উপনয়ন

 নয় বৎসর বয়সে আমার উপনয়ন হয়, ঘটনাটি বেশ মনে পড়ে। কর্ণভেদ শিরোমুণ্ডন এগুলি যদিও ভাল লাগেনি কিন্তু নাপিতের উপর বিদ্রোহাচরণ করেছিলুম বলে মনে হয় না। হবিষ্যান্ন ভোজনে বেশ তৃপ্তি লাভ করতুম, ভালই হোক মন্দই হোক রোজকার ডালভাতের চেয়ে রুচিকর। ভিক্ষার ঝুলি কাঁদে করে ‘ভবতি ভিক্ষা দেহি’ বলে উপবীতধারী ব্রহ্মচারী সাজা, তিন দিন ঘরে বন্ধ হয়ে থাকা—পাছে শুদ্রের মুখ দেখে ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয়, এই চিরন্তন হিন্দু প্রথা অনুসারে আমার পইতা হল। কারাবাস হতে মুক্তির পর ন্যাড়া মাথায় বাড়ীময় ঘুরে বেড়ানো আর সকলের কাছ থেকে ব্রহ্মচারী বলে অভিবাদন পাওয়া—মনে মনে কত গর্ব হচ্ছে—যেন আমি কি একটা ধনুর্ধর হয়েছি, অথচ ব্রহ্মচর্য কাকে বলে মানবক সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। ব্রহ্মচর্যের ব্যাখ্যা করে আমাদের পুরুতঠাকুর কোন উপদেশ দেন নাই। কেহ আমাদের বলে নাই, ‘আচার্যাধীনো বেদমধীস্ব’—আচার্যাধীন হইয়া বেদাধ্যয়ন কর,—অথবা ‘অধীহি, ভোঃ সাবিত্রীং মে’—আমার নিকট গায়ত্রী শিক্ষা কর। ‘মা দিবা স্বাপ্সীঃ:’—দিবানিদ্রা যেয়ো না বলে আমাদের কেহ সাবধান করে দেয়নি, আমরা ও আরামের জিনিষটা অনেকদিন পর্যন্ত আঁকড়ে ধরেছিলুম। তিন দিন ঘরে বন্ধ থাকা যে দ্বাদশ বৎসর গুরুকুলে বেদাধ্যয়ন করা—তা আমরা বুঝি নাই—ব্রাহ্মণ-শুদ্রের মধ্যে যে জাতিগত পার্থক্য (বৈদিককালে যেমন আর্য আর দস্যুর মধ্যে) সেই ভেদবুদ্ধি ফুটিয়ে তোলা যদি ঐ নিয়মের উদ্দেশ্য হয়, সেটা সিদ্ধ হয়েছিল বলতে হবে। কতকগুলি সন্ধ্যার মন্ত্র আবৃত্তি করতে শিখেছিলুম তার মানে না বুঝে। এখন দেখছি যে শব্দগুলি আওড়াতুম তার অর্থ—বারিবন্দনা।

ওঁ শন্ন আপো ধন্বন্যাঃ শমনঃ সন্তু কূপ্যাঃ

শন্ন সমুদ্রিয়া,—কুয়ার জল আমাদের মঙ্গল করুক ইত্যাদি। কূপোদককে কথা শোনানো সহজ, সে জল পরিষ্কার রাখা আমাদেরই হাতে; কিন্তু সমুদ্র সকল সময়ে রাস মানেন না, টাইটানিক জাহাজ ডুবিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ! এই সন্ধ্যা দুবার আবৃত্তি করবার নিয়ম; কিন্তু ঐ নিয়ম বেশিদিন পালন করেছিলুম বলে বোধহয় না। তবে আমরা মহর্ষির উপদেশে জানলুম যে উপবীত গ্রহণের মুখ্য তাৎপর্য গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষা। তা হতেই আমাদের নূতন জন্ম— তখন থেকে আমরা দ্বিজ। ব্রহ্মসাধনের অঙ্গরূপে গায়ত্রী মন্ত্রের উপর পিতৃদেবের কতটা আস্থা ছিল তা তাঁর আত্মচরিতে দেখতে পাই। তিনি বলছেন “পুরুষানুক্রমে আমরা এই গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া আসিতেছি। এই মন্ত্র আমাদের শিরায় শিরায়। যদিও আমি বুঝিলাম যে ব্রহ্মউপাসনার জন্য গায়ত্রী সাধারণের পক্ষে উপযুক্ত নহে, কিন্তু আমি সেই সাবিত্রী দেবীকেই ধরিয়া রহিলাম, কখনো পরিত্যাগ করিলাম। না। গায়ত্রীর গূঢ় ভাবার্থ আমার মনে দিন দিন আরো প্রকাশ হইতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে ‘ধিয়োয়োনঃ প্রচোদয়াৎ’ আমার সমস্ত হৃদয়ে মিশিয়া গেল। ইহাতে আমার দৃঢ় নিশ্চয় হইল যে, ঈশ্বর আমাকে কেবল মূক সাক্ষীর ন্যায় দেখিতেছেন তাহা নহে। তিনি আমার অন্তরে থাকিয়া অনুক্ষণ আমার বুদ্ধিবৃত্তি সকল প্রেরণ করিতেছেন। ইহাতে তাঁহার সহিত একটি ঘনিষ্ঠ জীবন্ত সম্বন্ধ নিবদ্ধ হইল।”

 আমাদের মধ্যে উপনয়ন প্রথা সাধারণতঃ যে ভাবে প্রচলিত আছে তাহা অর্থহীন আড়ম্বর মাত্র। বৈদিক ক্রিয়া সংক্ষেপে সারিয়া ফেলা—ঐ ক্রিয়ার সারভাগ পরিত্যাগ করে যেন শুধু খোলসটা রাখা হয়েছে। পিতৃদেব যে ভাবে উপনয়নকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেছেন তাতে প্রাচীন প্রথার কাছাকাছি যতটা রাখা যেতে পারে তার চেষ্টা করা হয়েছে আদি ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠান পদ্ধতির উপনয়ন-ভাগ দেখিলেই তাহা স্পষ্ট বোধগম্য হয়।

 এই অনুষ্ঠানে গায়ত্রী মন্ত্রের শ্রেষ্ঠতা রক্ষিত হয়েছে। ব্রহ্মচারীর প্রতি উপদেশে এই মন্ত্রের বিশদ ব্যাখ্যা দৃষ্ট হবে। সেই উপদেশের সারমর্ম এই:

 “গায়ত্রী মন্ত্র তোমাদের ইহকালের অবলম্বন, পরকালের সম্বল। সেই মন্ত্র দ্বারা ঈশ্বরকে মনন করিবে, তাঁর জ্ঞান শক্তি ধ্যান করিবে। ওঁ বলিয়া ব্রহ্মকে অন্তরে জানিবে এবং ভূভূর্বঃ স্বঃ বলিয়া স্বর্গমর্ত অন্তরীক্ষ বহির্জগতে তাঁহার আবির্ভাব দেখিবে। তিনি এই বিশ্বসংসার রচনা করিয়া আমাদের কাহারো নিকট হইতে দূরে নাই—তিনি আমাদের অন্তরে থাকিয়া আমাদের প্রত্যেককে শুভবুদ্ধি প্রেরণ করিতেছেন—‘ধিয়োয়োনঃ প্রচোদয়াৎ’।” গায়ত্রী মন্ত্রের অর্থ এই।