আমার বাল্যকথা/মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
“আমি কখনও তোমার পিতাকে দেখিনি, কিন্তু তাঁর নিকট থেকে আমি অনেকগুলি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তাঁর দেশের ধর্মোন্নতির জন্য তিনি যে সকল মহৎ অনুষ্ঠান করেছেন তাতে আমার আন্তরিক সহানুভূতি আছে। যদিও কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে তাঁর ধর্মবিচ্ছেদ ঘটেছিল, তবু তিনি তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।”
বিদায়কালীন পূর্ব কথা স্মরণ করে তিনি বল্লেন, “Oh! I have smoked many a Hookah with your grandfather in Paris!”
কর্তাদাদামশায়ের স্মৃতি যতই অস্পষ্ট হোক্ না কেন, মেজকাকা ও ছোটকাকাকে (গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ) আমার বেশ মনে পড়ে। তাঁদের মুখশ্রী জীবন্তভাবে দেখছি, তাঁদের কথাবার্তা শুনছি, এখনো মনে করতে পারি। বাবামশায় অনেক সময় বাড়ী থাকতেন না। তাঁর আত্মজীবনীতে দেখতে পাই, তিনি প্রতি বৎসর পূজার সময় কোন না কোনখানে ভ্রমণে বেরোতেন। যখন গঙ্গায় বেড়াতে যেতেন তখন কোন কোন বার আমাদের সঙ্গে নিতেন, নইলে বাড়ীতে রেখে যেতেন। মার কাছে আমরা বেশিক্ষণ থাকতুম না—আমাদের আসল আড্ডা ছিল মেজকাকিমার ঘর; সেই আমাদের শিক্ষালয়, সেই বিশ্রাম-স্থান। বলতে গেলে মেজকাকিমাই আমাদের মাতৃস্থানীয়া ছিলেন; তাঁর কাছে আমরা গল্প শুনতুম, তাঁর সঙ্গে তাস খেলতুম, তাঁর কাছ থেকে বেছে নিয়ে বই পড়তুম— হাতেমতাই, লয়লামজনু, নবনারী, আরব্য উপন্যাস, লাম্বস্ টেল, পল ভার্জিনিয়ার অনুবাদ, এই রকম কতকগুলি বই আমাদের পুঁজি ছিল। আমাদের অন্তঃপুরে মহিলাদের মধ্যে সেকালে উচ্চশিক্ষার প্রচার ছিল না, তবুও কাকিমা প্রভৃতি বাড়ীর মেয়েরা কেহ কেহ বাঙ্গালা বেশ জানতেন, তাঁরাই আমাদের একপ্রকার শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। কিন্তু অন্যসময় যাই হোক্ ব্যামোর সময় আমরা মার কাছেই থাকতুম। তখন আমাদের মাঝে মাঝে বাঁধা নিয়মে তিনদিনব্যাপী একরকম জ্বর হত তা ম্যালেরিয়া বলতে পারি না, কেননা তখন ম্যালেরিয়া ছিল না। জ্বর হলেই ডাক্তার দ্বারি গুপ্ত আমাদের দেখতে আসতেন, কে জানে তাঁকে দেখলেই প্রাণ উড়ে যেত। তাঁর ব্যবস্থ। ছিল—প্রথম দিন তেল (Castor Oil) ও তেলের চেয়েও বিস্বাদ জলের সাগু, দ্বিতীয় দিন এলাচদানার মত সামান্য কিছু পথ্য; তৃতীয় দিন ফুলকে। রুটি; চতুর্থ দিন ভাত—সেই জ্বরের এই ক্রম ছিল। তখনকার কালে ব্যামোর সময় হাওয়া বদলের জন্যে বরাহনগর প্রভৃতি কাছাকাছি গঙ্গার ধারের জায়গা ও হুগলী বর্ধমান প্রভৃতি দূরের কোন কোন স্থান স্বাস্থ্যকর বলে গণ্য হত। এইক্ষণে সেই সকল স্থান ম্যালেরিয়ার আবাসভূমি বলে পরিত্যজ্য। তেমনি আবার কলকাতা এখন জলের কলে, নালানর্দমার সংস্কারে ও আর আর ম্যুনিসিপাল বন্দোবস্তে পূর্বাপেক্ষা অনেক স্বাস্থ্যকর হয়েছে সন্দেহ নাই; এমনকি, কলকাতাই এক্ষণে পল্লীবাসীদের বায়ুপরিবর্তনের ও স্বাস্থ্য-অর্জনের প্রধান স্থান বল্লেও অত্যুক্তি হয় না। মৃত্যুর তালিকা পরীক্ষায় কলিকাতা ইউরোপেরও প্রধান প্রধান নগরীর সমকক্ষ দেখা যায়। অনেক ইংরাজে বলেন দুই একমাস ছাড়িয়া দিলে স্বাস্থ্যের হিসাবে কলিকাতার সমতুল্য স্থান ভারতবর্ষে মেলা দুষ্কর।