আনন্দী বাঈ/চতুর্থ অধ্যায়


চতুর্থ অধ্যায়

ষ্টীমারে আরোহণের পর আনন্দী বাঈর ঘোর পরীক্ষা আরব্ধ হইল। তিনি একে প্রিয়জনের বিরহে ও অপরিচিত দেশের দুঃখ কষ্টের কথা স্মরণ করিয়া বিহ্বল হইয়াছিলেন, সমুদ্র-পীড়ায় তাঁহার শরীর নিতান্ত অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছিল, তাহার উপর শ্রীমতী জন্সনের দুর্ব্যবহারে তাহাকে ঘোরতর নিগ্রহভোগ করিতে হইল। শ্রীমতী জন্সন মিশনরি-রমণী, খৃষ্টভক্তি-প্রচারের জন্য স্বামীর সহিত ভারতবর্ষে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টায় এদেশের কত জনের হৃদয় খৃষ্টের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা জানি না; কিন্তু তিনি আনন্দী বাঈকে খৃষ্টীয় ধর্ম্মের দীক্ষা-গ্রহণের জন্য যেরূপ অসীম যন্ত্রণা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা পাঠ করিলে, মিশনরিদিগের প্রতি অভক্তির সঞ্চার হয়। ষ্টীমারে অবস্থানকালে তিনি প্রথমে মিষ্ট উপদেশ, তাহার পর প্রলোভন এবং পরিশেষে তিরস্কার ও ভয়-প্রদর্শন দ্বারা অসহায় আনন্দী বাঈকে স্বধর্ম্মত্যাগ করাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু আনন্দী বাঈ কিছুতেই স্বধর্ম্মত্যাগে স্বীকৃত হন নাই!

 ইহার পর অন্য প্রকার প্রলোভনের ও বিপদের সূত্রপাত হইল। সেই ষ্টীমারের ইঞ্জিনীয়ার সাহেব শ্রীমতী জনের সহায়তায় আনন্দী বাঈকে বিপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। পাপিষ্ঠ তাঁহাকে একাকিনী দেখিলেই নিকটবর্ত্তী হইয়া তাঁহার তোষামোদে প্রবৃত্ত হইত এবং তাঁহাকে নিম্নতলে গিয়া এঞ্জিন প্রভৃতি যন্ত্রাদিদর্শনের জন্য অনুরোধ করিত। আনন্দী বাঈ সাহেবের অসদভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া তাহার প্রার্থনায় অমনযোগ করিলে, শ্রীমতী জন্সন তাহাকে তিরস্কার-পূর্ব্বক ষ্টীমারের যন্ত্রাদি দেখিতে যাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেন। এই কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাঁহাকে একটি সুবর্ণ-নির্ম্মিত বৃহুমূল্য ঘড়ি উপহার দিবার প্রস্তাব করিল; বলিল, “আপনার জ্ঞানলাভ বিষয়ে অধ্যবসায় দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। এই ঘড়িটি আমেরিকায় পাঠাভ্যাস কালে আপনার অনেক উপকারে লাগিবে।” সাধ্বী আনন্দী বাঈ এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করিলেন।

 আনন্দী বাঈকে এইরূপ অদম্য ও অবাধ্য দেখিয়া শ্রীমতী জন্সন তাঁহার প্রতি অতীব অসন্তুষ্ট হইলেন। এই সময় হইতে আনন্দী বাঈর প্রতি তাঁহার বিরাগ অতিশয় বৃদ্ধি পাইল। ষ্টীমারে অবস্থানকালে আনন্দী বাঈ দন্ত-রোগে অত্যন্ত কষ্ট পাইয়াছিলেন। সে অবস্থায় তাঁহাকে কয়েক দিন সম্পূর্ণ অনাহারেই কালযাপন করিতে হইয়াছিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, কঠোর-হৃদয় শ্রীমতী জন্সন রোগের সময়ে একদিনের জন্যও তাঁহার নিকটবর্ত্তিনী হন নাই। ষ্টীমারস্থিত অপর শ্বেতাঙ্গ-মহিলারাও তাঁহারই পন্থানুবর্ত্তিনী হইয়াছিলেন। কেবল তাহাই নহে, দাস-দাসীর প্রতি সাধারণতঃ লোকে যেরূপ ব্যবহার করে, তাঁহারা আনন্দী বাঈর সহিত প্রায় তদ্রূপ ব্যবহার করিতেন। তিনি অখাদ্য-ভক্ষণে অনিচ্ছা-প্রকাশ করিলে তাঁহারা তাহাকে বিদ্রূপ করিয়া লাঞ্ছিত করিতেও বিরত হইতেন না। এমন কি, সময়ে সময়ে তাঁহাদিগের মধ্যে দুই এক জন আনন্দী বাঈর প্রকোষ্ঠ অধিকার-পূর্ব্বক তাঁহাকে ডেকের উপর উন্মুক্ত স্থানে অবস্থিতি করিতেও বাধ্য করিতেন। এইরূপ নানাপ্রকার কষ্ট ও লাঞ্ছনা সহ্য করিয়াও আনন্দী বাঈ যখন তাঁহাদিগের প্রতি কোনও প্রকার অসদ্ভাব প্রকাশ করিলেন না, তখন তাহাদের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সহিত মিত্রতা-স্থাপনে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু শ্রীমতী জন্সনের প্রকৃতির কিছুতেই পরিবর্ত্তন ঘটিল না।

 ষ্টীমারে অবস্থানকালে আনন্দী বাঈ প্রত্যহ ২।৩টি আলু ভিন্ন প্রায় আর কিছু খাইতেন না। এইরূপ ভাবে তিনি ১০ই মে লণ্ডন ও ১৬ই মে লিভারপুলে উপস্থিত হন। তথায় দুই এক দিন অবস্থানের পর তিনি আমেরিকাগামী ষ্টীমারে আরোহণ করিলেন। শ্রীমতী জন্সন তখনও তাঁহাকে পরিত্যাগ করেন নাই। ষ্টীমারখানি আমেরিকার নিকটবর্ত্তী হইলে তিনি আনন্দী বাঈকে বলিলেন, “মিসেস জোসী! তোমার স্বামী তোমাকে আমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন। একারণে তোমার উপর মিসেস কার্পেণ্টারের কোনও অধিকার নাই। আমি তোমাকে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের নিকট রাখিতে পারি।” ইহার পর সেই দুষ্টা আনন্দী বাঈর নিকট শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে অতীব অসচ্চরিত্রা বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। আনন্দী বাঈ ইহাকে অসন্তোষ-প্রকাশ করিলে পাপীয়সী তাহাকে “চোর, দুষ্ট, অসভ্য ও খুনী আসামী” প্রভৃতি নানাপ্রকার কটুবাক্যে ব্যথিত করে। বোষ্টন নগরে তাঁহাকে লইয়া গিয়া খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিতা করিবার জন্য শ্রীমতী জন্সন ইহার পরও চেষ্টা করিতে বিরত হয় নাই। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এই সকল নির্য্যাতনের কথা আনন্দী বাঈ বহুদিন পর্য্যন্ত তাঁহার স্বামীকেও জ্ঞাপন করেন নাই। কেবল তাহাই নহে, অনেক পত্রেই তিনি সাধারণ-ভাবে শ্রীমতী জন্সনের প্রশংসাই করিয়াছেন। আমেরিকায় পৌঁছিবার বহুদিন পরে তিনি একখানি পত্রে প্রসঙ্গক্রমে স্বীয় স্বামীকে এই মর্ম্মে লিখিয়াছিলেন—

 “আজ পর্য্যন্ত যে কথা আপনাকে জ্ঞাপন করি নাই, অদ্য তাহা জানাইতেছি। শ্রীমতী জন্সনের দুর্ব্ব্যবহারের বিষয় অনেক বার আপনাকে বিস্তারিতরূপে জানাইব, মনে করিয়াছিলাম, কয়েকবার লিখিতেও বসিয়াছিলাম; কিন্তু সে কথা লিখিতে আমার এত কষ্ট হয় যে, অনেকবার অর্দ্ধ লিখিত পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি—অশ্রুমোচন করিয়া বহু ক্ষণ পরে চিত্তকে শান্ত করিতে হইয়াছে! তথাপি সে বিষয়ের আভাষ দিবার জন্য সংক্ষেপে দুই একটি কথা লিখিতেছি।” এই পত্রেও তিনি সকল কথা বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করিতে পারেন নাই। বহু প্রকারে নির্য্যাতনভাগিনী হইয়াও ক্ষমাশীলা আনন্দী বাঈ পরনিন্দা-বিষয়ে মূক-স্বভাবা ছিলেন।

 যথাসময়ে আনন্দী বাঈ রোশেলের নিকটবর্ত্তী বন্দরে উপনীত হইলেন। তাঁহার প্রত্যুদ্গমনের জন্য শ্রীমতী কার্পেণ্টার বন্দরে উপস্থিত হইয়াছিলেন। আনন্দী বাঈ ষ্টীমার হইতে অবতীর্ণ হইলে সহজেই উভয়ের সাক্ষাৎকার ঘটে। তাঁহারা তথা হইতে বাস্পীয় শকটযোগে রোশেল অভিমুখে যাত্রা করেন। এই প্রথম সাক্ষাৎকার-কালে আনন্দী বাঈর ব্যবহার দেখিয়া শ্রীমতী কার্পেণ্টার নিম্নলিখিত মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন,—

 আনন্দী বাঈ কখনও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা কহেন না। তিনি নিতান্ত স্বল্পভাষিণীও নহেন। তাঁহার ন্যায় গাম্ভীর্য্য অনেক বর্ষীয়সী রমণীর চরিত্রেও দুর্লভ। এরূপ অল্প বয়সে এতাদৃশ গাম্ভীর্য্য অন্যত্র অসম্ভবপ্রায় বলিয়াই মনে হয়। আনন্দী বাঈর সহিত বন্দরে যখন আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তখন আমি মনে করিয়াছিলাম যে, তিনি অন্যান্য চপল প্রকৃতি বালিকার ন্যায় গাড়ীর জানালা হইতে মুখ বাহির করিয়া চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিবেন; অথবা প্রত্যেক নব দৃষ্ট পদার্থ-সম্বন্ধে নানা প্রকার প্রশ্ন করিয়া আমাকে বিরক্ত করিবেন। কিন্তু তিনি তাহার কিছুই করিলেন না। তিনি অতি গম্ভীরভাবে গাড়ীতে বসিয়াছিলেন। অনেকবার আমার মনে হইত যে, এইবার তিনি আমার প্রশ্ন না করিয়া থাকিতে পারিবেন না। কিন্তু তিনি আমায় কোনও বস্তুর সম্বন্ধে আদৌ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না! তাঁহার বুদ্ধির স্থূলতা বা জিজ্ঞাসা-বৃত্তির অভাব যে ইহার কারণ নহে, তাহা বলাই বাহুল্য। তিনি পরে এ বিষয়ে যে সকল কথা আমায় বলিয়াছিলেন, তাহা হইতে আমি বুঝিলাম যে, তিনি অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রভাবে এই অজ্ঞাত-পূর্ব্ব দেশের অনেক ব্যাপারেরই কার্য্য-কারণ-সম্বন্ধ দৃষ্টিমাত্রেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি অতীব শান্তভাবে সমস্ত বিষয়ই সূক্ষ্মমরূপে পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন। এখানে আসিবার পর নিত্য নূতন পদার্থের ও রীতিনীতির সন্দর্শন করিয়াও তিনি কখনও সেবিষয়ে প্রশ্ন-পূর্ব্বক আমাকে বিরক্ত করেন নাই। তাঁহার ব্যবহারে দোষারোপ করিবার কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহার কার্য্যকুশলতা, একাগ্রতা, সদাচার প্রভৃতি গুণ সকলেরই অনুকরণীয়।”

 আমেরিকায় পৌঁছিয়া আনন্দী বাঈ শ্রীমতী কার্পেণ্টারের সমভিব্যাহারে প্রথমে নিউজারসী নগরে তাহার গৃহে গমন করিলেন। তথায় তাঁহাকে চারি মাস অবস্থিতি করিতে হয়। সেখানে বাসকালে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই কার্পেণ্টার পরিবারভুক্ত সকলেরই প্রীতিভাজন হইয়াছিলেন। বালক বালিকারা মুহূর্ত্তের জন্যও তাহাদিগের এই হিন্দু ভগিনীর সঙ্গ-ত্যাগ করিত না! প্রতিবেশিনীগণও তাঁহার নিতান্ত পক্ষপাতিনী হইয়াছিলেন। বিদেশে গিয়া উপহসিতা হইবার ভয়ে পরকীয় রীতিনীতির অবলম্বন দূরে থাকুক, স্বীয় ব্যবহার গুণে তিনি কার্পেণ্টার পরিবারে নানা বিষয়ে হিন্দু রীতিনীতির প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন। আনন্দী বাঈ কখনও নাম-গ্রহণ পূর্ব্বক শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে আহ্বান করিতেন না। গুরুজনের নামোল্লেখ-সহকারে আহ্বানের রীতি পাশ্চাত্য দেশে সর্ব্বত্র প্রচলিত আছে; এমন কি, তথায় পুত্রও পিতার নামগ্রহণ পূর্ব্বক আহ্বান করিতে সঙ্কোচবোধ করেন না। কিন্তু আনন্দী বাঈর আচরণে শ্রীমতী কার্পেণ্টারের আত্মীয় স্বজনেরা এ বিষয়ে হিন্দু রীতির শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিতে পারিলেন। প্রাতঃকালীন “শ্যেক্‌হ্যাণ্ডের পরিবর্ত্তে নমস্কার ও আশীর্ব্বাদ করিবার প্রথাও তাঁহারা গ্রহণ করিলেন। আনন্দী বাঈ কার্পেণ্টার পরিবারে “হেলেনা,” “সুবার্ট” এবং “এ্যামি” প্রভৃতি নামের পরিবর্তে “তারা”, “সগুণা,” ও “প্রমীলা” নামের প্রবর্ত্তন করেন। তিনি তাঁহার অনেক সঙ্গিনীকেই ভারতবর্ষীয় শাড়ীর পক্ষপাতিনী করিয়াছিলেন। কেবল তাহাই নহে, তাহাদিগের অনেকেই মহারাষ্ট্রীয় রীতিক্রমে বেণীযুক্ত কবরীবন্ধন ও সীমন্তদেশে সিন্দূর-ধারণে সমধিক অনুরাগ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। শ্রীমতী কার্পেণ্টারের গৃহে শাড়ীর মাহাত্ম্য এতদূর বর্দ্ধিত হইয়াছিল যে, বালক-বালিকারা তাহাদের পুতুলগুলিকেও শাড়ী না পরাইয়া তৃপ্তিলাভ করিত না।

 আনন্দী বাঈর ভারতবর্ষ-পরিত্যাগের পর গোপাল রাও একটি পত্রে তাঁহাকে, প্রয়োজন হইলে বৈদেশিক বেশভূষা ও মাংসাহার করিবারও অনুমতি দান করিয়াছিলেন। কিন্তু আনন্দী বাঈর স্বদেশীয় আচার ব্যবহারের প্রতি এরূপ প্রগাঢ় প্রীতি ছিল যে, তিনি আমেরিকার ন্যায় শীত-প্রধান দেশে অবস্থান-কালেও কখনও আমিষ স্পর্শ করেন নাই। সুস্থাবস্থায় তিনি সর্ব্বদা স্বহস্তে “ডাল রুটি” প্রস্তুত করিয়া ভোজন করিতেন। ঐ প্রদেশের শৈত্যাধিক্য-বশতঃ তাঁহাকে পোষাক পরিচ্ছদে সামান্য পরিবর্ত্তন করিতে হইয়াছিল। মহারাষ্ট্রীয় রীতিক্রমে শাটী পরিধান করিলে পদযুগলের নিম্নভাগ কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত থাকে বলিয়া তিনি গুজরাটী ধরণে শাটী পরিতেন। কিন্তু স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তনের জন্য অর্ণবপোতে আরোহণ করিবামাত্র তিনি পুনর্ব্বার মহারাষ্ট্রীয় ধরণে শাড়ী পরিতে বিলম্ব করেন নাই। স্বদেশীয় পরিচ্ছদের জন্য তাঁহাকে ইংলণ্ড, আয়ার্লণ্ড ও আমেরিকায় কয়েকবার দুষ্ট জনের হস্তে নিগ্রহভোগও করিতে হইয়াছিল। যাঁহারা পাশ্চাত্য সমাজের নিকট উপহাস-ভাজন হইতে হইবে বলিয়া প্রবাস-কালে ইউরোপীয় রীতিনীতির অনুবর্ত্তন করেন, স্বদেশে আসিয়া অভ্যাস-দোষের দোহাই দিয়া প্রচণ্ড গ্রীষ্মের সময়েও সাহেবী খানায় অনুরাগ-প্রকাশ ও উষ্ণ পরিচ্ছদে দেহকে আবৃত করিয়া সাহেবীয়ানার মর্য্যাদা রক্ষা করেন, তাঁহারা একবার আনন্দী বাঈর দৃষ্টান্ত স্মরণ করিলে সুখের বিষয় হয়।

 আমেরিকায় অবস্থিতিকালে একদিনের জন্যও কোন বিষয়ে তাঁহার অজ্ঞতা প্রকাশ পায় নাই, কেহই তাহাকে “আনাড়ী” বলিয়া ভাবিবার অবসর পায় নাই। তিনি তীক্ষ্ণবুদ্ধিবলে দুই একদিনের মধ্যেই পাশ্চাত্য গৃহকর্ম্মে যথোচিত অভিজ্ঞতালাভ করিয়াছিলেন। শ্রীমতী কার্পেণ্টারের গৃহে রন্ধন ভিন্ন তিনি যাবতীয় কার্য্যেই গৃহস্থদিগকে সহায়তা করিতেন। বাল্যবিধি তাঁহার ক্রীড়ানুরাগ প্রবল ছিল। একবারমাত্র দেখিয়া তিনি তত্রত্য বালক-বালিকাগণের ক্রীড়া-পদ্ধতি এরূপ আয়ত্ত করিয়াছিলেন যে, তাঁহার খেলিবার পর্য্যায় উপস্থিত হইলে তিনি প্রথমবারেই সকলের অগ্রস্থান অধিকার করিলেন! সঙ্গীতবিদ্যাও তাঁহার নিতান্ত অপরিচিত ছিল না! যাঁহারা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন, তিনি অনেক সময়ে তাঁহাদিগকে ব্রহ্মজ্ঞান ও ভক্তি বিষয়ক মহারাষ্ট্রীয় সঙ্গীত শ্রবণ করাইয়া পরিতৃপ্ত করিতেন। সকলেই তাঁহার সঙ্গীত শ্রবণ করিয়া তাহার ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিত। কিন্তু সেই প্রশংসাবাদ শ্রবণ করিয়া আনন্দী বাঈ কখনও গর্ব্বে স্ফীত হন নাই; এমন কি, তজ্জন্য আত্মপ্রসাদের কোন লক্ষণ কখনও তাঁহার বদনমণ্ডলে প্রকাশ পাইত না।

 কণ্ঠস্বরের ন্যায় তাঁহার সৌন্দর্য্যও আমেরিকাবাসীর প্রশংসা আকর্ষণ করিয়াছিল। শ্রীমতী কার্পেণ্টার লিখিয়াছেন,—“আনন্দী বাঈ স্বদেশীয় বেশভূষায় সজ্জিত হইলে, তাঁহার লাবণ্যচ্ছটায় আমার নেত্র উদ্ভাসিত হইয়া যায়। মনে হয়, যেন দেবলোক হইতে কোন সুরসুন্দরী ধরাতলে অবতীর্ণা হইয়াছেন।” আনন্দী বাঈর রূপ যে অনিন্দ্য সুন্দর ছিল, তাহা নহে; কিন্তু তাঁহার দিব্য-জ্যোতিঃ সকলকেই বিস্ময়ে আপ্লুত করিত। তাঁহার বিবিধ অবস্থার আলোেক-চিত্র (ফটোগ্রাফ) দর্শন করিলে অনেক সময়ে তাঁহাকে কামরূপধারিণী বলিয়াই সন্দেহ জন্মে। চিত্রের প্রতি বিশেষ অনুরাগ-বশতঃ তিনি আমেরিকায় আপনার বহুসংখ্যক ফটোগ্রাফ তুলাইয়াছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাঁহার প্রত্যেক চিত্রেই তদীয় বিভিন্ন মূর্ত্তি প্রকাশমান। এমন কি, তাঁহার কোন দুইখানি ফটোগ্রাফ একরূপ নহে। তাঁহার একই দিবসে অঙ্কিত দুই খানি আলোকচিত্রেও তাঁহার রূপের এতদূর বিভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয় যে, কোনও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিই সে দুইটিকে এক ব্যক্তির চিত্র বলিয়া সহজে বিশ্বাস করিতে পারেন না। তাঁহার এই নিত্য-পরিবর্ত্তনশীল সৌন্দর্যভঙ্গীর জন্যই বোধ হয় তিনি শ্রীমতী কার্পেণ্টারের চক্ষে দেবকন্যার ন্যায় প্রতিভাত হইয়াছিলেন। তাঁহার সদানন্দ ভাবও ইহার অন্যতম কারণ বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। কি পাঠাভ্যাসের সময়ে, কি গৃহস্থালীর কার্য্যে, সব বিষয়েই তাঁহার সদা-প্রফুল্ল-ভাব দেখিয়া শ্রীমতী কার্পেণ্টার এতদূর মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, তিনি তাহাকে “আনন্দ-নির্ঝরিণী” আখ্যা প্রদান করিয়াছিলেন।

 কিন্তু এই দেব-কন্যা-রূপিণী আনন্দ-নির্ঝরিণীও সময়ে সময়ে শোকের আবিল তরঙ্গে বিক্ষোভিত হইত। ভারতবর্ষের ডাক আসিবার সময় নিকটবর্ত্তী হইলে অথবা গোপাল রাওয়ের পত্র পাইতে বিলম্ব ঘটিলে আনন্দী বাঈর মুখে উদ্বেগ ও উদাসীনতার ছায়া পরিদৃষ্ট হইত। তিনি একটী পত্রে গোপাল রাওকে লিখিয়াছেন,—“অন্য কার্য্যে লিপ্ত থাকিলেও একটী বিষয়েই আমার মন সর্ব্বদা সংযুক্ত থাকে। আপনার চিন্তায় (ধ্যানে) আমি অধিকাংশ সময় আনন্দ উল্লাসে যাপন করি; কিন্তু যখন আমাদের উভয়ের মধ্যগত দূরত্বের বিষয় মনে উদিত হয়, তখন হৃদয়-নৈরাশ্যসাগরে মগ্ন হইয়া যায়। আমি যথাসাধ্য নিজের মনোভাব গোপন করিবার চেষ্টা করি, তথাপি মুখে বিষাদের ভাষা প্রকাশিত হইয়া পড়ে বলিয়া আমার মনে হয়। প্রথমে প্রথমে আমার রোদনোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পাইত, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক এপর্য্যন্ত কাহাকেও আমার অশ্রু দেখিতে দিই নাই। এখন আর প্রায় চক্ষে জল আসে না, দুঃখবেগ অসহ্য হইলে কেবল জিহ্বা ও কণ্ঠ শুষ্ক হয়, হৃদয় অব্যক্ত যন্ত্রণার ভারে মথিত হইয়া যায়। কিন্তু পাছে কেহ জানিতে পারে, এই ভয়ে আমি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া হৃদয়ের ভার লঘু করিবার অবসর সকল সময়ে পাই না।” এরূপ মর্ম্মান্তিক যন্ত্রণা সহ্য করিয়াও আনন্দী বাঈ শ্রীমতী কার্পেণ্টারের নিকট আনন্দ-নির্ঝরিণী-রূপে প্রতীয়মান হইয়াছিলেন, ইহা কি সামান্য ধৈর্যশীলতার পরিচায়ক?

 আনন্দী বাঈর আমেরিকায় বসতি-কালে এই দেশ হইতে কয়েকজন ভদ্রসন্তান বিদ্যা-শিক্ষার্থ তথায় গমন করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে, আনন্দী বাঈর পত্রে কেবল শ্রীযুক্ত বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের প্রশংসা দেখিতে পাওয়া যায়। অপর কয়েকজনের সম্বন্ধে তিনি পুণার কোন বান্ধবীকে লিখিয়াছিলেন—“আমেরিকায় আগমন করিলে যে ভারতবাসীর দায়িত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, একথা ইঁহাদের অনেকে বুঝেন না। এখানে আসিলে স্বর্গ হাতে পাইয়াছেন বলিয়া অনেকে মনে করেন এবং স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হন। সংখ্যায় কম হইলেও ইঁহাদিগের আচরণ দেখিয়াই আমেরিকার লোকেরা সমগ্র ভারতবাসীর স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে নানা প্রকার সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন। এই কারণে, অন্ততঃ জনক-জননীর ও স্বদেশের সুনামের জন্যও ইঁহাদিগের এদেশে অবস্থানকালে সদাচরণে অনুরাগ প্রকাশ কর্ত্তব্য। ইঁহাদিগের মধ্যে দুই একজন আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। তন্মধ্যে একজন আমাকে থিয়েটার দেখাইতে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করিলেন। আমি তাঁহার প্রস্তাবে ঘৃণা ও উপেক্ষা প্রকাশ করিলাম। ইনি বোধ হয় ভাবেন যে, তাঁহার ন্যায় সকলেই শিক্ষা-ব্যপদেশে বিলাস-বাসনা-চরিতার্থ করিবার জন্য এদেশে আসিয়াছে। ইঁহার ন্যায় কয়েক জনের ব্যবহারে মার্কিনবাসীর চক্ষে ভারতবাসীর মর্য্যাদা লাঘব হইয়াছে দেখিয়া বড় দুঃখিত হইয়াছি। একেই ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এদেশের লোকের নানাপ্রকার কুসংস্কার আছে; তাহার উপর আবার, খৃষ্টীয় “ভট্টাচার্য্যগণের” অনুগ্রহে তাহা অধিকতর ঘনীভূত হইয়া থাকে। এরূপ অবস্থায় এদেশে বাসকালে সতর্কতার সহিত সদাচরণ না করিলে ভারত-মাতার মর্য্যাদার হানি ঘটিবে, এ কথা প্রত্যেক ভারতবাসীর স্মরণ রাখা উচিত।”

 আমেরিকায় উপস্থিত হইবার পর আনন্দী বাঈ ফিলাডেলফিয়া ও নিউইয়র্ক হইতে শিক্ষালাভের জন্য আহূত হন। ফিলাডেলফিয়ার ওল্ড স্কুল নামক বিদ্যালয়ে চিকিৎসা-পারদর্শিনী রমণীগণের দ্বারা শিক্ষাদান কার্য্য সমাহিত হইয়া থাকে বলিয়া সেখানে গমন করাই আনন্দী বাঈ সঙ্গত মনে করিলেন। প্রথমে তথায় এক বৎসর কাল শিক্ষালাভ করিয়া পরে তাঁহার নিউইয়র্ক গমনপূর্ব্বক হোমিওপ্যাথি শিক্ষা করিবার সংকল্প ছিল, কিন্তু পরে সে সংকল্প তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে হয়। এদিকে ফিলাডেলফিয়ার স্কুলের প্রধান অধ্যাপিকা কুমারী বড্‌লে মহোদয়ী পুনঃ পুনঃ আনন্দী বাঈকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। তিনি তাঁহাকে তিন বৎসর শিক্ষার জন্য ছয় শত ডলার বৃত্তি-দানেরও অঙ্গীকার করিলেন। ঐ কলেজের নিয়মানুসারে বিংশ হইতে ত্রিংশবর্ষীয়া ছাত্রীরাই বৃত্তিলাভের অধিকারিণী হইয়া থাকে। আনন্দী বাঈ ইহা অবগত হইয়াও আপনার বয়স গোপন করেন নাই। তিনি যে অল্প দিনমাত্র অষ্টাদশ বর্ষে পদার্পণ করিয়াছেন, এ কথা তিনি কুমারী বড্‌লেকে স্পষ্টাক্ষরেই জানাইয়াছিলেন। তথাপি কুমারী বড্‌লে তাহাকে বৃত্তি দান করিতে প্রতিশ্রুত হন। বোষ্টন কলেজেও তিনি নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন; কিন্তু ফিলাডেলফিয়ার কলেজ সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ এবং তথায় সার্জ্জরি বা অস্ত্রচিকিৎসা শিক্ষার বিশেষ সুবিধা ছিল, এই কারণে আনন্দী বাঈ সেইখানে গমনেই কৃতসংকল্প হইলেন।

 নিউজারসী পরিত্যাগের পূর্ব্বে আনন্দী বাঈ তাঁহার আমেরিকান্‌ সঙ্গিনীদিগকে একদিন মারাঠী ধরণের ভোজ দিলেন। আঠারটি মার্কিন মহিলা সে দিন মহারাষ্ট্রীয় বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া চেয়ার, টেবিল ও কাঁটা চামচ পরিত্যাগ-পূর্ব্বক সম্পূর্ণ হিন্দুরীতিক্রমে ভোজন করিয়াছিলেন।

 সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া ১৮৮৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তারিখে আনন্দী বাঈ শ্রীমতী কার্পেণ্টারের সহিত ফিলাডেলফিয়া অভিমুখে যাত্রা করিলেন, এবং সেই দিনই সন্ধ্যাকালে তথায় উপস্থিত হইলেন। পরদিন কলেজকর্ত্তৃপক্ষ বিশেষ সমারোহসহকারে আনন্দী বাঈকে কলেজে ভর্তি করিয়া লইলেন। আনন্দী বাঈর অভিনন্দনের জন্য সে দিন পঞ্চশত মহিলা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উপস্থিত হইয়াছিলেন। শ্রীমতী কার্পেণ্টার সেদিনকার সমারোহের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন,—“এতগুলি রত্নালঙ্কারমণ্ডিত মহিলা সেদিন সমাবেত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কেহই সৌজন্যে আনন্দী বাঈর সমকক্ষ ছিলেন না।” সে যাহা হউক, কলেজের নিকটেই আনন্দী বাঈর জন্য একটি ঘর ভাড়া করা হইয়াছিল। শ্রীমতী কার্পেণ্টার তাঁহাকে তথায় রাখিয়া দুই একদিন পরে স্বগ্রামে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। ভারতবর্ষ পরিত্যাগের সময় আনন্দী বাঈর মনে যেরূপ কষ্ট হইয়াছিল, শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে বিদায় দিবার সময়েও তিনি সেইরূপ মনঃকষ্ট ভোগ করিয়াছিলেন। ৯।১০ দিন পর্যন্ত তাঁহার নিকট পানাহারাদি কিছুই সুখকর বোধ হয় নাই। ফলতঃ যাঁহার মাতৃতুল্য যত্নে তিনি চারি মাসকাল নিউজারসী নগরে বাস করিয়া একদিনের জন্যও বিদেশের দুঃখ বুঝিতে পারেন নাই, তাঁহার বিচ্ছেদ এরূপ দুঃসহ হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। শ্রীমতী কার্পেণ্টারের ন্যায় রমণী-রত্ন সকল দেশেই বিরল।

 ফিলাডেলফিয়ায় গিয়া অল্প দিনের মধ্যেই আনন্দী বাঈর স্বাস্থ্য-ভঙ্গ হইল; তিনি প্রত্যহ ১০।১১ ঘণ্টা পাঠাভ্যাস করিতেন। তদ্ভিন্ন সমস্ত গৃহ-কার্য্যও একাকিনী তাঁহাকেই করিতে হইত। তাঁহার বাসগৃহটি তাদৃশ স্বাস্থ্যকর ছিল না। চুল্লীর দোষে সকল দিন শীঘ্র আগুন ধরিত না। কাজেই কোনও কোনও দিন অনাহারে, কোনও দিন বা অর্ধসিদ্ধ অন্ন-ভোজন-পূর্ব্বক তাঁহাকে কলেজে যাইতে হইত। এই সকল কারণে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁহার স্বাস্থ্যহানি ঘটিল। আমেরিকায় জলবায়ুর ও শীতোষ্ণাদির এত ঘন ঘন পরিবর্ত্তন হইয়া থাকে যে, সর্বদা সাবধান না থাকিলে সুস্থ ব্যক্তিকেও সহসা পীড়িত হইতে হয়। এক একদিন তথায় গ্রীষ্মাধিক্যে ৪।৫ শত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। আবার তৎপর দিবসেই তুষার-শীতল সমীরণে অনেকেরই স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এরূপ অবস্থায় আনন্দী বাঈকে যেরূপ কষ্টে দিনপাত করতে হইত, তাহাতে তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ না হওয়াই বিচিত্র ছিল।

 ফেব্রুয়ারি মাসের প্রারম্ভে আনন্দী বাঈ “ডিপ্‌থিরীয়া” রোগে আক্রান্ত হইলেন। কণ্ঠনালীতে স্ফোটক হওয়ায় তাঁহার অসহ্য যন্ত্রণা-বোধ হইতে লাগিল। তাহার উপর জ্বর ও শিরঃপীড়া। সুতরাং দুই এক দিনের মধ্যেই তিনি নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িলেন। সে যাত্রা তাঁহার বাঁচিবার আদৌ আশা ছিল না। কিন্তু তাঁহার সহপাঠিকাগণের যত্নে ও শুশ্রূষায় তিনি বহু কষ্টে আরোগ্য লাভ করিলেন। এই সময়ে তিনি গোপাল রাওয়ের ও শ্রীমতী কার্পেণ্টারের নিকট হইতে যে সকল আশ্বাসপূর্ণ পত্র পাইয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার মানসিক কষ্টের বহু উপশম হইয়াছিল।

 ফিলাডেলফিয়ায় গমনের পর পীড়া ভিন্ন আরও নানা প্রকারে তাঁহাকে কষ্টভোগ করিতে হইয়াছিল। পূর্বোক্ত কঠিন পীড়া হইতে আরোগ্যলাভের পর তিনি এরূপ দুর্ব্বল হইয়া পড়েন যে, বহুদিন পর্যন্ত তাঁহাকে স্কুলের বোর্ডিং গৃহে গিয়া নিরামিষ ভোজন করিতে হয়। এই ভোজনালয় কলেজের প্রধান অধ্যাপিকা মিস্ বড্‌লের তত্ত্বাবধানে ছিল। তাঁহার ব্যবস্থাদোষে ভোজনপ্রার্থিনীদিগের নানা প্রকার কষ্ট ও অসুবিধা হইত। ছাত্রীদিগের সুবিধা অসুবিধার প্রতি তিনি প্রায়ই দৃষ্টি রাখিতেন না। সেই ভোজনালয়ের কদন্ন ভক্ষণ করায় আনন্দী বাঈ কিছুতেই শীঘ্র স্বাস্থ্যলাভ করিতে পারিলেন না। তদ্ভিন্ন মিস বড্‌লের হস্তে তাঁহাকে অন্য প্রকারেও নিগৃহীত হইতে হইয়াছিল। তাঁহাকে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করিবার জন্য এই অধ্যাপিকা অনেক যত্ন করিয়াছিলেন। কিন্তু তদ্বিষয়ে বিফলকাম হওয়ায় আনন্দী বাঈর প্রতি তিনি নানা প্রকারে বিরাগ-প্রকাশ করিতে লাগিলেন। সেজন্য সময়ে সময়ে আনন্দী বাঈকে উপবাসেও দিনপাত করিতে হইয়াছিল।

 এই সকল কষ্ট সহ্য করিয়াও আনন্দী বাঈ প্রাণপণে কলেজের শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ আয়ত্ত করিতে লাগিলেন। এই সময়ে ভারতবর্ষ হইতে কোনও নরপশু তাঁহাকে অতি কুৎসিৎ ভাষায় এক পত্র লিখিয়া মর্ম্মপীড়া প্রদান করে। ঐ পত্র পাঠ করিয়া আনন্দী বাঈ এরূপ মর্ম্মাহত হইয়াছিলেন যে, দশ দিন পর্য্যন্ত আহার ও নিদ্রায় তিনি কোনরূপ সুখশান্তি লাভ করিতে পারেন নাই। পরিশেষে একদিন তিনি স্বপ্নে দেখিলেন যে, একটী দিব্যরূপধারিণী রমণী আসিয়া তাঁহাকে এই পত্রের জন্য দুঃখবোধ করিতে নিষেধ-পূর্ব্বক সান্ত্বনা প্রদান করিতেছেন। তদবধি তাঁহার বিষণ্ণতা দূরীভূত হইল।

 এই সকল পাপের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইতে না পাইতে গোপাল রাও তাঁহার প্রতি বিরূপ হইলেন। প্রথমে আনন্দী বাঈ স্বামীকে প্রতি সপ্তাহে যথা নিয়মে বিস্তারিত পত্র লিখিতেন। ফিলাডেলফিয়ায় গমনের পর হইতে অবসরের অভাবে স্বামীকে পত্র লিখিতে তাঁহার প্রায়ই বিলম্ব ঘটিত। তদ্ভিন্ন গোপাল রাও কখনও তাহাকে প্রতি সপ্তাহে একখানি করিয়া কার্ড লিখিতে বলিতেন; আবার কখনও বলিতেন,—“মাসে চারিবার সংক্ষিপ্ত পত্র না লিখিয়া একবার বিস্তারিত পত্র লিখিও।” এইরূপ ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার মতের পরিবর্তন হওয়ায় কি করিলে তাঁহার সন্তোষ জন্মিবে, আনন্দী বাঈ তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেন না। কাজেই পত্র-সংক্রান্ত গোলযোগ ক্রমে বাড়িতে লাগিল। ইহাতে গোপাল রাও প্রথমে ভাবিলেন যে, আনন্দী বাঈর আলস্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। পরে তাহার মনে হইতে লাগিল, অহঙ্কার-বশে তাঁহাকে পত্র লিখিতে তিনি ঔদাস্য প্রকাশ করিতেছেন। তদ্ভিন্ন আনন্দী বাঈ গুজরাথী বেশ-গ্রহণের পূর্ব্বে গোপাল রাওয়ের অনুমতি গ্রহণ করেন নাই বলিয়াও তিনি তাঁহার প্রতি অতীব বিরক্ত হইলেন। বলা বাহুল্য, আনন্দী বাঈর সেরূপ অনুমতি লইবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কারণ, গোপাল রাও নিজেই তাঁহাকে ইতঃপূর্বে প্রয়োজন হইলে পাশ্চাত্য পরিচ্ছদ-ধারণ ও “আমিষ পর্য্যন্ত ভোজন করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন। কিন্তু এ সময়ে তাঁহার সে কথা মনে রহিল না। তিনি ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জানুয়ারী আনন্দী বাঈকে ‘গর্ব্বিতা’ ও ‘অবাধ্য’ বলিয়া অতি কঠোর তিরস্কার-পূর্ণ এক পত্র লিখিলেন। কিন্তু গোপাল রাওয়ের নিষ্ঠুরতার এই খানেই শেষ হয় নাই। তিনি একটি পত্রে তাঁহাকে “বিশ্বাসঘাতিনী” পর্য্যন্ত বলিতে কুণ্ঠিত হন নাই। গোপাল রাও বলেন, আনন্দী বাঈর চরিত্র লক্ষ্য করিয়া তিনি এই কঠোর শব্দের ব্যবহার করেন নাই। তাঁহার পাঠাভ্যাসে অমনোযোগিতাই গোপাল রাওয়ের নিকট “বিশ্বাসঘাতকতা” বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। কিন্তু এই সকল পত্র পাঠ করিয়া আনন্দী বাঈর মর্ম্মপীড়ার অবধি রহিল না। সুখের বিষয়, ইহার পর সহধর্ম্মিণীর ক্ষমা-প্রার্থনা ও ক্ষোভপূর্ণ পত্র পাঠ করিয়া গোপাল রাওয়ের পূর্বভাব দূরীভূত হইল। জ্ঞানলাভ-বিষয়ে উৎসাহিত করিবার জন্য তিনি ইহার পর তাঁহাকে “সরস্বতী” নামে অভিহিত করিতে লাগিলেন। অব্যবস্থিতচিত্ত ব্যক্তিমাত্রই এইরূপেই ক্ষণে রুষ্ট ও ক্ষণে তুষ্ট হইয়া থাকেন।

 বাল্যকালে আনন্দী বাঈর উদ্যানরচনার প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল, একথা ইতঃপূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে। এতদিন পর্য্যন্ত তিনি উদ্যানসম্বন্ধে চৰ্চ্চা করিবার অবসর প্রাপ্ত হন নাই। ফিলাডেলফিয়ায় আসিয়া তিনি সে বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্রের অধ্যয়ন করিয়া তিনি যে সামান্য অবকাশ পাইতেন, তাহা উদ্ভিদ্‌-বিদ্যার (বোটানির) আলোচনায় অতিবাহিত করিতেন। বনপুষ্পাদি-সংগ্রহপূর্ব্বক তাহাদিগের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় তাঁহার বহু সময় অতিবাহিত হইত। তিনি জর্ম্মান ও ফরাসী ভাষার অনুশীলনও আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু সময়াভাবে পরিশেষে তাহাকে সে অধ্যবসায় পরিত্যাগ করিতে হয়। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি তাঁহার যে অনুরাগ ছিল, বিদেশে গিয়াও তাহার লাঘব হয় নাই। গোপাল রাও তাঁহাকে সময়ে সময়ে এদেশ হইতে সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠাইয়া দিতেন।

 একখানি পত্রে আনন্দী বাঈ একবার ভারতবর্ষ হইতে শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে পত্র লিখিয়াছিলেন যে, “ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মার্কিনবাসীরা নিতান্ত অজ্ঞ। হিন্দুশাস্ত্রের ও হিন্দু আচারব্যবহারের মর্ম্ম মার্কিনবাসীকে বুঝাইবার জন্যই আমি সংস্কৃত শাস্ত্রের অধ্যয়ন করিতেছি।” ফিলাডেলফিয়ায় গিয়া আনন্দী বাঈ সে প্রতিজ্ঞার পূরণ করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষ হইতে প্রত্যাগত মিশনারী রমণীগণ হিন্দুদিগের সম্বন্ধে যদৃচ্ছা মতামত প্রকাশ করিলে তিনি প্রায়ই তাঁহাদিগের ভ্রান্তি-খণ্ডন করিবার সুযোগ পরিত্যাগ করিতেন না। একবার হিন্দু-বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে কোনও বক্তৃতাকারিণীর মতের প্রতিবাদ করিয়া তিনি একটি স্ত্রীসভায় জয়লাভ করেন এবং সে জন্য দশ ডলার পুরস্কার প্রাপ্ত হন। সেই সভায় প্রায় দুই সহস্র রমণী সেদিন উপস্থিত ছিলেন। “হিন্দু রমণী” সম্বন্ধেও তিনি একবার বক্ততা করিয়া মার্কিনবাসীর কুসংস্কার দূর করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণের জন্য সকলেই আগ্রহ প্রকাশ করিতেন। কিন্তু অবসরের অভাবে আনন্দী বাঈকে অনেক স্থলেই বক্তৃতার নিমন্ত্রণে প্রত্যাখ্যান করিতে হইত। তথাপি কি প্রকারে মার্কিনবাসীর চক্ষে ভারতবর্ষের গৌরব বৃদ্ধি পাইবে, তাহার চিন্তাই আনন্দী বাঈর চিত্তক্ষেত্রকে সম্পূর্ণরূপে অধিকার করিয়া রাখিত।

 একবার তিনি একখানি পত্রে তাঁহার জনৈক আত্মীয়কে নিম্নলিখিত কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন,—“আমাদিগের জাতীয় পতাকা কি?.. তাহার বর্ণ ও আকৃতি কি প্রকার? মহারাজ শিবাজীর বিজয়পতাকা কিরূপ ছিল? মহারাষ্ট্রীয় হইয়া একথা না জানা লজ্জার বিষয় বটে। প্রসিদ্ধ গৈরিক পতাকাই কি তাঁহার বিজয়ের পতাকা ছিল? বর্ত্তমান দেশীয় রাজন্যবৃন্দই বা কি প্রকার নিশান ব্যবহার করিয়া থাকেন? অনুগ্রহপূর্ব্বক আমাকে এ সকল তত্ত্ব জানাইবেন। যদি পারেন, তাহাদের চিত্র বা অনুকৃতি পাঠাইবেন। তাহা হইলে এখানে কলেজের সহপাঠিকাদিগকে এবং অধ্যাপিকা ও মাসিমাকে (শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে) এক একটী প্রতিলিপি বা প্রতিকৃতি প্রদান করিব। এবং নিজের কাছে আসল নিশানগুলি রাখিব”।

 আজকাল কয় জনের মনে এ সকল তত্ত্ব জানিবার জন্য আগ্রহ দেখিতে পাওয়া যায়?