অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত (প্রথম খণ্ড)

অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত

সংস্কৃত সাহিত্য গ্রন্থমালা —২

অশ্বঘোষের


বুদ্ধচরিত


প্রথম খণ্ড


শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক অনুদিত




বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়

২, কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা

প্রকাশক শ্রীপুলিনবিহারী সেন
বিশ্বভারতী, ৬৩ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন, কলিকাতা


প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫১
পুনর্মুদ্রণ পৌষ ১৩৫২

মূল্য দেড় টাকা


মুদ্রাকর— শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
শান্তিনিকেতন প্রেস, শান্তিনিকেতন, বীরভূম

ভূমিকা

 অশ্বঘোষ-কৃত সংস্কৃত বুদ্ধচরিতের ইংরেজী, জর্মান, রাশিয়ান, জাপানী ইত্যাদি পৃথিবীর নানা ভাষায় একাধিক অনুবাদ হইয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে কৃত একমাত্র হিন্দী অনুবাদ ব্যতীত, বোধ হয় আর অন্য কোনো ভারতীয় ভাষায় ইহার অনুবাদ হয় নাই।

 ই. বি. কাওয়েল সাহেব, ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে, মূল বুদ্ধচরিত প্রথম প্রকাশ করেন। ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দে, তিনি নেপাল হইতে বুদ্ধচরিতের পুঁথির এক প্রতিলিপি (transcription) পান। ইহা হইতে, এবং নেপাল হইতে সংগৃহীত, কেম্ব্রিজ লাইব্রেরিতে রক্ষিত, অন্য এক প্রতিলিপি হইতে তিনি এই গ্রন্থ সম্পাদন করেন। এই পুঁথির পাঠে বহু ভুল ছিল। সেইজন্য গ্রন্থ অনেক স্থানেই দুর্বোধ্য হইয়া পড়ে। বোথলিংক, সিল্‌ভ্যাঁ লেভি, ফরমিকি প্রভৃতি বহু পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত, ঐ সকল ভুলপাঠের স্থানে যথার্থ পাঠ কী হইতে পারে, তাহা লইয়া বহু গবেষণা করেন, এবং দুর্বোধ্য শব্দের অর্থনির্ণয়েরও চেষ্টা করেন। তাঁহাদের ঐ প্রচেষ্টা কতকটা ফলবতী হয়। ১৯২৬-২৮ খ্রীস্টাব্দে এফ.ওয়েলের, বুদ্ধচরিতের তিব্বতী অনুবাদখানি উদ্ধার করিয়া প্রকাশ করেন। তখন ভুলপাঠের স্থানে শুদ্ধপাঠ ও দুর্বোধ্য শব্দের অর্থনির্ণয় করা অনেকটা সহজ হয়।

 সংস্কৃত বুদ্ধচরিতের কয়েকটি অসম্পূর্ণ সংস্করণ ভারতীয় কর্তৃকও প্রকাশিত হইয়াছেঃ

 1. V. V.Sovani, Cantos I-V. With a Sanskrit Commentary by Appa Sastri, Poona, 1911.
 2. K. M. Joglekar, Cantos I-V. With notes and translation. Bombay, 1912.
 3. N. S. Lokur, Cantos, I-V. With notes and translation. Belgaum, 1912.
 4. G. R. Nandargikar, Cantos I-V. Poona, 1911.
 5. Jagannath Prasad Pandeya, Canto VIII. Bankipur, 1920.
 6. Madhava Sastri Bhandari. ed. Kavya-Samgraha containing Buddhacarita (II-III). Bombay, 1929.

 বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বুদ্ধচরিত ১-৫ পাঠ্য নির্দিষ্ট হওয়ায়, ঐ সংস্করণগুলি প্রকাশিত হয়।

 ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে, ডক্টর ই.এইচ. জনস্টন, বুদ্ধচরিতের একখানি উৎকৃষ্ট সংস্করণ সম্পাদন করিয়াছেন। তিব্বতী অনুবাদের সহিত মিলাইয়া বহু দুর্বোধ্য স্থানের অর্থ নির্ণয় করিয়া, তিনি ইহার একটি ইংরেজী অনুবাদও ঐ সঙ্গে দিয়াছেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক, ইহা দুই খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।

 মূল বুদ্ধচরিত ২৮ সর্গে রচিত হইয়াছিল। তিব্বতী ও চীন ভাষায় ঐ ২৮ সর্গের অনুবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু সংস্কৃতে অর্ধেকের উপর পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় হইতে ত্রয়োদশ সর্গ সম্পূর্ণ পাওয়া যায়। প্রথম সর্গের কতক অংশ, ও চতুর্দশ সর্গের শেষ অংশ হইতে বাকি কয়েক সর্গ পাওয়া যায় না।

 ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দে নেপালের অমৃতানন্দ নামক এক পণ্ডিত চতুর্দশ সর্গের লুপ্তাংশ হইতে সপ্তদশ সর্গ পর্যন্ত পূরণ করেন।

 কাওয়েল সাহেব এই সপ্তদশ সর্গ পর্যন্ত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু জনস্টন সাহেব, কেবলমাত্র অশ্বঘোষ রচিত অংশ, অর্থাৎ অসম্পূর্ণ চতুর্দশ সর্গ পর্যন্ত, প্রকাশ করিয়াছেন।

 কাওয়েল সাহেবের সংস্করণের সহিত জনস্টন সাহেবের সংস্করণের একস্থানে বিশেষ প্রভেদ আছে।

 কাওয়েল-এর সংস্করণে প্রথম সর্গের শ্লোকসংখ্যা ১৪; কিন্তু জনস্টনএর সংস্করণে উহা মাত্র ৬৬।

 উভয়ের আরম্ভ বিভিন্নপ্রকারের। কাওয়েল-এর সংস্করণ কপিলাবস্তুর বর্ণনা দিয়া আরম্ভ হইয়াছে। প্রথম ৮ শ্লোকে কপিলাবস্তুর বর্ণনা, তাহার পরের ৬ শ্লোকে শুদ্ধোপনের বর্ণনা, এবং তাহার পরের ৪টি শ্লোকে মায়াদেবীর বর্ণনা। তাহার পর বোধিসত্ত্বের তুষিত স্বর্গ হইতে আগমন করিয়া মায়াদেবীর গর্ভে প্রবেশ এবং মায়াদেবীর লুম্বিনী গমন ও সেখানে বৃক্ষশাখা অবলম্বনে দণ্ডায়মান অবস্থায়, কুক্ষিভেদপূর্বক বোধিসত্ত্বের জন্ম ইত্যাদির বর্ণনা আছে।

 জনস্টন সংস্করণের প্রারম্ভ সম্পূর্ণ অন্তরূপ প্রথমত, উহার প্রথম ৭টি শ্লোক নাই। ৮ম শ্লোকে মায়াদেবীর প্রসবকালের বর্ণনা। উহাও সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরনের শয্যায় শায়িতা অবস্থায় তিনি বোধিসত্ত্বকে প্রসব করিলেন— বৃক্ষশাখা অবলম্বন করিয়া নহে।

 জনস্টন সংস্করণের ১ শ্লোক ও কাওয়েল সংস্করণের ২৫ শ্লোক এক। জনস্টন সংস্করণের ১০ শ্লোক ও কাওয়েল সংস্করণের ২৯ শ্লোক এক। এবং ইহার পর হইতে উভয়ের সংস্করণ একরূপ। অবশ্য মাঝে মাঝে পাঠভেদ আছে।

 জনস্টন সংস্করণের প্রথম সর্গের প্রারম্ভ, চীনা অনুবাদ (৪১৪-৪২১ খ্রী ক্বত) এবং তিব্বতী অনুবাদের (অষ্টম শতাব্দীতে কৃত) সহিত মিলে। সুতরাং উহাকে প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। কাওয়েল সংস্করণের ঐ অংশ, তিব্বতী ও চীনা অনুবাদের সহিত না মিলিলেও, ভারতের নানাস্থান হইতে প্রাপ্ত একাধিক পুঁথি হইতে, উহা প্রায় অধিকল ঐরূপই পাওয়া গিয়াছে। উহার রচনাও উচ্চশ্রেণীর। সেইজন্য এই অনুবাদের প্রারম্ভ উক্ত সংস্করণ অনুযায়ীই রাখা গেল।

 অশ্বঘোষ, খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর প্রারম্ভে বর্তমান ছিলেন। তিনি সাকেত-এর এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্য লাভ করিয়া পরে তিনি বৌদ্ধ হন। ৪১৪-৪২১ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার এই কাব্য চীনভাষায় ধর্মরক্ষ কর্তৃক অনূদিত হয়। তিব্বতী ভাষায়, অষ্টম শতাব্দীতে, ক্ষিতীন্দ্র ভদ্র (বা মহীন্দ্রভদ্র) ও মতিরাজ কর্তৃক ইহা অনূদিত হয়।

 তিব্বতী অনুবাদ আক্ষরিক অনুবাদ—উহা হইতে যথাযথভাবে মূল উদ্ধার করা যাইতে পারে। কিন্তু চীনা অনুবাদ ভাবানুবাদ।

 কাব্য হিসাবে, অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত, য়ুরোপীয় পণ্ডিতসমাজে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছে। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ ইহাকে কালিদাসের কাব্যের সমপর্যায়ের কাব্য বলিয়া মনে করেন।

 Bothlingk, Cappeller, Finot, Formichi, Gawronski, Gurner, Hopkins, Hultzsch, Kern, Kielhorn, Leumann, Levi, Luders, Schmidt, Schrader, Speyer, Strauss, F. Weller, Windisch, Wohlgemuth, Peterson, Balmont Byodo, Kimura প্রভৃতি বহু য়ুরোপীয় ও জাপানী পণ্ডিত বুদ্ধচরিত লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। বৌদ্ধকাব্য বলিয়া হয়তো হিন্দুপণ্ডিতদের কাছে ইহা সমাদর পায় নাই। ভারতীয় পণ্ডিতসমাজে ইহা একরূপ উপেক্ষিত।

 বুদ্ধচরিত ব্যতীত আর একখানি কাব্য ও একটি নাটক অশ্বঘোষের রচিত বলিয়া জানা গিয়াছে। ইহার মধ্যে সৌন্দরনন্দ সম্পূর্ণই পাওয়া যায়। কিন্তু শারিপুত্র প্রকরণের, নয় অঙ্কের মধ্যে অতি সামান্য অংশমাত্র পাওয়া গিয়াছে।

 তিব্বতী ও চীনা অনুবাদের মধ্যে, তাঁহার নামে বহু দার্শনিক গ্রন্থও পাওয়া যায়। কিন্তু মূল সংস্কৃতে একমাত্র নৈরাত্ম্য-পরিপৃচ্ছা (বিশ্বভারতী হইতে প্রকাশিত) ও বজ্রসূচী[] ভিন্ন অন্য কোনো দার্শনিক গ্রন্থ তাঁহার নামে পাওয়া যায় নাই।

 অশ্বঘোষের কাব্যের সহিত কালিদাসের কাব্যের যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়।

 বুদ্ধচরিতের তৃতীয় সর্গের ১৩-২৪ শ্লোকের দৃশ্যবর্ণনার সহিত কালিদাসের রঘুবংশের সপ্তম সর্গের ৫-১২ ও কুমারসম্ভবের সপ্তম সর্গের ৫৬-৬৫ শ্লোকের দৃশ্যবর্ণনায় বেশ মিল আছে।

 বুদ্ধচরিতের প্রথম সর্গের ২৭ ও ৩৫ শ্লোক, রঘুবংশের দশম সর্গের ৭৭ শ্লোকের সহিত এবং বুদ্ধচরিতের প্রথম সর্গের ৩২ ও ৪১ শ্লোক ও অষ্টম সর্গের ২৫ শ্লোক, রঘুবংশের তৃতীয় সর্গের ১৪।১৫ শ্লোকের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। এইসব স্থানে উভয়ের শব্দ প্রয়োগ ও প্রকাশভঙ্গির সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

 কোথাও কোথাও বুদ্ধচরিতের সহিত রঘুবংশ বা কুমারসম্ভবের শব্দ প্রয়োগ হুবহু মিলিয়া যায়:—

নবং বয়ো দীপ্তমিদং বপুশ্চ—বুদ্ধ— ১০।২৩
নবং বয়ঃ কান্তমিদং বপুশ্চ—রঘু—২।৪৭
মহাত্মনি ত্বয়্যুপপন্নমেতৎ—বুদ্ধ—১।৬০
সর্বং সখে ত্বয়্যুপপন্নমেতৎ—কুমার—৩।১২

এইরূপ আরও বহুস্থানে উভয়ের কাব্যে নানা সাদৃশ্য আছে॥

  1. ইহা চীনা অনুবাদসহ বিশ্বভারতী হইতে প্রকাশিত হইতেছে

নিবেদন

 আমার পিতৃদেবের আদেশে ১৯০৫ সালে বুদ্ধচরিত বাংলাভাষায় তর্জমা করিতে প্রবৃত্ত হই। তখন কেবলমাত্র কাওয়েল সাহেবের সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। সদ্য আবিষ্কৃত এই কাব্যখানি পড়িয়া তিনি প্রচুর আনন্দ পান এবং আমার সহপাঠী সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও আমাকে তর্জমা করিবার জন্য সেই বইখানি দেন। আমাদের দুইজনের তখন ছাত্রাবস্থা, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে তখন কাহারো এত অধিকার ছিল না যে সাহস করিয়া এই কাজটি গ্রহণ করি। পিতৃদেবকে নিরুৎসাহিত করিতে ইচ্ছা করিল না— তর্জমা করিতে লাগিয়া গেলাম। প্রথম তিন সর্গ তিনি নিজে সংশোধন করিয়া দিয়াছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের কর্তৃপক্ষ আমার পিতৃদেবের নিকট সন্ধান পাইয়া পরিষৎ-পত্রিকায় সেই সময় এই বঙ্গানুবাদের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু অনুবাদটি তখন প্রকাশ করার বাধা ঘটিল। অনেকগুলি শব্দের যথার্থ অর্থবোধ করা তখন সম্ভব হয় নাই। বহু বৎসর ধরিয়া অনেক পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতের গবেষণার ফলে, এখন সেগুলি বোধগম্য হইয়াছে। অনুবাদের খাতাগুলি আমার নিকটেই অযত্নে পড়িয়া রহিল।

 বিশ্বভারতীর গ্রন্থপ্রকাশসমিতির সম্পাদক শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের বিশেষ অনুরোধে সম্প্রতি খাতাগুলির পুনরুদ্ধার করিতে হ‍ইল। ইতিমধ্যে নূতন বিপত্তি উপস্থিত। প্রায় চল্লিশ বৎসর চর্চার অভাবে সংস্কৃতজ্ঞান যাহা ছিল তাহা প্রায় বিলুপ্ত। এতকাল ধরিয়া এই কাব্য সম্বন্ধে যে-সব গবেষণা হইয়াছে তাহার অনুধাবন করিবার সময়েরও অভাব। এই বিপদ হইতে আমাকে উদ্ধার করিলেন চীনভবনের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সুজিতকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি বহু পরিশ্রম করিয়া মূল সংস্কৃতের বিভিন্ন পাঠ ও নানান পণ্ডিতদের টীকা তুলনা করিয়া বুদ্ধচরিতের এই বঙ্গানুবাদটি আগাগোড়া সংশোধন করিয়া দিয়াছেন। তাঁহার এই উৎসাহ ও পরিশ্রম বিনা গ্রন্থখানি প্রকাশযোগ্য হইত না বলা বাহুল্য।

শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র