আনন্দী বাঈ/প্রথম অধ্যায়

প্রথম অধ্যায়

শ্রীমতী আনন্দী বাঈ জোশী ১৮৬৫ খৃঃ ৩১ শে মার্চ (১৮৮৭ শকাব্দের চৈত্র শুক্লা নবমী) দিবসে পুণা নগরীতে স্বীয় মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা গণপৎ রাও অমৃতেশ্বর জোশীর সাংসারিক অবস্থা হীন ছিল না। বোম্বাইয়ের নিকটবর্ত্তী কল্যাণ নামক প্রদেশে গণপৎ রাওয়ের কিছু পৈতৃক ভূসম্পত্তি ছিল। তিনি ধর্ম্মনিষ্ঠ, শান্ত প্রকৃতি ও অতীব অমায়িক ছিলেন। তাঁহার প্রথমা পত্নী, দামু রাও নামক একটি পুত্রের জন্মদানের পর ইহলোক-পরিত্যাগ করিলে গণপৎ রাও দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করেন। তাঁহার দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভে একটি পুত্র ও তিনটি কন্যা জন্মে। কন্যা তিনটির মধ্যে আনন্দী বাঈ দ্বিতীয়। পিতা মাতা বাল্যকালে তাঁহার “যমুনা বাঈ” এই নামকরণ করিয়াছিলেন। বিবাহের পর মহারাষ্ট্রীয় রীতিক্রমে তাঁহার নামান্তর ঘটে। তদবধি তিনি আনন্দী বাঈ নামে পরিচিত হন।

 তৃতীয় মাসে পদার্পণ করিবার পর যমুনা জননীর সহিত পিত্রালয়ে আগমন করে। বালিকার ঈষৎ গৌরকান্তি, রক্তবর্ণ গণ্ডস্থল ও কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশদাম, সদা-প্রফুল্ল ভাব ও পরিচ্ছন্নতাদি দর্শনে সকলেই মুগ্ধ হইত। খেলায় তাহার সমকক্ষ কেহ ছিল না। পঞ্চম বর্ষ বয়সে তাহার বসন্ত রোগ হয়। সে যাত্রা যমুনা বহু কষ্টে রক্ষা পায়। তদবধি তাঁহার কান্তি ঈষৎ শ্যামভাব ধারণ করিল এবং তাঁহার শ্রবণশক্তির হ্রাস হইল।

 ছয় সাত বৎসর বয়ঃক্রমকালে যমুনা একবার স্বীয় গৃহের সম্মুখে একটি পাদরিকে বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছিল। তদবধি সে স্বীয় সঙ্গিনীদিগকে একত্র করিয়া তাহাদিগের সমক্ষে প্রায়ই পাদরি সাহেবের অনুকরণে বক্তৃতা করিত। বলা বাহুল্য, তাহার বক্তৃতায় বক্তব্য বিষয় কিছুই থাকিত না। তথাপি তাহার বক্তৃতায় হাব-ভাব, আবেগ ও পাদরির অবিকল অনুকরণ দেখিয়া সকলকেই বিস্মিত হইতে হইত। জননী তাহাকে “পাদরিণী” বলিয়া বিদ্রূপ ও তিরস্কার করিলে, সে কিয়ৎকালের জন্য বক্তৃতায় আগ্রহ পরিত্যাগ করিত।

 বাল্যকালে বালিকারা সাধারণতঃ গার্হস্থ্য ধর্মের অনুকরণে পুতুল খেলায় বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করে। কিন্তু যমুনা পুতুল খেলিতে ভালবাসিত না। যে সকল খেলায় লম্ফ ঝম্প ও দৌড়াদৌড়ি বেশী, সে সকলের প্রতি তাহার বিশেষ প্রীতি প্রকাশ পাইত। তদ্ভিন্ন ঠাকুর পূজা করা, খেলাঘর তৈয়ার করা ও বাগান করা প্রভৃতি কার্যে তাহার আন্তরিক অনুরাগ ছিল। বাগানে শাক শব্‌জী ও ফুলের গাছ রোপণ করা তাহার নিত্যকর্ম্ম ছিল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। প্রায় প্রত্যহ তাহার রোপিত গাছগুলি গরু বাছুরে চরিয়া খাইত। যমুনা পুনঃ পুনঃ তাহা রোপণ করিয়া অধ্যবসায়ের একশেষ প্রদর্শন করিত।

 যমুনার জননী অতীব কোপন-স্বভাবা ছিলেন। তাঁহার ক্রোধ হইলে, গণপৎ রাওকেও একটু ভীত হইতে হইত। বেচারী যমুনা তাঁহার হস্তে প্রায়ই বিষম দণ্ডভোগ করিত। নিকটে প্রস্তর খণ্ড, অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ প্রভৃতি যাহা পাইতেন, তাহারই প্রহারে তিনি যমুনাকে জর্জ্জরিত করিতেন। একদা পাঠশালায় যাইবার নাম করিয়া যমুনা কোনও প্রতিবেশিনীর গৃহে গিয়া খেলা করিতেছিল। যমুনার জননী সেই অপরাধে তাহাকে পদাঘাত করিতে করিতে গৃহে আনয়ন করেন। তাঁহার প্রহারে বালিকা সময়ে সময়ে জ্ঞানশূন্যা হইত। যমুনাও নিতান্ত অল্প দৌরাত্ম্য করিত না। এই কারণে প্রতিবেশিনীরাও তাহাকে তিরস্কার করিতে বিরত হইত না। কিন্তু যমুনা এই সকল কঠোর শাসন অতি ধীরভাবে সহ্য করিত। সে কেবল পিতা ও মাতামহীর নিতান্ত প্রিয়পাত্রী ছিল।

 সপ্তম বর্ষ বয়সে যমুনাকে পাঠশালায় ভর্ত্তি করিয়া দেওয়া হয়। তাহার স্মরণশক্তি অতীব তীব্র ছিল। কোনও কথা একবার শুনিলে সে তাহা কখনও ভুলিত না। কিন্তু লেখাপড়ায় তাহার আদৌ মনোেযোগ ছিল না। তাহ'র পিতা তাহাকে শিক্ষকের শাসনে রাখিবার জন্যই পাঠশালায় দিয়াছিলেন। কিন্তু জোর জবরদস্তি না করিলে যমুনা পাঠশালায় যাইত না। বিদ্যালয়ে যাইবার সময় উপস্থিত হইলেই তাহার কোনও দিন পেট কামড়াইত, কোনও দিন বা অন্য কোন প্রকার অসুখ করিত। স্নেহশীলা মাতামহী সেজন্য যমুনাকে পাঠশালায় যাইতে নিষেধ করিলেই তাহার অসুখ সারিয়া যাইত এবং সে সমস্ত দিন ঘরে থাকিয়া দৌরাত্ম্য করিত। এই কারণে ঘরের মধ্যে তাহার পিতা ও মাতামহী ভিন্ন কেহ তাহার প্রতি স্নেহ প্রকাশ করিতেন না। গণপৎ রাও বলিতেন, “আমার যমুনা অসাধারণ বুদ্ধিমতী হইবে। বয়োবৃদ্ধির সহিত তাহরি সদ্‌গুণনিচয় পরিস্ফুট হইবে।” তিনি প্রায়ই স্বীয় বন্ধুগণের সমক্ষে তাহাকে আনিয়া পরীক্ষা দিতে বলিতেন ও তাহার প্রশংসা করিতেন। তাঁহার বন্ধুগণের ইহা ভাল লাগিত না। তাঁহারা বলিতেন, বালিকাদিগকে এইরূপে সর্বদা পুরুষমণ্ডলীর সমক্ষে আনিয়া লেখাপড়ার চর্চ্চা করাইলে তাহারা নিতান্ত প্রগল্‌ভা ও দুঃসাহসিকা হইয়া উঠে।

 যমুনা তাহার জননীর ন্যায় দৃঢ়কায়া ও বলিষ্ঠা ছিল। একদা তাহার মাতৃস্বসা স্বীয় পুত্রের সহিত তাহাকে ‘কুস্তি’ খেলিতে বলেন। তাঁহার পুত্র যমুনা অপেক্ষা অধিক বয়স্ক হইলেও সেরূপ বলিষ্ঠ ছিল না। যমুনা কুস্তিতে তাহাকে সহজেই পরাস্ত করিল। তদবধি যমুনার মাসী তাহাকে “যমুনা মল্ল” বলিয়া ডাকিতেন। শৈশবে যমুনা স্বভাবতঃ এইরূপ বুলবতী ছিল; ইহার উপর মাতামহী তাহার স্বাস্থ্যের ও খাদ্যাদির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন। এই কারণে সপ্তম-বর্ষ-বয়সেই তাহার দেহ এরূপ বিকাশ প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, তাহাকে দেখিলে সহসা দশমবর্ষীয়া বলিয়া ভ্রম হইত। কাজেই শীঘ্র যমুনার বিবাহ জন্য সকলেই তাহার পিতাকে উত্ত্যক্ত করিতে লাগিল। গণপৎ রাও পাত্রের অনুসন্ধানে বিশেষ তৎপর হইলেন। কিন্তু তিনি সে বিষয়ে সহজে সফলকাম হইতে পারিলেন না। কারণ যমুনা দেখিতে তেমন সুশ্রী ছিল না।

 বহু অনুসন্ধান করিয়াও যমুনার বর জুটিল না দেখিয়া দিন দিন তাহার পিতা মাতার উদ্বেগ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দৈব উপায়ে যদি কোন ফল লাভ হয়, এই ভাবিয়া, যমুনার জননী তাহাকে নিকটবর্ত্তী শিবমন্দিরে গিয়া প্রত্যহ প্রদক্ষিণ করিতে আদেশ করিলেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই, যে দিন সে শিবমন্দিরে গিয়া প্রথমবার প্রদক্ষিণ করিয়া আসিল, সেই দিনই অপরাহ্ন কালে গণপৎ রাওয়ের জনৈক বন্ধু আসিয়া যমুনার মাতামহীকে বরের সংবাদ প্রদান করিলেন। তিনি বলিলেন, “এখানকার ডাকঘরে বর আসিয়াছে, ইচ্ছা হয় ত আমার সঙ্গে দেখিতে চল।” এই কথা শ্রবণে আনন্দিত হইয়া যমুনার মাতামহী, মাতৃষ্বসা ও ভগিনী সেই ব্যক্তির সহিত বর দেখিবার জন্য কল্যাণের ডাকঘরে গিয়া পশ্চাভাগের দরজা দিয়া ডাকবাবুর বাসায় প্রবেশ করিলেন। বর দেখিয়া শুনিয়া তাঁহাদিগের এক প্রকার মনোনীত হইল। পর দিন গণপৎ রাওয়ের জনৈক প্রতিবেশীর গৃহে ডাকবাবুকে আহ্বান করিয়া কন্যা দেখান হইল। বর মহাশয় তৎসম্বন্ধে কোনও প্রশ্নাদি করিয়া কন্যাকে দেখিবামাত্র বিবাহে আপনার সম্মতি জানাইলেন। তখনই বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল। গণপৎ রাও কিয়ৎ পরিমাণে আশ্বস্ত হইলেন।

 যাহার সহিত যমুনার বিবাহের সম্বন্ধ এইরূপে স্থির হইল, তাহার নাম শ্রীযুক্ত গোপাল বিনায়ক জোশী সঙ্গমনেরকর। মহারাষ্ট্রে যাঁহারা গণকের ব্যবসায় অবলম্বন করেন, তাঁহাদিগকে জোশী বলা হয়। সদ্বংশজাত যে কোনও মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ এই বৃত্তি অবলম্বন করিতে পারেন। এদেশে গণক ও দৈবজ্ঞেরা যেরূপ অপেক্ষাকৃত হীনশ্রেণীভুক্ত বলিয়া পরিগণিত হন, মহারাষ্ট্র দেশে সেরূপ হন না। গোপাল রাও ও তাঁহার ভাবী শ্বশুর গণপৎ রাও—ইঁহারা উভয়েই পুরুষানুক্রমিক “জোশী” ছিলেন। গোপাল রাও বোম্বাই নগরীর ৭০ মাইল ঈশানকোণস্থিত সঙ্গমনের নামক স্থানের অধিবাসী ছিলেন বলিয়া তাহাকে “সঙ্গমনেরকর” বলিত। গোপাল রাও অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাঁহার ন্যায় অব্যবস্থিতচিত্ত ব্যক্তি অতি বিরল দেখিতে পাওয়া যায়। তিনি প্রথমে ব্রাহ্ম, (আনন্দী বাঈর মৃত্যুর) পরে খৃষ্টান এবং শেষে পুনর্বার প্রায়শ্চিত্তপূর্ব্বক হিন্দু সমাজে প্রবেশ করেন। খৃষ্টধর্ম্মপরিগ্রহ করিয়াও তিনি স্বীয় যজ্ঞোপবীত পরিত্যাগ করেন নাই! সে যাহা হউক, গ্রাম্য পাঠশালায় মারাঠী লেখাপড়া শেষ করিয়া তিনি যখন ইংরাজী শিক্ষার জন্য নাশিকে গমন করেন, সেই সময়ে তাঁহাকে একটি ষড়্‌-বৎসর-বয়স্কা বালিকার পাণিপীড়ন করিতে হয়। বালিকা-বধূ শ্বশুরালয়ে আসিয়া দেশীয় প্রথানুসারে গৃহকর্ম্মে মনোনিবেশ করায় গোপাল রাও অতীব অসন্তুষ্ট হন। তাঁহার জননী বধূকে গৃহকর্ম্ম করিবার আদেশ করিলে, তিনি জননীর সহিত কলহ করিতেন। তাঁহার মতে যৌবনে পদার্পণ করিবার পূর্ব্বে বধূগণকে গৃহকর্মে বাধ্য করা নিতান্ত অনুচিত। তিনি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন ও স্বীয় স্ত্রীকে সামান্য লেখাপড়াও শিখাইয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য-ক্রমে অল্প বয়সেই তাঁহার প্রথম পত্নীর লোকান্তর-প্রাপ্তি ঘটে। ইহাতে গোপাল রাওয়ের হৃদয়ে বিষম আঘাত লাগে। তিনি আর দারপরিগ্রহ করিবেন না, প্রথমে এইরূপ সংকল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু অপর অনেক ব্যক্তির ন্যায় তাঁহার এ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইয়াছিল।

 গোপাল রাও অল্প দিনের মধ্যেই শিক্ষা সাঙ্গ করিয়া ডাক বিভাগে কর্ম্মগ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তিনি বদলি হইয়া কল্যাণের ডাকঘরে আগমন করিলে, যমুনার সহিত তাঁহার বিবাহসম্বন্ধ স্থির হয়। এই সম্বন্ধ স্থির করিবার সময় তিনি একটি বিষয়ে গণপৎ রাওকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়াছিলেন। তিনি ভাবী পত্নী যমুনাকে পিত্রালয়ে রাখিয়া নিজের ইচ্ছামত শিক্ষাদান করিবেন, তাহাতে তাঁহার শ্বশুর কোন আপত্তি বা বাধাদান করিতে পারিবেন —এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিতে তিনি গণপৎ রাওকে বাধ্য করিলেন। গণপৎ রাও স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ পক্ষপাতী না হইলেও নূতন বর অনুসন্ধানের দায় হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্য ভাবী জামাতার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তখন গোপাল রাও বিবাহের আয়োজন করিবার জন্য ছুটি লইয়া সঙ্গমনের অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 আমরা গোপাল রাওয়ের যে অব্যবস্থিত-চিত্ততার কথা বলিয়াছি, এই সময়ে তাহার প্রথম বিকাশ হয়। দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিবার সময় গোপাল রাও বিধবা-বিবাহ করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। যমুনার সহিত বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির হইবার পূর্ব্বে তিনি মহারাষ্ট্র দেশের বিদ্যাসাগর— বিধবা-বিবাহের প্রবর্ত্তক পণ্ডিতবর বিষ্ণু পরশুরাম শাস্ত্রী মহোদয়ের ও অপর সমাজ-সংস্কারদিগের সহিত এ বিষয়ে পত্র-ব্যবহার করিতেছিলেন। এমন কি, গণপৎ রাওয়ের নিকট তাঁহার কন্যার পাণিগ্রহণে প্রতিশ্রুত হইবার পরও তিনি বিবাহের জন্য বিধবা কন্যার অনুসন্ধানে বিরত হন নাই। তাঁহার পিতা, পুত্রের বিধবা-বিবাহে প্রবৃত্তির বিষয় অবগত হইয়া তাঁহার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিলেন। পিতাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য গোপাল রাও এবার বাটী গিয়া এই নূতন সম্বন্ধের কথা তাঁহাকে জ্ঞাপন করিলেন। পুত্রের সুমতি হইয়াছে ভাবিয়া পিতা মাতা অতীব আনন্দিত হইলেন এবং এই উদ্বাহ-কার্য সম্পন্ন করিবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। কিন্তু গোপাল রাও সে বিষয়ে নানা প্রকারে বিলম্ব ঘটাইতে লাগিলেন এবং স্বীয় বিবাহের জন্য একটি বিধবা কন্যার সন্ধান করিবার নিমিত্ত তাঁহার সংস্কারক বন্ধুদিগকে পত্র লিখিলেন।

 এদিকে গণপৎ রাও গোপাল রাওয়ের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিয়া কন্যার বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। আত্মীয় ও স্বজনবর্গকে নিমন্ত্রণ করা হইল। কন্যার অব্যুঢ়ান্ন (“আইবুড়-ভাত”) প্রভৃতি উৎসবও সমাহিত হইল। কিন্তু বরের কোন সংবাদ পাওয়া গেল না! কন্যাপক্ষীয় লোকেরা প্রতি মুহূর্ত্ত বিষম উদ্বেগে যাপন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে বিবাহের নির্দ্দিষ্ট দিবস অতীত হইয়া গেল। গ্রামের লোকেরা ও প্রতিবেশিগণ কেহ বরের চরিত্র, কেহ যমুনার ভাগ্য এবং কেহ বা, যিনি মধ্যস্থ হইয়াছিলেন—তাঁহার ব্যবহারের সমালোচনা করিয়া নানা প্রকার মতামত প্রকাশ ও নিন্দাবাদ করিতে লাগিল। যমুনার পিতামাতা এই ঘটনায় নিতান্ত ম্রিয়মাণ হইলেন।

 এদিকে গোপাল রাওয়ের মাথায় তখনও বিধবা-বিবাহ করিবার সংকল্প প্রবলভাবে ঘুরিতেছিল। এই কারণে তিনি পিতামাতাকে ও গণপৎ রাওকে প্রতারিত করিবার জন্য সঙ্গমনের হইতে অন্তর্হিত হইলেন। কিছুদিন পরে, বিবাহের নির্দ্ধারিত দিবস অতিক্রান্ত হইয়াছে দেখিয়া তিনি ‘কল্যাণে’ কর্ম্মস্থানে গমন করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। এমন সময়, যে ভদ্র লোকটি মধ্যস্থ হইয়া তাঁহার সহিত যমুনার বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির করিয়াছিলেন, সহসা তাঁহার সহিত নাশিক ষ্টেশনে গোপাল রাওয়ের সাক্ষাৎ হয়। ভদ্রসন্তান লোকনিন্দায় উত্ত্যক্ত হইয়া গোপাল রাওকে ধরিবার জন্য সঙ্গমনের অভিমুখে যাত্রা করিয়াছিলেন।

 পথিমধ্যে নাশিক স্টেশনে গোপাল রাওকে দেখিতে পাইবামাত্র তিনি তাঁহার যথেষ্ট তিরস্কার করিলেন। গোপাল রাও নিতান্ত লজ্জিত হইয়া তাঁহার নিকট পুনঃ পুনঃ ক্ষমাপ্রার্থনা করিলে, মধ্যস্থ মহাশয় তাঁহাকে নাশিক-নিবাসী শ্রীযুক্ত গঙ্গাধর নরসিংহ কেতকর নামক এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির নিকট লইয়া গেলেন। পরিশেষে কেতকর মহাশয়ের তাড়নায় গোপাল রাও নাশিকস্থিত আত্মীয়গণের সহিত বিবাহের জন্য কল্যাণে গমন করিতে বাধ্য হইলেন।

 যথাসময়ে বিবাহ-কার্য্য সম্পন্ন হইল। এই সময়ে যমুনার পূর্ব নাম পরিবর্ত্তিত হইয়া নূতন নামকরণ হয়। পরিণয়-কালে গোপাল রাও নব বধূকে “আনন্দী বাঈ” নাম প্রদান করিলেন। তদবধি যমুনা ঐ নামে সর্ব্বত্র পরিচিত হইল।

 অতঃপর গণপৎ রাওয়ের অনুরোধক্রমে গোপাল রাও শ্বশুরগৃহেই বাস করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বসংকল্প অনুসারে তিনি আনন্দী বাঈর পাঠের জন্য কতিপয় মারাঠী পুস্তক আনিয়াছিলেন। লেখা পড়ার প্রতি আনন্দী বাঈর পূর্ব্বাবধি বিরাগ ছিল। সুতরাং পাঠ্য পুস্তকগুলি প্রায় যেখানকার সেইখানেই পড়িয়া থাকিত। গণপৎ রাও স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি তাহার বন্ধুগণের দ্বারা স্বীয় অভিপ্রায় জামাতাকে জ্ঞাপন করিলেন। কিন্তু গোপাল রাও কাহারও অনুরোধ পালন করিবার লোক ছিলেন না। যিনি তাঁহাকে বুঝাইতে গিয়াছিলেন, গোপাল রাও তাহাকে যে উত্তর দিয়া বিদায় করিলেন, তাহা শিষ্টাচার-সম্পন্ন বিজ্ঞ জনের মুখে কখনও শোভা পায় না। ফলতঃ তিনি অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন। নানা কার্য্যে তাঁহার এই অদ্ভুত প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যাইত। তিনি বিবাহের সপ্তাহ দুই পরেই একদিন অতি সামান্য কারণে ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া একখণ্ড কাষ্ঠ দ্বারা নববধূকে এরূপ প্রহার করিয়াছিলেন যে, তাহার যন্ত্রণায় কয়েক দিন পর্য্যন্ত আনন্দী বাঈকে কাতর থাকিতে হইয়াছিল! যিনি স্ত্রীশিক্ষার অতীব পক্ষপাতী ও বালিকা-বধূর শ্বশুরালয়ে অবস্থানপূর্ব্বক গৃহকর্ম্ম করিবার ঘোর বিরোধী ছিলেন, তাঁহার এরূপ নিষ্ঠুরতা সত্য সত্যই অতীব বিস্ময়কর।

 বিবাহের পর আট মাস গোপাল রাও শ্বশুরমন্দিরে ছিলেন। বলা অনাবশ্যক যে, আনন্দী বাঈ তাঁহাকে যমের ন্যায় ভয় এবং লেখাপড়ায় যথাসাধ্য ঔদাস্য প্রকাশ করিতেন। সেখানে থাকিলে স্ত্রীর লেখাপড়া শিক্ষা হইবে না, ইহা বুঝিতে পারিয়া গোপাল রাও কর্ত্তৃপক্ষকে অনুরোধপূর্ব্বক আলিবাগে বদলি হইয়া গেলেন। আনন্দী বাঈর তত্ত্বাবধানের জন্য তাঁহার মাতামহীও নাতিনী-জামাইয়ের সঙ্গে আলিবাগে গমন করিলেন।

 সেখানে গিয়াও আনন্দী বাঈ লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করিলেন না। তিনি গোপাল রাওয়ের সম্মুখেই পুস্তক ও শ্লেট ছুড়িয়া ফেলিয়া দিতেন! গোপাল রাও স্ত্রীর এইরূপ অবাধ্যতা দেখিয়া অন্যবিধ নীতির অবলম্বন করিলেন। তিনি আদৌ রোষ প্রকাশ না করিয়া আনন্দী বাঈকে নানা প্রকার ক্রীড়া ও বিলাসের সামগ্রী আনিয়া দিলেন এবং বলিলেন, লেখাপড়া শিখিলে আরও অনেক জিনিষ আনিয়া দিবেন। এইরূপ প্রলোভন প্রদর্শন করায় বিশেষ সুফল ফলিল। আনন্দী বাঈ লেখাপড়ায় অল্পে অল্পে মনোযোগ করিতে লাগিলেন। তথাপি পড়িতে বসিলে পিঞ্জরগত নূতন শুকপক্ষীর ন্যায় তাঁহার অবস্থা হইত। অল্পকালমাত্র একস্থানে স্থির ভাবে বসিয়া থাকিলে তাহার প্রাণ ছটফট করিত। পড়া শেষ হইলে তিনি লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক তাঁহার খেলিবার সঙ্গিনীগণের নিকট গমন করিতেন। কিন্তু তাঁহার বুদ্ধি অতীব তীক্ষ্ণ ছিল বলিয়া দুই চারিবার পাঠ করিলেই সমস্ত বিষয় তাহার আয়ত্ত হইত।

 বেশ-ভূষায় চাকচিক্য ও সৌষ্ঠবের প্রতি আনন্দী বাঈর বিশেষ দৃষ্টি থাকিত। গোপাল রাও ঠিক ইহার বিপরীত ভাবাপন্ন ছিলেন, আড়ম্বর ও বিলাস-প্রিয়তার প্রতি তাহার ঘোরতর বিরাগ ছিল। আনন্দী বাঈর বেশ-বিন্যাস তাঁহার আদৌ ভাল লাগিত না এবং সেজন্য তিনি তাঁহাকে সময়ে সময়ে অতীব গ্রাম্য ভাষায় তিরস্কার পর্য্যন্ত করিতেন। ফলে, কিছুদিনের মধ্যে আনন্দী বাঈ পূর্ব্বাভ্যাস পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বামীর মতানুবর্ত্তিনী হইলেন। এদিকে আলিবাগে গমনের পর এক বৎসরমধ্যে তিনি ভূগোল, ব্যাকরণ, মারাঠী ইতিহাস ও পাটীগণিতের প্রথমাংশ শিক্ষা করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার হাতের লেখাও ভাল হইল।