুমিত্রা পদ্মনাভন, রানা হাজরা, সঞ্জয় কর্মকার, অনাবিল সেনগুপ্ত আর পঞ্চমজন আমি।

 সংগঠন এভাবেই তৈরি, যাতে পাঁচজনের কোনও এক দু’জনের মৃত্যুর পরও গতিশীল থাকে। আরও দুরন্ত গতিতেই চলবে। এই গ্যারাণ্টি দিলাম।

 এই পাঁচজনের পর যে কয়েকটি নাম অনিবার্যভাবে এসে পড়ে তাঁরা হলেন অরুণ মুখার্জি, বিপাশা চ্যাটার্জি, মানসী মল্লিক, অনিন্দ্যসুন্দর, সুবীর মণ্ডল, দেবাশিস চ্যাটার্জি, সুদীপ চক্রবর্তী, পিনাকী লাহা, সন্তোষ শর্মা, নিতাই রুইদাস, অজয় বৈরাগী, দ্বিজপদ বাউরি, মধুসূদন মাহাতো, মধুসূদন বাউরি, মনোজ গিরি, গোপাল ছেত্রী, শংকর ভড়, পলাশ ভট্টাচার্য, বিপ্লব চক্রবর্তী, অনিন্দিতা ও চৈতালী।

 আরও অনেক নাম ভিড় করে আসছে। কিন্তু আজ এখানেই থামলাম। ভবিষ্যতে আরও নতুন নামকে তুলে ধরব জানি। সঙ্গে এও জানি, যাঁরা আজও আছেন তাঁরা কাল নাও থাকতে পারেন। সমিতি চলমান একটা ট্রেন। বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীরা উঠছেন, নামছেন। সমিতি যখন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছােবে তখন কে থাকবে, কে থাকবে না, সময়ই বলে দেবে। বিভিন্ন সময়ে শান্তিদা, জ্যোতিদাকে আমরা হারিয়েছি। মৃত্যু ওঁদের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আবার অঞ্জন, সেণ্টুদা, সমীর, অশােক এর মতাে সৎ মানুষরা আমাদের পথ ভুল পথ মনে করে বসে গেছেন। বিপ্লব, সৌরভ, শৌভিক, কমল কর্মসূত্রে দূরে থেকেও যােগাযােগ রাখেন। সংসারের চাপে বা কাজের চাপে সরে গিয়েও মানসিক ভাবে আছেন সাংবাদিক জ্যেতির্ময় দত্ত, সংগঠক অতনু, ম্যাজিসিয়ান রবি, গানের গ্রুপের তপন কাহালী, গােপাল দত্ত, গােবিন্দ দত্ত, প্রমিলা রায়, সত্যানুসন্ধানী বলু এমনি আরও কিছু মানুষ।


 যুক্তিবাদী সমিতি একুশে পা দিল। বাংলার বহু মিডিয়ার কাছে আমরা যখন ব্রাত্য, তখন জাতীয় স্তরের টিভি নিউজ মিডিয়ায় আমরা বারবার ঘুরে ফিরে আসছি। আমাদের উপর বিশাল প্রচারের আলাে ফেলছে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ থেকে ‘টাইম’ ম্যাগাজিন, ‘বিবিসি’ থেকে ‘ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের মত পৃথিবী বিখ্যাত প্রচার মাধ্যমগুলাে। “এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এনসাইক্লোপিডিয়া আর ‘ব্রিটেনিকা’ নয়। তা বরং ‘উইকিপিডিয়া’— এক অনলাইন বিশ্বকোষ”— একথা বলেছে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ (১৬ জুলাই, ২০০৬)।সেই ‘উইকিপিডিয়া’-য় (www.wikipedia.org) সংযােজিত হয়েছে ‘প্রবীর ঘােষ’ নামটি এবং তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে। পৃথিবী জুড়ে কয়েক হাজার অনলাইন মিডিয়ায় প্রচারের আলােতে থাকার পর কোন বাংলা মিডিয়ায় কতটা প্রচার পেলাম, কোন কোন মিডিয়া ‘ব্ল্যাক আউট’ করার দুর্নীতি গ্রহণ করেছে—এসব আর স্পর্শ করে না। যুক্তিবাদী সমিতি ও হিউম্যানিস্টিস্ অ্যাসােসিয়শন ১ ডিসেম্বর ২০০৬ অসাধারণ একটি কাজ করে ফেলেছে। এই দিন থেকে জয়যাত্রা শুরু হল online magazine: www.thefrecthinker.tk (অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দ্য ফ্রিথিঙ্কার’)। দুর্বার স্রোতের সামনে সব বাধাই ভেসে যাচ্ছে, ভেসে যাবে। অথবা নতুন পথ করে আমরা এগােবাে। ‘আমরা’ অর্থাৎ যুক্তিবাদীরা মানবতাবাদীরা, সাম্যবাদীরা।

 আমার সংগ্রামের সাথী প্রত্যেককে জানাই উষ্ণ অভিনন্দন।

প্রবীর ঘােষ

১ জানুয়ারি ২০০৭
৭২/৮ দেবীনিবাস রােড

কলকাতা — ৭০০ ০৭৪

e-mail: Prabir_rationalist@hotmail.com
www.srai.org.prabirghosh.tk
rationalistprabir.bravehost.com
www.the freethinker.tk