ওঁ

বোলপুর

বিনয় সম্ভাষণ পূর্ব্বক নিবেদন―

 আমার কাছে আমার ছবি একখানিও নাই। অন্যত্র হইতে সংগ্রহ করাও আমার পক্ষে সহজসাধ্য নহে। Hopsing কোম্পানি আমার ছবি তুলিয়াছিলেন তাঁহাদের কাছে থাকিতেও পারে।

 আমার জীবনের ঘটনা বিশেষ কিছুই নাই এবং আমার জীবনচরিত্র লিপিবদ্ধ করিবার যোগ্য নহে।

 আমার জন্মের তারিখ ৬ই মে ১৮৬১ খৃষ্টাব্দ। বাল্যকালে ইস্কুল পালাইয়াই কাটাইয়াছি। নিতান্তই লেখার বাতিক ছিল বলিয়া শিশুকাল হইতে কেবল লিখিতেছি। যখন আমার বয়স ১৬ সেই সময় ভারতী পত্রিকা বাহির হয়। প্রধানত এই পত্রিকাতেই আমার গদ্য লেখা অভ্যস্ত হয়।

 আমার ১৭ বছর বয়সে মেজদাদার সঙ্গে বিলাত যাই― এই সুযোগে ইংরাজি শিক্ষার সুবিধা হইয়াছিল। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যাপক হেন্‌রি মর্লির ক্লাসে ইংরাজি সাহিত্য চর্চ্চা করিয়াছিলাম।

 এক বৎসরের কিছু ঊর্দ্ধকাল বিলাতে থাকিয়া দেশে ফিরিয়া আসি। জাহাজে “ভগ্নহৃদয়” নামক এক কাব্য লিখিতে শুরু করি— দেশে আসিয়া তাহা শেষ হয়।অল্পকালের মধ্যে সন্ধ্যা সঙ্গীত, প্রভাত সঙ্গীত, প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রকাশিত হইয়াছিল। আমার ২৩ বৎসর বয়সে শ্রীমতী মৃণালিনী দেবীর সহিত আমার বিবাহ হয়।

 ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, রাজা ও রাণী, সোনার তরী প্রভৃতি কাব্যগুলি পরে পরে বাহির হইয়াছে— তাহাদের প্রকাশের তারিখ প্রভৃতি আমার মনে নাই।

 সোনার তরী কবিতাগুলি প্রায় সাধনা পত্রিকায় লিখিত হইয়াছিল। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ তিন বৎসর এই কাগজের সম্পাদক ছিলেন ― চতুর্থ বৎসরে ইহার সম্পূর্ণভার আমাকে লইতে হইয়াছিল। সাধনা পত্রিকায় অধিকাংশ লেখা আমাকে লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকদের রচনাতেও আমার হাত ভূরি পরিমাণে ছিল।

 এই সময়েই বিষয় কর্ম্মের ভার আমার প্রতি অর্পিত হওয়াতে সর্ব্বদাই আমাকে জলপথে ও স্থলপথে পল্লীগ্রামে ভ্রমণ করিতে হইত ― কতকটা সেই অভিজ্ঞতার উৎসাহে আমাকে ছোট গল্প রচনায় প্রবৃত্ত করিয়াছিল।

 সাধনা বাহির হইবার পূর্ব্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়। যাঁহারা ইহার জন্মদাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে কৃষ্ণকমল বসু, সুরেন্দ্রবাবু, নবীন চন্দ্র বড়ালই প্রধান ছিল। কৃষ্ণকমল বাবুওসম্পাদক ছিলেন। সেই পত্রে প্রতি সপ্তাহেই আমি ছোট গল্প সমালোচনা ও সাহিতিপ্রবন্ধ লিখিতাম। আমার ছোট গল্প লেখার সূত্রপাত ঐখানেই। ছয় সপ্তাহকাল লিখিয়াছিলাম।

 সাধনা চারিবৎসর চলিয়াছিল। বন্ধ হওয়ার কিছুদিন পরে একবৎসর ভারতীর সম্পাদক ছিলাম, এই উপলক্ষ্যেও গল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ কতকগুলি লিখিতে হয়।

 আমার পরলোকগত বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের বিশেষ অনুরোধে বঙ্গদর্শন পত্র পুনরুজ্জীবিত করিয়া তাহার সম্পাদনভার গ্রহণ করি। এই উপলক্ষ্যে বড় উপন্যাস লেখায় প্রবৃত্ত হই। তরুণ বয়সে ভারতীতে বৌ ঠাকুরাণীর হাট লিখিয়াছিলাম ইহাই আমার প্রথম বড় গল্প।

 এই সময়েই আমি বোলপুর শান্তিনিকেতন আশ্রমে ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম নামক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করি। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তখন আমার সহায় ছিলেন ― তখন তাঁহার মধ্যে রাষ্ট্রনৈতিক উৎসাহের অঙ্কুরমাত্রও কোনোদিন দেখি নাই ― তিনি তখন একদিকে বেদান্ত অন্যদিকে রোমান ক্যথলিক খৃষ্টানধর্মের মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। কোনোকালেই বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা আমার না থাকাতে উপাধ্যায়ের সহায়তা আমার পক্ষে বিশেষ ফলপ্রদ হইয়াছিল। বিদ্যালয়ের দুই এক বৎসর চলার পর ১৩০৭ শালে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়।

 বঙ্গদর্শন পাঁচ বৎসর চালাইয়া তাহার সম্পাদকতা পরিত্যাগ করিয়াছি। এক্ষণে বিদ্যালয় লইয়া নিযুক্ত আছে।

 উপাধ্যায় ৺মোহিতচন্দ্র সেন মহাশয়ের সহিত আমার আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি আমার বিদ্যালয়ের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবান্ ছিলেন ― কিছুকাল ইহাকে তিনি চালনা করিয়াছিলেন। এই সময় তিনি আমার কাব্যগ্রন্থাবলী বিস্তর পরিশ্রমে Edit করিয়াছিলেন। সেই গ্রন্থে বিষয় ভেদ অনুসারে আমার সমস্ত কবিতাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত করিয়া তিনি প্রকাশ করিয়াছেন।

 আমার জীবন ও রচনার ইতিহাস সংক্ষেপে উপরে লিখিয়া দিলাম। সন তারিখের কোনো ধার ধারিনা। আমার অতি বাল্যকালেই মা মারা গিয়াছিলেন ― তখন বোধহয় আমার বয়স ১১।১২ বৎসর হইবে। তাঁহার মৃত্যুর দুই এক বৎসর পূর্ব্বে আমার পিতা আমাকে সঙ্গে করিয়া অমৃতসর হইয়া ডালহৌসী পর্ব্বতে ভ্রমণ করিতে যান ― সেই আমার বাহিরের জগতের সহিত প্রথম পরিচয়। সেই ভ্রমণটি আমার রচনার মধ্যে নিঃসন্দেহ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। সেই তিন মাস পিতৃদেবের সহিত একত্র সহবাসকালে তাঁহার নিকট হইতে ইংরাজি ও সংস্কৃতভাষা শিক্ষা করিতাম এবং মুখে মুখে জ্যোতিষ শাস্ত্র আলোচনা ও নক্ষত্র পরিচয়ে অনেক সময় কাটিত। এই যে স্কুলের বন্ধন ছিন্ন করিয়া মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে তিনমাস স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়াছিলাম ইহাতেই ফিরিয়া আসিয়া বিদ্যালয়ের সহিত আমার সংস্রব বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। এই শেষ বয়সে বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া তাহার শোধ দিতেছি ― এখন আমার আর পালাইবার পথ নাই ― ছাত্ররাও যাহাতে সর্ব্বদা পালাইবার পথ না খোঁজে সেইদিকেই আমার দৃষ্টি।

ইতি ২৮শে ভাদ্র ১৩০৭

ভবদীয় শ্রীরবীন্দ্রনাথঠাকুর