আজকের আমেরিকা/আমেরিকার পথে



আজকের আমেরিকা

――):☆:(――

আমেরিকার পথে

 আমি একজন ভবঘুরে; পৃথিবীতে দেখেছি অনেক, জেনেছি অনেক। আমার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিবার মত যদি কিছু থাকে দেশবাসী হয়ত তা গ্রহণ করবেন, সেই আশা নিয়েই পুনরায় আমি আমার যাযাবর জীবনের কাহিনী লিখতে বসেছি।

 এবার আমি আমার আমেরিকা ভ্রমণের কথা এখানে বলব। আমেরিক গণতন্ত্রের দেশ। স্বাধীনতা-যুদ্ধের ইতিহাস, জর্জ ওয়াশিংটন ও লিন্‌কনের কথা এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধি এই দেশটি দেখবার জন্যে আমার অন্তরে একটা তীব্র আবেগ জাগিয়ে রেখেছিল। এতদিন পরে যখন সেই আমেরিকার পথে পা বাড়ালাম মন তখন আশা ও আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল।

 কেনেডা থেকে একবার আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার কারণ দেখান হয়েছিল—আমি গরিব, গরিবের স্থান কেনেডায় নাই। আসল কথা তা নয়, আমি ভারতবাসী; তাই ইমিগ্রেসন বিভাগের সু-নজরে পড়তে পারিনি। আমার উপর কড়া হুকুম হল কেনেডা ছেড়ে চলে যাবার জন্য। আমেরিকা যাবার ইচ্ছা আমার মোটেই দমল না। ইউরোপ ভ্রমণ সমাপ্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে যখন দরকারী টাকা যোগাড় করতে সমর্থ হলাম, তখন আমেরিকা যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা হতে আমেরিকায় যাবার পথ আমার রুদ্ধ ছিল। আমাদের দেশের দক্ষিণ আফ্রিকার এজেণ্ট জেনারেলগণ সে কথা ভাল করে জানতেন কিন্তু কখনও এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করেন নি। যদি তার প্রতিবাদ করতে যেতেন, তবে তাঁদের নিশ্চয়ই কাজে ইস্তফা দিতে হত। চাকরির মায়া ছেড়ে যদি চার পাঁচজন এজেণ্ট জেনারেল এই অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করতেন, তবেই দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়ার সরকারের কান খাড়া হয়ে উঠত। ভারতের গণ্যমান্য লোক বুঝতেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীর প্রকৃত অবস্থা। ফলে হয়ত আমাদের কষ্টের অনেকটা প্রতিকার হত।

 আমাদের দেশের লোক শুনেছে দক্ষিণ আফ্রিকাতে ‘কালার বার’ আছে। তার স্বরূপ কি তা অনেকেই বুঝতে পারে না, যারা বুঝেছে তারা আবার বলতেও চায় না। দক্ষিণ আফ্রিকাতে ভারতীয়দের মাঝে দুটি দল আছে; সে দল হিন্দু-মুসলমানের নয়―কংগ্রেস এবং কলোনিয়্যাল-বর্ণ (Colonial Born)। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কলোনিয়্যাল-বর্ণ অর্থাৎ উপনিবেশে জাতদের দল এবং ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের জন্মদাতা হলেন মিঃ মণীলাল গান্ধী। পিতা যা গড়েছেন পুত্র তা ভাংতে না পেরে নতুন দল গঠন করেছেন। আমি এই দুটা প্রতিষ্ঠান হতেই পৃথক্‌ভাবে থাকবার জন্যে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি।

 অনুনয় বিনয় করার অভ্যাস আমার নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় কংগ্রেস দল কিন্তু তার অনেকটা পক্ষপাতী। ‘কালার বার’ যারা নীরবে সহ্য করতে পারে, তারা অনুনয় বিনয়ের পক্ষপাতী না হয়ে যায় কোথায়? যাদের আত্মসম্মান বোধ নাই, তারা মোটেই বুঝতে পারে না―অনুনয় বিনয় মানসিক অধোগতির একটা প্রত্যক্ষ ফল। আমি খাঁটি মানুষের সংগে থেকে সে তথ্য বুঝতে পেরেছিলাম।

 দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর অবস্থিতির সময়ই বুয়ার সরকার কংগ্রেসীদলকে স্বীকার করেছিলেন। কলোনিয়্যাল-বর্ণ এবং ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনকে এখনও স্বীকার করেছেন বলে মনে হয় না। স্বীকার না করার নানা কারণও আছে। যত লোক কালোনিয়্যাল-বর্ণ, তারা হল ইউরোপীয়ান মেজাজের। ইউরোপীয়ান ধরণে খাওয়া-পরা ত আছেই, উপরন্তু এদের মেজাজটা নিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকায় কংগ্রেস এবং বুয়ার সরকার একটু বিপদে পড়েছেন। এখন ইউরোপীয়ান মেজাজ কাকে বলে তা বুঝিয়ে বলি। আমাদের দেশে লণ্ডনের গাওয়ার স্ট্রীট ফেরতা বাবুদের দেখে আমরা বলি তারা ইউরোপীয়ান মেজাজী হয়েছেন। আসলে কিন্তু তা নয়। হ্যাট কোট পরলে এবং মদ খেলেই যদি ইউরোপীয়ান মেজাজ হত, তবে গাধাও সিংহ হয়ে যেত। অনেক স্কচ্‌-ম্যান্ পর্যন্ত Inferiority of complexion হতে বাদ পড়ে না; কিন্তু তারাও আমাদের দেশে বড়লাট হয়। Inferiority of complexion যদি দূর করতে হয়, তবে সকল সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়, মরতে হয় তাও বরণ করে নিতে হয়। মাথা নত না করাই হল ইউরোপীয় মেজাজ। দক্ষিণ আফ্রিকায় কলোনিয়াল-বর্ণরা সে দলের লোক। তারা ভাল করেই জেনেছে ভারতীয় জাতিভেদ ভারতের কত অনিষ্ট করেছে, তাই তারা জাতিভেদ মোটেই মানে না। তারপর তারা এটাও বুঝতে পেরেছে কালার বার মানুষকে কত খাট করে ফেলে। তাই আজ তারা মানুষ বলে পরিচয় দেয় এবং মানুষের প্রাপ্য সম্মান তারা আজ যদি না পায় একদিন তারা তা আদায় করবেই। তারা তাদের দাবী মিটাবার জন্য কারো কাছে কিছুই ভিক্ষা চায় না। অথবা সাহায্য পাবার জন্য প্রত্যাশাও রাখে না।

 যাদের জন্ম ভারতে হয়েছে কিংবা ভারতে যারা অনেক দিন থেকেছে তাদের মতিগতি অন্য ধরণের। তারা ধর্মের কথা বলে, টাকা জমায় এবং আরও ধনী হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। ঔপনিবেশিকরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে সভা করে, দরকার হলে লড়াই করে, তারপর বুয়ার সরকারকে মাঝে মাঝে হুমকিও দেখায়। মহাত্মা গান্ধী তাদেরই অনুগ্রহে দক্ষিণ আফ্রিকাতে সত্যাগ্রহ করে কৃতকার্য হয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বলতে পারি না, অনিচ্ছায় সেই দলেই মিশে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।

 ডারবান, ইস্টলণ্ডন, পোর্ট এলিজাবেথ এবং কেপ্‌টাউনই হল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রসিদ্ধ বন্দর। যাত্রী জাহাজ ডারবান এবং কেপটাউনে ছুঁয়ে থাকে; কার্গোবোটগুলি অন্য দুই বন্দরে নিয়মিতভাবে এসে দাঁড়ায়। আমেরিকা যাবার ভিসা পেয়েছিলাম, জাহাজ ভাড়ার টাকা পকেটে ছিল, তবুও আমার পথ বন্ধ ছিল। ধর্ম আমাকে এখানে সাহায্য করতে পারে না, আমার টাকা এখানে অচল, কারণ টাকারও মূল্যের তারতম্য আছে। সাদা লোকের হাতে আমারই হাতের টাকা যখন চলে যায় তখন তার মূল্য বাড়ে। অবশ্য এরূপ তারতম্য অনেকে পছন্দ করেন না। আমি স্বচক্ষে দেখেছি অনেক ইংলিশম্যান্‌ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে একগুঁয়েমী করে এর প্রতিকার করবার চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগেন, কিন্তু রোগের কারণ না জেনে ঔষধ দেওয়ায় যে ফল হয় এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়ে থাকে।

 ডারবানে আমেরিকা যাবার টিকেট কেনার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু টিকেট কেনা আমার দ্বারা সম্ভবপর হয় নি। জাহাজের এজেণ্টরা কেউ বলে, সকল বার্থই ভাড়া হয়ে গিয়েছে, গতকল্য যদি আসতেন। তবে নিশ্চয়ই একটা বার্থ পেয়ে যেতেন। কেউ বলে আগামী ছয় মাসের জন্য সমগ্র জাহাজটাই ভাড়া হয়ে গেছে; এসব কথা শুনে আমি চিন্তিত হয়েছিলাম। বন্ধুবান্ধবদের কাছে সাগর পার হবার উপায় খোঁজবার ভার দিয়েছিলাম এবং নিজেও খুঁজতেছিলাম।

 রেডিওতে লেকচার দেওয়া তখন আমার একটা পেশা হয়ে গিয়েছিল, কারণ সকলেই বিদেশের খবর শুনতে বড়ই উৎসুক ছিল। ডারবানে এসে টিকেট কেনার কাজে ব্যস্ত থাকায় সেদিকে মন দিতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক জন রেডিও ব্রোকার বলল যে, প্রধান এনাউন্সার হলেন একজন প্রাক্তন সৈন্য এবং অনেক জাহাজ কোম্পানীর লোকের সংগে তার সম্বন্ধও রয়েছে। হয়ত রেডিওতে লেকচার দিলে তিনি জাহাজের টিকেট কেনার কোনরূপ সুবিধা করে দিতে পারেন। আমি তৎক্ষণাৎ ডারবানের বেতারে লেকচার দিতে স্বীকৃত হলাম। লেকচার দিবার পর প্রধান এনাউন্সার আমার টিকেট কেনায় সাহায্য করেন। তিনি যদি টিকেট কিনতে আমাকে সাহায্য না করতেন, তবে আমাকে অন্য কোন উপায়ে বিলাত যেতে হ’ত।

 টিকেট কেনা হয়ে গেলে ইস্টলণ্ডন হয়ে পোর্ট এলিজাবেথ হতে কেপটাউনে যাই এবং সেখান থেকে ক্যাসেল লাইনের যাত্রী জাহাজে সাউথহ্যামটনের দিকে রওনা হই।

 কেপটাউনে আমাকে অনেক দিন থাকতে হয়েছিল। কেপটাউন দেখার জন্য অনেক আমেরিকান ও ইউরোপীয়ান লালায়িত। এতে কেউ সফলকাম হয়, আর কেউ হয় না। যারা কেপটাউন দেখার চেষ্টা করে, কৃতকার্য হয়নি, তারাও কেপটাউন সম্বন্ধে বই লিখেছে; সেরূপ বই আমি পাঠ করেছি। দেখেছি, যারা কেপটাউন না দেখেই বই লিখেছে, তাদের লেখাতে অনেক সার কথা রয়েছে। আর যারা কেপটাউন দেখে বই লিখেছে তাদের লেখায় অনেক এলোমেলো ভাব রয়েছে। আমি যখন কেপটাউন সম্বন্ধে বই লিখব, হয়ত তখন অনেক এলোমেলো ভাব তাতে থাকবে, কিন্তু তাতে দুঃখ নাই। কেপটাউন স্বচক্ষে দেখতে পেরেছি এই আনন্দেই আমার বুক ভরা।

 প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি আঁকার ইচ্ছা আজ আমার হচ্ছে না। প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকদিন থাকবে। কিন্তু মানুষের মনের ভাব বদলায় অতি সত্বর। সেই পরিবর্তনশীল মনকে জানতে আমি পছন্দ করি। কেপটাউন সম্বন্ধে যখন কিছু লেখব তখন আজকের দিনের কথাই লেখব আর যারা ভবিষ্যতে সুখময় পৃথিবীতে আসবে তারা তুলনা করে দেখবে তাদের পূর্বপুরুষ কত বর্বর ছিল।

 এখনও কয়েকটা কাজ আমার বাকি রয়েছে তা সমাপ্ত করতে হবে। প্রথম কাজ হল, যে পন্‌চাশ পাউণ্ড জমা দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রবেশ করেছিলাম, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। দ্বিতীয় কাজ হল, দেখতে হবে কেবিনটি কোথায়।

 টাকার রসিদটা ফিরিয়ে দিবার সময় তাতে প্রাপ্তিস্বীকারের স্থানে নাম সই বরে দিলাম এবং পাউণ্ডগুলি গুণে পকেটে রেখে বিদায় নিলাম। কেবিনটা দেখে বেশ আনন্দই হল। কেবিনে আর একজন লোক ছিলেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতবাসী। দুঃখের বিষয় যখন আমি কেবিন দেখতে গিয়েছিলাম তখন তিনি কেবিনে ছিলেন না। কেবিন হতে বাইরে এসে আমার কেপটাউনের বন্ধুবান্ধবদের সংগে কথা বলতে লাগলাম। মিঃ কল্যাণজী (হিন্দু সভার পৃষ্ঠপোষক), মিঃ কেশব (হিন্দু সভার সেক্রেটারী), মিঃ পালসেনীয়া (কেপটাউনের কংগ্রেসের সেক্রেটারী) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কতকগুলি স্কোলী বালকও (Scholi Boys) আমার মমতা ত্যাগ করতে পারেনি। তারা ডকের উপর দাঁড়িয়ে নানারূপ শ্লোগান বলতে শুরু করে দিয়েছিল। তিনখানা সংবাদপত্রের প্রতিনিধি একসংগে এসে আমার বিদায় বাণী ও মন্তব্য শুনতে চাইলেন। আমি তাদের বল্‌লাম, “দক্ষিণ আফ্রিকার জল এবং ফলের তুলনা অন্য কোন দেশের জলের এবং ফলের সংগে হয় না। জোহান্সবার্গের স্বর্ণ-খনি এবং কিম্বালির হীরার খনি জগৎ বিখ্যাত; কিন্তু ঐ ‘কালার বারটা’ আমার মোটেই সহ্য হয়নি। ‘কালার বারের’ দুর্গন্ধ নাক হতে ছাড়াবার জন্য লণ্ডনে গিয়ে অনেক দিন থাকতে হবে এবং যে পর্যন্ত কালার বারের দুর্গন্ধ নাক হতে না যায় সে পর্যন্ত লণ্ডন পরিত্যাগ করব না।

 “আমি জানতাম না কালার বার কেমন হয়। এখন জনেছি এবং বুঝেছি কালার বার কাকে বলে। এতে আমার যদিও ক্ষতি হয়েছে অনেক, কিন্তু শিক্ষা হয়েছে ক্ষতির চেয়েও বেশী। আমি জগতে এসেছি ছাত্র হয়ে, আজীবন ছাত্রই থাকব তাই যতদূর পারি শুধু শিখে নিতেই চাই।

 “জগতের লোক, বিশেষ করে যারা ধর্ম নিয়ে চর্চা করে, তারা বলে পূর্বে জগৎ ভাল ছিল এখন খারাপ হয়েছে কিন্তু তারা বুঝে না কিংবা বুঝতে চেষ্টাও করে না জগৎ যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। জগতের উন্নতির গতি বুঝবার উপায় আছে এবং উন্নতি যাতে হয় তার চেষ্টাও করা দরকার। নিরপেক্ষ মানুষেরা এবং স্বাধীনচেতা লোকেরা তাই বলবে। ধর্মের ঘাড়ে সকল দায় চাপিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। ধর্মগুলি জগতকে উন্নতির পথে অনেক টেনেছিল, কিন্তু ধর্মের তেজ ক্ষণস্থায়ী। দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যাচারিত কালো, ব্রাউন এবং বাদামী একত্র হও, যাতে মানুষ বলে পরিচয় দিতে পার। ধর্ম তোমাদের সাহায্য করবে না, করতেও পারে না, উপরন্তু তোমাদের মাঝে ভাংগন এনে দিবে। ইউরোপীয়ানরা নিজেদের ‘আফ্রিকানেরার’ বলে পরিচয় দেয়, তোমরা নিজেদের আফ্রিকান্ বলে পরিচয় দাও দেখবে স্বাধীনচেতা মানুষ, পরাধীন ভারতবাসী, মরণ-বিজয়ী চীন তাতে যোগ দিবে। মুষ্টিমেয় বুয়ার তোমাদের পদদলিত করে রাখতে পারে না, পারবেও না।” এই বলে আমি সাংবাদিকদের কাছ হতে বিদায় নিয়েছিলাম।

 এদিকে ইমিগ্রেসন বিভাগ আমাকে খোঁজ করবার জন্য অন্ততঃ পাঁচটা লোক পাঠিয়েছে। যে-ই আমার কাছে আসে সে-ই দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনে, ফিরে আর যায় না। তারা সকলেই ‘কালার্ড ম্যান'। তারপর ইমিগ্রেশন অফিসার নিজে এসে একটু দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে আমাকে বললেন, “মহাশয়, দয়া করে পাঁচ মিনিটের জন্য এদিকে আসুন।” ইমিগ্রেসন বিভাগে ইউরোপীয়ান অফিসার বোধহয় দু’তিন জন থাকে। একজন বললেন, “মহাশয়, দয়া করে আপনার আংগুলের টিপ দিতে হবে। আমি বল্‌লাম, “অন্যান্য ইউরোপীয়ানরা তো আংগুলের টিপ দেয় না। আমি তা দিব কেন?”

 “আপনি যে ভারতবাসী সেকথা আপনার স্মরণ রাখা দরকার। ভারতবাসীর দস্তখতে হয় না, অনেকে দস্তখত বদলিয়ে ফেলে, কিন্তু আংগুলের টিপ বদ্‌লাতে পারে না।” কোন কথা না বলে আংগুলের টিপ দিয়ে চলে এলাম।

 যে সকল স্কোলী বয় আমাকে বিদায় দিতে এসে শ্লোগাণ ঝাড়ছিল তাদের চিৎকার জাল চার্‌লী চ্যাপলিন্ এসে থামিয়ে দিল। আসল চার্‌লী চ্যাপলিন্‌ থাকেন হলিউডের এক কাণা গলিতে তা দেখেছি এবং সে সম্বন্ধে নানারূপ গল্পও শুনেছি। অবশ্য এসব বাজে কথা এখানে বক্তব্য নয়। জাল চার্লীর দিকে কৌতূহলী দর্শকরা ছয় পেনী এবং এক শিলিং-এর রৌপ্যমুদ্রা বর্ষণ করছিল! যাত্রী এবং ছাত্র-সেপাইগণ আনন্দে চিৎকার করছিল। আমাদের মন সেদিকে ক্ষণিকের তরে আকৃষ্ট হল।

 কেপটাউন! যদিও তোমার সৌন্দর্য আমার মনকে মুগ্ধ করেছে, তোমার বুকের অনেক সন্তান আমাকে আপন করে গ্রহণ করেছে, তবুও তোমার কথা ভুলার জন্য আমাকে অনেকদিন অন্যত্র গিয়ে থাকতে হবে। কারণ তোমার শরীরে এমন এক ক্ষত আছে, যা আমি সহ্য করতে পারি না, যা আমার মনকে বিচলিত করে তোলে। তোমার সন্তানগণ যদিও সে ক্ষত দেখে ক্ষণিকের জন্য ঘৃণা প্রকাশ করে, তারপরই কিন্তু সব ভুলে যায়।

 তারা জানে তাদের মায়ের শরীরে ক্ষতের কারণ তাদেরই আপন ভাই, আর সে ভাই কত দুর্দান্ত। হয়ত একদিন তোমার দুর্দান্ত ছেলেকে তারা শাসন করবে, সেদিনের জন্য অপেক্ষা কর, আর আমাকে বিদায় দাও। আমাকে যেতে হবে বহুদূর। আমার কাজই হল পুরাতনকে ভূলে গিয়ে নূতনের স্বরূপ চিন্তা করা! আমি এখন আমেরিকার পথে।

 জাহাজ ছাড়তে এখনও অনেক দেরী। যারা জাহাজের যাত্রী নয় তাদের নেমে যাবার আদেশ হয়েছে। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবগণও জাহাজ পরিত্যাগ করে নীচে নেমে গিয়ে জেটিতে দাঁড়ালেন। জেটিতে শ্বেতকায়দের ভিড় ছিল। তাদের গা ঘেঁষে আমার বন্ধুদের দাঁড়ান খুব নিরাপদ ছিল না। ইউরোপীয়ানরা বন্ধুদের বিদায় দেবার শোকে যদিও মুহ্যমান, তবু পাশে কালা আদমী এসে দাঁড়ালে সে শোক মুহূর্তে ক্রোধে পরিণত হয় এবং অসহায় নিরীহ ভারতীয়দের উপর অসৎ ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং ভারতীয়দের বাধ্য হয়েই বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াতে হল। কিন্তু স্কোলী বালকরা অন্যরূপ। তারা শ্বেতকায়দের কাছেই দাঁড়িয়েছিল। সাদাদের বুটের লাথির ভয় তারা রাখে না। তারাই আমাকে লাল নীল সবুজ সাদা নানা রংএর ফিতা দিয়ে গিয়েছিল উপরের ডেক হতে ছাড়বার জন্যে। আমি ফিতাগুলি ছাড়লাম। কয়েকটা ফিতা তারা ধরল এবং আমার মুখের দিকে সকরুণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইল। জাহাজ নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে জেটি ছেড়ে বাহির সমুদ্রে এসে মোড় ফিরেই দম বাড়িয়ে দিল। জাহাজের খালাসী থেকে কাপ্তান সকলেই শ্বেতকায়, তারা সকলেই আপন আপন কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

 আটলাণ্টিক মহাসাগরে যে সকল জাহাজ চলাফেরা করে, তাদের কতকগুলি আইন মানতে হয়। সর্বপ্রথম আইন হল, ডেক প্যাসেন্‌জারের কোন ব্যবস্থাই নাই। দ্বিতীয় নিয়ম হল, এশিয়াটিক ফুড অর্থাৎ চীনা খাবার কোনও যাত্রীকে খেতে দেওয়া হয় না। জাহাজের টিকেট কেনার মানেই হল, সর্ববাদীসম্মত খাদ্য তোমাকে খেতেই হবে।

 আমি টিকেট কিনেছি তৃতীয় শ্রেণীর। প্রশান্ত মহাসাগরের, চীন সমুদ্র তীরের এবং ভারত মহাসাগরের জাহাজে তৃতীয় শ্রেণীকেই ডেক প্যাসেন্‌জার বলা হয়। এখন আটলাণ্টিক মহাসাগরের ডেক প্যাসেন্‌জার বা তৃতীয় শ্রেণীর লভ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্বন্ধে একটু সংবাদ দিতে ইচ্ছা করি। কেপটাউন হতে সাউথহাম্‌টন তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া চৌত্রিশ পাউণ্ড অর্থাৎ আমাদের দেশের সাড়ে চারশ টাকা। আমাদের কেবিনে দুখানি বার্থ, তাতে বিছানা পরিপাটিরূপে সাজানো ছিল। তিনটি আলো ছিল। একটা কেবিনের মধ্যস্থলে, আর দুটা আলো প্রত্যেক বালিশের পেছনে। বই পড়তে বেশ আরাম। ছোট শিকলে টান দিলেই বাতি জ্বলে উঠে, আবার সেই ছোট শিকলে টান দিলেই বাতি নিবেও যায়। ভিতরেই হাতমুখ ধোবার জন্য গরম এবং ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা আছে, তাছাড়া পাঁচটা কেবিনের পরই একটি করে স্নানের ঘর। ডাইনিং রুম, স্মোকিং রুম, লাইব্রেরী, খেলবার নানারূপ সরন্‌জাম, রুম স্টুয়ার্ট, স্নানাগারের স্টুয়ার্ট―এসকল ত ছিলই। দৈনিক সংবাদপত্র জাহাজে ছাপান হ’ত এবং সকাল বেলায় ঘুম ভাংতেই প্রত্যেকের হাতের কাছে একখানা করে সংবাদপত্র দেবার ব্যবস্থা ছিল। এর জন্য দাম দিতে হ’ত না। ডিনারের পর সিনেমা দেখান হ’ত। প্রত্যেক কেবিনেই কলিংবেল-এর ব্যবস্থা ছিল। বেল বাজালেই বয় দৌড়ে আসত। কোনও এক সময়ে ইংলণ্ড ও স্পেন হতে যখন যাত্রীরা উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকায় যেত তখন ছিল ডেক প্যাসেন্‌জারের ব্যবস্থা। এতে অনেক লোক পথেই মরত, আর যারা বেঁচে থাকত তারাও আমেরিকায় পৌঁছবার পর কয়েক মাসের মাঝেই মরত। এরূপ মৃত্যু হবার পর ডেক প্যাসেন্‌জার ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের সমুদ্রে গরম বাতাস থাকার জন্য ডেক প্যাসেন্‌জারের ব্যবস্থা এখনও রয়েছে, এবং আমাদের নিয়ম কানুন অর্থাৎ ধর্মের গোড়ামী থাকায় আমরাও ডেক প্যাসেন্‌জারী পছন্দ করি। এতে আমাদের কত হীন হতে হয়, কত অপমান সহ্য করতে হয় তার ইয়াত্তা নাই। এসব জেনে শুনেও আমরা এসবের প্রতিবাদ করি না।

 জাহাজ এখন গভীর সমুদ্রে। আমার কেবিন দেখা হয়েছে, এবার আমাকে জাহাজ দেখতে হবে। তাই জাহাজের একদিক থেকে অন্যদিকে দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণী সবই দেখলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার যে কোনও শহরে জাপানী এবং তুরুক ছাড়া অন্য কোন এসিয়াবাসী বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারে না, আমি কিন্তু হেঁটেছি। জাহাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে ভয় পাব কেন? কিন্তু সকলের তা সহ্য হয় না। দু’একজন এরই মধ্যে জিজ্ঞাসা করেছেন, “এই, তুই কি প্যাসেন্‌জার?” আমার জবাব ছিল, “হ্যাঁ, তোর মতই!” আমার মনে হয় এই লাইনে যে সকল ভারতবাসী ভ্রমণ করেছে, তাদের মাঝে আমিই বোধ হয় সর্বপ্রথম অভদ্র এবং স্বাধীন যাত্রী।

 আমার ইচ্ছা হল কেবিনে যে ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক এসেছেন তার সংগে একবার দেখা করি এবং কথা বলি। কিন্তু কেবিনে এসে তাঁর দর্শন পেলাম না। আমি স্মোকিং রুমে বসে একটু আরাম করেই বাইরে এসে চায়ের আদেশ দিলাম। চায়ের তখনও সময় হয় নি, তবুও বয় চা এনে হাজির করল এবং বলল, চারটার সময় চায়ের ভাল বন্দোবস্ত হবে। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলাম।

 একদল যাত্রী আমারই কাছে ভিড় করে বসে নানা রকমের গল্প-গুজবে মশগুল হয়ে উঠল, কিন্তু আমার তা মোটেই ভাল লাগছিল না। আমার মন যেন ক্রমশই নিরুৎসাহে দমে আসছিল। আমি যে গদি আঁটা বেন্‌চিটাতে হেলান দিয়ে বসেছিলাম, তাতে প্রচুর স্থান থাকা সত্ত্বেও কেউ আমার কাছে এসে বসছিল না অথচ অন্যান্য আরাম কেদারায় ঠেলাঠেসি করে তারা বসছিল। তার কারণ আর কিছুই নয়, আমার সংগে বসলে ওদের সম্মান থাকবে না।

 কেবিনে এসে দেখি ভারতীয় ভদ্রলোকটি মুখ নত করে বসে আছেন। তাঁকে আমার পরিচয় দিলাম। তিনি তাঁর পরিচয় সংক্ষেপে দিয়ে আমার বোঁচকার দিকে দৃষ্টি ফিরালেন এবং বললেন, “এরূপ পুঁটলি নিয়ে বিলাত চলেছেন, এটা দেখে লোকে যে হাসবে!” আমি তার কথার কোন প্রতিবাদ না করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ডাইনিং রুমে আপনি কোন্ দিকে বসে খান?” গম্ভীর হয়ে বললেন―কেবিনে তাঁর খাবার এনে দেওয়া হয়। আমি বললাম, “কেবিন তো শোবার জন্য খাবার জন্য ডাইনিং হল রয়েছে, সেখানেই গিয়ে আমরা খেয়ে আসতে পারি।” তারপরই বললাম, “চলুন এক গ্লাস বিয়ার খেয়ে আসি।” ভদ্রলোক দুই চোখ কপালে তুলে বললেন―যান, অপমানিত হয়ে আসুন। ভদ্রলোকের কথার ভাবে বুঝতে পারলাম স্মোকিং রুমে গেলেই অপমানিত হতে হবে, তাই তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, যদি কিছু ঘটে তার জন্য আমি দায়ী হব আপনি চলুন। তিনি বিয়ার খেতে রাজি ছিলেন কিন্তু স্মোকিং রুমে যেতে রাজি ছিলেন না, তবুও একরকম জোর করেই তাঁকে বিয়ারের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্মোকিং রুমে গিয়েই দু’গ্লাস বিয়ারের জন্য আদেশ করলাম। বোধ হয় পনের মিনিট পর বিয়ার নিয়ে একজন ইংরেজ ছোকরা এল। তাকে বিয়ারের দাম বাবদ এক শিলিং দিয়ে আর একটি শিলিং দিলাম বখ্‌শিস স্বরূপ। অন্যান্য যাত্রীরা তিন পেনীর বেশী কেউ বখ্‌শিস দেয়নি সেদিকে আমার লক্ষ্য ছিল। এখনও পৃথিবী টাকার বশ। এক শিলিং বখ্‌শিস পেয়ে ইংলিশ বয় আমাদের অনুগত হয়ে পড়ল এবং কোন কিছুর আদেশ দিলেই সর্বাগ্রে আমাদের হুকুমই তামিল করতে লাগল।

 আমার কেবিন-সাথীটি হলেন ব্যবসায়ে ধোপা। তাঁর আয় বৎসরে পাঁচ হাজার পাউণ্ড। তিনিও প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনতে পারেননি। তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কিনতে পেরেছিলেন, আমারই টিকেটের লেজ ধরে। যাহোক, আমাদের মাঝে মোটেই মনের মিল ছিল না―কারণ তিনি ধনী আর আমি দরিদ্র। এই যে শ্রেণীযুদ্ধ, আজ পর্যন্ত কেউ তাড়াতে পারেনি, এড়াতেও পারা যায় না। শ্রেণীযুদ্ধের অবসান হয়েছে রুশিয়ায়, লেনিনের ভালবাসায় এবং ষ্ট্যালিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে। যদিও আমরা দুজনই ইণ্ডিয়ান, দুজনের একই ধর্ম, কিন্তু আমাদের আকাশ-পাতাল ভেদ রয়েছিল। ধনী শতকষ্ট সহ্য করতে রাজি, কিন্তু যার রক্ত শোষণে ধনীর শরীর পুষ্ট হয়েছে, তার কাছে বসতেও রাজি নয়। আমার ধনী বন্ধু বুয়ারদের লাঞ্ছনা নিঃশব্দে হজম করে তাদের সংগেই মিলামিশা করবার জন্যে আগ্রহান্বিত কিন্তু আমার সংগে কথা বলতেও রাজি নন। যদিও আমার চামড়া তাঁরই মত কালো!

 বিয়ার খেয়েই যেন তাঁর অনেকটা জ্ঞান হল, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন স্মোকিংরুমে যেতে কোনদিনই তার সাহস হয়নি। আমি সংগে থাকায় আজ তাঁর সে সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি ডারবানে জাহাজে উঠেছিলেন এবং ডি ডেকে তাঁর দুদিন কেটেছিল। আমি তাঁকে বললাম, পূর্বেও একবার আমি লণ্ডন দেখেছি এবং সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ করেছি তাই বুয়ারদের দেখে আমার ভয় হয় না। আমার সাহস দেখে সহযাত্রী ভারতীয়টির মনে বেশ আনন্দ হয়েছিল। তিনি আমাকে নাবিকদের সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন; নাবিকরা একদিন আমার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনেক কথা শুনার পর অনেকেই আমার বন্ধু হয়েছিল।

 সেদিন বিকালে সাতটায় আমরা কেবিনে খানা না আনিয়ে ডাইনিং রুমে ডিনার খেতে গেলাম। আমাদের দুজনের জন্য ডিনার রুমের এক পাশে একটা ছোট টেবিলে খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছিল। ওয়েটার অন্য সকলের চেয়ে আমাদের ভালভাবে পরিবেশন করতে লাগল। সেই আপ্যায়ন আমাদের টাকার মহিমায় নয়, কথার দ্বারা, ভাবের আদানপ্রদানের দ্বারা। আমাদের প্রতি ওয়েটারের পক্ষপাতিত্ব অনেকেরই মনে অসহ্য হয়ে উঠছিল এবং তার জন্য আমাকে জাহাজের কেরানির কাছে কৈফিয়ৎও দিতে হয়েছিল। মনে আমার যাই থাকুক, কৈফিয়ৎটা দিয়েছিলাম একটু ঘুরিয়ে যাতে দুকূল বজায় থাকে। কারণ বাণিজ্যপোতের যে আইন, নৌবিভাগেও একই আইন। বাণিজ্যপোতের বয়দেরও কড়া ডিসিপ্লিন মানতে হয়।

 সমুদ্র নীরব নিস্তব্ধ। জাহাজ চলেছে প্রবল বেগে। আমরা তারই মাঝে কখনও ঘুমাচ্ছি, কখনও বেড়াচ্ছি, কখনো বা আপন আপন মনের কথা একে অন্যের কাছে বলছি। আমাদের মন সর্বদাই নানা সন্দেহ জালে অচ্ছন্ন ছিল। আগেকার দিনে ধর্মের কথা নিয়ে তর্ক ও আলোচনা হত এবং সেই তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই মন গড়ে উঠত। এযুগের কথা অন্য রকমের। আগে ছিল মোহম্মদ বুদ্ধ খৃষ্ট এদের কথা। এখন হয় ষ্ট্যালিন হিটলার মুসোলিনী দালাদিয়ের আর চেম্বারলেনের কথা এবং এখনকার মতবাদ হলো ইম্পিরিয়্যালিজম্‌, ফ্যাসিজম্‌, নাজিইজম্ আর কমিউনিজম্‌। আমরা দুজনেই ছিলাম সকলের দৃষ্টি পথে সকল সময়। আমার ভারতীয় সংগীর এসব কোনও মতবাদ নাই তা প্রকাশ করতে গিয়ে একদিন বললেন, তিনি পলিটিক্সের কোন ধার ধারেন না। তাঁর কথা শুনে সকলে হাসল, তারপর আমার দিকে একজন তাকিয়ে বলল, “আপনারও বোধহয় একই মত?” আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম, যেদিন এই পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছে সেদিনই আমি পলিটিক্সের আওতায় এসেছি। পলিটিক্স ছাড়া মানুষ কোন মতেই বাঁচতে পারে না। দুজনের দুদিকে মতিগতি দেখে সকলেই নানা মন্তব্য করতে লাগল। আমি ওদের মন্তব্যে মোটেই কান দেইনি। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম, এই পৃথিবীতে শরীরের রংএর জন্য যে তারতম্যের সৃষ্টি হয়েছে, ধর্মের গোঁড়ামীতে যে ছোট বড় বলে একটি নকল আভিজাত্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার যাতে ধ্বংস হয়, তাই আমি দেখতে চাই। মানুষ সম্পর্কে মানুষের মনের সংকীর্ণতা না ঘুচলে উন্নত সভ্যতার দাবী চলে না।

 জাহাজ গোল্ডকোষ্ট পার হবার পরই বুয়ার এবং অন্যান্য ইউরোপীয়ানদের মতিগতি পরিবর্তন হতে লাগল। অনেকেই মন খুলে আমার সংগে কথা বলতে লাগল। কিন্তু আমার বন্ধুটি কোন কথাতেই ছিলেন না। কি করে বড় একটা কাপড় কাচার মেশিন কিনবেন এবং কি করে তার কলকব্জা ঠিক হবে, সেই নিয়েই তাঁর মন পড়ে রয়েছিল।

 আমি সকলের সংগে অবাধে মিলামিশা করতে লাগলাম। ইউরোপীয়ান, বয়ার সকলেই আমার সংগে নানা কথা বলতে লাগল। তাদের প্রধান জিগ্‌গাস্য বিষয় ছিল, মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রভাব ও তাঁর কৃতকার্যতা সম্বন্ধে। সেই সংগে সুভাষ ও জওহরলালের কথাও এসে পড়ছিল। আমি অনেক সময় তাদের কাছে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যেসকল তীব্র মন্তব্য করতাম, সে কথাগুলি বোধ হয় তাদের মনে বেশ লাগত। আমার চিন্তার ধারা ও কথা শুনে ওরা ভাবত, হয়ত আমি অনেক বই পড়েছি। তাই একজন জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কার্লমার্কস্‌এর বই পড়েছি কিনা। আমি যখন বলতাম কার্লমার্কস্‌এর বই চোখেও দেখিনি তখন তারা অবাক হয়ে যেত। আমি তাদের বুঝিয়ে বলতাম, দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতাই আমাকে এই দৃষ্টিভংগী এনে দিয়েছে।

 আমি অনেক সময়ই দেশের কথা ভাবতাম। মধ্যবিত্ত লোকের অর্থের অভাব, তাদের পরাধীনতার অনুভূতি, দরিদ্রতার লান্‌ছনা, তাদের প্রতি ধনীদের উৎপীড়ন এসবের প্রতিকার কিসে হয় তার চিন্তা এখন বোধহয় তাদের মাঝে এসেছে। হরিজনরা কোনদিন মুখ খুলে তাদের দুঃখের কথা কারো কাছে বলেনি। তারা এখন শুধু দুঃখের কথা বলে না, যাতে তাদের দুঃখ মোচন হয় তার দাবীও বোধহয় করে। যে হরিজন একদিন অপরের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করত এখন তারা আর উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে না। এখন উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে তারাই যারা এই অসৎ নিয়মের প্রবর্তন করেছিল। আমি আরও ভাবতাম এখন দেশে আর বোধ হয় আধ্যাত্মিকতার বাচালতা চলে না। এখন বোধ হয় সাধুদের কথায় কেউ কান দেয় না, বোধ হয় এখন দেশে আর জাতিভেদ নাই। আমি ভাবতাম আমি যেন অনেক বৎসর আগে দেশ ছেড়ে এসেছি। কিন্তু সুখের চিন্তা মিলিয়ে যেত যখনই অতলান্তিকের ঢেউ লেগে জাহাজ কেঁপে উঠত।

 দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন জাহাজে কেটে গেল। বিরাট সমুদ্র আর অন্তহীন আকাশ দেখে মন একঘেয়ে হয়ে উঠছিল। রাত এখনও কাটেনি। সিনেমা দেখে অনেকেই স্মোকিং রুমে এসে বসেছিল। কেউ হুইস্কি, কেউ বিয়ারের গ্লাস সামনে রেখে গল্প করছিল। আমিও এক গ্লাস বিয়ারের আদেশ দিয়ে একটা খালি টেবিলে গিয়ে বসেছিলাম। আলাদা বসলাম এই ভেবে যে, এখন গভীর রাত, অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। যদি ওদের টেবিলে গিয়ে বসি আর মদের নশায় শ্বেতবর্ণাভিমান ওদের জেগে ওঠে, তবে আমাকে লড়তে হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এতগুলি লোকের সংগে আমি কোন মতেই পেরে উঠব না।

 মিনিট দুই পরই একটি স্কচ্‌ম্যান্ এসে আমারই টেবিলের কাছে একখানা ছোট চেয়ার টেনে এনে বসল এবং বলল, আমার কোন অসুবিধা হবে কি? আমি বললাম, “নিশ্চয়ই না!” স্কচ্‌ম্যানটি দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা, ডাচ ভাষা বেশ ভালই জানে। সে ডাচ ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করল। ডাচ আর স্কচ্‌ ভাষায় যত মিল আছে, ইংলিশ এবং স্কচ্‌ ভাষায় তত মিল নাই। স্কচ্‌ লোকটিকে জানিয়ে দিলাম, আমি ডাচ ভাষা মোটেই জানি না এবং এ জীবনে আর ডাচ ভাষা শিখবার বাসনাও রাখি না। আমার কথা শুনে স্কচ্‌ম্যান্ বলল, “আপনার কথায় মনে হচ্ছে আপনি প্রবৃটিশ।” আমি বললাম, “হয়ত আপনি ভাবছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছি, অনেক বৃটিশের পাল্লায় পড়েছি, তাই আমি প্রবৃটিশ।” স্কচ্‌ম্যানটি হেসে বলল, “আপনি এখন কোন্ দেশের

যাত্রী?” আমি বললাম, “আমেরিকার।” তিনি বললেন, “আমেরিকায় যান, সেখানে গেলে আপনার চোখ খুলবে। দেখবেন সাম্রাজ্যবাদীদের তাণ্ডব নৃত্য। দেখবেন ওরা নিগ্রোদের উপর কত অত্যাচার করছে। আমার মনে হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ডুয়েল এডমিনিস্ট্রেশন্‌ থাকায় ভারতীয়দের বেশ ভালই হয়েছে।” কথাটা বুঝলাম এবং তা মেনে নিতেও হল। প্রকাশ্যে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “আমার ভ্রান্তি দূর হয়েছে।”

 আমাদের আলাপ যখন বেশ জমে উঠেছে এমন সময় একটি সুদর্শন নির্ভীক বালক এসে আমার কাছে দাঁড়াল। ছেলেটি ইংলিশ। তার সোণালী রং-এর চুলগুলি রক্তাভমুখের উপর পড়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। ছেলেটির বয়স বার-তের বছরের বেশী নয়, কিন্তু এরই মধ্যে তার মুখে কর্মদক্ষতার সুস্পষ্ট ছাপ পড়েছে। ছেলেটি আমাকে ইংগিত করে ডাকল। তার ইংগিত বুঝতে পেরে তখনই উঠে আসলাম।

 প্রথমত আমরা “ডি” ডেকে নেমে জাহাজের সামনের দিকে চললাম। জাহাজ ছোট নয়, দশ মিনিটে আমাদের গন্তব্য স্থানে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। অনেকগুলি সিঁড়ি উঠানামা করে তারপর গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে হয়েছিল। আমাদের পথে ছোট ছোট বাতি মিট্ মিট্‌ করে জ্বলছিল। আমার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ এবং চলতে পারছি না দেখে ছেলেটি আমার হাত ধরে এগিয়ে চলছিল। আমরা একটা বড় কেবিনের দরজায় এসে টোকা দিলাম। দরজা খুলে দিবার পর কেবিনে ঢুকেই দেখি, অন্তত পন্‌চাশ জন লোক বসে আছে এবং আমার অপেক্ষা করছে। স্কচ্‌, ইংলিশ, আইরিশ, ডেনিস, চেক, সব জাতের লোকই তাতে ছিল। সকলের সংগে পরিচয় হল। এরা মজুর আর আমি পর্যটক। এদের যেমন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন কাটাতে হয়, আমারও অবস্থা তেমনি। এদের এবং আমার মাঝে পার্থক্য হল―এরা বিদ্যা অর্জন করেছে বই পড়ে, আমার যা শিক্ষা তো চোখের দেখা বাস্তব হতে। এরা আমার কাছ থেকে কিছু জানতে চায়, আমিও তাদের কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। কলমে অনেক বিষয় বিবৃত করা যায় না, মুখের ভাষায় তা প্রকাশ করা চলে; তাই এরা আমার মুখের কথা শুনতে চেয়েছিল।

 জাহাজের মজুরদের সঙ্গে কথার যেন শেষ হচ্ছিল না। তারাও বলছিল আমিও বলছিলাম। উভয়পক্ষে যদি জানারই মতলব থাকে তবে এরূপই হতে থাকে। সময় চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দখলাম রাত তিনটা হয়েছে। এত রাত্রে ঘুমালে সকালে উঠার কোন উপায়ই থাকে না। এদিকে নিদিষ্ট সময়ে খানার টেবিলে যদি না যাওয়া যায় তবে জাহাজের নিয়মমত কারো জন্যে খাবার চাপা দিয়ে রাখা হয় না। তাই কাছে-বসা টেবিল স্টুয়ার্টকে বললাম, “দয়া করে সকাল বলা উঠিয়ে দিবেন নতুবা সকালে খেতে পাব না।” টেবিল ষ্টুয়ার্ট সম্মতি জানাল। আমি আর তথায় বসে থাকলাম না। রুমে এসে দেখি আমার কেবিন-সাথী গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। তাকে বলার মত অনেক কথা ছিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল একে উঠিয়ে আজ আমার প্রাণের কথা তার কাছে বলি, কিন্তু ঘুমন্ত মানুষকে জাগাতে নাই জানতাম বলেই তাকে আর ডাকিনি।